You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধের সময় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতর থেকে প্রকাশিত একটি প্রচার পুস্তিকা

রণাঙ্গনে প্রধানমন্ত্রী

সৈনিক বেশে রংপুর জেলার মুক্তাঞ্চলে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এসেছিলেন মুক্তিবাহিনীরই একজন সেনানী হিসেবে। সেদিন ছিল ১০ অক্টোবর। বঙ্গবন্ধুর মহান জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ বাংলার বীর মুক্তিযােদ্ধাদের অসমসাহসিক রণনৈপুণ্য এবং বিজয়ের অগ্রাভিযানকে প্রধানমন্ত্রী নির্যাতিত বিশ্বের জাগ্রত জনমানবের এক নতুন উজ্জ্বল ইতিহাস বলে উল্লেখ করেন। তিনি পূর্বদিন বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় ঘটনা স্বাধীন বাংলার এক দল সৈনিক অফিসার ক্যাডেট হিসেবে কমিশন লাভ অনুষ্ঠানে যােগদানের পর মুক্তাঞ্চলের এই সফরে বের হন। প্রথমে তিনি মুক্তাঞ্চল বুড়িমারিতে শিক্ষা সমাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে মিলিত হলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত দুর্জয় সেনানীদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী আলাপ-আলােচনার পর বুড়িমারি স্কুলগৃহে প্রধানমন্ত্রী ও তার সাথে আগত অতিথিদের দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হল। হঠাৎ উইং কমান্ডার বাসারকে ডেকে প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন-“আমাদের যােদ্ধারা খেয়েছে ? উত্তর এল—‘ওরা মাটির মধ্যে খেতে বসেছে। একটি মুহূর্ত মাত্র। দেখলাম প্রধানমন্ত্রী আস্তে করে উঠে চলে গেলেন। সমস্ত জিনিসটাই বুঝতে পারলাম যখন বাইরে এসে দেখি একটি টিনের থালায় খাবার হাতে নিয়ে অসংখ্য মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে বসে প্রধানমন্ত্রী পরম তৃপ্তির সাথে আহার করে চলেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর দুই পার্শে উপবিষ্ট দু’জন মুক্তিযােদ্ধা সংকোচ ও জড়তায় খাবার কথা ভুলে অবাক নেত্রে চেয়েছিল। নিজের থালা থেকে দু’টি মাংসের টুকরা ওদের হাতে তুলে দিয়ে স্নিগ্ধ হাসি মুখে প্রত্যয়দৃঢ় কণ্ঠে বললেন—“বাংলার সাড়ে সাত কোটি নর-নারীর প্রত্যেকেই আজ মুক্তিযােদ্ধা, মুক্তি ও স্বাধীনতার এই যুদ্ধে আমি, তুমি, সে আর তিনি সবাই সমান। দেশব্যাপী এই সর্বাত্মক যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কারও জন্যেই বিশ্রামের কোন অবকাশ নেই। তাই আহার শেষ হওয়া মাত্র নেতার নির্দেশে আবার আমরা সকলেই প্রস্তুত হলাম। এগিয়ে চললাম মুক্তাঞ্চলের একের পর এক গ্রাম পেরিয়ে বড়খাতা অঞ্চলের রণাঙ্গনে। আসন্ন শীতের আহ্বান মৃদুমন্দ শীতল বাতাস আর তার সাথে মুক্তিসেনাদের মর্টার আর রাইফেলের আওয়াজ কানে আসতে শুরু করায় রােমাঞ্চিত আমরা বড়খাতা রণক্ষেত্রে পৌছলাম সন্ধ্যার কিছু আগে। সমস্ত এলাকায় অসংখ্য বাংকার তৈরি করে অতন্দ্র প্রহরীর মত মেশিনগান আর রাইফেল হাতে দাড়িয়ে রয়েছে মুক্তিযােদ্ধারা। সৈনিক বেশে সজ্জিত প্রধানমন্ত্রী আমাদের পেছনে রেখে এগিয়ে গেলেন। হঠাৎ চোখে পড়ল একদল গ্রামবাসী সারিবদ্ধভাবে বাশের সাথে বড় বড় হাঁড়ি ঝুলিয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী তাদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তােমরা কোথায় যাচ্ছ ভাই?’ ওরা বলল, “আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের জন্যে খাবার নিয়ে যাচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলে উঠেলেন, ‘ধন্য আমার প্রিয় দেশবাসী।’ তারপর তিনি আমাদের বাঙ্কারের দিকে এগিয়ে গেলেন।

