জেল হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন আইজি প্রিজনস ও ডিআইজি প্রিজন যে প্রতিবেদন তৈরি করেন তা দীর্ঘ ২১ বছর ধামাচাপা থাকার পর উদ্ধার করা হয়। এর ওপরে পত্রিকায় প্রকাশিত রিপাের্ট
দৈনিক ভােরের কাগজ ঃ ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬
জেল হত্যার প্রামাণ্য দলিল উদ্ধার ঃ মাঈনুল আলম ঃ ২১ বছর পর জেল হত্যার সকল সত্য উদঘাটিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে অসহায় নিরস্ত্র অবস্থায় নিহত চার জাতীয় নেতা হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী তৎকালীন আইজি প্রিজনস নূরুজ্জামান ও ডিআইজি প্রিজন আবদুল আউয়ালের প্রতিবেদন এবং নিহত নেতাদের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। তথ্য প্রমাণেও এটা এখন পরিষ্কার খন্দকার মােশতাক আহমদ ও আত্মস্বীকৃত খুনী কর্নেল রশীদ চক্র রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বসে ক্ষমতা অপব্যবহার করে আইন-কানুনের তােয়াক্কা না করে এই জঘন্য কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেছিল। তাদের নির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন মােসলেমের নেতৃত্বে কালাে পােশাকধারী ৫ জনের একটি ঘাতক দল এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। জেলে নিহত চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলি ও কামরুজ্জামান হত্যার পর ৫ নভেম্বর ‘৭৫ আইজি প্রিজনস স্বরাষ্ট্র সচিবকে ও ডিআইজি প্রিজন আইজি প্রিজনসের কাছে যে প্রতিবেদন দেন এবং দু’জন ম্যাজিস্ট্রেট মােঃ আজমল চৌধুরী ও খন্দকার মিজানুর রহমান চার মৃতদেহের যে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন তা গত ২১ বছর ধরে চাপা পড়েছিল। গত ১৩ সেপ্টেম্বর আইজি প্রিজনসের কক্ষে রক্ষিত আলমিরার ফাইলের স্তুপ থেকে ভারপ্রাপ্ত আইজি প্রিজনস লিয়াকত আলি খান এ ফাইলটি উদ্ধার করে কর্তৃপক্ষের কাছে পৌছে দেন। এ ফাইল ধরেই এখন সিআইডি তদন্ত করছে। আর এ ফাইল থেকেই জেল হত্যার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে। আইজি প্রিজনস ও ডিআইজি প্রিজন এবং নিহতদের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন আজকের ভােরের কাগজ-এ পৃথক পৃথক ভাবে ছাপা হল।
তৎকালীন আইজি প্রিজনস নূরুজ্জামান তার প্রতিবেদনে বলেছেন, মােসলেম কারাগারে এসে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। বিষয়টি সেখানে উপস্থিত ডিআইজি প্রিজন, জেলারসহ সকলকে হতভম্ব করে দেয়। অবশেষে আইজ প্রিজনস নূরুজ্জামান রাষ্ট্রপতি খন্দকার মােশতাকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে সমর্থ হন। নুরুজ্জামান মােশতাককে বলেন, ক্যাপ্টেন বন্দিদের হত্যা করতে চাচ্ছে। এর জবাবে মােশতাক তাকে বলেন, “সে যা। বলছে তাই হবে।’ আইজি প্রিজনস প্রতিবেদনে বলেন, ক্যাপ্টেন ও তার দলকে। ক্রোধান্বিত দেখাচ্ছিল এবং সে কারণে কেউ তার নির্দেশ অমান্য করার সাহস দেখায়নি। মােসলেমের দল গুলি করে চার নেতাকে ফেলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর নায়েক এ. আলির নেতৃত্বে আরেকটি দল গুলিবিদ্ধদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে কারাগারে ঢেকে। এ দলটি তখনও যারা আহত হয়ে কাতরাচ্ছিলেন তাঁদের বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। ডিআইজি প্রিজন কে. এ. আউয়াল তার প্রতিবেদনে বলেন, ক্যাপ্টেন মােসলেম তাঁদের জানিয়েছিল, সে মাত্র তিন মিনিটে শেখ মুজিবকে শেষ করেছিল। আউয়াল বলেন, নায়েক এ. আলির নেতৃত্বে দ্বিতীয় দলটি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলির দেহে বেয়নেট চার্জ করেছিল।
মােশতাক বললেন, আপনি মেজর রশিদের নির্দেশ পালন করুন ঃ আইজি প্রিজনস নূরুজ্জামানের বক্তব্য ও কাগজ প্রতিবেদন : ১৯৭৫-এর নভেম্বরে জেলহত্যা সম্পর্কে তৎকালীন আইজি প্রিজনস নূরুজ্জামান ঘটনার একদিন পর ৪ নভেম্বর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের বরাবর নিজের একটি বিবৃতিসহ তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্তব্যরত ঢাকা বিভাগের ডিআইজি প্রিজন কে, আবদুল আউয়ালের রিপোের্ট পাঠান। আইজি প্রিজনস নূরুজ্জামানের বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ এখানে দেওয়া হল ঃ ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর রাত ৩টায় আমি বঙ্গভবন থেকে মেজর রশিদের একটি ফোন পাই। তিনি আমার কাছে জানতে চান, ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে কোন সমস্যা আছে নাকি। আমি জানালাম, ঠিক এই মুহূর্তের অবস্থা আমার জানা নাই। এরপর তিনি আমাকে জানালেন, কয়েকজন বন্দিকে জোর করে নিয়ে যেতে কয়েকজন সেনা সদস্য জেল গেটে যেতে পারে, আমি যেন জেল
গার্ডদের সতর্ক করে দেই। সে অনুযায়ী আমি সেন্ট্রাল জেলে ফোন করি এবং জেল গেটে দায়িত্বে থাকা ওয়ার্ডারকে মেসেজটি জেলারকে পৌছে দিতে বলি, যাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। ৩/৪ মিনিট পর বঙ্গভবন থেকে আরেকজন আর্মি অফিসারের ফোন পাই। তিনি জানতে চান আমি ইতােমধ্যেই ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে গার্ডদের সতর্ক করে দিয়েছি কিনা। আমি ইতিবাচক জবাব দেওয়ার পর তিনি আমাকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সচক্ষে দেখার জন্য জেলগেটে চলে যেতে বলেন। আমি তখন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ডিআইজি প্রিজনকে ফোন করি। খবরটি জানিয়ে আমি তাকে তাৎক্ষণিকভাবে জেলগেটে চলে যেতে বলি। দেরি না করে আমিও জেলগেটে চলে যাই এবং ইতােমধ্যেই সেখানে পৌছে যাওয়া জেলারকে আবার গার্ডদের সতর্ক করে দিতে বলি। এরই মধ্যে ডিআইজিও জেলগেটে পৌছেন। বঙ্গভবন থেকে পাওয়া খবরটি আমি আবার তাঁকে জানাই। এর পরপরই মেজর রশিদের আরেকটি ফোন পাই। তিনি আমাকে জানান, কিছুক্ষণের মধ্যেই জনৈক ক্যাপ্টেন মােসলেম জেলগেটে যেতে পারেন। তিনি আমাকে কিছু বলবেন। তাকে যেন জেল অফিসে নেওয়া হয় এবং ১। জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ ২। জনাব মনসুর আলি ৩। জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম ৪। জনাব কামরুজ্জামান—এ ৪ জন বন্দিকে যেন তাকে দেখান হয়। এ খবর শুনে আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাই এবং টেলিফোন প্রেসিডেন্টকে দেওয়া হয়। আমি কিছু বলার আগেই প্রেসিডেন্ট জানতে চান, আমি পরিষ্কারভাবে মেজর রশিদের নির্দেশ বুঝতে পেরেছি কিনা। আমি ইতিবাচক জবাব দিলে তিনি আমাকে তা পালন করার আদেশ দেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ৪ জন সেনা সদস্যসহ কালাে পােশাক পরা ক্যাপ্টেন মােসলেম জেলগেটে পৌছান। ডিআইজি প্রিজনের অফিসকক্ষে ঢুকেই তিনি আমাদের বলেন, পূর্বোল্লিখিত বন্দিদের যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে তাকে। নিয়ে যেতে। আমি তাকে বলি, বঙ্গভবনের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি আমাকে কিছু বলবেন।
উত্তরে তিনি জানান, তিনি তাদের গুলি করবেন। এ ধরনের প্রস্তাবে আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে যাই। আমি নিজে এবং ডিআইজি প্রিজন ফোনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করি, কিন্তু ব্যর্থ হই। সে সময় জেলারের ফোনে বঙ্গভবন থেকে মেজর রশিদের আরেকটি কল আসে। আমি ফোনটি ধরলে মেজর রশিদ জানতে চান, ক্যাপ্টেন মােসলেম সেখানে পৌছেছেন কিনা। আমি ইতিবাচক জবাব দেই এবং তাঁকে বলি, কী ঘটছে আমি কিছুই বুঝতে। পারছি না। তখন মেজর রশিদ আমাকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। আমি প্রেসিডেন্টকে ক্যাপ্টেনের বন্দিদের গুলি করার ইচ্ছার কথা জানাই। প্রেসিডেন্ট জবাব দেন, সে যা বলছে তাই হবে। তখন আমরা আরাে উত্তেজিত হয়ে যাই। ক্যাপ্টেন মােসলেম বন্দুকের মুখে আমাকে, ডিআইজি প্রিজন, জেলার ও সে সময় উপস্থিত অন্যান্য কর্মকর্তাদের সেখানে যাওয়ার নির্দেশ দেন, যেখানে উপরিল্লিখিত বন্দিদের রাখা হয়েছে। ক্যাপ্টেন ও তার বাহিনীকে তখন উন্মাদের মতাে লাগছিল এবং আমাদের কারাে তাদের নির্দেশ অমান্য করার উপায় ছিল না। তার নির্দেশ অনুযায়ী পূৰ্বোল্লিখিত ৪ জনকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করা হয় এবং একটি রুমে আনা হয়, সেখানে জেলার তাদের শনাক্ত করেন। ক্যাপ্টেন মােসলেম এবং তার বাহিনী তখন বন্দিদের গুলি করে হত্যা করে। কিছুক্ষণ পর নায়েক এ. আলির নেতৃত্বে আরেকটি সেনাদল সবাই মারা গেছে কিনা তা নিশ্চিত হতে জেলে আসে। তারা সরাসরি সেই ওয়ার্ডে চলে যায় এবং পুনরায় তাদের মৃতদেহে বেয়নেট চার্জ করে।
স্বা: এন. জামান, মহা-কারাপরিদর্শক, ৫-১১-৭৫
৪ সশস্ত্র কর্মকর্তা নিয়ে ভীতিকর ভঙ্গিতে ক্যাপ্টেন মােসলেম এলেন ঃ ডিআইজি প্রিজন আউয়ালের রিপোের্ট ঃ কাগজ প্রতিবেদক ঃ ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ৪ জাতীয় নেতাকে হত্যার পর তখন কর্তব্যরত ডিআইজি প্রিজন আবদুল আউয়াল আইজি প্রিজনস বরাবর ঘটনার বিবরণ সংবলিত যে বিস্তারিত রিপাের্ট পেশ করেন তার পূর্ণ বিবরণ এখানে দেওয়া হল। আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি, গত ২ নভেম্বর ‘৭৫ দিবাগত রাত ৩ ঘটিকায় আমি আমার বাসভবনে অবস্থানকালে জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেলের কাছ থেকে আমাকে জেলগেটে যাওয়ার নির্দেশ সংবলিত একটি মেসেজ পাই। তিনি আরাে জানান, বঙ্গভবন থেকে প্রাপ্ত নির্দেশের ভিত্তিতে তিনি নিজেও জেলগেটে অভিমুখে রওয়ানা দিচ্ছেন। আমাকে আরাে বলা হয়, এই মর্মে রিপাের্ট পাওয়া গেছে যে, কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা জেলগেটে আসতে পারেন এবং জোরপূর্বক কয়েকজন বন্দিকে নিয়ে যেতে পারেন। মুহূর্তমাত্র ব্যয় না করে আমি জেলগেটের উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম এবং রাত ৩টা ২০ মিনিট নাগাদ সেখানে পৌছলাম। গিয়ে দেখি জেলগেটে জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল এবং জেলার আগে থেকেই উপস্থিত। অতঃপর আমি ইন্সপেক্টর জেনারেলকে সঙ্গে নিয়ে আমার অফিস কক্ষে গেলাম। একটু পরেই জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল একটি টেলিফোন কল রিসিভ করলেন, আমাকে বলা হল তা বঙ্গভবন থেকে এসেছে। এখানে বলা যেতে পারে, এই টেলিফোন সংলাপে ইন্সপেক্টর জেনারেল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা পােষণ করেছিলেন। স্পষ্টতই তার অনুরােধ মেনে নেওয়া হয়েছিল। কেননা আমি তাকে স্যার’ সম্বােধন করতে এবং সালাম দিতে শুনলাম। টেলিফোনে আলাপ সেরে ইন্সপেক্টর জেনারেল আমাকে জানালেন যে, তাকে বলা হয়েছে কয়েকজন সশস্ত্র গার্ড নিয়ে ক্যাপ্টেন মােসলেম জেলে আসবেন এবং তাকে ভেতরে নিয়ে যেতে হবে।
তিনি (ক্যাপ্টেন মােসলেম) যা করতে চান তাকে তা করতে দিতে হবে এবং বন্দি তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও এ. এইচ, এম, কামরুজ্জামান কারা তাঁকে তা চিনিয়ে দিতে হবে। ইতােমধ্যে ইন্সপেক্টর জেনারেল বঙ্গভবন থেকে আর একটি টেলিফোন মেসেজ রিসিভ করলেন। ইন্সপেক্টর জেনারেল আমাকে জানালেন যে, তাকে আবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, সব গার্ডকে ঠিকমত সতর্ক করা হয়েছে কিনা। তিনি হ্যা’ বােধক উত্তর দিলেন এবং অতঃপর কর্মকর্তাসহ অন্যান্য স্টাফদের খুবই সতর্ক ও অতন্দ্র থাকার নির্দেশ দিলেন। ইন্সপেক্টর জেনারেলের এই নির্দেশ পালন করা হল। এর কিছুক্ষণ পর স্টেনগান, এসএলআর প্রভৃতিতে সুসজ্জিত ৪ জন সশস্ত্র কর্মকর্তা সহযােগে ভীতিকর ভঙ্গিতে ক্যাপ্টেন মােসলেম আমার অফিস কক্ষে এলেন এবং জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেলকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনিই নূরুজ্জামান কিনা। জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল হ্যা’ বােধক উত্তর দিলেন। এরপর তিনি ইন্সপেক্টর জেনারেলকে তাড়াতাড়ি করতে বললেন। ইন্সপেক্টর জেনারেল তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী করতে হবে ? আমাদের ভয়ানক আতঙ্কিত করে তিনি ইন্সপেক্টর জেনারেলকে বললেন, তাঁর কাছে পূর্বে যে কয়জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তিনি তাদের গুলি করবেন। ইন্সপেক্টর জেনারেল বললেন যে, তিনি পূর্বে এ জাতীয় কোন নির্দেশ পাননি এবং তাঁকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে। আমার অফিসের টেলিফোনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কয়েকবার যােগাযােগ করার চেষ্টা করা হল কিন্তু যােগাযােগ করা গেল না। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ইন্সপেক্টর জেনারেলকে জানান হল যে, জেলারের অফিসের টেলিফোন সেটে তাঁর নামে বঙ্গভবন থেকে টেলিফোন এসেছে। ইন্সপেক্টর জেনারেল টেলিফোন ধরার জন্য রওয়ানা দিলেন। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। পেছন পেছন চলল সামরিক কর্মকর্তারা। টেলিফোনে কথা বলার সময় ইন্সপেক্টর জেনারেল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন এবং তার অনুরােধ রাখা হল বলে স্পষ্ট মনে হল।
