You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.11 | শরণার্থী শিবিরগুলাের অব্যবস্থা দূর করতে লে, গভর্নরের নিকট নৃপেন চক্রবর্তীর চিঠি | দেশের ডাক - সংগ্রামের নোটবুক

শরণার্থী শিবিরগুলাের অব্যবস্থা দূর করতে
লে, গভর্নরের নিকট নৃপেন চক্রবর্তীর চিঠি

সদর মহকুমায় বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের ৫১টি শিবির পরিদর্শন করে মার্কসবাদী কমিউনিটি পার্টির রাজ্য কমিটির সম্পাদক কমরেড নৃপেন চক্রবর্তী লে. গভর্নর শ্রী এ এল, ডায়াসের নিকট নিম্নের স্মারকলিপি পেশ করেছেন।
১. বর্তমানে যে হারে শরণার্থীদের রেশন দেওয়া হচ্ছে তা প্রয়ােজনের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। কোথাও দৈনিক চাউল এবং ডাল দেওয়া হচ্ছে আবার কোথাও কিছু পরিমাণ সবজি ও তৈল ইত্যাদি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কেরােসিন এবং সাবান কোথাও দেওয়া হয় না।
২. সদরে সিমনা তহশিলে, যেখানে বেশিরভাগ হিন্দুস্থানী শ্রমিক ও মুসলিম সম্প্রদায়ের লােক বাস করছেন- সেখানে সরকারের নির্ধারিত ১.১০ পয়সাও তাদের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে না। সােনাচরণ প্রাইমারী স্কুল, কাটাছড়া, সুন্দরটিলা, মতাই, সিমনা, দলদলী, কাতলামারা, বৈকুণ্ঠপুর, মন লা ইত্যাদি সমস্ত শিবিরেই ১৮০০০ শরণার্থীদের মাত্র চাল, ডাল এবং কিছু মরিচ দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। একটা মােটামুটি হিসাবে দেখা যায়, সীমানা তহশিলের শরণার্থীরা মাথাপিছু প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪৫ পয়সা কম পাচ্ছে। এর কারণ জানতে চাইলে সীমানার তহশিলদার জানান যে, বি-ডি-ও’র উপর সমস্ত দায়িত্ব অর্পিত। তিনি ঠিকমতাে জিনিসপত্র কেনার টাকা দেন না এবং তাকে এ ব্যাপারে যে সমস্ত প্রস্তাব দেওয়া হয় তা তিনি অগ্রাহ্য করেন।
৩. সীমানা তহশিলের বিভিন্ন ক্যাম্পগুলােতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা যে রান্নার ব্যবস্থা ছিল তা বর্তমানে বহুলাংশে নেই, সে জন্য শরণার্থী এবং এলাকার জনসাধারণকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। কিন্তু মােহনপুরের চিত্র আলাদা। মােহনপুরে অনেক শরণার্থী উপােস করে আছেন। সেখানে কতকগুলাে আলাদা গ্রামীণ রান্নাঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে দুই তিন মাইল দূর থেকে শরণার্থীদের হেঁটে এসে তাদের খাবার নিয়ে যেতে হয়। কোনাে কোনাে দিন বেলা গড়িয়ে যায়। সেখানকার শরণার্থীদের অভিমত হলাে অবিলম্বে এ ধরনের ব্যবস্থার পরিবর্তে শুকনাে রেশন দেওয়া হােক।
৪. চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। সীমানা তহশিলের বিভিন্ন শিবিরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য নানা প্রকার রােগ ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে। ব্রহ্মকুণ্ড শরণার্থী শিবিরে বসন্তের প্রার্দুভাব ঘটেছে। প্রায় প্রতিটি শিবিরেই আমাশয় মহামারী রূপে দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে করিমখােলা শিবিরে তিনজন মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রায় প্রতিটি শিবিরেই গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা আছে এবং সেখানে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক দল যেতে পারেন। কিন্তু তার ব্যবস্থা করা হয়নি। টিউবওয়েলের ব্যবস্থা না থাকায় সীমানার শরণার্থীদের পুকুর এবং ছড়ার জল পান করিতে হয়। এখন পর্যন্ত কোথাও শিশু খাদ্যের ব্যবস্থা করা হয়নি।
৫. বিভিন্ন স্কুল গৃহে অবস্থানরত এই সকল শরণার্থীদের কোথায় থাকার ব্যবস্থা করা হবে তা সরকারের দৃষ্টির মধ্যে নেই। শিক্ষা বিভাগ থেকে গ্রীষ্মের ছুটি ১৫ দিন বাড়ানাে হয়েছে অথচ এদের অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করার কোনাে চেষ্টা এখনাে নেই। কোথাও কোথাও সরকারি উৎসাহ পেয়ে শরণার্থীরা তাদের নিজেদের অর্থ ও শ্রমের বিনিময়ে স্কুল সীমানার মধ্যে কুড়েঘর তৈরি করছেন। সরকার পেশাদারি কন্ট্রাক্টদের কুড়েঘর তৈরি করার জন্য টেন্ডার দিয়েছেন কিন্তু যে সমস্ত ঘর তৈরি করা হচ্ছে তাতে করে তারা বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।
৬. মােহনপুরের কোথাও কোথাও শিবিরের বাইরের শরণার্থীদের রেশন দেওয়া হচ্ছে কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলে সেই ব্যবস্থা নেই। সীমানায় শিবিরগুলােতে নতুন করে কোনাে শরণার্থী নেওয়া হচ্ছে না।
৭. শরণার্থীদের পরিচয়পত্র দেওয়ার ব্যাপারে সরকারি ব্যবস্থা সন্তোষজনক নয়। আগরতলার পুরনাে থানার ও সিধাই থানায় শত শত লােক লাইন করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অবিলম্বে আরাে কতকগুলাে স্টেশন না খুললে শরণার্থীদের আরাে হয়রানি হতে হবে।
৮. এই স্মারকলিপি পেশ করার পূর্বে মােহনপুরের বি.ডি.ও’র কাছে ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছিল। তাঁর কাছে শরণার্থীদের এই সমস্ত অসুবিধা দূর করার জন্য কয়েকটি প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। প্রস্তাবগুলাে নিম্নরূপ:
(ক) অবিলম্বে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা রান্নার ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে এবং যদি তাদের রেশন দেওয়া হয় তবে তা খুবই ভালাে।
(খ) শিবিরের বাইরে অবস্থানরত শরণার্থীদের রেশন দিতে হবে। প্রয়ােজনে যাতে নতুন করে আগত শরণার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করা যায় সে জন্য গাঁও প্রধানদের সাহায্য নিতে হবে।
(গ) কেরােসিন ও লবণ সরবরাহ করতে হবে এবং ছােটদের প্রাতঃরাশ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। শরণার্থীদের প্রতিদিন ১.১০ পয়সা এর পরিবর্তে ১.৫৫ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
(ঘ) কাপড়-চোপড় দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
(ঙ) শিশুদের বেবিফুড দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
(চ) পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে হবে।
(ছ) ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক দল প্রতি শিবিরে সপ্তাহে অন্তত দু’বার প্রেরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
(জ) শিবির পরিচালনা কমিটি ঠিকভাবে নির্বাচন করতে হবে।
(ঝ) দুর্নীতির অভিযােগগুলাের উপযুক্ত তদন্ত করতে হবে।
৮. সীমানার তেলিয়াপাড়া অঞ্চলে পাক ফৌজের গােলায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীদের সাহায্য দিতে হবে।
৯. ত্রিপুরায় সাত লক্ষ শরণার্থী আগমনের ফলে এলাকায় উপজাতি এবং দিন মজুরদের জীবনের সঙ্কট দেখা দিয়েছে এবং দিন মজুরেরা কাজ পাচ্ছে না। দিনমজুর ও উপজাতিদের অবস্থার উন্নতিকল্পে ইতিপূর্বে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল।

সূত্র: দেশের ডাক
১১.০৬.১৯৭১
২৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭৮