You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুজিব-তাজ দ্বন্দ্বের দুটি ঘটনা

শেখ সাহেবের সাথে শেষের দিকে তাজউদ্দীন সাহেবের যে সম্পর্কে চিড় ধরল সেটা সত্যিই খুব দুর্ভাগ্যজনক। এই দুজনের মাঝে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার পেছনে আমি সেই সমস্ত লােকদের দায়ী করব যারা সব সময় এই দুই পক্ষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে। এই সমস্ত লােকেরা সব সময় শেখ সাহেবকে বলত এক কথা আর অন্য দিকে বলত অন্য কথা। আর একই মানুষ সম্পর্কে বারবার একই কথা বলতে থাকলে হয়ত সেসব কথা বিশ্বাসও করতে শুরু করে দেয় মানুষ। তাজউদ্দীন সাহেব পদত্যাগ করবার পর আমি ওয়াশিংটন থেকে ঢাকায় এলাম। শেখ সাহেবের সাথে আগে থেকেই আমার সুন্দর সম্পর্ক ছিল। সে কারণেই আমি সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে তাঁর ৩২ নম্বরের বাড়িতে গেলাম। সেখান থেকেই সােজা তাজউদ্দীন সাহেবের বাড়িতে এলাম। তাজউদ্দীন সাহেবের বাড়িতে রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক লােকজন ছিল। এর মধ্যে তিনি আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন এবং ভেতরে নিয়ে বসালেন। অনেক কথা হল। সব শেষে আমি বললাম, ‘স্যার, আমি তাে জানি প্রধানমন্ত্রী আপনার নেতা এবং আপনি তাকে কত সম্মান করেন। আপনি তাকে সবসময় সমর্থন দিয়েছেন, কোন সময়ই আপনি তার মতের বিরুদ্ধে যাননি। এখন আপনাদের দু’জনের মধ্যে এই যে দূরত্ব, তা কি কোনক্রমে দূর করা যায় না ? কোনভাবে জোড়া দেয়া কি একদমই সম্ভব না ? তাজউদ্দীন সাহেব পরিষ্কার বললেন, ‘না।’

আমি আর কিছু বললাম না, চলে এলাম। বুঝলাম মতপার্থক্যটা এত বেশি যে ওখানে আর তিনি সমঝােতা করতে রাজি নন। এই মতপার্থক্যটা বােধ হয় বাকশাল থেকেই হয়েছে। আমি তাে বিদেশে চলে গেলাম ‘৭৩-এর অক্টোবর মাসে। এর আগে অবশ্য দু’একটি বিষয়ে বুঝতে পারতাম কিছু কিছ। যেমন দু’একটি অর্ডার তিনি পছন্দ করেননি। তিনি বলছেন মুখে, কিন্তু আমি আন্দাজ করতে পেরেছি তিনি প্রধানমন্ত্রীর অর্ডারটি পছন্দ করছেন না। একটি উদাহরণ দিচ্ছি, স্বাধীনতার পরপরই তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, যারা মুজিবনগরে ছিলেন আমরা তাদেরকে একটা কিংবা দুটো ইনক্রিমেন্ট দেব। আমি সেইভাবে লিখে ফাইল তৈরি করলাম। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এটা প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, না, আমার টাকাপয়সা নেই, আমি দেব না। অর্থমন্ত্রী বলছেন, অর্থ সচিব বলছেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলছেন, না, আমি দেব না। আশ্চর্যের বিষয়, এক বছর পর অর্থমন্ত্রীকে, অর্থ মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ সেই একই অর্ডারটি ইস্যু করলেন। এটা তাজউদ্দীন সাহেব পছন্দ করলেন না। তাঁর মনের ভাবটা এমন ছিল যে, এই অর্ডারটি কার্যকর করতে এক বছর আগে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলাম, তখন সবকিছু আমাদের অনুকূলে ছিল এবং আমরা পরিস্থিতি সামলাতে পারতাম। আর এই এক বছরে সব কিছু তাে অন্য রকম হয়ে গেছে। এখন কে মুজিবনগর, কে কোথায়, সব এলােমেলাে। অথচ তিনি এক বছর পর অর্ডারটি দিলেন, আমাদেরকে জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করলেন না। যাই হােক, আদেশটি কার্যকর করা হল। তখন দেখলাম তাজউদ্দীন সাহেব মনঃক্ষুন্ন হয়েছেন। কষ্ট পেয়েছেন যে প্রধানমন্ত্রী তাকে জিজ্ঞাসা না করে অর্ডারটি দিয়ে দিলেন। আর একটি অর্ডার প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন—যারা পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে গিয়েছিল তাদের যে পােষ্য বাংলাদেশে ছিল তাদেরকে টাকা দিতে হবে। এই বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে পরামর্শ করেননি। পরে আমি অর্থ সচিব হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আপত্তি করেছিলাম যে এটা বােধ হয় ঠিক হয়নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমি আদেশ দিয়েছি, তােমরা কার্যকর কর। এটাও এইভাবে অর্থমন্ত্রীকে না জানিয়ে করাটি তাজউদ্দীন সাহেব পছন্দ করেননি। তাজউদ্দীন সাহেব অবশ্য চাইতেন না বাইরে এসব জিনিস প্রকাশ পাক। তাই মুখে কিছু বলতেন না, কিন্তু আমি পরিষ্কার বুঝতে পারতাম তিনি এইভাবে কাজ করাটা পছন্দ করছেন না। আজ বলছি, আমার কারণে যেন প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর মধ্যে কোন ভুল বােঝাবুঝি না হয় আমি সব সময় সেই চেষ্টাই করেছি। এবং শেষ পর্যন্ত আমি আমার এই চেষ্টা বজায় রাখতে পেরেছিলাম।

(১০..১৯৯৯)

মতিউল ইসলাম : সরকারি কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অর্থ সচিব।

Reference: তাজউদ্দীন আহমদ – আলোকের অনন্তধারা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!