You dont have javascript enabled! Please enable it!
১৩ অক্টোবর ১৯৭৪ বিদেশ থেকে দেশে ফিরে ঢাকা
বিমানবন্দরে সাংবাদিক সম্মেলনে তাজউদ্দীন আহমদ যে বক্তব্য প্রদান করেন তার রিপাের্ট দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক পূর্বদেশঃ অক্টোবর ১৪, ১৯৭৪ সােমবার খাদ্য সংকটকে রাজনীতির উর্ধ্বে রাখতে হবে; নিরন্ন মানুষকে বাঁচাতে দলমত নির্বিশেষে এগিয়ে আসুন : অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বর্তমান জাতীয় দুর্যোগকালে উট পাখির মত বালিতে মাথা গুঁজে থাকলে চলবে । বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। অবিলম্বে দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষকে সাথে নিয়ে জাতীয়ভাবে খাদ্য সংকটের বাস্তব সমাধানের পথে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি গতকাল ঢাকা বিমানবন্দরে এই অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, সকল দল ও মতের নেতৃবৃন্দ এবং বিশেষজ্ঞদের একত্রিত করে বর্তমান খাদ্য সংকট মােকাবেলায় সুনির্দিষ্ট ও কার্যকরি পন্থা গ্রহণের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুরােধ করবেন। তিনি তার বক্তব্য দ্বারা কোন সর্বদলীয় বা জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলছেন কিনা এই প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেছেন যে, সে প্রশ্নই ওঠে না, কারণ বর্তমান সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। ক’দিন আগের উপ-নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। তিনি বলেন, খাদ্য সমস্যাকে অবশ্যই রাজনীতির উর্ধ্বে রাখতে হবে। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, শুধুমাত্র বক্তৃতা, বিবৃতি, স্লোগান দিয়ে সংকটের সমাধান হবে না। এই প্রসঙ্গে তিনি ১৯৫৬ সালের সর্বদলীয় খাদ্য কমিটির কথা উল্লেখ করেন। অর্থমন্ত্রী আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, মানুষ না খেয়ে মরছে—এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। এর অবসান ঘটাতে হবে। তিনি বলেন, মাটি আর মানুষ নিয়ে দেশবাংলাদেশ এখন সার্বভৌম, তার মাটি কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। কিন্তু মানুষ না থাকলে কাকে নিয়ে রাজনীতি, কার জন্যই বা রাজনীতি।
মানুষ যখন মরে যাচ্ছে তখন নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকা যায় না। এ পরিস্থিতি মােকাবেলা করতে যারা ব্যর্থ হবে তাদের ব্যক্তি নির্বিশেষে ছাটাই করা দরকার। এমনকি আমি যদি হই আমাকেও বাদ দেয়া উচিত। মােটকথা যে কোন মূল্যে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মত বর্তমান সঙ্কট মােকাবেলা করে মানুষ বাঁচাতে হবে।  জনৈক সাংবাদিক বর্তমান গণঐক্য জোটের পরিপ্রেক্ষিতে তার দলমত নির্বিশেষে খাদ্য সঙ্কট মােকাবেলার বক্তব্যের ব্যাখা দাবি করলে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি গণঐক্য জোটকে আরাে ব্যাপকভিত্তিক (ব্রড বেজড) করার কথা বলেছি। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, আমি মনে করি কিছুসংখ্যক (মাইক্রোস্কপিক মাইনরিটি) লােক যারা বিদেশের এজেন্ট, তারা ছাড়া এ দেশের সকল মানুষ দেশপ্রেমিক। তাছাড়া বিরােধী দল করলেই মানুষ অ-দেশ প্রেমিক হয় না।  দুঃখ ভারাক্রান্ত কষ্ঠে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, কেউ অভিজাত বিপনী কেন্দ্রে মার্কেটিং করবে আর কেউ না খেয়ে রাস্তায় মরে পড়ে থাকবে এ অবস্থা  চলতে দেয়া যেতে পারে না। তিনি আরাে বলেন, যারা আজ না খেয়ে ধুকে ধুকে পথে-ঘাটে পড়ছে-মরছে, তারা আমাদের মানবতাবােধের প্রতি বিদ্রুপ করে বিদায় নিচ্ছে। তিনি জানান যে, বিদেশ সফরকালে তিনি বিদেশী সংবাদপত্রে বাংলাদেশে অনাহারে মৃত্যুর সচিত্র খবর পাঠ করে ব্যথিত হয়েছেন। লন্ডনে বৃটিশ টেলিভিশনে তিনি বাংলাদেশে অনাহারে মৃত্যু এবং এরই পাশাপাশি এক শ্রেণীর মানুষের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার দুই বিপরীত মর্মান্তিক ছবি দেখেছেন।
তিনি দেখেছেন ঢাকার রাজপথে না খেয়ে মরে যাওয়া মানুষের লাশ আর তারই পাশাপাশি নাইট ক্লাবে এক শ্রেণীর মানুষ বেআইনীভাবে আমদানিকৃত দামী বিদেশী মদ এবং আস্ত মুরগি খাচ্ছে। তিনি জানান যে, লন্ডনে বসে নিজ দেশের দুই বিপরীত ও অমানবিক দৃশ্য দেখে তিনি মর্মাহত ও লজ্জিত হয়েছেন। তিনি দুঃখ করে বলেন, দেশের মানুষ যখন না খেতে পেয়ে মরছে, তখন কালাে টাকার মালিকরা তাদের সম্পদ আরাে বাড়ানাের জন্য অবৈধ প্রতিযােগিতায় মেতে উঠেছে। তিনি বলেন, ভিক্ষাবৃত্তি সকল অধঃপতন ও দুর্নীতির মূল কারণ। আমরা স্থায়ীভাবে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভশীল হতে পারি না। আমাদের দেশে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। সেই সম্পদ আহরণ করে গণ-মানুষের মধ্যে সুষম বন্টনের মাধ্যমে আমাদের সুষম জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তােলার কাজ করে যেতে হবে। যদিও অনেক আগ থেকেই আমাদের তা করা উচিৎ ছিল। অর্থমন্ত্রী দেশের বিত্তবান লােকদের কৃতা সাধনের জন্যেও আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যাদের নাই তাদেরকে কৃতা সাধনের কথা বলে মরতে বলতে পারি না। আমরা সবাই সহানুভূতিশীল হলে এ পরিস্থিতির বেদনা কিছুটা প্রশমিত হত। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ আরাে বলেন, সরকারী দলই হােক আর বিরােধী দলই হােক—কারাে হাতে অস্ত্র থাকা উচিৎ নয়। এতে আইন শৃংখলা রক্ষায় নিয়ােজিত সরকারী কর্মচারিদের মধ্যে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও উপদলের মধ্যে অনাস্থার মনােভাব সৃষ্টি হয়। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আপনারা কেন সরকারের ভালমন্দ তুলে ধরছেন না ? কেন বাস্তব অবস্থা তুলে ধরে জনগণকে শুধু আশার বাণীই শােনাচ্ছেন ? অমুক দেশ থেকে চাল আসছে, গম আসছে, সাহায্য পাওয়া যাবে—এইটুকু লিখলেই চলবে না। কি ভাবে উৎপাদন বাড়ানাে যেতে পারে, কিভাবে সকল মানুষকে একত্রিত করে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে তার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। পরিশেষে তিনি বলেন যে, একটি স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তােলার ব্যাপারে আমাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।

সূত্র : আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমেদ – সিমিন হোসেন রিমি

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!