বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৮শে ফেব্রুয়ারী, বৃহস্পতিবার, ১৬ই ফাল্গুন, ১৩৮০
আমদানি লাইসেন্স প্রসঙ্গে
শিক্ষাক্ষেত্রে কাঁচা মালের ঘাটতি। তারই ফলশ্রুতিতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এই অবস্থাকে ‘একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি’ আখ্যা দিয়ে চট্টগ্রাম শিল্প ও বানিজ্য সমিতি এদিকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সমিতি বলেন, উৎপাদনের স্বল্পতা হেতু বাজারে সরবরাহ কমে গেছে এবং এতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। সরকারের কাছে তারবার্তায় বণিক সমিতি বলেন যে, গত পহেলা জানুয়ারি, জানুয়ারি-জুন শিপিং পিরিয়ডের জন্য আমদানি নীতি ঘোষিত হলেও এ পর্যন্ত বাণিজ্যিক শিল্প লাইসেন্সের ভিত্তি প্রকাশ করা হয়নি। বণিক সমিতির মনে করে, দুটি শিপিং পিরিয়ডে পর্যাপ্ত পরিমান লাইসেন্স ইস্যু না হওয়ায় নিত্যব্যবহার্য সরবরাহের স্বল্পতা হেতু দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। যেমন নারকেল তেল, লৌহ-ইস্পাতজাত পণ্য, সাগু, ও মসলার দাম মারাত্মক ভাবে বেড়েছে।
বণিক সমিতি উত্থাপিত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বর্তমানে বাংলাদেশে যে অবস্থা বিদ্যমান তাতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। একটি সদ্য স্বাধীন দেশে এমনিতেই নানান সমস্যা ও সংকট বিদ্যমান থাকে। এক সমস্যার থেকে আরেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। মুনাফাখোর, মজুতদার আর ফটকাবাজরা মনেপ্রাণে এই কামনা করে যে কোথাও না কোথাও একটা না একটা ফ্যাকড়া লেগে থাকুক। এমনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারকে সবদিক দিয়েই ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হবে। কোথাও কোনো গরমিল দেখা দিলে তার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া পড়বে দেশের সর্বত্র। কিছুদিন আগে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যে, কাঁচামালের জন্য ব্যাটারি শিল্প, সাবান ও দিয়াশলাই শিল্পে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। বাজারে ব্যাটারি পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলেও মূল্য আকাশচুম্বী। বর্তমানে নিম্নমানের সাবানের মূল্য দশ টাকা। স্বাভাবিকভাবেই দেখা যাচ্ছে যে, উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে অসামঞ্জস্য দেখা দিলে জনজীবনে তার প্রতিফলন ঘটে। তারই ফলশ্রুতিতে দুর্ভোগ পোহাতে হয় নিরীহ জনসাধারণকে।
সমস্যাটা যে জটিল এটা বিস্তারিত ভাবে বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং আমদানি লাইসেন্স ইস্যু করার ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তার একটা সুষ্ঠু সমাধান হওয়া উচিৎ।
প্রসঙ্গত এ কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আমদানি লাইসেন্স প্রদানের ব্যাপারে যদি গড়িমসি চলে তাহলে দেশের অভ্যন্তরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারেও নাস্তানাবুদ হতে হয়। কেননা তেল সংকটের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে স্থিতিশীল নয়। প্রতিদিনই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক মাস আগে যে মাল যে দামে আনা সম্ভব একমাস পরে তা আর আনা সম্ভব হয়না। সেই দিকটা বিবেচনা করে দেখাও অবশ্য প্রয়োজন। আমরা জানিনা কেন এবং কি কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন বাণিজ্য মৌসুমের আমদানি নীতি গত পহেলা জানুয়ারি ঘোষণা হওয়া সত্বেও এখনও পর্যন্ত কোন আমদানি নীতি প্রকাশ ও কোন লাইসেন্স ইস্যু করা হয়নি। আমরা আশা করব সংশ্লিষ্ট দপ্তর আমদানি লাইসেন্সের ব্যাপারে যে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে তা নিরসনের জন্য এগিয়ে আসবেন।
রেশম শিল্পকে বাঁচাতে হবে
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে অবস্থিত দেশের একমাত্র রেশম শিল্প কারখানা রাজশাহী সিল্ক ফ্যাক্টরিতে নাকি বর্তমানে দুর্নীতি, হরির লুট ও অব্যবস্থা এমন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে যে এর আশু প্রতিকার না করলে কিন্তু এমন অবস্থা আর কিছুদিন চলতে থাকলে অল্প দিনের মধ্যেই ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য।
