জাতিসঙ্ঘে সেদিন প্রত্যেকটি দেশের প্রতিনিধি হাজির। বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি বাংলায় ভাষণ দেবেন। তাঁর ইংরেজির দক্ষতা সারা বিশ্ব জানে। কিন্তু গরিব দেশের রাখাল রাজা কথা বলবেন বাংলায়। কেউ বুঝুক আর না বুঝুক, কিচ্ছু যায় আসেনা। “আমার বাঙালি আজ বীরের জাতি।” সেই জাতির প্রতিনিধি, সেই জাতির পিতা বীরের মতই মঞ্চে অবস্থান নিলেন। বীর বাঙ্গালীকে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই শিখিয়েছিলেন আত্বসন্মান নিয়ে কী করে চলতে হয়। It was usual that the representatives of the countries would use English as a language of delivering their speech at a UN council as it is understandable for everyone. But the father of the nation, father of 75 million people, showed his strong girth and personality to the world by being strict on delivering his speech in Bengali and represented his country and fellowmen the best way he could and also left a lesson for us to stand on our own foot like a hero. That was the real face of our people, no doubt about it. But we lost that face and morale by killing our beloved father in 1975.
জাতিসঙ্ঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪
মি. প্রেসিডেন্ট, সম্মানিত প্রতিনিধিবৃন্দ ভদ্র মহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ,
আজ এই মহান পরিষদে আপনাদের সামনে দুটো কথা বলার সুযোগ পেয়ে আমি নিজকে ভাগ্যবান মনে করছি। মানব জাতীর এই পার্লামেন্টে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ প্রতিনিধিত্ব লাভ করায় আপনাদের মধ্যে যে গভীর সন্তুষ্ঠিভাব আমি লক্ষ্য করেছি আমিও তার অংশিদার। বাঙালি জাতীর জন্য এটা এক ঐতিহাসিক মুহুর্ত। কারণ তারা আত্ম নিয়ন্ত্রনের অধিকার অর্জনের সংগ্রাম আজ বিরাট সাফল্য দ্বারা চিন্থিত। একটি স্বাধীন দেশে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে মুক্ত ও সম্মানজনক জীবন যাপনের অধিকার অর্জনের জন্য বাঙালিজাতী বহু শতাব্দি ধরে সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে। তারা চেয়েছে বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে সার্বিক শান্তি ও সৌহার্দের মধ্যে বসবাস করতে। জাতিসঙ্ঘ সনদে যে মহান আদর্শের কথা বলা হয়েছে তা আমাদের জনগণের আদর্শ এবং এ আদর্শের জন্য তারা চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে। এমন এক বিশ্ব ব্যবস্থা গঠনে বাঙালি জাতি উৎসর্গকৃত যে ব্যবস্থায় সকল মানুষের শান্তি ও ন্যায়বিচার লাভের আকাঙ্খা পরিতৃপ্ত হবে এবং আমি জানি আমাদের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের মধ্যে আমাদের লাখো লাখো শহীদের বিদেহী আত্মা পরিতৃপ্ত নিহীত রয়েছে। আমাদের জন্য বিশেষ সৌভাগ্যের কথা বাংলাদেশ এমন এক সময় জাতিসংঘে প্রবেশ করেছে যখন এই পরিষদের প্রেসিডেন্ট পদ অলংকিত করেছেন এমন এক মহান ব্যক্তি তিনি নিজেও ছিলেন একজন সক্রিয় মুক্তি সংগ্রামী।
মাননীয় প্রেসিডেন্ট, গতবছর আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন সফল করে তোলার কাজে আপনার মূল্যবান অবদানের কথা আমি স্বরণ করছি। যাদের মহান আত্মত্যাগে বাংলাদেশ আজ জাতি সংঘে আসন লাভে সমর্থ হয়েছে। এই সুযোগে আমি তাদের অভিবাদন জানাই। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে যে সব দেশ ও জাতি সমর্থণ জাগিয়েছেন আমি তাদের প্রতিও জানাই আমার অন্তরের গভীর কৃতজ্ঞতা। নবলব্ধ স্বাধীনতা সংহত করার কাজে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্ঘটনে এবং জনগণের জন্য অধিকার কল্যাণকর ভবিষ্যত গঠনের বিরাট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার কাজে যে সব দেশ ও জাতি বাংলাদেশকে সাহায্য করেছেন আমি তাদেরও আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। জাতিসংঘে আমাদের আসন গ্রহণকে যারা অভিনন্দন জানিয়েছেন আমি তাদেরও বাংলাদেশের জনসাধারনের আন্তরিক ধন্যবাদ পৌঁছে দিচ্ছি। বাংলাদেশের সংগ্রামের ন্যায় ও শান্তির জন্য যে সার্বজনীন সংগ্রাম তারই প্রতীকস্বরুপ। সুতরাং বাংলাদেশ শুরু থেকেই বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের পাশে দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। জাতিসংঘের জন্মের পর তার এক চতুর্থশতাব্দির অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে তার আদর্শ বাস্তবায়নে বিরাট বাঁধার মুখে কী অবিরাম সংগ্রামীই না চলাতে হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ সনদে যে আত্ম নিয়ন্ত্রন অধিকারের প্রতিশ্রুতি সে প্রতিশ্রুতি অধিকার অর্জনে জন্য এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন অ্যামেরকিা লাখো লাখো মুক্তিসেনানীকে আত্মহুতি দিতে হয়েছে। এই সংগ্রাম এখনো চলছে। গায়ের জোরে বেআইনি ভাবে এলাকা দখল জনগণের ন্যায় সংঘত অধিকারকে নসাৎ করার কাজে শক্তির ব্যবহার বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে চলেছে এই যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ব্যর্থ হয়নি। আলজেরিয়া, ভিয়েতনাম বাংলাদেশ ও (অস্পষ্ট) বিরাট বিজয় অর্জিত হয়েছে। এই জয় দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে ইতিহাস জনগণের পক্ষে এবং ন্যায়ের চূড়ান্ত বিজয় অবধারিত। পৃথিবীর বহু স্থানে অন্যায় অবিচার এখনো চলেছে। আমাদের আরব ভায়েরা এখনো লড়ছেন তাদের ভূমি থেকে জবর দখলকারীদের সম্পূর্ণ উচ্ছেদের জন্য। প্যালেস্টাইনের জনগণের ন্যায়সঙ্গত জাতিয় অধিকার এখনো অর্জিত হয় নাই। উপনিবেশবাদ উচ্ছেদের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হলেও চূড়ান্ত প্রক্রিয়া এখনো পৌঁছেনি। একথা আফ্রিকার জন্য আরো বিশেষভাবে সত্য। সেখানে জিম্বাবুয়ে ও নামিবিয়ার জনগণ স্বাধীনতা ও জাতিয় মুক্তির চূড়ান্ত সংগ্রামে এখনো ব্যাপৃত। বর্ণ বৈষম্য এই পরিষদে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে বারবার চিন্থিত হওয়া সত্বেও মানুষের বিবেককে এখনো তা দংশন করছে। এক দিকে অতীতের অন্যায় অবিচার – অবিচারের ধারাকে উৎখাতের সংগ্রাম। অন্যদিকে ভবিষ্যতে বিরাট চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে। আজ বিশ্বের সকল জাতি পথ বেঁছে নেওয়ার এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখিন। এই পথ বাঁছাই করার প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যত। অনাহার, বেকারত্ব, দারিদ্র, ভভুক্ষার তাড়নায় জর্জরিত এবং পারমানবিক যুদ্ধের দ্বারা সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ার শঙ্কায় শিহরিত বিভীষিকাময় জগতের দিকে আমরা এগোব। না, আমরা তাকাবো এমন এক পৃথিবীর দিকে যেখানে বিজ্ঞান ও কারীগরি জ্ঞানের বিষ্ময়কর অগ্রগতির যুগে মানুষের সৃষ্টি ক্ষমতা ও বিরাট সাফল্য আমাদের জন্য এক সঙ্কামুক্ত উন্নত বিশ্ব গঠনে সক্ষম। এই ভবিষ্যত হবে পারমানবিক যুদ্ধ আশঙ্কা থেকে মুক্ত। বিশ্বের সকল সম্পদ ও কারীগরি জ্ঞ্যানের সুষ্ঠু বন্টন দ্বারা এমন কল্যাণে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যাবে যেখানে প্রত্যেক মানুষ সুখি ও সম্মানজনক জীবনে নূন্যতম নিশ্চয়তা লাভ করবে। সম্প্রতি গোটা বিশ্বে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায় সংঘত ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে আমাদের আরো ত্বড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এ বছরের গোড়ার দিকে অনুষ্ঠিত এই পরিষদের বিশেষ অধিবেষণে বিশ্বের বর্তমান গুরুতর অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। আমি এমন একটি দেশের পক্ষ থেকে কথা বলছি যে দেশটি বর্তমানে অর্থনৈতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে। এই ক্ষতি কতোটা গুরুতর আমি সে সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। যুদ্ধে ধ্বংসস্তুপের ওপরেই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিলো। তারপর থেকে একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আমরা সম্মুখিন হয়েছি। সর্বশেষ এবারের নজীরবিহীন বন্যা। সাম্প্রতিক বন্যার বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার উদ্দেশ্য বাংলাদেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যপারে সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আমরা জাতিসঙ্ঘ সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ ও সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে কৃতজ্ঞ। আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদিন (Houari Boumédiène) পররাষ্ট্র মন্ত্রী বুতে ফ্লিকা (Abdelaziz Bouteflika) বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য জোট নিরেপক্ষ দেশসমূহের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। বন্ধু দেশসমূহ মানব কল্যান সংস্থাগুলোর কাছ থেকেও এ ব্যপারে ভালোই সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি শুধু প্রতিহত করেনি দেশে প্রায় দুর্ভিক্ষ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একই সময় বিশ্বব্যাপি মুদ্রাস্ফিতির অর্থ আমাদের মতো একটি দেশের জন্য দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে কোটি কোটি ডলারের টাকার ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। জনসাধারণের জীবন ধারনের মান নিছক বেঁচে থাকার পর্যায় থেকেও নিচে নেমে গেছে। মাথাপিছু যাদের বার্ষিক আয় একশ ডলারেরও কম তাদের অবস্থা আরোও শোচনীয়। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার হিসাব অনুযায়ী বেঁচে থাকার জন্য যে নূন্যতম খাদ্য প্রয়োজন তারও কম খাদ্য খেয়ে যারা এতদিন বেঁচে রয়েছে তারা এখন অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। আরো দরিদ্র অভাবী দেশগুলোর ভবিষ্যত সম্পর্কে যে আভাস দেওয়া হয়েছে তা অত্যন্ত হতাশাজনক। ক্রমাগত মূল্য বৃদ্ধির ফলে খাদ্যের দাম গরীব দেশগুলোর ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। অন্যদিকে ধনী ও উন্নত দেশগুলোই হচ্ছে খাদ্য ও খাদ্যের মূল রপ্তানিকারক। কৃষি যন্ত্রপাতি ও উপকরণের অসম্ভব দাম বাড়ার ফলে গরীব দেশগুলোর খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভের চেষ্টাও তেমন সফল হতে পারছে না। বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফিতির ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয় বহু গুণে বেড়ে গেছে। তাদের নিজেদের সম্পদ কাজে লাগানোর শক্তিও হ্রাস পেয়েছে। ইতিমধ্যেই যে সব দেশ দরিদ্র ব্যাপক বেকার সমস্যায় ভুগছে তা তাদের অতি নগন্য উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোকেও কেটে ছেটে কলেবর ছোট করতে বাধ্য হয়েছে। এ পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলে মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ হারে বর্ধিত আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা ছিলো। বিশ্বের সকল জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে অগ্রসর না হলে মানুষের দুঃখ দুর্দশা এমন আকার ধারণ করবে ইতিহাসে যার তুলনা পাওয়া যাবেনা। অবশ্য বর্তমানে অসংখ্য মানুষের পুঞ্জিভূত দুঃখ-দুর্দশার পাশাপাশি মুষ্টিমেয় মানুষ যে অভূতপূর্ব বৈষয়িক সমৃদ্ধি ও সুখ সুবিধা ভোগ করছে তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। এই অবস্থার পরিবর্তন করাতে পারে আমাদের মধ্যে মানবিক ঐক্যবোধ ও ভার্তৃত্ববোধের পুনর্জাগরণ। পারস্পরিক নির্ভশীলতা স্বীকৃতি বর্তমান সমস্যার যুক্তিসঙ্গত সমাধান ঘঠাতে সক্ষম। বর্তমান দূর্যোগ এড়াতে হলে অবিলম্বে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দরকার। বর্তমানের মতো এতো বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা জাতিসঙ্ঘ অতীতে কখনো করেনি। এই চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একটা ন্যায়সংগত আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যুক্তির শক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা। এই অর্থনীতিক ব্যবস্থা থাকবে নিজের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর প্রতিটি দেশের স্বার্বভৌম অধিকারের নিশ্চয়তা। এই ব্যবস্থা গড়ে তুলবে আন্তর্জাতিক সহযোগীতা বাস্তব কাঠামো যার ভিত্তি হবে স্থিতিশীল ও ন্যায়সংগত অর্থনীতির ব্যবস্থায় বিশ্বের সকল দেশের সাধারণ স্বার্থের স্বীকৃতি। এমন একটি – এখন এমন একটি সময় যখন আমাদের দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করতে হবে যে আমাদের একটা আন্তর্জাতিক দায়িত্ব রয়েছে। এই দায়িত্ব হলো বিশ্বের প্রতিটি মানুষ যাতে তার ব্যক্তি ও মর্যাদার উপযোগী অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার ভোগ করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। মানবধিকার সংক্রান্ত স্বার্বজনীন ঘোষণায় এই অধিকারের গেরান্টি দেওয়া হয়েছে। মানবধিকার সংক্রান্ত সনদের ঘোষণা অনুযায়ী আমাদের আন্তর্জাতিক দায়িত্ব এমনভাবে পালন করতে হবে যাতে প্রতিটি মানুষ তার নিজের এবং পরিবারের সুখ সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় জীবন ধারনের মান প্রতিষ্ঠার অধিকার অর্জনের নিশ্চয়তা লাভ করে। আন্তর্জাতিক সহযোগীতা সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশই যে শুধু বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট দূর করা সম্ভব সে সম্পর্কে আমার – আমরা সম্পূর্ণ সচেতন। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন বর্তমান অস্ত্র প্রতিযোগীতা নিয়ন্ত্রন করার জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। অস্ত্র প্রতিযেগীতা হ্রাস করা সম্ভব হলে অর্থনৈতিক সংকট দূর করার উপযোগী পরিবেশই শুধু গড়ে ওঠবে না। এ প্রতিযোগীতায় যে সব বিপুল সম্পদ অপচয় হচ্ছে তা মানবজাতির সাধারণ কল্যাণে নিয়োগ করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ তার শুরু থেকেই জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করেছে। এ নীতির মূল কথা শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান এবং সকলের সঙ্গে মৈত্রী। শান্তির প্রতি আমাদের যে পূর্ণ আনুগত্য তা এ উপলব্ধি থেকেই জন্মেছে যে একমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই আমরা আমাদের কষ্টার্জিত জাতিয় স্বাধীনতার ফল আস্বাদ করতে পারব এবং ক্ষুধা, দারিদ্র, রোগশোক অশিক্ষা অপঘাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আমাদের সকল সম্পদ ও শক্তি নিয়োগ করতে সক্ষম হব। সুতরাং আমরা স্বাগত জানাই সেই সকল প্রচেষ্টাকে যার লক্ষ্য বিশ্বে অত্যাচার হ্রাস করা। অস্ত্র প্রতিযোগীতা সীমিত করা। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও ল্যাটিন অ্যামেরিকা তথা পৃথিবীর প্রত্যেকটি অংশে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান নীতি জোরদার করা। এই নীতি অনুযায়ী ভারত মহাসাগরকে শান্তি এলাকা করার প্রস্তাবকে আমরা অবিরাম সমর্থন জানিয়ে এসেছি। এই পরিষদেও শক্তিশালী অনুমোদন লাভ করছে। আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে শান্তি, স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা এলাকা ঘোষণা করার প্রস্তাব আমাদের অকুন্ঠ সমর্থণ জানিয়েছি। আমাদের বিশ্বাস জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বিশ্বের যে উদীয়মান জাতিসমূহ একত্রিত হয়েছিলো তারা শান্তির পক্ষে শক্তিশালী সমর্থন জুগিয়েছে। তারা বিশ্বের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অভিন্ন প্রতিজ্ঞার কথাই আবার ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণা জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষা এবং শান্তি ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। মানব জাতীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার। এই শান্তির মধ্যে সারা বিশ্বের সকল নরনারীর গভীর আশা-আকাঙ্খা মুর্ত হয়ে রয়েছে। ন্যায় নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত না হলে শান্তি কখনো স্থায়ী হতে পারে না। আমরা শান্তিকামী বলেই আমরা উপমহাদেশের আমরা আপোষ মিমাংশা নীতির অনুসারী। এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার সহায়ক হয়েছে। এবং অতীতের সংঘাত ও বিরোধের বদলে আমাদের তিনটি দেশেরই জনগনের জন্য কল্যানকর ও বন্ধুত্ব সহযোগীতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। আমরা আমাদের মহান নিকটপ্রতিবেশি ভারত এবং বার্মার সঙ্গে যেমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছি তেমনি অতীতের থেকে মুখ ফিরিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে নুতন সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টায়ও লিপ্ত রয়েছি। অতীতের তিক্ততা দূর করার জন্য আমরা কোন প্রচেষ্টা থেকে নিবৃত হই নাই। ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকেও ক্ষমা প্রদর্শন করে এই উপমহাদেশের শান্তি ও সহযোগীতার নতুন ইতিহাস রচনার কাজে আমরা আমাদের আন্তরিকতার প্রমাণ দিয়েছি। এবং ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত থাকার অসংখ্য স্বাক্ষ্যপ্রমাণ ছিলো। তবুও সকল অপরাধ ভুলে গিয়ে আমরা ক্ষমা ও উদারতার এমন মূলধন নিয়োগ করতে চেয়েছি যা ভবিষ্যতে এই উপমহাদেশে শান্তি সমৃদ্ধি ও সহযোগীতার এক নুতন অধ্যায়ের সূচনা করবে। উপমহাদেশের শান্তি নিশ্চিত করার কাজে আমরা কোন পূর্বশর্ত দেই নাই কিংবা দর কষাকষি করিনি। বরং আমরা জনগণের জন্য এক সুখময় ভবিষ্যত গড়ে তোলার প্রেরণা দ্বারা উদ্বুদ্ধ প্রভাবান্বিত হয়েছি। অন্যান্য অমীমাংশিত বৃহৎ নিষ্পত্তির কাজেও আমরা ন্যায় বিচার ও পারস্পরিক সমঝোতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছি। ৬৩ হাজার পাকিস্তানি পরিবারের দূর্গতি এখন একটি জরুরি মানবিক সমস্যা হয়ে রয়েছে। পাকিস্তানের প্রতি তাদের আনুগত্যের কথা তারা আবার প্রকাশ করেছে এবং স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য তাদের নাম রেডক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটির কাছে তালিকাভূক্ত করেছে। আন্তার্জাতিক বোঝা পড়া এবং আইন অনুসারে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করার অধিকার তাদের রয়েছে। একই সঙ্গে মানবতার তাগিদেও তাদের সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন। সাবেক পাকিস্তানের সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বাটোয়ারা আরেকটি সমস্যা – যার আশু সমাধান দরকার। বাংলাদেশ আপোষ মীমাংশার জন্য প্রস্তুত। আমাদের প্রত্যাশা এই উপমহাদেশের জনগণের বৃহত্তম স্বার্থে পাকিস্তান আমাদের