ইন্সপেক্টর জেনারেলকে বলতে শুনলাম, ক্যাপ্টেন মােসলেম তাদের গুলি করবেন বলে বলছেন। এরপর ইন্সপেক্টর জেনারেল টেলিফোন রেখে দিলেন এবং তাঁর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। ক্যাপ্টেন মােসলেম তখন বন্দুকের নল ঠেকিয়ে আমাদের তক্ষুণি পূর্বোক্ত বন্দিরা যেখানে আটক রয়েছে সেখানে যাওয়ার হুকুম দিলেন। নির্দেশ মাফিক সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে ইন্সপেক্টর জেনারেল রওয়ানা দিলেন। আমি জেলার এবং অন্যান্য নির্বাহী স্টাফরাও সঙ্গে চললাম। পথিমধ্যে আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছার কথা জানালাম। ক্যাপ্টেন হুমকির সুরে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ভয় পাচ্ছেন? আমি বললাম, ভয়ের প্রশ্ন আসছে না, আমার ৩২ বছরের চাকরি জীবনে আমি এ জাতীয় ঘটনার কথা শুনিনি। তিনি ক্রোধান্বিত হলেন এবং একজন সামরিক কর্মকর্তা (সেপাই) আমার কাঁধে হাত রেখে আমাকে চলে যেতে বললেন। এতে ইন্সপেক্টর জেনারেল বললেন, না, উনি থাকবেন। আতঙ্ক ধরিয়ে দেওয়া চোখে ক্যাপ্টেন আমার দিকে তাকালেন। ইতােমধ্যে ক্যাপ্টেন মােসলেমের নির্দেশে জেলার এবং অন্যান্য কয়েকজন নির্বাহী স্টাফ মিলে তাজউদ্দীন আহমেদ, মনসুর আলি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামানকে অন্যান্য বন্দিদের থেকে আলাদা করলেন। তাদেরকে একটা ওয়ার্ডে জড়াে করা হল এবং ঐ ওয়ার্ডের অন্যান্য সদস্যদের সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হল। ইতােমধ্যে ক্যাপ্টেন এ জাতীয় বিলম্বে বেশ ক’বার বিরক্তি প্রকাশ করে বলছিলেন, শেখ মুজিবকে খতম করতে তাঁর মাত্র ৩ মিনিট সময় লেগেছিল। যখন তাদের জানান হল ৪ বন্দিকে একটি কক্ষে আনা হয়েছে, ক্যাপ্টেন মােসলেম আর তার দল তৎক্ষণাৎ সেই রুমের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন।
যে ওয়ার্ডে উক্ত বন্দিদের আটক রাখা হয়েছে সেখান থেকে ৪০ গজ দূরে আমি আর জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল দাঁড়িয়ে রইলাম। অচিরেই আমাদের কানে গুলি করার ভয়াবহ শব্দ ভেসে এল। তারা ফিরে এলেন আর তড়িঘড়ি জেলগেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমরা তাদের অনুসরণ করলাম। রেকর্ড অনুসারে ক্যাপ্টেন মােসলেম আর তার দল জেলগেটে ঢুকেছে ভাের ৪টায় এবং জেলগেট ছেড়ে গেছে ভাের ৪টা ৩৫ মিনিটে। এরপর ভাের ৫টা ২৫ মিনিটে বঙ্গভবন থেকে নায়েক এ. আলির নেতৃত্বে সশস্ত্র কর্মকর্তাদের আর একটি দল। এল এবং গুলি করার জায়গাটি পরিদর্শন করে ভিকটিমদের মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে চাইল। তাদের নির্দেশও পালন করা হল। যেহেতু আমি সে সময় আমার অফিস কক্ষে ফজরের নামাজ পড়ছিলাম আমি এই দলটিকে স্বচক্ষে দেখিনি। নামাজ শেষ করে আমি জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেলের কাছ থেকে এ তথ্য পেলাম। তিনি তখনাে তার অফিস কক্ষে ছিলেন। দলটি তাদের পরিদর্শন শেষে ৫টা ৩৫ মিনিটে জেল ছেড়ে চলে যায়। আমি পরে জানতে পারি এই দলটি মনসুর আলি এবং নজরুল ইসলামের দেহে বেয়নেট দিয়ে আঘাতও করে। জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল ভাের ৫টা ৪৫ মিনিটে জেল ত্যাগ করেন এবং আমি সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে আমার অফিস কক্ষ ত্যাগ করি। আমি আবার অফিসে ফিরে আসি সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে। অফিসে এসে আমি জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেলকে টেলিফোন করি এবং মৃতদেহগুলাে সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ করতে তাকে অনুরােধ করি। তিনি আমাকে মেজর রশিদের সঙ্গে যােগাযােগ করতে অনুরােধ করেন।
আমি তাকে অনুরােধ করি যাতে তিনি নিজেই মেজরের সঙ্গে যােগাযােগ করেন, কিন্তু তিনি কাজটা আমাকেই করতে অনুরােধ করেন। আমি কিছুটা সময় অপেক্ষা করি। বিশেষত আমার কিছু মন্তব্যের কারণে আমি ক্যাপ্টেন মােসলেমের ভয়ানক বিরাগভাজন হয়েছি বলে সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ করতে আমার খানিকটা ভয় ভয়ই লাগছিল। সকাল ১০টার দিকে আমি তবু কর্নেল রশিদের সঙ্গে ফোনে যােগাযােগ করলাম এবং মৃতদেহগুলাে কী করে সরানাে হবে জানতে চাইলাম। তিনি আমাকে পুরােপুরি নীরব থাকতে বললেন এবং মৃতদেহগুলাে যেভাবে রয়েছে সেভাবেই রাখার নির্দেশ দিলেন। আমি একথা। ইন্সপেক্টর জেনারেলকে অবগত করলাম। ঐ দিন দুপুর ২টার দিকে জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেলের অফিসে গিয়ে এ ঘটনায় আমাদের কি কি করণীয় তা পর্যালােচনা করলাম। খানিকক্ষণ আলােচনার পর আমরা বিষয়টা সম্পর্কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবকে রিপাের্ট করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিকেল ৩টার দিকে আমি এবং ইন্সপেক্টর জেনারেল সচিবের দপ্তরে গেলাম। ইন্সপেক্টর জেনারেল পুরাে ঘটনাটি সচিবকে জানালেন। মৃতদেহগুলাে সরানাের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনরকম নির্দেশের অভাবে যেখানে হত্যা করা হয়েছে লাশগুলাে ৪ নভেম্বর ‘৭৫ সন্ধ্যাবেলা পর্যন্ত সেখানে। সেভাবেই পড়ে রইল।
৪ নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের তরফ থেকে নির্দেশ পাওয়া গেল। অচিরেই লাশগুলাের সুরতহাল সম্পর্কিত রিপোের্ট এবং দ্রুত ময়না তদন্তের রিপাের্ট তৈরি করার ব্যবস্থা করতে বলা হল। সচিব মহােদয় সদয় হয়ে পুলিশ কর্তৃপক্ষ, মেডিকেল কর্তৃপক্ষ এবং ম্যাজিস্ট্রেটকে তাদের করণীয় পদক্ষেপগুলাে গ্রহণের নির্দেশ। দিয়েছিলেন। নিহতদের পরিবার যাতে লাশগুলাে ফেরত পেতে পারে এ ব্যাপারে তিনি পুলিশ কর্তৃপক্ষকে সবরকম সহায়তা দেওয়ার নির্দেশ। দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে লাশ দাফনের ব্যাপারে সাহায্য করারও নির্দেশ ছিল। পুলিশ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়েছে এবং ম্যাজিস্ট্রেট ও মেডিকেল কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেছে। পুলিশের ডিআইজি, ঢাকা রেঞ্জ এডিসি (জেনারেল) এবং বিপুলসংখ্যক উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা ঐ দিন রাত ১১টা পর্যন্ত জেলে অবস্থান করেছে। ৪ নভেম্বর রাতে তাজউদ্দীন আহমদ এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামের লাশ জেলগেটে তাদের আত্মীয়স্বজনের হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং প্রয়ােজনীয় পুলিশ প্রহরায় পুলিশের ট্রাকে করে তাদের বাসায় লাশ পৌছে দেওয়া হয়। কামরুজ্জামান এবং মনসুর আলির লাশ ৫ নভেম্বর ভােরে তাদের আত্মীয়স্বজনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তাদের আত্মীয়স্বজনরা যেভাবে চেয়েছে পুলিশ কর্তৃপক্ষ সেভাবেই। প্রহরা এবং গাড়ি দিয়ে লাশ বাসায় পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে।
স্বা: কে. এ. আউয়াল, ডিআইজি প্রিজন
ঢাকা বিভাগ, কেন্দ্রীয় কারাগার, ঢাকা। ৫-১১-৭৫
সূত্র : আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমেদ – সিমিন হোসেন রিমি