বাঙ্কারে বাঙ্কারে

আনন্দাশ্রু বিসর্জন করতে করতে তিনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন এক এক করে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদেরকে। হঠাৎ একটি ১২/১৩ বছরের কিশােরকে হাতে অটোমেটিক মেশিনগান নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মুহূর্তের জন্য প্রধানমন্ত্রী হতবাক। ওর গালে ছােট্ট একটি আদর করে জিজ্ঞেস করলেন—এই খােকা, তােমার বয়স কত?’ ‘স্যার, আঠার।’ বুঝলাম ছেলেটি মিথ্যে বলল। ঠাট্টা করে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘তুমি ফিরে যাও তােমার যুদ্ধের দরকার নেই।’ অপলক নেত্রে চেয়ে দেখলাম—কিশােরটির দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। আকুতি জানিয়ে বলল, আমাকে বাদ দেবেন না স্যার, এগিয়ে চলার পথে আমি পেছু হটতে শিখিনি। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কেউ তােমায় বাদ দেবে না ভাই।’ পরে সেক্টর কমাণ্ডার জানালেন, ঐ বাচ্চা ছেলেটি পরপর সাতটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে সাফল্য নিয়ে ফিরে এসেছে। রণক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অনির্ধারিত আগমনে সেনাবাহিনীর মাঝে দেখা দিল এক অভূতপর্ব প্রাণচাঞ্চল্য। হঠাৎ একসঙ্গে গর্জে উঠল মুজিব ব্যাটারি, চার্জে বাংলা বাহিনীর কামান আর মর্টার। অব্যর্থ তাদের লক্ষ্য। চোখে দূরবীন লাগিয়ে প্রধানমন্ত্রী সচক্ষে দেখলেন মাত্র ৪০০ গজ দূরে শক্রবাঙ্কারে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হানাদার পশুদের। ইতােমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর আগমন বার্তা পৌঁছে গেছে মুক্তাঞ্চলের জনগণের মাঝে। তাই ফেরার পথে দেখলাম শত শত নর-নারী পথিপার্শ্বে দাড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলে অভিনন্দন জানাল প্রধানমন্ত্রীকে। পথের মােড়ে মােড়ে দাঁড়িয়ে ওদের সাথে কথা বললেন প্রধানমন্ত্রী। ওদেরকে তিনি শােনালেন আসন্ন বিজয়ের বাণী।

জয় আমাদের কজায়

পাটগ্রামে যখন পৌছুলাম তখন রাত্রি প্রায় ৮টা। দূর থেকে ভেসে এল সহস্র সহস্র জনতার কণ্ঠনিঃসৃত বলিষ্ঠ স্লোগান। পাটগ্রাম হাইস্কুল প্রাঙ্গণে ওরা সমবেত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধের কথা শুনতে। বীর জনতার সে ডাক প্রধানমন্ত্রীর সকল ক্লান্তিকে কেড়ে নিয়ে গেল। তিনি ছুটে গেলেন জনতার মাঝখানে। আবেগবিহ্বল কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বললেন—ভায়েরা আমার। সুদীর্ঘ ২৪ বছর ধরে উপনিবেশবাদী শাসক চক্রের হাতে শােষিত, লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত সাড়ে সাত কোটি বাঙালি নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চেয়েছিল তাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে, আর তাই তারা বাংলাদেশের শতকরা ৯৮২টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে ভােট দিয়ে জয়যুক্ত করেছিল। তারা স্বপ্ন দেখেছিল একটি শােষণহীন সমাজব্যবস্থার। কিন্তু অত্যন্ত পৈশাচিকভাবে ইতিহাসের এই নজীরবিহীন গণরায়কে বানচাল করে দিয়ে বাংলার আবালবৃদ্ধবণিতার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হানাদার পশ্চিমা পশুর দল সারা বাংলাদেশব্যাপী এক অশ্রুতপূর্ব গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছে বিগত ২৫ মার্চ থেকে। একদিকে নিহত, লাঞ্ছিত ও লুণ্ঠিত মানবাত্মার আর্তনাদে বিমর্ষ বাংলা আর একদিকে আঘাতের প্রত্যাঘাত হেনে মাতৃভূমিকে শত্রু কবলমুক্ত করার দুর্জয় শপথে বলীয়ান বীর মুক্তিযােদ্ধাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার বেদীতটে মহান নেতার আদর্শে নবজন্ম লাভ করেছে বাঙালি জাতি। সারাদিন রণাঙ্গনে ঘুরে দেখে এলাম জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কিশাের, যুবক, প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ নর-নারী আজ অস্ত্র ধারণ করেছে হানাদার পশুদের মােকাবিলা করতে।

এ যুদ্ধ আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতার যুদ্ধ। জয় আমাদের হবেই। আপনারা মুক্তাঞ্চলের অধিবাসীরা জীবনের প্রতি পদক্ষেপে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করুন—মনে রাখবেন বাংলার প্রতিটি মানুষই ‘আজ এক একজন মুক্তিযােদ্ধা। মাতৃভূমি থকে শেষ হানাদার শত্রুকে খতম অথবা বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এ যুদ্ধ আমাদের চালাতে হবে। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বললেন, বাংলার মানুষের নয়নমণি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে আমরা আবার আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনবই। বিক্ষুব্ধ গর্জনে সমগ্র এলাকাকে থরথর করে কাপিয়ে দিয়ে ওরা আওয়াজ তুলল ‘জয় বঙ্গবন্ধু, জয় শেখ মুজিব’। সভাশেষে আঞ্চলিক আওয়ামী লীগ নেতা ও স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে ডেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থাকে জনগণের স্বার্থে গড়ে তােলার কাজে সহযােগিতা করতে। বুড়িমারি ক্যাম্পে ফিরেছিলাম। রাত্রি প্রায় ১২টায়। পরদিন সকালে তেঁতুলিয়ার পথে রওনা হওয়ার কথা। কিন্তু ভাের বেলায় পাটগ্রাম থেকে খবর এল ওখানকার যুব সম্প্রদায় একটি সাংস্কৃতিক। অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছে প্রধানমন্ত্রীর সফরকে অভিনন্দন জানাতে। তাই আবার চললাম পাটগ্রামের পথে। পথের দু’ধারে সহস্র সহস্র মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত নর-নারী, চোখে মুখে তাদের প্রভাত সূর্যের আলােকরশ্মির স্বর্ণচ্ছটা, চিত্ত ওদের হর্ষোৎফুল্ল আর কণ্ঠ ওদের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে সােচ্চার। একের পর এক পাটগ্রাম পােস্ট অফিস, থানা, বালিকা বিদ্যালয় ও আওয়ামী লীগ শাখা অফিস পরিদর্শন করে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠান কক্ষে (পাটগ্রাম সদর দফতর) প্রবেশ করলেন। ওরা গেয়ে উঠল—’আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালােবাসি’—তারপর পরিবেশন করল বাংলাদেশে গণহত্যা ও আজকের স্বাধীনতা সংগ্রামের উপরে রচিত একটি ছােট নাটিকা। ওদেরকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন, মুক্তিযুদ্ধের সাথে সাথে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়ােজনীয়তার কথা ।

ডিফেন্স লাইনে

তারপর এগিয়ে চললাম ভুরুঙ্গামারি ও ফুলবাড়ি রণক্ষেত্রে। পথিমধ্যে এক দুর্ঘটনা ঘটে গেল। প্রধানমন্ত্রী ও আমাদের গাড়ির সামনে আর পশ্চাতে একটি জিপে চড়ে আসছিল আমাদের চলচ্চিত্র ও স্টিল ক্যামেরাম্যান আসিক ও আলম। হঠাৎ ওদের জিপখানি রাস্তার উপর থেকে স্কিড করে উল্টে গিয়ে খালের মধ্যে। পড়ল। মুহূর্তের জন্যে আমরা হতভম্ব হয়ে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে ছুটে গেলাম। হঠাৎ দেখলাম খালের মধ্য থেকে ভিজাদেহে বেরিয়ে এসে ফটোগ্রাফার আলম চিৎকার করে উঠল আমরা সবাই ভাল আছি। প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়ে আলম, আসিক ও গাড়ির ড্রাইভারকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। দু’হাত উঁচু করে খােদার দরবারে জানালেন অশেষ কৃতজ্ঞতা। ওদেরকে আমাদের গাড়িতে তুলে। নিয়ে আবার এগিয়ে চললাম । ভুরুঙ্গামারি অঞ্চলে পৌছলাম সন্ধ্যার কিছু আগে। শত সহস্র মুক্তিযােদ্ধা ও গ্রামবাসী আমাদের অভিনন্দন জানাল। মুক্তিযােদ্ধাদের সামনে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আমাদের ডিফেন্স ক্যাম্প পরিদর্শনে বের হন। আমাদের ডিফেন্স লাইন থেকে মাত্র দু’ মাইল দূরে রণসজ্জায় সজ্জিত হানাদার পশুর দল। স্থানীয় নেতৃবর্গ ও সেনাপতিদের সকল অনুরােধ উপরােধ উপেক্ষা করেও বিপদ মাথায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে গেলেন। সামনে পড়ল একটি খরস্রোতা নদী। সেনাবাহিনীর আঞ্চলিক প্রধান বললেন নদীর ঐপারে আমাদের ডিফেন্স লাইন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, চলুন, আমি ওদেরকে দেখতে চাই। নদী পার হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিল। একটি মাত্র কলাগাছের তৈরি ভেলা ছাড়া সে মুহূর্তে সেখানে আর কিছুই ছিল না। দেখলাম প্রধানমন্ত্রী সােজা গিয়ে ভেলায় চড়ে বসলেন। অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেন অন্যেরা। ভেলা ভেসে চল । হঠাৎ মাঝনদীতে গিয়ে স্রোতের কাছে পরাভূত হ’ল ভেলার গতি। কিছুতেই আর এগােন সম্ভব নয়। কিন্তু ওকি ? ওপার থেকে দু’জন বলিষ্ঠ মুক্তিসেনা তাদের হাতের স্টেনগান দু’টি অন্য সাথীদের হাতে দিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল। স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করে ওরা ভেলাটিকে টেনে ওপারে নিয়ে গেল। বাঙ্কারে বাঙ্কারে ঘুরে ঘুরে প্রতিটি সৈনিকের সাথে ব্যক্তিগতভাবে মিলিত হয়ে অনেক রাতে ফিরে আসলেন প্রধানমন্ত্রী কর্তব্য পালনের প্রশান্তি মুখে নিয়ে । খাওয়া-দাওয়া সেরে আমাদের প্রত্যেকেই ঘুমাতে গেলেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে দেখলাম গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থেকে স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মাধ্যক্ষ, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও গ্রামবাসীর সাথে অভাব অভিযােগ ও প্রয়ােজনীয়তা নিয়ে আলাপ-আলােচনা করতে।

শোষণহীন সমাজ গড়াই

১২ অক্টোবর। প্রত্যুষে উঠেই আবার আমরা সদলবলে তেঁতুলিয়ার পথে রওনা হলাম। সারাদিন পথ চলে তেঁতুলিয়ার মুক্তাঞ্চলে গিয়ে পৌছুলাম প্রায় বিকেলে ৩-৩০ মিনিটে। মধ্যাহ্নভােজন শেষ করেই যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। নেতার আগমনে আনন্দে উৎফুল্ল মুক্তিযােদ্ধারা চতুর্দিক থেকে ছুটে এসে যুদ্ধক্ষেত্রেই নেতাকে দিল সামরিক গার্ড অব অনার। ওদেরকে উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বললেন—ভায়েরা আমার, আগের বার আমি যখন এসেছিলাম তখন আপনারা অনেক পেছনে ছিলেন। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তেঁতুলিয়া, ভজনপুর ও কোটগাছিসহ প্রায় সাড়ে ছয় শত বর্গমাইল এলাকা মুক্ত করে দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মত আপনাদেরকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আনন্দে আমার বুক ভরে উঠেছে। আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর কোন শক্তিই আর আমাদের এ অগ্রযাত্রাকে রােধ করতে পারবে না। প্রতিটি শত্রুসেনাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আমাদের বহু সাধের ধর্মনিরপেক্ষ ও শােষণহীন সমাজ আমরা গড়ে তুলতে পারবই এ বিশ্বাস আমার আছে। কঠিন আত্মবিশ্বাস নিয়ে আপনারা এগিয়ে চলুন। জয় আমাদের হবেই। বক্তৃতা শেষে সৈনিকেরা তাদের বাঙ্কারে ফিরে গেল। প্রধানমন্ত্রী ওদের অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেন। দেখলাম একটি গ্রাম্য দুর্গমস্থানের মাঝখানে ওদের প্রধান বাঙ্কার। বর্ষার জলে বাঙ্কার ভরে গেছে। আর তার মধ্যে কোমর জলে দাড়িয়ে প্রহরারত আমাদের বীর মুক্তিযােদ্ধারা। এক মুহূর্তে উপলব্ধি করলাম মাতৃভূমিকে হানাদারদের কবলমুক্ত রাখার শপথে বলীয়ান ঐ বঙ্গ-শার্দুলেরা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে তাচ্ছিল্য করে কর্তব্য পালনে রত ।

ট্রেনিং ক্যাম্পে

পরদিন সকালে প্রধানমন্ত্রী একটি ট্রেনিং ক্যাম্প পরিদর্শন করলেন। সেখানে প্রায় তিন সহস্রাধিক মুক্তিসেনা শিক্ষা গ্রহণ করছে। ওদেরকে শেখান হচ্ছে। অটোমেটিক মেশিনগান ও রাইফেল চালনা, মর্টার শেলিং, গ্রেনেড চার্জ ও ডিনামাইট বিস্ফোরণের আধুনিকতম পদ্ধতি ও গেরিলা কার্যক্রম। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী ওদের পাশে পাশে দাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী দেখলেন কত ধৈর্য সহকারে ও মনােযােগ দিয়ে ওরা শিখছে। টার্গেট করে মেশিনগানের ৫টি করে গুলি চালাল ২০ জন শিক্ষার্থী। হতবাক হয়ে চেয়ে দেখলাম গড় হিসেবে প্রত্যেকেরই ৫টির মধ্যে চারটি গুলিই টার্গেটে আঘাত করেছে! প্রশ্ন করে জানলাম, ওরা মাত্র এক সপ্তাহ আগে মেশিনগানে হাত দিয়েছে। গর্বে বুক ভরে উঠেল। শুধু মনে হল জন্মভূমি মা ওদেরকে গড়ে তুলছে তার নিজের মত করে, কারণ ওরা মুক্তিসেনার দল। চেয়ে দেখলাম ওদের মধ্যে প্রত্যেকেই ১৩ থেকে ১৯ বৎসর বয়স্ক কিশাের অথবা যুবক। ওদের সকলকে সমবেত করে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী বললেন—তােমরা আজ সকলেই দেশমাতৃকার আজাদী রক্ষার যে মহান সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছ তার জন্যে তােমরা আমার অভিনন্দন গ্রহণ কর। সকল প্রকার রাজনৈতিক স্বার্থ বা আদর্শের উর্ধ্বে তােমরা আজ এক একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিসেনা। আজ থেকে তােমাদের আদর্শ মাত্র একটি মহান নেতা শেখ মুজিবের বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর একটি মাত্র শপথ—বিদেশী শত্রু কবলমুক্ত স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিরক্ষার প্রশ্নে আত্মােৎসর্গ করা। তােমরাই আমার দেশের ভবিষ্যৎ। অপরাহ্নে সদলবলে প্রধানমন্ত্রী গেলেন মুক্তিযুদ্ধে আহত সৈনিকদের একটি হাসপাতাল পরিদর্শনে। সারা বিকেল ধরে এক এক করে প্রতিটি আহত সৈনিককে বুকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুসজল চোখে প্রধানমন্ত্রী শােনালেন তাদের সান্ত্বনার বাণী। ওদের ঘরবাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে লিয়াজোঁ অফিসারকে বললেন যােগাযােগ করতে, নির্দেশ দিলেন ওদের জন্যে স্থায়ী ব্যবস্থা করতে । প্রধানমন্ত্রীর চোখ অশ্রুসিক্ত কিন্তু আহত ঐ মুক্তিসেনাদের চোখেমুখে দেখলাম বারুদের গন্ধ বিস্ফোরণের প্রতিজ্ঞা। হাসপাতালের ডাক্তাররা অভিযােগ করলেন ওরা চিকিৎসা গ্রহণে কালক্ষেপ করতে চায় না, ওরা যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে যেতে চায়।

যা চাই, দিতে পারবেন

হাসপাতালের বিছানায় বসে অপলক নেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিল একজন সৈনিক। হানাদার পশুদের একটি মর্টার শেল ওর দু’টি হাতকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন, বল তুমি কি চাও?’ ধীর শান্ত অথচ ইস্পাত কঠিন কণ্ঠে ও পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘পারবেন আমি যা চাই তা আমাকে দিতে।’ প্রধানমন্ত্রী নির্বাক। ও বলল, ‘স্যার, হৃদয়ের জ্বালা আমার থামেনি, আমি আবার যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে চাই। প্লাস্টিক সার্জারি করে আমার হাত দুটিকে ভাল করে দিন। কয়েক মুহূর্তের জন্য আমরা সকলে স্থবির হয়ে গেলাম—মন ডেকে বলল, যে মাটি এমন বীর সন্তানকে জন্ম দিয়েছে সে মাটিতে হানাদার পশুদের কোন স্থান নেই। হাসপাতালের বিছানায় দুটি চেনামুখ দেখে আমরা সবাই চমকে উঠলাম। প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তােমাদেরকে তাে আমি গত পরশু দিন বড়খাতা রণাঙ্গনে দেখে এলাম, কিন্তু আজ তােমরা এখানে আসলে কেমন করে ? ওরা হাসিমাখা মুখে বলল, এখানে কেমন করে এসেছি তা আমাদের মনে নেই। কিন্তু একথা স্পষ্ট মনে আছে যে সেদিন আপনাকে আমাদের মাঝে পেয়ে যে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলাম তারই ভিত্তিতে সেদিন রাতে আমরা অগ্রসর হই। সারারাত যুদ্ধ করে হানাদারদের ২৪/২৫ জনকে খতম করে আমরা আরও ৪/৫ বর্গমাইল এলাকা দখল করে ওদেরকে বিতাড়িত করেছিলাম। আমাদের একজন বীর সঙ্গী বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা যায় আর আমরা দু’জন গুলিবিদ্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন আমাদের জ্ঞান ফেরে, তখন আমরা এই হাসপাতালে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতরের পক্ষ থেকে এম. আর. আখতার কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত। সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশিত প্রচার পুস্তিকা রণাঙ্গণে প্রধানমন্ত্রী’ থেকে গৃহীত।

সূত্র : আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমেদ – সিমিন হোসেন রিমি

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!