আহ্বানে সাড়া দেবে। এবং ন্যায়বিচার ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে অমীমাংশিত সমস্যাগুলির সমাধানে এগিয়ে আসবে। তাহলে উপমহাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা সফল হওয়ার পথে আর কোন বাঁধা থাকবে না। বাংলাদেশ তার সকল প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশি সুলভ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। যে সম্পর্কের ভিত্তি হবে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান, পরস্পরের স্বার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখন্ডতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং একে অন্যের আভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা। বিশ্বের এই এলাকায় এবং সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠা অক্ষুন্ন রাখার প্রতি প্রচেষ্টায় আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে। এই দুঃখ দুর্দশা সংঘাতপূর্ণ বিশ্বে জাতিসঙ্ঘ মানবের ভবিষ্যত … বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সর্বনাশা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের সাহায্যের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী আহরণের কাজে জাতিসঙ্ঘ যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এর জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে যেসব দেশ বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতির মোকাবিলায় বিশ্বসমাজের দ্রুত এগিয়ে আসার উপযোগী একটি নিয়মিত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গঠনে বাংলাদেশের বিশেষ স্বার্থ নিহিত রয়েছে। অবশ্য সূচনা হিসেবে এই ধরণের একটি ব্যবস্থা ইতোমধ্যে রয়েছে। এই ব্যবস্থা হল জাতিসঙ্ঘের বিপর্যয় ও ত্রাণ সমন্বয়কারী অফিস স্থাপন। এই সংস্থাটি যাতে কার্যকরভাবে তার ভূমিকা পালন করতে পারে সেজন্য সংস্থাটি শক্তিশালী করে তোলা একান্ত দরকার। জাতিসঙ্ঘের সদস্য দেশগুলোর এই ব্যাপারে বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। প্রিয় প্রেসিডেন্ট, সর্বশেষে আমি মানবের অসাধ্য সাধন মানুষের অজেয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতা এবং অজেয়কে জয় করার শক্তির প্রতি আকুন্ঠ বিশ্বাস রেখে আমি আমার বক্তৃতা শেষ করতে চাই। আমাদের মতো যেসব দেশ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে, এই বিশ্বাস তাদের দৃঢ়। আমরা দুঃখ ভোগ করতে পারি, কিন্তু মরব না। টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি। আমাদের লক্ষ্য স্বনির্ভরতা। আমাদের পথ হচ্ছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সম্পদ ও প্রযুক্তিবিদ্যার মাধ্যমে মানুষের দুঃখ দুর্দশা হ্রাস পাবে এবং আমাদের কর্মকাণ্ডকেও সহজতর করবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। নতুন বিশ্বের অভ্যুদয় ঘটছে। আমাদের নিজেদের শক্তির ওপর আমাদের বিশ্বাস রাখতে হব্যে। আর লক্ষ্যপূরণ এবং সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আমাদের নিজেদের গড়ে তুলবার জন্য জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই আমরা এগিয়ে যাব।
Reference:
বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র, সংগ্রামের নোটবুক
পিপলস ভয়েস, প্রকাশনা – শেকড় সন্ধান
(আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় ভাষণটি এখানে শেষ হয়েছে। তবে শেষ সমাপ্তি বাক্য মিসিং। সংগৃহীত একাধিক ভিডিও, পত্রিকা ও প্রকাশনায় যা পাওয়া যায়নি। তবে উদ্ধার সাপেক্ষে শেষ শব্দগুলি যুক্ত করা হব্যে। শেষ নয়টি বাক্য প্রকাশনা থেকে এবং বাকি অংশ একাধিক ভিডিও থেকে লিপিবদ্ধ করা হল।)