বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২রা ফেব্রুয়ারী, শনিবার, ১৯শে মাঘ, ১৩৮০
অসম অর্থনৈতিক অবস্থার অবসান চাই
বর্তমানে বাংলাদেশে সফররত তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা যুগোস্লাভিয়ার মহান প্রেসিডেন্ট মার্শাল জোসেফ ব্রোজ টিটো গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ভাষণ দানকালে বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি বিশেষ অধিবেশন আহ্বানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পদের ক্ষেত্রে বর্তমানের ব্যবস্থা যুগোপযোগী নয়। এ ব্যবস্থা আজকের প্রয়োজন মেটাতে পারেনা। একে ঢেলে সাজাতে হবে। এর প্রেক্ষিতে জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির প্রতিও তিনি আলজিয়ার্স সম্মেলনের সিদ্ধান্তের আলোকে পরস্পরের মধ্যে বৃহত্তর সহযোগিতার প্রয়াসী হতে আহ্বান জানান।
মার্শাল টিটো বিশ্বব্যাপী এখন যে গুরুতর অর্থনৈতিক বৈপরীত্য বিরাজ করছে তা লক্ষ্য করেছেন। এতে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যকার বৈষম্য কেবলেই বাড়ছে। এর ফলে বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বিঘ্নিত হচ্ছে এবং এ সম্পর্ক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এর প্রমাণ সাম্প্রতিক জ্বালানি সংকট কেবলমাত্র তেলের সমস্যার জন্যই নয়- এটা বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থারই একটা ফলশ্রুতি।
তিনি বলেন, এই সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া উচিৎ নয় যে, পৃথিবীতে বহু দেশ রয়েছে যারা এখনও তাদের লাখো মানুষের খাদ্য ও বেঁচে থাকার মত সামান্যতম সুযোগদানের সমস্যাতেই জর্জরিত। অথচ অপরদিকে কোন কোন দেশে প্রচুর অর্থ ব্যয়িত হচ্ছে অস্ত্র প্রতিযোগিতার পেছনে। যুগোস্লাভিয়ার মহান নেতা উন্নত দেশগুলো কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে সস্তায় কাঁচামাল কিনে পড়ে সেই কাঁচামালেই উৎপাদিত পণ্য বেশি দামে সেই সব পন্য বিক্রির কথাও উল্লেখ করেছেন। এত অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়বার সুযোগ হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন, এবং বলেন যে, জোট নিরপেক্ষ দেশ গুলো সব সময়ই এহেন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছে। সেজন্যই তিনি আলজিয়ার্স সিদ্ধান্তের আলোকে বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কথা বলেছেন। তার এই বক্তব্য আজকের বিশ্বের নিপীড়িত নিষ্পেষিত মানুষেরই প্রাণের কথা। এ দাবি আজ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষের প্রাণের দাবি। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে, গত সেপ্টেম্বর মাসে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণদানকালে বলেছেন যে, আজকের বিশ্ব কেবল ক্রমাগত দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই বিভক্তিটা হচ্ছে ধনী-নির্ধনের মধ্যকার বিভক্তি। এটা কোন আদর্শগত বিভক্তি নয়-বরং এটা আসলে আদর্শ হননের বিভক্তি। কেননা বিশ্বের মুষ্টিমেয় ধনী দেশগুলোর ধনের পাহাড় তথা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে শোষণ-বঞ্চনার মাধ্যমে উপার্জন তারা করে চলেছেন তা দিনকে দিন কেবল স্ফীতই হচ্ছে। আর উন্নয়নশীল দেশগুলো একমাত্র অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার কবলে পড়ে দিনদিন দারিদ্র্য, জরা, রোগ, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, স্বাস্থ্যহীনতা, বাসস্থান ও জনসংখ্যায় জর্জরিত অপরিকল্পিত সামাজিক জীবন নিয়ে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছে এবং এই উন্নয়নশীল দেশেই আজ বিশ্বের সবচাইতে বেশি লোকের বাস। মহামতি টিটোর অন্তরে সেই একই অনুভূতির অনুরণন- কণ্ঠে সেই একই বক্তব্য ধ্বনিত হয়েছে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো আজ নিজেরা একদিকে যেমন ধন সম্পদ আহরণ তেমনিভাবে অস্ত্র প্রতিযোগিতায়ও মেতে উঠেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে তারা একদিকে কেবল অস্ত্র প্রতিযোগিতারই বিষবাস্প ছড়াচ্ছে অন্যদিকে এর মাধ্যমে সেসব দেশের কাঁচামাল গুলো নিয়ে আসছে। এই অসম বাণিজ্য আজ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একমাত্র অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তার জন্যই আজ উন্নয়নশীল দেশগুলো বৃহৎ শক্তিবর্গের উন্নত দেশগুলোর লেজুড়ে পরিণত হচ্ছে। সম্প্রতিকালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ এবং আরব বিশ্বের তেল নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের ছিনিমিনি খেলাটাই তার সবচাইতে বড় প্রমাণ। এহেন পরিস্থিতিতে বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এসব অসমতা দূর করার জন্য বিশ্বের জাতিসমূহের সবচাইতে বড় সংস্থা জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করে সেই অধিবেশনে আলজিয়ার্স সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নতুন কর্মসূচি প্রণয়নের নির্দেশ করলে আজকের উন্নয়নশীল সমাজ কিছুটা রক্ষা পেতে পারে বলে বিশ্বের উন্নয়নশীল সমাজের অন্যতম অংশ বাংলাদেশের জনগণের বিশ্বাস।
মহামতি টিটোর উক্ত বক্তব্য এবং বাংলাদেশের মানুষের এই বিশ্বাসের প্রতিধ্বনিই করেছেন জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আলজিয়ার্সের মহান নেতা কর্নেল হুয়ারী বুমেদীন। তিনিও কেবল জ্বালানি সংকট নয়, সব ধরনের কাঁচামাল ও বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থাকে ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক বিশেষ অধিবেশন আহ্বানের উদ্দেশ্যে সেক্রেটারি জেনারেলের নিকট এক চিঠি লিখেছেন। আমরাও তার বক্তব্যের সাথে সুর মিলিয়ে বলবো, সেই অধিবেশনে অবশ্যই সকল দেশের সমতা ও অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন বিবেচনা করতে হবে।
ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান দিকে নজর দিতে হবে
বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এদেশকে শিল্পায়িত করার ব্যাপারে আজ নানাবিধ পরিকল্পনা, রাষ্ট্রগুলির সহৃদয় সহযোগিতা, সহজ পদ্ধতিতে পুঁজি বিনিয়োগ ইত্যাদি কাজ চলছে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকালে যে সকল শিল্প কারখানা ছিল তার সংস্কার এবং শ্রীবৃদ্ধি সাধনের প্রচেষ্টাও আজ ব্যাপক। অতএব ক্ষুদ্র শিল্প গুলিও তার আওতায় পড়বে এটাই স্বাভাবিক।
এরই প্রেক্ষিতে পত্রিকান্তরে পরিবেশিত সংবাদ উল্লেখ করে বলা যায় যে, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশে যে সকল ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে উঠেছিল এবং উঠছে, সরকারের শিল্পনীতির ত্রুটির জন্য সেগুলোর অবস্থা আজ সংকটজনক। ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুদ্র শিল্প মালিকরা তাদের শিল্পসংস্থা গুলিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আন্তরিক চেষ্টা চালাচ্ছেন, কিন্তু বর্তমান শিল্পনীতির অবস্থান ফলে সেগুলোর শ্রীবৃদ্ধি তো দূরের কথা, টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
শিল্প নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যে সকল শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকার যন্ত্রপাতি আছে (যেগুলো উৎপাদনের ব্যাপারে খাটছে) কেবলমাত্র সেই সমস্ত শিল্প কারখানাকে অনুমোদন এবং বৈদেশিক পণ্য আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে।
এ নিজের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সকল শিল্পপ্রতিষ্ঠান ৫০ হাজার টাকার উর্ধ্বে মূলধন নিয়োজিত, সেগুলো মোটামুটিভাবে সচল ও সচ্ছল। অপরপক্ষে যে সকল ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থায় ৫০ হাজার টাকার কম মূলধন নিয়োজিত- তারা নিজেদের টিকিয়ে রাখার একান্ত প্রয়োজনে তা সত্বেও বর্তমান শিল্প নীতির আওতায় পড়ে বিলুপ্তির দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, এই শিল্পনীতিতে আরও বলা হয় থেকে ৫ থেকে ১০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্র শিল্প কারখানাগুলোতে ও ৫০ হাজার টাকার ‘মেশিনারী শো’ করে নতুনভাবে লাইসেন্সের অনুমতি নিতে হবে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ধ্বংসপ্রাপ্ত ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র শিল্পগুলি ঠিকানা পরিবর্তন হয়েছে সেগুলোকেও আবার নতুন করে ঐ ‘মেশিনারি শো’ দেখিয়ে লাইসেন্সের অনুমতি নিতে হবে।
নিঃসন্দেহে এ হয়রানি ও ঝামেলার কাজ। ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থাগুলোতে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি অধিকাংশই তৈরি হয়। সাবান, সোডা, চিরুনি, সুঁচ, সুতো, সেফটিপিন, ন্যাপথলিন, কাটা, ক্লিপ, ব্লেড, মলম ইত্যাদি জাতীয় বহুবিধ দ্রব্যাদি ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থাই উৎপাদন করে থাকে। বর্তমান শিল্পনীতির ফলে এরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে জনসাধারণের জীবনে অশেষ ভোগান্তি নেমে আসবে। পুরোপুরি শিল্পায়িত না হওয়া পর্যন্ত দেশের মানুষকে ক্ষুদ্র শিল্প জাতীয় সমস্যা দ্রব্যাদির উপর নির্ভর করতেই হবে।
ক্ষুদ্র শিল্প গুলিকে সাহায্য দেবার ব্যাপারে তাদের ‘মেশিনারী শো’ ৫০ হাজার টাকা পুঁজি বিনিয়োগের প্রমাণ টা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো- সংস্থাগুলির ভূমিকা। ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত দ্রব্যাদি জনসাধারণের সামগ্রিক মৌল চাহিদার কতটা মেটাতে পারছে, উৎপাদিত দ্রব্যাদির মান কেমন ইত্যাদি দেখা উচিত। এবং ভেজাল দ্রব্য প্রস্তুতের শাস্তি বিধানের জন্য লাইসেন্স বাতিল করার কথাও চিন্তা করা যায়। অর্থের অভাব বা পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষমতার জন্য লাইসেন্স বাতিলের কথা চিন্তা করা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় না।
এ প্রসঙ্গে কিছুকাল পূর্বে প্রকাশিত এক শিল্পনীতির উল্লেখ করা যায়। সেখানে বলা হয়েছিল, ব্যক্তিগত মালিকানা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা বিনিয়োগের শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়া যাবে। বর্তমান সময়ে ২৫ লাখ টাকায় কোন কলকারখানা প্রতিষ্ঠান সম্ভব নয়, অতএব পুঁজি থাকা সত্বেও তা করা যাবে না।
ফলে, একদিকে ক্ষুদ্র শিল্প গুলির জন্য ন্যূনপক্ষে ৫০ হাজার টাকা মূলধন থাকা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে, অপরদিকে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন শিল্পের ক্ষেত্রে ২৫ লাখ টাকার গন্ডিতে তাকে সীমিত করা হয়েছে। এই পরস্পর বিরোধী নীতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বোঝা সত্যিই মুশকিল হয়ে পড়েছে।
যাই হোক, দেশের সামগ্রিক স্বার্থ ও সমৃদ্ধির দিকে লক্ষ্য রাখতে হলে এখন ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাঁচাতেই হবে। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা মেটাবার ব্যাপারে ক্ষুদ্র শিল্পগুলোর ভূমিকা কোন অংশেই নগণ্য নয়। তাই এজন্য প্রয়োজনবোধে শিল্পনীতির পরিবর্তন বা সংশোধন যাই হোক একটা কিছু করা অপরিহার্য।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক