বাংলার বাণী
ঢাকা : ১২ই নভেম্বর, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ২৫শে কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
বিশ্ব শান্তি ও বাংলাদেশ
গত রোববার কায়রো সফর শেষ খরে কুয়েত যাত্রার প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ উপমহাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁর অঙ্গীকারের কথা পুনরায় ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, আমরা পুনরায় আরব ভাইদের ন্যায়-যুদ্ধের প্রতি সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর—বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর পূর্ণ সমর্থনের কথা ঘোষণা করছি। আমরা রাবাত সম্মেলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্যমন্ডিত সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি। এবং আমাদের প্যালেস্টাইনী ভাইদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থনের কথা পুনরায় ঘোষণা করছি। জোটনিরপেক্ষ এবং ইসলামী সম্মেলনের সদস্য হিসেবে আমাদের সাধারণ লক্ষ্য অর্জনে আমরা একযোগে কাজ করে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
কায়রো সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ উপমহাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী সংগ্রামে আরব ভাইদের প্রতি সমর্থন প্রসঙ্গে যে বক্তব্য পেশ করেছেন তা একজন প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য রক্ষামূলক কোনো কথা নয়। এ কথা সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের। বাংলাদেশের মানুষ সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী সংগ্রামে জয়লাভ করে জন্মলগ্ন থেকেই বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী। যুদ্ধ নয়—শান্তি চাই—এ বক্তব্য সকল বাঙালীর চেতনায় প্রবাহিত।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্যই হলো সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব—কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়। জোটনিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাসী বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ সকল শোষণ, শাসন, অত্যাচার, অবিচার ও নিপীড়নের বিরোধী। বিরোধী বলেই মিশর-ইসরাইল যুদ্ধে প্যালেস্টাইনীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রশ্নে বাংলাদেশ সোচ্চার সমর্থন জানিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও জানাবে। মিশর, কুয়েত সহ অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়েছে চিন্তা ও চেতনার একই কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থানের জন্য। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ শান্তির অতন্দ্র প্রহরী বলেই বিশ্বশান্তি পরিষদ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও শান্তির সূর্য সৈনিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জুলিও কুরি পদকে ভূষিত করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর মিশর ও কুয়েত সফয় উভয় দেশের মধ্যে একদিকে যেমন পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তৃত করবে, অন্যদিকে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠারও সহায়ক হবে।
পাট বিক্রয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা
গত পরশুদিন সরকার এক নির্দেশ জারি করে রাজশাহী, যশোর ও খুলনা সীমান্ত এলাকার দশ মাইল আওতার মধ্যে সমস্ত পাটচাষী, ফড়িয়া ও বেসরকারী ডিলারদেরকে তাদের সকল কাঁচা পাট কিংবা মওজুত পাট সরকার অনুমোদিত ডিলারদের কাছে বিক্রি করার কথা বলেছেন। নির্দেশনামায় সরকার হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন যে, যারা এই নির্দেশ অমান্য করবে তাদের স্টক অবিলম্বে আটক করা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জনগণের সাধারণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে পাট শিল্প ও পাট ব্যবসার গতিধারাকে বাধামুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এদিকে পাট প্রতিমন্ত্রী উল্লেখিত সরকারী কর্মসূচী সফল করে তোলার জন্য সংসদ সদস্য, ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য, রাজনৈতিক কর্মী ও দেশপ্রেমিক জনগণের প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছেন। কাঁচা পাট এবং মওজুত পাট সরকার নিয়োজিত ডিলারদের কাছে বিক্রির ব্যাপারে সরকার যে নির্দেশনামা জারি করেছেন তার পেছনে নিঃসন্দেহে সরকারের সৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। এটা বাস্তবায়ন সম্ভব হলে সরকার ছাড়া পাট অন্য কোথাও বিক্রির সুযোগ বন্ধ হবে। দেশের বর্তমান পাটনীতি অনুযায়ী সরকারই একমাত্র পাটের রপ্তানীকারক। যারা দেশে সরকার অনুমোদিত ক্রয় কেন্দ্র ছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে পাট কিনে থাকেন তারাও সরকার ডিলারদের নিকট তাদের কেনা পাট বিক্রি করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এতোদিন আমরা লক্ষ্য করেছি এবং সে ব্যাপারে আমরা আমাদের মতামতও কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে যে, বেসরকারী উদ্যোগে যারা পাট ক্রয় করে থাকেন তাদের অধিকাংশই সরকারী এজেন্টদের নিকট পাট বিক্রি করেন না। তারা অবৈধ পথে ঐ ক্রয় করা পাট বিক্রি করে থাকেন। সরকারের উচিত ছিল পূর্বাহ্নেই এ ব্যাপারে একটি কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। কিন্তু তারা করেননি। বস্তুতঃ দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে পাটের ব্যাপারটি বড় বেশী উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে একমাত্র উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদের প্রকৃত ব্যবহার আজ হচ্ছে না। পাট বিচ্ছিন্নভাবে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সীমান্তের ছিদ্রপথ বন্ধ করার পক্ষে দেশের প্রত্যেকটি পত্র-পত্রিকা ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো জোরালো মতামত ব্যক্ত করেছে বহু পূর্ব থেকেই। এভাবে প্রতিদিন যদি দেশের সম্পদ পাচার হয়ে যায় তাহলে গোটা অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়তে বাধ্য। এবং কোনোদিনও চোরাচালানের মতো ক্ষয় রোগ, যদি জাতীয় অর্থনীতির দেহ থেকে না মুক্ত হয় তাহলে দেশের মেরুদন্ড কোনোদিন মজবুত হতে পারবে না। সরকারী পাট ক্রয়কেন্দ্রগুলো বর্তমানে দেশের বিভিন্নাঞ্চলে যে দরে পাট কিনছে তার চাইতে অনেক ক্ষেত্রেই বেশী দরে বেসরকারী সংস্থা ও ডিলাররা পাট কিনছে। এর অন্তর্নিহিত কারণ কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই বুঝতে হবে। এরা কোনোক্রমেই সরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে ক্ষতি দিয়ে পাট বিক্রি করবে না। তাহলে এরা কেন বেশী মূল্যে পাট কিনছে তা অবশ্যই বিচার্য বিষয়। অধিকাংশ মানুষেরেই ধারণা—বেসরকারী উদ্যোগে যারা বেশী দামে পাট কিনছে—তারা হয় চোরাচালানের মাধ্যমে পাট বিদেশে বিক্রি করবে, নয়তো পুড়িয়ে দিয়ে বীমার মাধ্যমে অধিক টাকা উসুল করে নেবে। কর্তৃপক্ষ সরকারী ডিলার ছাড়া অন্যত্র পাট বিক্রির ব্যাপারে যে নির্দেশ দিয়েছেন তাতে ফলপ্রসূ করার নিশ্চয়তা দিতে হবে। যে করেই হোক বেসরকারী খাত থেকে যাতে করে পাট অন্যত্র বিক্রি হতে না পারে তার জন্য প্রয়োজন হলে অভিযান চালিয়ে প্রত্যেক ডিলারের কাছ থেকে মওজুত পাট কিনে নিতে হবে সরকারকে। আমরা সরকারের উল্লেখিত পাট বিক্রয়ের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে যথার্থ অর্থে বাস্তবায়নের জন্য আহ্বান জানাই।
তাহলে আড়তদাররাই সব?
কয়েকটা দিন থেমেছিল, আবার চালের দাম তর তর করে বাড়তে শুরু করেছে রাজধানী সহ দেশের সারাটা অঞ্চলে। নতুন আমন ধান উঠতে শুরু করলে চালের দাম অবশ্যই নামতে বাধ্য হবে এই বিশ্বাস নিয়ে আমরা যারা বগল বাজাতে শুরু করেছিলাম, সেই আমাদের সকল আশায় ছাই ছিটিয়ে চালের দাম পাঁচ টাকা সাড়ে পাঁচ টাকা সের থেকে হঠাৎ করে বাড়তে শুরু করেছে এবং বর্তমানে ঢাকার বাজারে সাড়ে ছয় টাকা সেরের নীচে কোনো নিকৃষ্টমানের চাল পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এমনটা হবার কোনো কারণ যে নেই তা বোধ করি খাদ্য দপ্তর তথা সরকার বাহাদুরেরও জানা কথা।
আজ পঁচিশে কার্তিক। কৃষকের ঘরে ঘরে আমন উঠতে শুরু করেছে, বাজারেও প্রচুর নতুন চাল দেখছি। আগে না হয় মনকে প্রবোধ দেয়া যাচ্ছিল, বাজারে চাল নেই দাম ত বাড়বেই। কিন্তু এখন? এখন চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কোনো সঙ্গত কারণ আমাদের জানা নেই।
দু’মাস আগের ঘটনা : কাঁচা মরিচের সের যখন দু’দিনের জন্য বিশ, শুকনো মরিচ বত্রিশ, খাবার তেল চৌত্রিশ হয়েছিল সরকার যেন অনেকটা গাঁটছড়া বেঁধেই নেমেছিলেন, হেস্তনেস্ত একটা কিছু করতে হবেই। বেধড়ক কয়েকজন মওজুতদারকে ধরে হাজতে চালান করে দেয়া হলো। কিন্তু তারপরই—যা দু’দিনেও মওজুত করে রাখা যায় না সেই কাঁচা মরিচ সহ ঐ তিনটি জিনিস বাজার থেকে একেবারে লাপাত্তা হয়ে গেল। ভাব-সাব বুঝে শুনে কর্তারা হাত পা ঝেড়ে ঝুড়ে আবার গদি আঁটা চেয়ারে যেয়ে বসলেন। কৌশল পালটিয়ে এবার বক্তৃতা আর গলাবাজি করে মওজুতদারদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে শুরু করলেন। তেল নূন মরিচের সাথে পাল্লা দিয়ে চালের মণ চার শ’ টাকায় যেয়ে পৌঁছালো। কর্তারা আগের মতোই নয়া কৌশল মত চিল্লানের মাত্রা সপ্তগ্রামে চড়ালেন—মাঠে আর নামলেন না। আমরা জনগণও বুকে পাথর বেঁধে ধুঁকতে লাগলাম।
এর মধ্যে আশীর্বাদের মতো আমন উঠতে শুরু করলে দাম নেমে যাচ্ছে দেখে মওজুতদাররাও আড়তের তালা খুলে দিল এবং নয় টাকা সেরের চাল হঠাৎ করে পাঁচ টাকায় চলে এলো। কিন্তু ইদানীং খবর পাওয়া যাচ্ছে চাল মওজুতদাররা পুরোদমে নতুন চাল খরিদ করতে শুরু করেছে এবং তার ফলটা ভোগ করতে হচ্ছে আমাদেরকে। চাল প্রচুর পাওয়া গেলেও মুনাফা শিকারীরা চালের দাম আর নিম্নমুখী করতে চাইছে না অর্থাৎ ঘাপটি মেরে রয়েছে। এখন প্রশ্ন : নতুন ধান উঠবার পরও কি আমাদেরকে সেই বন্যার সময়কার দামে চাল কিনতে হবে? সমস্ত কলকাঠিই যদি আড়তদারদের হাতে বলে মেনে নিতে হয়, তাহলে এদেশে সরকার রয়েছেন কোন কাজে?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক