You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.16 | সাপ্তাহিক সপ্তাহ-এর সম্পাদকীয়: বাংলাদেশের ঘটনার তাৎপর্য | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের ঘটনার তাৎপর্য

বাঙলাদেশের ঘটনাবলি থেকে কতকগুলাে রাজনৈতিক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক কর্মী এবং পার্টিসমূহকে এইসকল প্রশ্নের জবাব খুঁজে বার করতে হবে।
সংসদীয় গণতন্ত্র সংক্রান্ত প্রশ্নটি নিয়েই আলােচনা চলতে পারে। বাঙলাদেশের উদাহরণ দিয়ে অনেকে বলতে চাইছেন যে, সংসদীয় গণতন্ত্রের কোন মূল্য নেই। ওখানে ইলেকশন হলাে; শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ শতকরা ৯৬ ভাগ ভােট পেলেন। সংশয়াতীতভাবে প্রমাণিত হলাে, বাঙলাদেশের জনগণ আওয়ামী লীগের পেছনে আছেন। কিন্তু ফল কি হলাে? অতএব ইলেকশন, পার্লিয়মেন্ট ইত্যাদি সবই বাজে। দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলাে বিচ্ছিন্নতা বনাম জাতীয় সংহতির প্রশ্ন। বাঙলাদেশের ঘটনা থেকে কি দেখা যাচ্ছে না যে আজকের দিনে জাতীয় সংহতি কথাটার কোন বিশেষ তাৎপর্য নেই? ইয়াহিয়া খাই কি জাতীয় সংহতির প্রবক্তা নন? আর বাঙলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনই তাে বিচ্ছিন্নতাকামী। নয় কি?
বাঙলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, সংসদীয় গণতন্ত্র যে শােষক শ্রেণীরই একটি হাতিয়ার এমন কথা প্রমাণিত হয় না। বরং সংসদীয় গণতন্ত্র সেখানে ইয়াহিয়া খারই স্বার্থ বিরােধী হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছিল। পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠি যেভাবে নির্বাচন, পার্সিয়ামেন্ট প্রভৃতি ব্যবস্থাকে ওলট পালট করে দিল তা থেকে প্রমাণ হয় যে, এইসব ব্যবস্থা শাসক ও শােষকদের পক্ষে বিপদের কারণ হতে পারে।
কিউবার ইতিহাস থেকেও একই জিনিস দেখা গেছে। সেখানেও ইলেকশনের কথা ছিল। ফিদেল কাস্ত্রো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একজন প্রার্থী ছিলেন। ডিক্টেটর বাতিস্তা সেসময় কিউবায় ইলেকশনই বাতিল করে দেন। অতঃপর অস্ত্র হাতে লড়াই করা ছাড়া বিপ্লবিদের আর কোন বিকল্প পথ ছিল না।
অর্থাৎ নির্বাচন ও পার্লামেন্ট ব্যবস্থায় প্রতিক্রীয়াশীলদেরই আপত্তি, প্রগতিশীলদের নয়। তাহলে আমাদের দেশের নকশালপন্থিরা কি তাদের স্লোগান দ্বারা প্রতিক্রিয়ার বাহন হচ্ছেন না? বাঙলাদেশের তারা এবং মাওলানা ভাসানী নির্বাচন বয়কটের আওয়াজ তুলে ইয়াহিয়ার হাতেই খেলেননি কি?
লেনিনীয় প্রজ্ঞা অবশ্যই অন্যরকম। একথা বিপ্লবী কর্মীদের জানা দরকার Masses learn through experience, শুধু বক্তৃতায় চলে না। বাঙলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ নির্বাচন ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে অভিজ্ঞতা লাভ না করলে অস্ত্র হাতে নেবার বাস্তব প্রয়ােজনীয়তা বুঝতে পারত না। অর্থাৎ মওলানা ভাসানী ও সেখানকার নকশালপন্থীরা জনগণের সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রস্তুতিকে বাস্তবে নষ্ট করতেই চেয়েছিলেন, যদিও তাদের মুখে সশস্ত্র যুদ্ধের কথা হরবখতই শােনা যেত। তাদের তুলনায় শেখ মুজিব বাস্তবে বিপ্লবের অনেক বেশি সহায়তা করেছেন। কারণ তিনি বাঙলাদেশের জনগণকে পরিচালিত করেছেন তাদের নিজ নিজ অভিজ্ঞতা অর্জনের পথে । পরবর্তী স্তরে শেখ মুজিব যদি নেতৃত্ব দান করতে ব্যর্থ ও হন, তবু তাঁর অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিপ্লবীর আসল পরিচয় কর্মক্ষেত্রে, বুলি কপচানিতে নয়।
আর একটি কথা। পাকিস্তান এবং পুরাতন কিউবায় শাসকগােষ্ঠী নির্বাচন ও সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পেরেছে তার কারণ দুই দেশের একটিতেও সংসদীয় গণতন্ত্রের কোনাে ট্রাডিশন তৈরি হয়নি। অতএব শাসকগােষ্ঠি পৃথিবীর সর্বত্র ইয়াহিয়া এবং বাতিস্তার মতাে কাণ্ড করতে পারবে বলে মনে করলে ভুল হবে। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির “পিপলস ডেমােক্র্যাসী” ঠিক সেই ভুল টা করেছেন। পার্লিয়ামেন্টারী প্রথায় কোনােরকম অগ্রগমণের সম্ভাবনাকে তারা পরিহাসের সঙ্গে বাতিল করে দিয়েছেন।
বাঙলাদেশের দর্পণে দেখা যাচ্ছে ভাসানী, নকশালী ও সি পি এম মূলত একই Left wing communism নামক খােকামি রােগে ভুগছেন। সিপি এম কেন নির্বাচনে অংশ নেন সেইটিই প্রশ্ন। সে কি নিছক সুবিধাবাদ? না কি ঐ পার্টির কর্মনীতি ও কর্মকৌশলের মধ্যেকার contradiction এর পরিণতি?
দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে সর্ব সম্প্রতি একটি ঘটনা ঘটেছে। সেখানে নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্রপ্রধান। হয়েছেন একজন মার্কসপন্থী। সেখানে সমাজের পরিবর্তন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শেষ কথা বলার সময় এখনাে আসেনি। কিন্তু ঘটনাটি থেকে শিক্ষা গ্রহণের কি কিছু নেই? | দ্বিতীয় প্রশ্ন-বিচ্ছিন্নতা। বাঙলাদেশের ঘটনা থেকে কেউ বলবার চেষ্টা করছেন যে, আম জাতীয় সংহতির কথা অর্থহীন। জাতিসত্তার ব্যাপারটিকে ধরতে পারছেন না।
বাঙলাদেশের ঘটনাবলী আজ কি প্রমাণ করছে? প্রমাণ করছে যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে কৃত্রিমতার বুনিয়াদে। ধর্ম কর্ম একটি জাতি ও রাষ্ট্রের একমাত্র বুনিয়াদ হতে পারে না। পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র, অথচ এই রাষ্ট্রের সর্ব বৃহৎ অংশের (যার নাম বাঙলাদেশ) সঙ্গে অপর অপর অংশগুলাের কোনাে ভৌগলিক অখণ্ডতা নেই। সে থেকেই তাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষিত হয়েছে সাম্রাজ্য শাসনের মাধ্যমে। বলা বাহুল্য এরকম ব্যবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হতে পারে না।
রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে রাখার একটিই উপায় ছিল। তিন প্রদেশকে পরিপূর্ণ স্বায়ত্বশাসন করে তার ভিত্তিতে রাষ্ট্র-কাঠামাে ফেডারেল রূপ নিশ্চিত করা। আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে কাজ করা হলে সেইটাই নিশ্চিত ইয়াহিয়া শাসন সে পথে গেল পরিবর্তে এমন একটা পথ নেওয়া যার পরিণতিতে পাকিস্তানের বিখণ্ড হয়ে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী।
কাজে কাজেই একথা স্পষ্ট বাঙলাদেশ তথা আওয়ামী লীগ আন্দোলনটি বিচ্ছিন্নতাবাদী হলেন ইয়াহিয়া। পাকিস্তান ভেঙে দেবার দায়িত্ব তাকেই করতে হবে।
জাতিতত্ব ও রাষ্ট্রতত্বের সাথে কান্ডজ্ঞান হারিয়ে সি পি এম এর কেউ “ইন্দিরা ইয়াহিয়া এক” কথা বলে স্লোগান তুলেছেন। ভাবছেন এইভাবে তারা বাঙলাদেশেরে মতাে ব্যাপক জনসাড়া পাবেন। এই ধারণা মূঢ়তা; ভারত ও পাকিস্তানের গঠন কাঠামাের পার্থক্যটি মৌলিক। বাঙলাদেশের পুনরাবৃত্তি পশ্চি আমাদের দেশে নানা ধরণের বিচ্ছন্নতাকামী ঝোঁক আছে তা রাষ্ট্রকে তার মােকাবিলা করতে হবে। সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে রাজ্যগুলােকে অধিকতর ক্ষমতা আদায়পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন প্রভৃতির মধ্য ফেডারালিজম এর দিকে অগ্রসর হওয়াই সমস্যা সমাধানের পথ। শেষ বিচারে অবশ্য প্রদর্শিত পথই একমাত্র উপজাতি সমস্যা সমাধানের ঐ এক নির্ভুল পথ আছে।
সূত্র: সপ্তাহ, ১৬ এপ্রিল ১৯৭১