যেসব অভিযোগ প্রকাশ পেয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কোকন পাচার। রেশম শিল্পের জন্য কোকন একান্ত অপরিহার্য কাঁচামাল এবং কোকন উৎপাদনে রাজশাহী স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েও বেশি। অথচ, সীমান্ত পাচারের ফলে কোকনের দারুন সঙ্কট দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে। দু’শিফটে কাজ চালানোর জন্য ফ্যাক্টরিতে বছরে কোকন প্রয়োজন হয় প্রায় ছ’হাজার মণ এবং রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় কোকন উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় দশ হাজার মণ। অথচ, অসাধু ব্যক্তিদের কারসাজিতে কোকনের এমন সঙ্কট দেখা দিয়েছে যে কতৃপক্ষ মণ প্রতি সর্বোচ্চ মূল্য চারশ’ পঞ্চাশ টাকা দিয়েও নাকি দুই হাজার মণের বেশি কোকন সংগ্রহ করতে পারছে না। ফলে উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে এবং বর্তমানে মাত্র এক শিফটে কাজ চলছে তাও অত্যন্ত ধুকে ধুকে এবং যে কোন মুহূর্তে বন্ধও হয়ে যেতে পারে।
এরই সঙ্গে যোগ দিয়েছে বিভিন্ন যন্ত্রাংশের অভাব বর্তমানে এই ফ্যাক্টরির শতকরা প্রায় ত্রিশ ভাগ যন্ত্রপাতি ও মেশিন নাকি মেরামতের অভাবে অনেক দিন ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এর মূল্যবান কিয়েন মেশিনটি বন্ধ রয়েছে প্রায় গত দশ বছর ধরে। এছাড়া, এর রিলিং মেশিন, বয়েলিং মেশিন ও বোশন সহ প্রায় পঞ্চাশ লাখ টাকার যন্ত্রপাতিও মেরামতের অভাবে বিকল হয়ে পড়ে আছে। ফ্যাক্টরিতে এমন কোন দক্ষ টেকনিশিয়ানও এ পর্যন্ত নিয়োগ করার ব্যবস্থা করা হয়নি যে কিনা সত্যিকারভাবে অকেজো মেশিনগুলোকে চালাতে বা কথা বলাতে পারে।
তাছাড়া, নানান দুর্নীতি, হরির লুট ও অব্যবস্থার জন্য নাকি ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। কোকন কেনা নিয়ে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা রকমের অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। ১৯৭২ সালের অগ্রহায়ণ মৌসুমে কর্মকর্তাকে খোকন কেনার জন্য নাকি ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা অগ্রিম দেয়া হয়। অথচ, তিনি কোকন কেনেন নাকি মাত্র ১ লাখ টাকার ৩৪ হাজার টাকার। বাকি ৫১ হাজার টাকার হিসেব নাকি তিনি আজও পর্যন্ত কর্তৃপক্ষকে দেননি।
তাছাড়া, যে ১ লাখ ৩৪ হাজার টাকার খোকন কেনা হয়েছে বলে কাগজে-কলমে দেখানো হয়েছে, তাতেও নাকি গুদাম জরিপ করে প্রায় ১৯ হাজার টাকার কোকন কম পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। এ কারচুপি ও অর্থ-আত্মসাৎ সম্পর্কের মাঝে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় সে কমিটিও নাকি স্পষ্টভাবে অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে অপরাধীকে অভিযুক্ত করেছে। অথচ আজও পর্যন্ত নাকি তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, উপরন্তু, দেশ স্বাধীন হবার পর তার পদোন্নতি হয়েছে।
১৯৬২ সনে স্থাপিত হবার পর থেকে এ রেশম শিল্প ফ্যাক্টরিটি একটি মডেল কারখানা হিসেবে কাজ করে আসছিল। কিন্তু গত ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এই চার বছর কারখানা বছরে প্রায় পাঁচ লাখ টাকারও বেশি লোকসান দিতে থাকে। ১৯৭২-৭৩ সালে এ ক্ষতির পরিমাণ ৫ লাখ টাকা থেকে ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকায় দাঁড়িয়ে কিছুটা উন্নতির লক্ষণ দেখা যায়। কিন্তু, একশ্রেণীর উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নানারকম চক্রান্তে কারখানাটি নাকি আবার ধ্বংসের মুখে এগিয়ে চলেছে। কর্তাদের হরিলুট প্রতিযোগিতায় কারখানাটির এখন দারুণ নাজুক অবস্থা বলে জানা গেছে। কারখানার প্রয়োজনে লাখ লাখ টাকা অগ্রিম প্রদান, ক্রয়-বিক্রয়ের ভুয়া ভাউচার প্রদান, বাকিতে তেল সরবরাহ করে বকেয়া আদায়ে অনীহা দেখানো, স্টোর থেকে কোকন, কাপড় সরানো, কেনাকাটির হিসাব নেয়া প্রভৃতি বিভিন্ন অভিনব পদ্ধতিতে এসব দুর্নীতি চলছে বলে জানা গেছে।
এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে, দেশের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প কারখানার এসব আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও অভাব-অব্যবস্থার প্রতিকার করার জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি পড়ছে না অথচ জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর গুরুত্ব বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি সাবেক পাক আমলেও কারখানাটি দেশের অর্থনৈতিক ‘উন্নয়নে’ এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। আগে এখানে উৎপাদিত বিভিন্ন রেশমি কাপড় পাকিস্তানের নিয়ে ছাপ মেরে নানান নকশা লাগিয়ে পরে আবার এদেশেই উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হতো। এমনকি বিদেশেও এর একটা ভালো বাজার ছিল।
অথচ, বর্তমানে কারখানাটিতে যা চলছে তাতে বিদেশি বাজার পর্যন্ত যাওয়া তো দূরের কথা দেশের মানুষ পর্যন্ত পৌঁছুনোই দুস্কর হয়ে উঠেছে। অচিরেই এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের পর্যাপ্ত ও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে দেশের এই একমাত্র রেশম শিল্প কারখানাটিকে বাঁচিয়ে জাতিকে এক বিরাট অর্থনৈতিক লোকসান থেকে বাঁচানো উচিত।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক