পাকি-সেনানিবাস বহুশত যুবতীকে তিলে তিলে হত্যা করা হচ্ছে
কৃত্তিবাস ওঝা
মার্চ মাসের ২৬ তারিখের পর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যখন কামান দিয়ে ঢাকা শহরের বাড়িগুলাে উড়িয়ে দিচ্ছিল তখন থেকেই সেনাবাহিনী লক্ষ্য রাখছিল বাঙালি মেয়েদের উপর। তারা সবকিছু ধ্বংস করে, শিশু বৃদ্ধ যুবক সকলকে হত্যা করে, শুধু নিরাপদে রক্ষা ও অপহরণের চেষ্টা করেছিল যুবতী মেয়েদের। এই ধ্বংসলীলার মধ্যে যুবতী মেয়েদের পেলেই সােজা ধরে নিয়ে যাওয়া হয় কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট। শুধু মাত্র সর্বস্তরের মানুষের বাড়ি থেকে নয়—স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল যেখানেই যুবতী মেয়ে পাওয়া গেছে নরপশুর দল তাদের ধরে নিয়ে গেছে সেনানিবাসে। শুধু গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যাওয়া নয়, পায়ে হাঁটিয়ে, হাঁটতে অক্ষম হলে চুল ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নাকি কোনাে কোনাে স্থানে বাড়ি বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা মেয়েদের জমা করে একসঙ্গে সেনাবাহিনীর লােকেদের সঙ্গে মার্চ করিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ২৬ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত এইভাবে নারী ও যুবতীদের খুন না করে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়, তার পর শতশত বাঙালি মা বােন সেনানিবাসগুলােতে দিনে রাত্রে পাঞ্জাবি বাহিনীর পশুত্বের খােরাক হয়। পরবর্তী অবস্থায় আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা-সমর্থকদের খুঁজে বের করতে হানা দেওয়া শুরু হয়। এই হানা দিয়ে কোথাও কোন যুবা ছাত্র বা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোন পুরুষ মানুষকে পাওয়া যায় না কিন্তু কোথাও কোথাও দুই-একজন মহিলাকে পাওয়া যায়। সেই মহিলাদের মধ্যে যারা বয়সে কম তাদের সঙ্গে সঙ্গে তুলে নেওয়া হয় ট্রাকে, তার পর ট্রাক বােঝাই হলেই সােজা কুর্মিটোলা সেনানিবাসে। এই মেয়ে লুঠ শুধু ঢাকা শহরেই নয় পাকিস্তানি দস্যুরা যেখানেই গেছে সে শহর হােক গ্রাম হােক সর্বত্রই তাদের লক্ষ্য হয়েছে যুবতী নারী মা বােনেরা। বহু স্থানে আবার মেয়েদেরও তুলে নিয়ে যাবার চেষ্টা না করে বাড়িতে ঢুকে বা হাসপাতালে বা স্কুল কলেজ হােস্টেলে ঢুকে অত্যাচার করে পশুরা অচৈতন্য দেহগুলাে ফেলে গেছে। এই জাতীয় অত্যাচার সম্পর্কে জনৈক বিদেশি মি.এ. সানডার্স গত ৬ এপ্রিল যে বিবরণ দিয়েছেন তার অতি সামান্য অংশ তুলে ধরছি। মি. সানডার্স ব্রিটিশ ব্যবসায়ী হিসাবে ঢাকায় ছিলেন। গত ২ এপ্রিল তিনি ঢাকা ত্যাগ করে দেশে চলে যান। দেশ থেকে তার এই স্বচক্ষে দেখা বিবরণ একটি ইংরাজী পত্রিকায় প্রেরণ করেন ও প্রকাশিত হয়। মি. সানডার্স-এর দেওয়া বিবরণের সামান্য অংশ তুলে ধরা হলাে। কাহিনির ঘটনাস্থল হলাে ঢাকার রােকেয়া হলাে। “সেই দিন বিকেল পাঁচটা হবে। ৩৫০ থেকে ৪০০-এর মতাে পাকিস্তানি সেনা রােকেয়া হলাে ছাত্রীনিবাসটি আক্রমণ করে। তারা মেয়েদের থাকার ঘরগুলাের মধ্যে ঢুকে পড়ে ছাত্রীদের টেনে বের করে। এরপর আরম্ভ হয়। ধর্ষণ । মেয়েরা কাঁদতে থাকেন, আর্তনাদ করতে থাকেন, ধস্তাধ্বস্তি করতে থাকেন কিন্তু পশুরা তাদের পৈশাচিকতা চালিয়ে যায়। ছাত্রীনিবাসের অধিকাংশ মেয়েই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন।
এইরকম সাংঘাতিক পরিস্থিতি হয়ে ওঠে যে পঞ্চাশটি মেয়ে এই বর্বরদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য ছাত্রীনিবাসের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করে।
একটি বারাে বছরের মেয়ের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। সে এসেছিল ছাত্রাবাসে একটি ছাত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। এই বর্বরদের অত্যাচারে সে মৃত্যুবরণ করে। মেয়েটি প্রথমে করুণ আর্তনাদ করে অচেতন হয়ে পড়ে। কিন্তু পশুটি তার উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে যায়।…
যতটুকু সংবাদ সভ্য জগতে এসে পৌচেছে তাতে জানা যায় এই সংখ্যা অনেক। টিক্কা খা-ইয়াহিয়া খার বাহিনীকে নরহত্যায়-গণহত্যায় উৎসাহ ও পুরস্কার হিসাবে উপহার দেওয়া হচ্ছে এই বা মেয়েদের। আর বাঙালি মেয়েরা তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করেছে ঢাকার সেনানিবাসে পাঞ্জাবী দস্যুদের অত্যাচারে, যে মায়েদের কান্না আর্তনাদ সভ্য জগতের মানুষ শুনতে পাচ্ছেন না।
সূত্র: সপ্তাহ, ১৪ মে ১৯৭১