You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্বাধীনতার পথে বঙ্গদেশ?

বঙ্গদেশের শাসনভার হতে নিয়েছেন মুজিবর। প্রত্যেকটি বাঙালী এই বিকল্প সরকারের সৈনিক। রক্তমূল্যে রক্ষা করবেন তাঁরা নবলব্ধ স্বাধীকার। মরণ কামড় দিতে উদ্যত হয়েছেন ইয়াহিয়া খান। সামরিক শাসকদের হুকুম—সােমবার প্রতিরক্ষা দপ্তরে হাজিরা দিতে হবে কর্মীদের। অন্যথায় বরখাস্ত এবং শাস্তি। অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভাঙ্গতে চায় পাঞ্জাবী-চক্র। এই চ্যালেঞ্জের যােগ্য উত্তর দিয়েছেন। মুজিবর। বঙ্গদেশের জনতা তার পিছনে। বাঙালীর চোখে ইয়াহিয়া খান বিশ্বাসঘাতক এবং নরহস্তা। তার ভ্রুকুটি গ্রাহ্য করেন না বিপ্লবী বাঙালী। দীর্ঘ অপেক্ষার পর তিনি গেছেন ঢাকায়। হয়ত রাস্তা চিনতে অসুবিধা হবে। উর্দু নির্বাসিত। বাংলায় ভরে গেছে রাস্তাঘাট। সাইনবোের্ডগুলােও বাংলায় লেখা। ঢাকা বেতারে বাজছে দেশাত্মবােধক গান। রাতারাতি চেহারা পাল্টিয়েছে পূর্ব পাকিস্তান। তার সারা অঙ্গে বাঙালী ছাপ। মনে বাঙালীর নিজস্ব সাধনা। পূর্ব পাকিস্তান কথাগুলাে মুছে গেছে তার কবর থেকে জন্ম নিয়েছে। বঙ্গদেশ! এই বঙ্গদেশের রাজধানী ঢাকায় গিয়েছেন ইয়াহিয়া খান। বঙ্গদেশের অতিথি তিনি। তার কোন অমর্যাদা করবেন না বাঙালী। অভয় দিয়েছেন মুজিবর। বঙ্গদেশের দাবী স্বাধীকার এবং ঔপনিবেশিক পাঞ্জাবী শাসনের অবসান। বহু টালবাহানা করেছেন ইয়াহিয়া খান। বাঙালী নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন বঙ্গদেশের শাসন ক্ষমতা। দর কষাকষির আর কোন সুযােগ নেই। মুজিবরের দাবী মানতে হবে ইয়াহিয়া খানকে। নইলে ইসলামাবাদের সঙ্গে শেষ বন্ধনটুকু একেবারে ছিড়ে যাবে।
দুর্বিনীত ভুট্টো করাচীতে বসে এখনও দাবার গুটি চালছেন। পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যে তিনি ক্ষমতা ভাগ করে নিতে চান। পশ্চিম পাকিস্তান কি একটি ইউনিট? সেখানে কি চারটি অঙ্গরাজ্য তৈরী হয় নি? বেলুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ভুট্টোর পিপলস পার্টি সংখ্যাধিক্য পায় নি। তাদের হয়ে ফোপড় দালালীর অধিকার তাঁকে কে দিল? গায়ে পড়ে মােড়ল সাজার উৎকট বাসনা লজ্জাহীনদের পক্ষেই সম্ভব। ভুট্টোও যাবেন আবার ঢাকায়। দেখা করবেন মুজিবরের সঙ্গে। দেখা করে লাভ কি? বাঙালী তার পথ বেছে নিয়েছেন। ভুট্টোর মতামত তাদের কাছে অর্থহীন। পাকিস্তানের এই রাজনৈতিক শকুনি বিশ্বাসের অযােগ্য। গণতন্ত্রের শবযাত্রায় তার উৎকট উল্লাস। মিথ্যা ভাষণ এবং পরস্পরবিরােধী উক্তিতে তিনি অনন্যসাধারণ। পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব রক্ষায় ভুট্টোর চেচামেচি আকাশচুম্বী। আবার পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগিতে তার উৎসাহ অদম্য। ক্ষমতা ভাগাভাগির বেলায় তার চোখে ভেসে ওঠে দুটি পাকিস্তান। আর পাঞ্জাবী শাসন কায়েম রাখার প্রশ্নে ভুট্টো দেখেন অখণ্ড পাকিস্তান। এই সিদ্ধি শয়তানের সঙ্গে গটিছড়া বেধেছেন ইয়াহিয়া খান। তাদের কুচক্রের বলি শত শত বাঙালী। যাদের হাত রক্ত কলঙ্কিত তারা কি করে বুঝবেন পূবের মর্মবেদনা? গত তেইশ বছরের শােষণের জ্বালা ভুলতে পারে না বঙ্গদেশ। একটি একটি করে সে ছিড়ে ফেলেছে নাগপাশ। বাঙালী আজ সিদ্ধি-পাঞ্জাবীর আয়ত্বের বাইরে। ছিনিয়ে নিয়েছেন তারা স্বায়ত্ব শাসন। ইয়াহিয়া খান যদি দেয়ালের লিখন পড়তে না পারেন তবে পূর্ণ স্বাধীনতার পথে জোর কদমে এগিয়ে যাবে বঙ্গদেশ। এই অগ্রগতি প্রতিরােধের ক্ষমতা পাঞ্জাবী সৈন্যদের নেই। তাদের বুলেট সাড়ে সাত কোটি বাঙালীল দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভাঙ্গতে পারবে না।
মুজিবর-ইয়াহিয়া সাক্ষাৎকার ইতিহাসের নবযুদের ইঙ্গিতবাহী। আপােষে রাজী মুজিবর। কিন্তু তার নিজের শর্তে। সম্ভাব্য আলােচনা যদি ব্যর্থ হয় তবে শাণিত হয়ে উঠবে পাঞ্জাবী ঘাতকের অস্ত্র। দখলদারী বাহিনীর সঙ্গে চলবে নিরস্ত্র বাঙালীর সম্মুখ সমর। বাঙালী পুলিশ এবং বাঙালী নিরাপত্তা বাহিনীর দেহে বইছে উঞ্চ শােণিত ধারা। ঘরে ঘরে তৈরী হচ্ছে প্রতিরােধ দুর্গ। সরকারি এবং বেসরকারি কর্মীরা বয়কট করেছেন ইসলামাবাদের শাসকদের। তারা নির্দেশ নিচ্ছেন মুজিবরের বিকল্প সরকারের কাছ থেকে। বঙ্গদেশের বিদ্রোহী পটভূমী প্রস্তুত। ইয়াহিয়া খান কি চান? শান্তি, না সংগ্রাম? অনেক দেরী হয়ে গেছে। দু সপ্তাহ আগে যে সব শর্তে আপােষ চলত এখন তাতে চলবে না। রাজনৈতিক স্রোত দুর্বার। সংগ্রামের পথ নিলে প্রচণ্ড জোয়ার আসবে। ইয়াহিয়া খান তাতে ভেসে যাবেন। রক্তের ফেনিল উচ্ছ্বাসে শিউরে উঠবে পাঞ্জাবী ঘাতকের দল। মুজিবর দুর্জয় । তার আহ্বান সাড়ে সাত কোটি বাঙালী প্রাণের দুরন্ত প্রেরণা। বঙ্গদেশে ইয়াহিয়া খানের কবর তৈরী। এ কবর খোঁড়ে নি বাঙালী। খুঁড়েছে পাঞ্জাবী নরহত্যার দল। তাদের আত্মরক্ষার পরিখাই ইসলামাবাদের গােরস্থান। মুজিবরের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় মনে রাখবেন ইয়াহিয়া খান—স্বাধীনতার পথে বঙ্গদেশ। তাকে থামাতে হলে দরকার বাস্তব বুদ্ধি। তাসের ঘর চুরমার হয়ে গেছে। সামরিক দাপট অচল। অচলকে সচল করার উদ্যমের একমাত্র উত্তর জয় বাংলা।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৬ মার্চ ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!