সুস্বাগত বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিব মুক্ত। বিশ্ব জনমতের কাছে শেষ পর্যন্ত মাথা নত করতে হলাে জুলফিকার আলি ভুট্টোকে, জেলের দরজা খুলে দিতে হলাে।
শেখ মুজিব ফিরে এসেছেন অন্ধকার থেকে আলােতে, কারাগার থেকে স্বাধীন দেশে, তাঁরা স্বদেশে। সােনার বাঙলায়।
মুক্তির স্বাদ প্রথমে পেলেন লন্ডনে। দিল্লি তাঁকে জানাল বীরােচিত সংবর্ধনা। ঢাকা দু বাহু মেলে বুকে তুলে নিল তাদের আদরের দুলালকে।
অভিভূত শেখ অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানালেন বাঙলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু ভারতের জনসাধারণের প্রতি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি। ধন্যবাদ জানালেল সােভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য মিত্র রাষ্ট্রের প্রতি যাদের শুভেচ্ছা ও সমর্থনের ফলেই জয়যুক্ত হয়েছে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। তাঁর স্বদেশবাসীর প্রতি শেখ জানালেন ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার আবেদন, শৃঙ্খলা মেনে … আবেদন। পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, তাদের প্রতি তার কোনাে বিদ্বেষ নেই, ভুট্টো সাহেব সুখে থাকুন কিন্তু পাকিস্তানের বাঁধন আর নয়।
সােমবার দ্বিপ্রহরে শেখ সাহেব যখন ঢাকা পৌঁছালেন তখন সেখানে জনসমুদ্র উত্তাল। বঙ্গবন্ধু আর তার সহকর্মীদের নিয়ে ট্রাকটি সেই তরঙ্গশীর্ষে ছােট ভেলার মতাে ভাসতে ভাসতে এসে পৌছাল রমনার সেই ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানেন মাস আগে যেখান থেকে তিনি বজ্রনির্ঘোষে ঘােষণা করেছিলেন “আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
এই ন মাসে দেশের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। শেখ সাহেবের অননুকরণীয় ভাষায়, এই ন মাসে দেশের মানুষ শতাব্দীর পথ অতিক্রম করেছে। যখন দেশের মানুষের কাছ থেকে শেখকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তারা অশ্রু বিসর্জন করেছিল। “যখন আমাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল তখন তারা অস্ত্র হাতে লড়াই করেছে আর আজ যখন আবার তাদের মধ্যে ফিরে যাচ্ছি তখন তারা বিজয়ী। আজ ফিরে যাচ্ছি তাদের লক্ষ মুখের হাসির রৌদ্র উদ্ভাসের মধ্যে।”
সত্যি এই ন মাসে দীর্ঘ মতাব্দীর পথ অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। ন মাস আগে শেখ সাহেব যে দেশ রেখে গিয়েছিলেন সে দেশ আর নেই। সে মানুষেরও ঘটছে রূপান্তর। সংগ্রামের আগুনে-পােড়া খেয়ে তারা এখন নতুন দেশের নতুন মানুষ। লড়াইয়ের ময়দানে তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য। এই ঐক্য এবং সংহতি শেখ সাহেবের চলার পথকে সুগম করবে, বাহুতে বল দেবে।
এ ন মাসে বাঙালি জাতি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে—কে তাদের শত্রু আর কে তাদের মিত্র। তারা দেখেছেন তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছির ভারত, সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাে আর তাদের বিরােধীতা করেছে আমেরিকা, চীন এবং তাদের কয়েকটি তাঁবেদার রাষ্ট্র। বাঙলাদেশের মানুষ তাদের সংগ্রামের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে দেখেছেন সমাজতন্ত্রের শিবির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু। এই অভিজ্ঞতা শেখ মুজিবকে সাহায্য করবে বন্ধুর দিকে হাত বাড়াতে।
শেখ মুজিবের সামনে এখন অনেক কাজ। বিধ্বস্ত দেশকে নতুন করে গড়তে হবে। বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে নতুন বনিয়াদের উপর। যে প্রায় এককোটি মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল তাদের পুনর্বাসন দিতে হবে। গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শকে বাস্তবায়িত করার জন্য রচনা করতে হবে নতুন সংবিধান। শেখ মুজিবের সামনে এখন অসংখ্য কাজ, অসংখ্য দায়িত্ব।
শেখ মুজিবের প্রধান সম্পদ দেশের মানুষের অকৃত্রিম ভালােবাসা। ভারত এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলাে নিশ্চয়ই প্রসারিত করবেন সাহায্যের হস্ত । ভগীরথের মতাে দেশবাসীর উৎসাহ ও উদ্দীপনার বন্যাপ্রবাহকে শেখ নিশ্চয়ই চালিত করতে পারবেন দেশগঠনের খাতে। শেখ মুজিবের কাছে তাঁর দেশবাসীর অনেক প্রত্যাশা। তিনি নিশ্চয়ই পূর্ণ করবেন।
সুস্বাগত শেখ মুজিব। আপনার দেশ আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী অটুট থাকুক।
সূত্র: সপ্তাহ, ১৪ জানুয়ারি ১৯৭২