You dont have javascript enabled! Please enable it!

আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট গণতন্ত্রের গতিরােধ

১. ১৯৭৬ সনের নভেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক দলবিধির শর্তমালা পূরণ করে ৫৬ টি দল অনুমােদনের জন্য আবেদন করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি, ডেমােক্রেটিক লীগ, জাতীয় লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সহ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঘােষিত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী জানাতে থাকে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম এই লক্ষ্যে ১৯৭৫ সনের ৮ই নভেম্বর জারীকৃত এবং জাতির নিকট ওয়াদা বদ্ধ ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকেন। বিচারপতি সায়েম নিজেই বলেছেন যে, তার সরকার অন্তবর্তীকালীন সরকার। তঁাকে সাহায্য করার জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়েছিলাে এবং তাদের দায়িত্ব ছিলাে সরকারের দৈনন্দিন কাজসমূহ এগিয়ে নেয়া মাত্র। তারা মন্ত্রীদের মর্যাদা এবং পতাকা বহন করতে পারতেন না।

২. নির্বাচন বানচাল করার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমানের সূক্ষ্ম, গােপনীয় ও লক্ষ্যাভিসারী পদক্ষেপগুলাে গণতন্ত্র উত্তরণের পক্ষে বাধা সৃষ্টি করে। জিয়াউর রহমান নির্বাচন অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিষয়ে প্রকাশ্যে ও বাহ্যতঃ যত অঙ্গীকারই করুন না কেন ৭ই নভেম্বর ৭৫ সনের ঘােষিত সামরিক প্রধানের পদটি পুনরায় দখল এবং সুযােগমত প্রেসিডেন্ট পদটিও করায়াত্ত বিষয়ে শিকারী বাঘের মতই এগিয়ে আসছিলেন। ঘােষিত ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচন সংক্রান্ত অঙ্গীকার বানচাল করার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান সর্পিণ সন্তর্পনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। অর্থ, স্বরাষ্ট্র ও তথ্য, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা দপ্তরের দায়িত্ব প্রাপ্ত জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সায়েম মােঃ সায়েমের ক্ষমতাকে সুপারসিড় করে রাষ্ট্রপরিচালনায় মুখ্য ব্যক্তি হিসেবে জাতির সামনে নিজেকে উপস্থাপিত করেন। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও দিবসে প্রেসিডেন্টের ভাষণের পাশাপাশি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান পৃথকভাবে রেডিও টিভিতে ভাষণ দান শুরু করেন। এমনকি, নীতি নির্ধারণী বিষয় যা রাষ্ট্রপতির ভাষণে প্রতিফলিত হওয়ার কথা। সে সম্পর্কেও প্রেসিডেন্টের আওতাকে অগ্রাহ্য করে বলতে গেলে চ্যালেঞ্জ করে, ভাষণ বিবৃতি প্রচার করতে থাকেন। যদিও শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে দেশে প্রেসিডেন্টশিয়াল পদ্ধতি বহাল ছিলাে।

৩. অত্যন্ত সূক্ষভাবে সামরিক এক ফরমান বলে সামরিক প্রধান ও প্রেসিডেন্ট আবু মােহাম্মদ সায়েমের বিদেশ ভ্রমণকালে কে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন তাও ঘােষণা করা হয়। এবং জিয়াউর রহমান সে স্থলে স্থলাভিষিক্ত হবার পথ সুগম করেন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ও ক্ষমতার সীমাহীন স্বাদ গ্রহণ করতে সমর্থ হন। এরপর হতেই জিয়াউর রহমান প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যে কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হতে ওঠেন। ক্ষমতা দখলের জন্য স্বাধীনতা বিরােধী চক্র ও চৈনিকপন্থী উগ্র দলগুলােকে রাজনৈতিক দাবার ঘুটি হিসেবে রাজনৈতিক আসরে নামিয়ে দেন। ৪. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জাতীয় দল বাংলাদেশ শ্রমিক।

আওয়ামী লীগ ঘােষণা করলে মওলানা ভাসানী শশাষণ মুক্ত দেশ গঠনে শেখ। মুজিবের পদক্ষেপকে স্বাগত এবং বঙ্গবন্ধুকে দোয়া করেন। ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক ও নির্বাচিত সরকার প্রধান রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর খন্দকার মােশতাক ক্ষমতা দখল করলে মওলানা ভাসানী মােশতাককে অভিনন্দন জানান। মােশতাককে হটিয়ে প্রকাশ্যে বিচারপতি সায়েম নেপথ্যে কূটবুদ্ধি সম্পন্ন জিয়াউর রহমান ক্ষমতা প্রয়ােগের প্রধান ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ালে মওলানা ভাসানী জিয়াউর রহমানের দিকে ঝুঁকে পরেন। জিয়াউর রহমানের পৃষ্টপােষকতায় মওলানা ভাসানী দেশের মধ্যে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভারত বিদ্বেষকে উসকে দেবার কৌশল গ্রহণ করেন। এবং এই লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী ১৬ই মে ‘৭৬ ফারাক্কা মিছিলের আয়ােজন করেন। দেশে তখন সামরিক আইন ও শাসন বলবৎ। সর্বপ্রকার মিটিং মিছিল নিষিদ্ধ। তার মধ্যে মওলানা ভাসানী সামরিক ফরমান ভঙ্গ করে মিটিং মিছিল কিভাবে করতে পেরেছেন? সামরিক শাসক জিয়া চক্রের সহযােগিতা ব্যতীত এটি কি আদৌও সম্ভবপর ছিলাে? ফারাকা সমস্যা আমাদের জাতীয় সমস্যা সন্দেহ নেই, নির্বাচিত সরকারই কেবলমাত্র এই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুটি দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাধান করতে সক্ষম। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে এই জটিল সমস্যা সমাধান যে সম্ভবপর নয় একথা মওলানা ভাসানীর মতাে রাজনীতিবিদদের অজানা নয়। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী হলে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর একমাত্র শ্লোগান ছিলাে- ‘সবার আগে গণতন্ত্র চাই।” সামরিক শাসনের অবসান চাই। মওলানা ভাসানী দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সামরিক শাসনের বলয় থেকে দেশকে উদ্ধারের পরিবর্তে জাতীয় জীবনের বহুবিধ সমস্যার মধ্যে কেবলমাত্র। ফারাক্কা ইস্যুকে প্রধান ও একমাত্র ইস্যু করার ক্ষেত্র নির্ণয়ে রাজনৈতিক বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণােদনাই ছিলাে মুখ্য। ফারাক্কা ইস্যু ও মিছিলের মূল লক্ষ্য ছিলাে রাজনৈতিক। সে রাজনীতি স্বাধীনতা বিরােধী শক্তিকে প্রকাশ্য আসতে ও ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করেছে। ভারত বিরােধীতার আবরণে আওয়ামী লীগ বিরােধী রাজনীতিকে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের মনে এথিত করার সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ হিসেবে জিয়াউর রহমানের।

ছকেই মওলানা ভাসানী পা দিয়েছিলেন- যেমন অতীতেও ‘ডােন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব বলে বাংলার জনগণের দাবীকে পাশ কাটিয়ে কাশ্মীর ইস্যুকেই বড় করে। ধরেছিলেন। ঘােষিত পার্লামেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে কার্যকর। ও অর্থবহ করার লক্ষ্যে তঁার উদ্যোগ ছিলাে অপরিহার্য, সেক্ষেত্রে মওলানা ভাসানী। জিযার পরিকল্পিত প্রিন্ট অনুসারেই কাজ করেছেন মাত্র। জাতির জনক ও জাতীয় চার নেতার অবর্তমানে মওলানা ভাসানী জাতীয় নেতার গুরু দায়িত্ব পালনে সক্ষম। হলেন না। এটা ছিলাে জাতীয় জীবনে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ১৯৭৭ সনের। ফেব্রুয়ারী মাসের অনুষ্ঠিতব্য পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্পর্কে মওলানা ভাসানীর মন্তব্য। ছিলাে “দেশে অনুকূল পরিবেশ থাকলে নির্বাচন হবে। এটা ছিলাে প্রকৃত পক্ষে। নির্বাচন বিরােধী চক্রের প্রতিধ্বনি মাত্র। জিয়াউর রহমানের নির্বাচন স্থগিত প্রক্রিয়ায় সাহায্যে মওলানা ভাসানী অন্য এক বিবৃতিতে বললেন “দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচনী পরিবেশের উপযােগী নয়। বরং জনগণ এই মুহূর্তে নির্বাচন চায় না। জনগণ নির্বাচন চায় কি চায় না সে ব্যাপারে গণভােট অনুষ্ঠান নেয়া হােক। তাছাড়া অতীতেও জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে কোন প্রকার লাভবান হয়নি। জিয়াউর রহমানের চীন সফরের ব্যবস্থা ঠিকঠাক হয়ে গেলে মওলানা ভাসানী আরাে এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, “তিনি এই মুহূর্তে জাতিকে বিভক্ত করতে চান না, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই জাতি বিভক্ত হয়ে যাবে। তাই আপাততঃ নির্বাচন। স্থগিত রেখে সামরিক শাসন বজায় রাখা হােক।”

৫. নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য প্রেসিডেন্ট সায়েম নির্বাচন কমিশনকে ভােটার লিস্ট তৈরি করার আদেশ প্রদান করেছিলেন। ভােটার লিস্ট তৈরীও হয়েছিলাে-যার ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছিলাে। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের গােপন রিপাের্টে জিয়ার নিকট পরিস্কার হয়ে গেলাে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরাই শতকরা ৬০%টি আসন দখল করেছে। ঐ নির্বাচনে বামডান চীনপন্থী ও মুসলিম লীগের গণভক্তির বিচ্ছিন্নতা প্রমাণ হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের নিকট ১৯৭৭ সনে ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করা ব্যতীত অন্য কোন বিকল্প রাস্তা খােলা ছিল না।৬ ৬. গণবিচ্ছিন্ন চৈনিকপন্থী দল, গােষ্ঠী ও ব্যক্তি মিলে জাতীয় প্রতিরােধ কমিটি গঠন করে এবং রুশ-ভারতের দালালদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে বিপ্লবী শ্লোগান তােলে। সামরিক শাসনের কড়া সেন্সরশীপের মধ্যেও আওয়ামী-বাকশালী ও “রুশ-ভারতের কথিত দালালদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ বৈপ্লবিক লড়াইয়ের ভাষা প্রচারিত হতে বাধা পায়নি। স্বাধীনতার বিরােধীতাকারী এসব চৈনিক’গ্রুপ আন্ডার গ্রাউন্ড রাজনৈতিক নেট ওয়ার্কের মাধ্যমে ৭৫ সনের ১৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে সশস্ত্র বিপ্লবের কর্মসূচী গ্রহণ করে।

সমগ্র দেশে খতমের রাজনীতি শুরু করে। ‘মুসলিম বাংলার’ শ্লোগান তােলে। মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিকট অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য প্রার্থনা করে।৭ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এসব চৈনিক পন্থী উল বিপ্লবীগণ প্রকাশ্য রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়। এবং ঘােষিত ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের নির্বাচনের বিরােধীতা করে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বৈঠক ও আঁতাত করে নির্বাচন বানচালের জন্য জাতীয় প্রতিরােধ কমিটি’ নামে তথাকথিত কমিটি গঠন করে। জাতীয় প্রতিরােধ কমিটির শরীক দলগুলাে সর্বদা নির্বাচন বিরােধীতা করে এসেছে। আসলে তারা নির্বাচনেই বিশ্বাস করেন না। নির্বাচন এলেই তারা ভােটের বাক্সে লাথি মেরে ভাত দাবি করেন। এটাই তাদের রাজনীতি। জাতীয় প্রতিরােধ কমিটি’ রুশ-ভারত ও আওয়ামী বাকশালীদের প্রতিরােধ করতে গিয়ে প্রকারান্তরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও গণতন্ত্রকেই প্রতিরােধ করেছে। চীনপন্থী ও পাকিস্তান পন্থী গ্রুপ সামরিক সরকারের নেপথ্য শক্তিধর ব্যক্তি জিয়াউর রহামনের হাতের ক্রীড়নক হয়ে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রমূলক খেলায় উঠেছিলাে। নির্বাচনকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সামরিক শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত জাতির জন্য, গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রয়ােজনে নির্বাচন যে ক্ষেত্রে ছিল অপরিহার্য, সেক্ষেত্রে জিয়ার ছকে পা দিয়ে মার্শাল ল প্রলম্বিত করার ঘৃণ্য তৎপরতায় তােয়াহা সাহেব, ছিলেন চক্রান্তে লিপ্ত।

৭. জনাব সায়েম বলেছেন, তার উপদেষ্টাগণ বিশেষ করে দেশে দ্রুত গণতান্ত্রিক পরিবেশ, দলগঠন নির্বাচন ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে জন্য রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী হিসেবে বিচারপতি আবদুস সাত্তার যাকে বিশ্বাস ও আস্থার সঙ্গে উপরােক্ত লক্ষ্য সাধনের জন্য নিয়ােগ দান করেছিলেন তিনিও ঐ চক্রান্তের অংশীদার হয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দেবার পক্ষে ছিলেন। রাষ্ট্রপতি বলছিলেন, দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে। অন্যদিকে উপদেষ্টাদের মধ্যে অনেকেই তখন বলে চলেছিলেন দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা নেই। অর্থাৎ রাজনীতি বন্ধ করার পর সামরিক শাসনের মধ্যেও কি করে রাজনৈতিক শূন্যতা থাকে না তা বােধগম্য হলেও এটা পরিষ্কার হয়ে আসছিলাে যে জিয়াউর রহমান সরকারী খরচে হেলিকপ্টার, যানবাহন, টিভি, রেডিও-ও প্রচার মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় জোরেশােরেই অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যদিও রাজনৈতিকভাবে নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছিল নির্বিচারে। ১৯৭৬ সনের ৮ই জানুয়ারি সামরিক ফরমান জারি করে বলা হয়েছিলাে, বক্তব্য, লেখনি, স্বাক্ষর বা প্রতীক দ্বারা যেভাবেই হােক না কেন সামরিক শাসন জারী, বলবৎ থাকা নিয়ে প্রধান সামরিক প্রশাসক বা ডেপুটি সামরিক প্রশাসক বা সামরিক কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কথা বললে দশ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে। [পরিশিষ্ট-৭] এই ফরমান জারির মূল লক্ষ্য ছিলাে, আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি যেন মাঠে নামতে না পারে।

৮. দেশ গণতন্ত্রের পথে স্বাভাকিভাবে অগ্রসর হােত জিয়াউর রহমানের নিকট ছিল তা অনাকাঙ্খিত। গণতন্ত্রের গতিরুদ্ধ করা হয়েছে বারবার। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ১৯৭৬ সনের ৩রা অক্টোবর জিয়াউর রহমান কড়া মার্শাল ল’-এর মধ্যে ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিনিধি মিঃ ওয়েন কোরকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। প্রচুর উপঢৌকন, খানাপিনা এবং হােটেল ইন্টারকনের আরামদায়ক কক্ষে অবস্থান করে তিনি ভােয়া থেকে প্রচারিত এক প্রতিবেদন উল্লেখ করেন যে, “বাংলাদেশের জনগণ এক্ষুণি নির্বাচন চায় না, নির্বাচনের প্রয়ােজন নেই। প্রতিবেদনে বলা হয় সামরিক শাসনে জনগণ ভালাে আছে, জনগণ হারাবার ঝুঁকি নিতে চায় না। ৯

৯. বিচারপতি সায়েম একাকী হয়ে পড়েন। তার উপদেষ্টাগণও বঙ্গভবনে আসার চাইতে আর্মি হেডকোয়ার্টারে দৌড়ানােতে স্বাচ্ছন্দ্যরােধ করেন। আওয়ামী লীগ ব্যতীত চীন-পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাের নেতৃবৃন্দ ক্যান্টনমেন্টের দিকে ছুটতে থাকেন। জিয়াউর রহমান দেখলেন নির্বাচন বন্ধ না করতে পারলে তার ক্ষমতার পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে পড়বে। কালবিলম্ব না করে জিয়াউর রহমান ২৯শে নভেম্বর ৭৬ সনে প্রধান সামরিক পদটি বিচারপতি সায়েমের নিকট কেড়ে নেন। অসহায় বিচারপতির করুণ নিঃশব্দ আত্মনা তার বইয়ের বিবরণীতে প্রকাশিত হয়েছে। ১০দেশে মার্শাল ল জারি থাকার প্রেক্ষিতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি কেড়ে নেওয়ার ফলে সায়েম ‘ফুটো জগন্নাথ হিসেবে কেবলমাত্র রাষ্ট্রপতির পদটিতে বহাল থাকলেন মাত্র।

১০, বিচারপতি সায়েম জিয়াউর রহমানের উচ্চাভিলাষ এবং দেশকে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার কারণে জেনারেল জিয়াকে। সরিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নতুন কোন সামরিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ােগ দানের কথা ভাবছিলেন। এয়ার ভাইস মার্শাল বাশারেরও এতে সম্মতি ছিলাে। বলাবাহুল্য, এয়ার ভাইস মার্শাল বাশার বিমানবন্দরে এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। মুক্তিযােদ্ধা মােহাম্মদ খাদেমুল বাশারের নিহত হওয়ার রহস্য। জিযার জীবদ্দশায় কেন, আজ পর্যন্ত জনসাধারণ জানতে পারেনি।

১১. ১৯৭৬ সনেই জিয়ার রহমান এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তােয়াবকে সরিয়ে দেয়। কেননা সেনাবাহনিীর আর্টিলারী ফিল্ড রেজিমেন্ট ও ট্যাংক রেজিমেন্টসহ পদাতিক বাহিনীর উল্লেখযােগ্য অংশ তােয়াবকে সমর্থন করে যাচ্ছিলাে এবং তােয়াব ক্রমান্বয়ে তার অবস্থান দৃঢ় করতে প্রয়াস পাচ্ছিলাে। জিয়া অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে নির্মম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তার পথের কাটা সরিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি।১১

১২. এই অবস্থার মধ্যেও প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্ম। সায়েম দেশে দ্রুত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার লক্ষ্যে ১৯৭৬ সনের ১১ই আগস্ট সামরিক ফরমান জারি করে হাইকোর্ট বিভাগে সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তিদের আইনে আশ্রয় লাভের অধিকারের গ্যারান্টি প্রদান করেন। সেই সুবাদে গ্রেফতারকৃত আওয়ামী লীগ নেতা বেগম সাজেদা চৌধুরী, সালাহউদ্দিন ইউসুফ, আবদুল মমিন তালুকদারসহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের মুক্তির লক্ষ্যে হাইকোর্টে রীট পিটিশন দায়ের করা সম্ভব হয়েছিলাে। যা ইতিপূর্বে সামরিক ফরমান বলে নিষিদ্ধ ছিলাে।

১৩, জিয়াউর রহমান জাতীয় প্রতিরােধ কমিটির নেতাদের দিয়ে নির্বাচন পিছানাের দাবি তুলে তাদের হাত থেকে নিজের হাতে বলটি তুলে নেন। ইতিপূর্বে নির্বাচন অনুষ্ঠান ঘােষণার মাধ্যমে যা ছিলাে জিয়াউর রহমানের হাতের নাগালের বাইরে। জিয়াউর রহমান তার দক্ষ গােয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ভালাে করেই জানতেন প্রতিরােধ কমিটি নেতারা নির্বাচনে বিশ্বাস করে না। সেজন্য নির্বাচন পেছানাের দাবি তাদের দ্বারা সহজেই গে নাে সম্ভব। ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের সাধারণ নির্বাচন স্থগিত ঘােষনার পর চৈনিকপন্থীদের ‘মগজ’ নামে খ্যাত জনাব এনায়েত উল্লাহ খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “জাতীয় প্রতিরােধ কমিটির আর প্রয়ােজন নাই।” “দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা চলছে।” অপর এক প্রশ্নের উত্তরে জনাব এনায়েত উল্লাহ খান বলেন, বর্তমান সরকারকে কোন অবস্থাতেই অন্তবর্তীকালীন সরকার বলে উল্লেখ করা যায় না। কেননা, তারা এই মুহূর্তে ক্ষমতা হস্তান্তর করছেন না। তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ ও সিপিবি দেশের প্রধান শক্র। কেননা তারা ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগষ্টের ঐতিহাসিক পরিবর্তনকে আজো মেনে নেয়নি। তিনি বলেন, সরকার জাতীয় কনভেনশন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন।১২

১৪. জনাব আতাউর খানের জাতীয় লীগের পক্ষ হতে জাতীয় লীগের জনাব আবুল কাশেম নির্বাচন স্থগিত করার দাবি জানিয়ে এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিটি সরকারী প্রচার মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়। ৭৭-এর ফেব্রুয়ারীতে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন হয়ে পড়বে’- এ মর্মে জাতীয় প্রতিরােধ কমিটিও অনুরূপ বিবৃতি প্রদান করে। জনাব আতাউর রহমান খান যথাসময়ে নির্বাচন প্রদানে দাবি এত বেশী করেছেন যে, এখন তিনি নিঃশ্রুপ। এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন-“প্রদত্ত বিবৃতিই তার পার্টির মতামত।” স্বাধীনতা বিরােধী চক্রের অন্যতম হােতা মওলানা মতিন আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, ‘নির্বাচন দিলে তিনি ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করবেন।’১৩ জিয়াউর রহমান এসব রাজনীতিবিদদের কাজে লাগিয়ে কাগুজে পরিস্থিতি সৃষ্টিকরে ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারীর মধ্যে অনুষ্ঠিতর ও প্রতিশ্রুত পার্লামেন্ট নির্বাচন স্থগিত ঘােষণা করতে বিচারপতি সায়েমকে বাধ্য করলেন। প্রতিশ্রুত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার গতিরুদ্ধ হয়ে গেলাে।

১৫. বিচারপতি সায়েম ১৯৭৫ ১৯৭৫ সনের ৬ই নভেম্বর ক্ষমতা গ্রহণের পর নির্বাচিত জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন-যদিও এই জাতীয় সংসদের মেয়াদ ছিলাে আরাে ৪ বছর। সেই সময় তিনি প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ‘৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন করবেন। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ থেকে বিচারপতি আবু সাদতমােঃ সায়েমকে অস্ত্রের মুখে তাড়িয়ে দিয়ে মেজর জেনারেল জিয়া প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ও ক্ষমতা দখল করে ঘােষণা দেন যে, প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে এবং তার প্রতি জনগণের আস্থা আছে কিনা? অর্থাৎ মেজর জেনারেল জিয়া দেশে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে প্রেসিডেন্টশিয়াল পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে অগ্রসর হলেন। জিয়াউর রহমানের নির্বাচনী’ সার্কাস হাঁ/না ভােট শেষ হওয়ার পর পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। কিন্তু জিয়াউর রহমান সে পথে অগ্রসর হলেন না। অত্যন্ত গােপনে তিনি প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি বহাল ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জন্য অগ্রসর হতে থাকেন।

জাগদল হ্যাজ কাম টু স্টে

১৬. ১৯৭৭ সনের জানুয়ারী মাসেই প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাগণ বলে বেড়াতে থাকেন জাতীয় সার্বভৌমত্ব সংহত করা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে একটি স্থিতিশীল ব্যবস্থা গড়ে তােলার জন্য একটি রাজনৈতিক কাঠামাে অপরিহার্য। রাজনৈতিক দলগুলিকে আগের চেয়ে আরাে বেশী তৎপরতা চালানাের সুযােগ দেয়া হবে। সার্বভৌমত্ব সংহত করা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সরকার একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন। ১৪

১৯শে জানুয়ারী প্রেসিডেন্টর অন্য এক উপদেষ্টা বাগেরহাটে সর্বস্তরের জন সাধারণের সামনে ঘােষণা করেন যে, “প্রস্তাবিত ফ্রন্টের ম্যানিফেস্টো হবে পূর্ণ গণতান্ত্রিক।”

১৭. মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সহযােগী ও সেনা ছাউনির সহযােগিতায় ১৯৭৮ সনের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী জিযার ক্ষমতায় আগমনের গােপন ক্রীড়নক ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে আহবায়ক করে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) গঠনের অনুমতি পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলবিধির নিয়ম অনুযায়ী ও রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ চালানাের উদ্দেশ্যে আইযুব খানের পেয়ারা এন.এস.এফ নেতা ব্যারিস্টার আবুল হাসানাত ৭ই ফেব্রুয়ারী প্রয়ােজনীয় কাগজপত্র জমা দেয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারী ‘৭৮ তারিখে দলটি সরকার কর্তৃক অনুমােদিত হয়। মেজর জেনারেল জিয়ার ও সেনা ছাউনির প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপােষকতা, সাহায্য সহযােগতািয় গঠিত জাগদল-এর মেনিফেস্টোতে ঘােষিত হলাে সরকার পদ্ধতি হবে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির।১৫ [৪ঠা ফেব্রুয়ারি ৭৮ অবজারভার) আমলা, জেনারেল এবং বিদেশী কোম্পানীর বেতনভােগীরা উচ্চস্বরে ঘােষণা করতে থাকেন, ‘আফ্রিকা-এশিয়ার বৃহত্তম দল হিসেবে জাগদল টিকে থাকবে।” ১৮,

২৭শে ফেব্রুয়ারী জাগদলের ১১ দফার মূল লক্ষ্য ও কর্মসূচী প্রদান করা হয়। ১৬ জাগদলের ঘােষণাপত্রে প্রেসিডেন্টশিয়াল পদ্ধতির সরকারকে জোড়ালােভাবে সমর্থন জানিয়ে মন্তব্য করা হয়-রাষ্ট্রপতি জনগণের দ্বারা পরিচালিত হলে। স্বাভাবিকভাবেই গণবিমুখ ও স্বৈরতন্ত্রের পথ রদ হবে। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে আইন। ও জাতীয় নীতি প্রণয়নে সহায়তা করার জন্য নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ থাকবে। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারে আইন প্রয়ােগ ও নীতি বাস্তবায়নে সুষ্ঠুভাবে করার জন্য রাষ্ট্রপতিকে সাহায্য করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীমন্ডলীর ব্যবস্থাও থাকবে।

জাগদেল আহবায়ক কমিটি জিয়ার উপদেষ্টা

১৯. ২৩শে ফেব্রুয়ারী জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল-এর ১৬ সদস্যের আহবায়ক কমিটির নাম ঘােষিত হয়। দলের আহবায়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার, সদস্যগণ হলেন পেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা সর্বজনাব সৈয়দ আলী আহসান, আব্দুল মমানেম খান, শামসুল হুদা চৌধুরী, ক্যাপ্টেন নূরুল হক, এনায়েত উল্লাহ খান, মওদুদ আহমদ, জাকারিয়া চৌধুরী, এম আর খান, আবুল হাসানাত, এম এ হক, ক্যাপ্টেন (অবঃ) সুজাত আলী, আলহাজ্ব এম এ সরকার, আবুল কাশেম।

সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ থাকে না।

২০. জাগদল সরকারী পৃষ্ঠপােষকতায় শুধু নয় সরকারী অর্থে ও সহায়তায় গড়ে তােলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উত্থাপিত হয়। প্রতিবাদে বলা হয় উপরাষ্ট্রপতি ও উপদেষ্টামন্ডলী সরকারী কর্মচারী। সরকারী কর্মচারী হিসেবে তারা কোন দলের সদস্য হতে পারেন না। ১৭ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় জনতা পার্টি উপরােক্ত মন্তব্য করে। জেনারেল ওসমানী জিয়াউর রহমানের সুরকারকে সামরিক সরকার হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “এই সরকারের কোন কর্মকর্তা, উপদেষ্টা কোন রাজনৈতিক দলে যােগ দিলে কেবল সরকারের দল নিরপেক্ষ চরিত্র নষ্ট হয় না, এর ফলে বর্তমান সরকারের ভিত্তি সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা ও জাতির প্রতি প্রদত্ত অঙ্গীকারের বরখেলাপ করা হয়।”১৮ জাগদলের কাগজপত্র তৈরী, এমনকি সাংবাদিক সম্মেলনের কাজেও সরকারী কর্মচারীদের নিয়ােগ করা হয়েছে। সরকারী স্টেশনারী ব্যবহার করে আমন্ত্রণ জানানাে ইত্যাদি সরকারী অর্থে দল গঠনের নজির কেবলমাত্র জেনারেল আইয়ুব খানের কনভেনশন মুসলিম লীগ গঠনের সঙ্গেই তুলনীয়। অথচ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিবেশী ভারতে একটি জনসভার কাজে প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরাগান্ধীর ব্যক্তিগত সচিবের জড়িত থাকার অভিযােগ প্রমাণিত হওয়ায় বিচারপতি জগলােছন তার নির্বাচনই বাতিল করে দিয়েছিলেন।

অনিয়মের চ্যালেঞ্জ

২১. দেশে সামিরক আইনের অধীনে জারীকৃত রাজনৈতিক দল বিধির ৬ ও ৭ নং ধারায়।

দলের তহবিল গঠনের উদ্দেশ্যে চাদা গ্রহণ, রশিদ প্রদান, ব্যাঙ্ক একাউন্টের মাধ্যমে তার পরিচালনার জন্য যে সমস্ত শর্ত যােগ করে দেয়া হয়েছিলাে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ১ম রাজনৈতিক সন্তান জাগদল তার কিছুই পালন। করেনি। তাছাড়া সামরিক সরকারের বেতনভুক্ত উপদেষ্টা হিসেবে রাজনৈতিক দল গঠনে তাদের নৈতিক ও আইনগত অধিকার ছিলােনা। এ অবস্থায় জাগদল গঠিত হলে ঢাকা মুন্সেফ কোর্টে ১৯৭৮ সনে ৪ঠা মার্চে জাগদল গঠনের আইনগত দিক চ্যালেঞ্জ করা হয় কিন্তু সামরিক ফরমানের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল বিধির অধীনে রাজনৈতিক দল হিসেবে জাগদলকে অনুমতি দেবার ফলে কোর্টের করার কিছুই ছিল। মামলাটি বর্তমান আকারে ও প্রকারে অচল বলে কোট রায় দেয়। ১৯

২২. মামলার রায় যাই হােক না কেন, প্রকৃত প্রস্তাবে উপদেষ্টাগণ ছিলেন বাস্তব অর্থেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। সংবিধানে উপদেষ্টা পরিষদ বলে কিছুই ছিলাে না। এটা ছিলাে নিছক সাময়িক ব্যবস্থা, সামরিক ফরমানের মাধ্যমে গঠিত। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তারকে দিয়ে জাগদল গঠন করলেও এর উপর ভরসা করতে পারছিলেন না। সরকারী সুযােগ-সুবিধা যানবাহন, হেলিকপ্টার, এমনকি সরকারী তােষাখানা হতে বিপুল অর্থ ব্যয়, প্রশাসন, সেনা চাউনি এবং গােয়েন্দা বাহিনীকে ব্যবহার করেও জিয়ার সামনে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক ও গ্রাম পর্যন্ত বিপুল অগণিত কর্মীবাহিনী জিয়ার হিসেবী মস্তি ক্ষকে ‘গরম করে রেখেছিলাে। জিয়াউর রহমানের হিসেবের যােগফলে বাম, ডান, স্বাধীনতা বিরােধী, মুক্তিযােদ্ধা সবকে মিলিয়ে একটি সুবিধাজনক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেন। তাছাড়া এ সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়, জেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত নেতাদের গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল। যাদের সংখ্যা ছিল অর্ধ লক্ষাধিক। ২০

১৩, এমনি অবস্থায় জিয়াউর রহমানের ‘সবুজ সংকেত পেয়ে জাগদল-এর আহবায়ক কমিটির এক জরুরী সভা ১৯শে এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তারের বাসভবনে। সভায় প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির নির্বাচন ঘােষণাকে অভিনন্দন জানানাে হয়। এবং ঐ ঘােষণার আলােকে অবিলম্বে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘােষণার অনুরােধ জানানাে হয়। সভায় রাজনৈতিক দলের সক্রিয় অংশ গ্রহণ সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলবিধি আইনের যে ধারা রাজনৈতিক দল গঠন এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের পরিপন্থী তা অবিলম্বে বাতিল করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানানাে হয়। অপর এক প্রস্তাবে রাজনৈতিক ক্রিয়াকে সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিক করার জন্য সকল রাজনৈতিক দলকে অবাধ ও প্রকাশ্য রাজনীতি করার অধিকার প্রদানের অনুরােধ জানানাে হয়।২১

২৪. জাগদল কর্তৃক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘােষণার নির্দিষ্ট তারিখ ঘােষণার দাবীর মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান টেলিভিশন ও রেডিওতে এসে ভাষণ দিলেন। ২১শে এপ্রিলের এই ভাষণে ঘােষণা করলেন, দেশে ৩রা জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১লা মে থেকে ঘরােয়া রাজনীতির পরিবর্তে খােলা রাজনীতি শুরু হবে। সভা সমিতির করা যাবে। তবে মিছিল করা চলবে না।।

২৫. ২৬শে এপ্রিল সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ চতুর্থ সংশােধনী বাতিলের দাবী জানান। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম চতুর্থ সংশােধনী বাতিল করে দেশে পার্লামেন্টারী পদ্ধতি প্রচলনের জন্য মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী বিচারপতি সাত্তার ও মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেদিন এই বলে বাধা দিয়েছিলেন যে, নির্বাচিত সংসদই ঠিক করবে সরকার পদ্ধতি কি হবে। কিন্তু ৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে নির্ধারিত সে নির্বাচন হয়নি। জিয়া ক্ষমতা দখল করে বিচারপতি সায়েমকে বঙ্গভবন হতে বের করে দিয়ে নির্বাচিত সংসদের উপর সরকার পদ্ধতি নির্ধারণের ক্ষমতা হরণ করে দেশে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা করেন। এই অবস্থায় ২৬শে এপ্রিল আওয়ামী লীগ ৪র্থ সংশােধনীর বাতিল এবং সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি করে। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা দখলের পর টেলিভিশন, বেতার ভাষণে মে মাসে তার প্রতি আস্থাসূচক গণভােট অনুষ্ঠানের কথা ও ১৯৭৮ সনের ডিসেম্বর মাসে পার্লামেন্ট নির্বাচনের কথা ঘােষণা করে। কিন্তু জিয়া দেশবাসীকে দেয়া তার প্রতিশ্রুতি বরখেলাপ করে ১৯৭৮ সনের ৩রা জুন প্রেসিডেন্ট নির্বানের ঘােষণা দেন।

ইলাবরেড ফ্রড

২৬. প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘােষণার পর ৭ দলীয় ঐক্যজোটের পক্ষে আতাউর রহমান খান এক দীর্ঘ বিবৃতিতে বলেন, দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে রাজনৈতিক দলগুলােকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে, তাদের জনগণের সামনে হাজির হবার সুযােগ্ না দিয়ে, সভা সমাবেশ গণসংযােগ করার সুযােগ না দিয়ে প্রেসিডেন্ট ও তার উপদেষ্টা অফিসারগণ আড়াই বছর ধরে হাওয়াই জাহাজ ও সরকারী যানবাহনে ঘুরে ফিরে বালাদেশে অতঃপর মাত্র ৪২ দিনের নােটিশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ফরমান জারী করেছেন তা হচ্ছে একটি ইলাবরেড ফ্রড বা বিরাট ভাওতা।২২

জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ঃ দ্বিতীয় সন্তান

২৭. জিয়া বুঝতে পেরেছিলেন জাগদল দিয়ে তিনি নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারবেন । সেজন্য, তিনি আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্যে এগিয়ে যান। ১৯৭৮ সনের ১লা মে তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হলাে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট। নির্বাচনে জয়লাভের জন্য এটা ছিলাে একটি জগাখিচুড়ী ব্যবস্থা। জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল অবশ্য প্রেসিডেন্ট জিয়াকে জাগদলের প্রার্থী হয়ে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রূপে প্রদ্বিন্দ্বিতার অনুরােধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু জিয়া সে। অনুরােধে সাড়া না দিয়ে চীন-সৌদি বলয়ের আশ্রিত দলগুলােকে এক করে নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়ার প্রিন্ট তৈরী করেন। ফ্রন্টে যে সমস্ত দল যােগদান করেছিলাে তারা হলাে জাগদল, ভাসানী ন্যাপ (মশিউর), ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (শাহ আজিজ) লেবার পার্টি ও বাংলাদেশ তফসিলী জাতি ফেডারেশন। প্রেসিডেন্ট জিয়া এর কোনটারই সদস্য ছিলেন না। কিন্তু তাকেই করা হলাে ফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের প্রার্থী। প্রত্যেক দল থেকে দু’জন করে প্রতিনিধি নিয়ে ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হলাে।

২৮. ৭৮ সনের ২৫ মে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের নির্বাচনে নির্বাচনী ঘােষণা ও কর্মসূচী প্রকাশ করা হয়। ফ্রন্টের দফা ছিলাে ১৩টি। অথচ ১৯৭৭ সনের মে মাসে অনুষ্ঠিত গণভােটে জিয়াউর রহমান ঘােষণা করেছিরেন ১৯ দফা কর্মসূচী। ২৩ কিন্তু গনভােটের ম্যানডেটকে ঝেড়ে ফেলে জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে ঘােষণা করলেন ১৩ দফা [পরিশিষ্ট-৮ ১৩ দফার সঙ্গে ১৯ দফার তাৎপর্য ও পার্থক্য লক্ষ্যণীয়, কতিপয় দফা পরস্পর বিরােধী।

২৯. বিভিন্ন পরস্পর বিরােধী নেতৃত্ব ও স্বার্থ লালনকারী ফ্রন্ট নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা একমত হতে পেরেছিলেন কেবলমাত্র নিজেদের স্বার্থের প্রশ্নে। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বানােয়াট মিথ্যাচার, কল্প কাহিনী, অতিরঞ্জিত অপপ্রচার এবং ভারত বিরােধীতা তাদের একসূত্রে ঐক্যবদ্ধ করেছিলাে। তাদের ঐক্যের সূত্রে কোন আদর্শবােধ ছিলাে না। কোন রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিতে এই ফ্রন্ট গঠিত হয়নি। স্বাধীনতার স্বপক্ষের দল ও শক্তিকে প্রতিরােধ করার লক্ষ্যেই এই ফ্রন্ট গঠিত হয়েছিলাে। জিয়াউর রহমান তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘দোহার’, সৃষ্টির জন্যই ফ্রন্ট গঠন করলেও নির্বাচনের ১০৭ দিন পর ফ্রন্ট ভেঙে জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নামে আর একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ৩০. ১৯৭৮ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সামনে রেখে ২৮শে মে ১৯৭৮ সনে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের ১৩ দফা নির্বাচনী ঘােষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারকালে ঘােষিত ও প্রতিশ্রুত এই দফা সম্পর্কে তেমন একটি প্রচার করা হয়নি। নির্বাচনী কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে আওয়ামী লীগ, ভারত বিদ্বেষকে। সামরিক শাসনের অধীনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যে ক্ষেত্রে দেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজেই যেখানে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী সেক্ষেত্রে নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক ঐক্য জোট (গজ) গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে দাড় করানাে সেই সময়ের বিচারে যুক্তিযুক্ত হয়েছিলাে বলে ইতিহাস প্রমাণ করবে। আওয়ামী লীগ জেনারেল ওসমানীকে সামনে রেখে ঘর গােছানাের প্রক্রিয়া চালায়। ২৪

৩১. ১৯৭৫ সনের ১৫ ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর রাজনৈতিক দল ও কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করার পর প্রায় ৩ বছর রাজনৈতিক দলসমূহকে ঘরে আটকে রেখে আওয়ামীলীগের শাসনামল সম্পর্কে বানােয়াট মিথ্যাচার প্রচার করা হয় অহরহ। রেডিও টিভি হতে এমন সব বিষয় প্রচার করা হয়। যা শুধু মিথ্যাচারই নয়, জাতীয় স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ও মর্মবাণীকে। প্রচন্ডভাবে আঘাত করে। মনগড়া কল্পকাহিনী, ২৫ বছর চুক্তি সীমান্ত চুক্তি ইত্যাদি। মিলিয়ে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে জনমনে বিভীষিকাময় চিত্র তুলে ধরা হয়। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে ফেলার ষরযন্ত্র অব্যাহত থাকে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম উচ্চারণ সামরিক ফরমানে নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়।

৩২. এই অবস্থা জিয়াউর রহমানের তিন বছর স্বাধীনতার স্বপক্ষের বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ১ লক্ষ ১৩ হাজার নেতা কর্মীকে পর্যাক্রমিক গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখে।২৫ নির্মম অত্যাচার অনেককে জেলখানায় হত্যা করা হয়। প্রায় তিন হাজার জোয়ান-অফিসারদের ফাঁসী দেয়। সমগ্র দেশে এক বিভীষিকাময় অবস্থার সৃষ্টি করে। জিয়াউর রহমানের নির্দেশে স্বাধীনতা বিরােধী উগ্র ডান বাম চক্র যারা জিয়ার দলে ভীড় জমায় তারা শ্লোগান তুলে ‘একটা দুটো বাকশাল ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর।’ সর্বোপরি দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রধান সেনাপতি জিয়াউর রহমান ৭৮ এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ৩০শে মে, ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভায় বলেন, আজ আমি আপনাদের কাছে সত্য কথা বলিব। আওয়ামী বাকশালীরা কোন দিন স্বাধীনতা চায় নি। ওরা স্বাধীনতা বিক্রী করে দিয়েছিলাে। অই ওরা স্বাধীনতা রক্ষা করিতে পারিবেনা ৩১ শে মে নারায়ণগঞ্জ জনসভায় ঘােষণা করেন, আওয়ামী বাকশালীরা স্বাধীনতা চায় না। ওরা পরাধীনতা চায়। ওরা দেশকে বিক্রি করতে চায়। যারা দেশকে বিদেশের কাছে বিক্রি করতে চায় তাদের ভােট না দেবার জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহবান জানান। ২৬

৩৩. সাধারণ একজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী একথাগুলাে উচ্চারণ করলে এটাকে নির্বাচনী ‘স্টান্ট’ হিসেবে বিবেচনায় আনা যেতে পারে। আওয়ামীলীগ সম্পর্কে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান যে সমস্ত মারাত্বক অভিযােগ করেছেন, তা স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রদ্রোহীতার প্রশ্ন। তিনি নিজেই দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন পশাসক, প্রধান সেনাপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার। দেশ চলছিলাে সামরিক শাসনের অধীনে। এই অভিযােগের স্বপক্ষে নিশ্চয়ই প্রয়ােজনীয় তথ্য ও প্রমাণপত্র তার হাতে আছে । যারা স্বাধীনতা চায়নি, এখনাে চায়না, যারা অতীতে স্বাধীনতা বিক্রি করে দিয়েছে। এবং আজও বিক্রি করে দিতে চায় এতসব জেনে শুনে কেন সেই আওয়ামী লীগকে সামরিক শাসনের আওতায় দল গঠনের অনুমতি দিলেন ?

৩৪. আসলে এসবই ছিলাে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ভাওতাবাজী, মিথ্যাচার। জিয়াউর রহমান নিজেই আওয়ামীলীগের সহযােগিতা চেয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামীলীগকে “উইন ওভার করতে না পেরে জিয়ার মাথা গরম হয়ে যায়। দেশের বুকে তখন মাঝে মাঝেই গুজবের মতাে শুনা যে-জিয়া খুব শীঘ্রই বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ঘােষণা করবেন। এসব গুজব জিয়াউর রহমান নিজেই ছড়াতেন। জিয়াউর রহমান আওয়ামীলীগ নেতাদের সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন “আমি তাে আওয়ামীলীগেরই। আপনাদের অধীনেই যুদ্ধ করেছি। আপনাদের অধীনেই চাকুরী করেছি। আওয়ামীলীগের জন্য আমিই তাে আছি।” কিন্তু আওয়ামীলীগের সরাসরি শর্ত ছিলাে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিচার করতে হবে, জাতির পিতাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং আওয়ামীলীগে যােগদান করতে হবে। জিয়া প্রস্তাবিত দলে আওয়ামীলীগ যােগদান করবেনা। ২৮

৩৫. নির্বাচনের পূর্বে সেনা ছাউনি হতে লক্ষ লক্ষ টাকা বিলানাে হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের এক অংশকে ক্যান্টনমেন্টে ডেকে নিয়ে নির্বাচনের টাকা দেয়া হয়। শ্রমিক বেল্টে কাজী জাফর দু’হাতে টাকা খরচ করেন। চিহ্নিত দাগী মাস্তান ও আসামীদের কারাগার হতে ছেড়ে দেয়া হয়।

৩৬, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মহসীন হলে ১৯৭৪ সনে ৭জন ছাত্র হত্যার মূল আসামী ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট শফিউল আলম প্রধান, যাকে বঙ্গবন্ধুর সরকার গ্রেফতার। করেছিলেন। ছাত্র হত্যার দায়ে ৭ বছর সশ্রম করাদন্ড ভােগ করছিল সেই শফিউল আলম প্রধানকে জিয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কারাগার হতে ছেড়ে দেন।

৩৭. ৩রা জুল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৬ই জুন সাংবাদিক সম্মেলনে জেনারেল ওসমানী বলেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে।২৯

জিয়াউর রহমান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেন। ব্যবহার করেন গােয়েন্দাবাহিনীকে। বিশেষ তহবিল হতে কোটি কোটি টাকা দু’হাতে খরচ করেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতেও বিপুল পরিমাণ টাকার অপচয় করেন জিয়া নির্বাচনী স্বার্থে।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গুরুতর অনিয়ম

৩৮, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য তিনি আর্মি এ্যাক্ট পর্যন্ত। সংশােধন করেছেন হাসানুজ্জামান পৃ. ৪৪/৪৫) নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দিতা করার জন্য তিনি ‘আর্মি এক্ট’ পর্যন্ত সংশােধন করেছেন। জিয়াউর রহমানের মনােনয়নপত্র বাছাই কালে এম, এ, জি, ওসমানীর মনােননের অন্যতম সমর্থক ও অন্যতম প্রস্তাবক ফেরদৌস আহমদ কোরেশী রিটার্নিং অফিসারের কাছে একটি আপত্তি পেশ করেন। এতে বলা হয় যে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অধ্যাদেশের ৫ (২) খ ধারা অনুযায়ী এবং সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২) দফার (ছ) উপদফা অনুযায়ী এবং সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ও সেনাবাহিনীর রেগুলেশন বা সেনা আইনের ২৯৩ ও ২৯৬ বিধিদ্বয় অনুসারে সেনাবাহিনীর চাকুরী করা কালে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যাবে না। এই আপত্তি বাতিল হয়ে যায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের ২৮/৪/১৯৭৮ তারিখের রুল ৫/১/৭৮/২৪১ নম্বর আদেশ ” লে সংশােধিত আকারে ২৯৩-ক বিধি অনুযায়ী প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বা। ‘ষ্ট্রপতি পদে আসীন এমন কোনাে অফিসারের ক্ষেত্রে উপরােক্ত নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়।৩০ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ হতেও আপত্তি উথাপিত করা হয়।

৩৯. আওয়ামী লীগ ও গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের পক্ষ হতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে সেনাপতি পদ হতে জেনারেল জিয়ার পদত্যাগ, নির্বাচনের আগে ৬ মাস সময় প্রদান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকরে পদ হতে প্রেসিডেন্ট জিয়ার পদত্যাগ, পি,পি,আর বাতিল, সামরিক আইনে সাজাপ্রাপ্ত সকল মামলা উচ্চতর আদালতে আপীল করার সুযােগ, সামরিক আইন প্রত্যাহার, ‘৭২ পার্লামেন্টারী সরকার পদ্ধতি এবং চতুর্থ সংশােধনী বাতিল, ‘৭২ সনের সংবিধান পুনরুজ্জীবিত করার দাবী জানানাে হয়।

৪০, জিয়াউর রহমান এর কিছুই মানলেন না। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২রা মে আওয়ামী লীগ, পিপলস্ লীগ , ন্যাপ (মােজাফফর) সি,পি,বি, গণআজাদী : লীগ, জাতীয় জনতা পার্টি সমন্বয়ে গঠিত হয় গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট-গজ। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গজের প্রার্থী হলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল (অবঃ) আতাউল গনি ওসমানী।। নির্বাচনে জেনারেল ওসমানী বললেন ঃ আমার এক দফা। আমি সংসদীয় গণতন্ত্র চাই।৩১

৪১. ৭ দলীয় ঐক্য জোট আওয়ামী লীগের দাবীর প্রায় হুবহ দাবী উত্থাপন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখলেও নির্বাচনের ১ সপ্তাহ পূর্বে আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আওয়ামী-বাকশালীদের প্রতিহত করতে হবে। দেশ থাকলে গণতন্ত্র আসবে। আওয়ামী-বাকশালীদের প্রতিহত করুন।” ৩২

৪২. সামাজবাদী দলের ফাস্ট সেক্রেটারী সিদ্দিকুর রহমান সাংবাদিক সম্মেলনে “আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে অর্থহীন এবং ইহাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে থাকার জন্য একটি ন্যাক্কারজনক নিম্নশ্রেণীর রাজনীতির খেলার চাকুরী মাত্র।”৩৩

ভােট জালিয়াতির বিশ্বরেকর্ড

৪৩. ৭৮ সালের নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি পদপ্রর্থীর সংখ্যা ছিল ১০ জন। এরা হলেন মেজর

জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল এম,এ,জি, ওসমানী, জনাব আজিজুল ইসলাম, জনাব আবুল বাশার, প্রিন্সিপাল আবদুল হামিদ, হাকিম মাওলা খবির উদ্দিন আহমদ, জনাব আবদুস সামাদ, জনাব গােলাম মােরশেদ, শেখ আবু বকর সিদ্দিক, ও সৈয়দ সিরাজুল হুদা। সর্বমােট ৩ কোটি ৮৪ লাখ ৮৬ হাজার ২৪৭ জন ভােটারের মধ্যে ২ কোটি ৮৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৯৪ টি ভােট পরে। এর মধ্যে জিয়াউর রহমান ১কোটি ৫৭ লাখ ৩৩ হাজার ৮০৭টি, জেনারেল (অবঃ) ওসমানী ৪৪ লাখ ৫৫ হাজার ২ শ’ ভােট, আজিজুল ইসলাম ৪৯ হাজার ৬৪, আবুল বাশার ৫১ হাজার ৯৩৬, প্রিন্সিপাল আবুল হামিদ ২৩ হাজার ৯৬৪, হাকিম মাওলা খবির উদ্দিন ৮ হাজার ৪২৫, আবদুস সামাদ ৩৭ হাজার ২৭৩, গােলাম মােরশেদ ৩৮ হাজার ১৯৩. শেখ আবু বকর সিদ্দিক ২৫ হাজার ৭৭ এবং সৈয়দ সিরাজুল হুদা ৩৫ হাজার ৬১৮টি ভােট পেয়েছিলেন। শতকরা ৫৪% লােক ভােট দিয়েছিল। ৪৪. সুধি পাঠকদের একটু স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়ােজন যে, ১৯৭৭ সনে মেজর জেনারেল জিয়া হাঁ/না ভােট করেছিলেন। তখন ভােটের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৮৩

লাখ ৩৬ হাজার ৮৫৮ জন। এর মধ্যে বৈধ ভােট পড়েছে ৩ কোটি ৩৭ লক্ষ ৭০ হাজার ৭৬৮ টি। এর মধ্যে জিয়াউর রহমান হা সূচক ভােট পেয়েছিলেন ৩ কোটি ৩৪ লক্ষ ৮৭০টি। প্রদত্ত ভােটের ৯৮,৮৮% ভাগ- যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৭৭ সনের ৩০শে মে এবং ১৯৭৮ সনের ৩রা জুন- এই ৩৬৯ দিনের মধ্যে জিয়ার ভােট কমেছে ১ কোটি ৭৬ লক্ষ ৬৭ হাজার ৩৬ টি। এবং ভােটারদের উপস্থিতি কমেছে ১, ৪৮, ৯৩, ৮৭৪টি। ১৯৭৭ সনের ৩০শে মে-র নির্বাচনে প্রকৃত প্রস্তাবে ভােটারদের উপস্থিতির হার ছিল নগণ্য। কিন্তু প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রধান সেনাপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের তুলনাহীন জনপ্রিয়তা দেখাতে নির্দেশিত জেলা-থানা প্রশাসকগণ বিপুল পরিমাণ ভােট জালিয়াতি করেছে। যা ছিলাে বিশ্বরেকর্ড। নির্বাচন কমিশন-এর নিরপেক্ষতা বলতে কিছুই ছিলােনা। সামরিক শাসনের অধীনে স্বয়ং সামরিক প্রধান যেখানে প্রার্থী সেখানে সকল আইনানুগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছিলাে।

৪৫. জিয়াউর রহমান প্রধান সেনাপতির উর্দি পরে সশস্ত্র বাহিনীর স্যালুট নিচ্ছেন। নির্বাচনে তার পক্ষে কাজ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর সদস্যগণ প্রকাশ্যভাবে ড্রেস পরে গ্রামে গিয়ে জিয়ার পক্ষে ভােট চাইছেন- জিয়াকে ভােট না দিলে জনগণের ভােগান্তি হবে বলে হুমকি দিচ্ছেন। সামরিক অফিসারদের জেলায় জেলায় নির্বাচন তদারকীর নাম করে জেলা প্রশাসনকে কবজা করে নেবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে; এমনি অবস্থায় নিরীহ জনগণ জানমালের নিরাপত্তা বিধানে জিয়াউর রহমানকেই ভােট দিয়েছেন। কেননা ৭১ সনে সামরিক বাহিনীর নির্মম নিষ্ঠুরতা তাদের চেতনায় তখনও জ্বল জ্বল করে জ্বলছিল। এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় রাত দশটার পর কার্য্য এই পরিবেশে ৭৮-এর প্রহসন মূলক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সমগ্র নির্বাচন কাঠামাে ও ব্যবস্থাকেই দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলেছিলাে। নির্বাচনের পর ২৯ শে মে জুন ৭৮ সনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ২৮ সদস্যের একটি মন্ত্রী পরিষদ ও দু জন প্রতি মন্ত্রী নিয়ােগ করেন।৩৫

৪৬. ১৯৭৭ এর গণভােট ও বিগত ৩রা জুন -এ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যেমন দেশের ভবিষৎ শাসনতন্ত্র ও সরকারের কাঠামাে সম্পর্কে দেশবাসীকে সুস্পষ্টভাবে জ্ঞাত করানাে হয়নি, ‘৭৮ ডিসেম্বরের পার্লামেন্ট নির্বাচনেও তেমনি শাসনতান্তিক কাঠামাে ও সরকারের পদ্ধতি সম্পর্কে নীরবতা ও অস্পষ্টতা বিদ্যমান।

৪৭. ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন পদ দখলের পর বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে মে মাসে তার প্রতি আস্থা সূচক গণভােট অনুষ্ঠানের কথা এবং ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে পার্লামেন্ট নির্বাচনের কথা ঘােষণা করেন। এ ঘােষণাতেও সংসদীয় গণতন্ত্রের ওয়াদা অপরিবর্তিত থাকে। তৎসত্বেও জনগণ মনে করছিলাে যে, মধ্যবর্তী দেড় বছরের জন্য জেনারেল জিয়া রাজত্ব করবেন তার জন্য তিনি গণভােটের দ্বারা ম্যান্ডেট নিয়েছেন।

৪৮, কিন্তু প্রশ্ন উঠলাে ১৯৭৮ সালেন ডিসেম্বর মাসে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তিনি কি সংসদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন? ব্যারাকে ফিরে যাবেন? নাকি তিনি প্রধান সেনাপতি পদ ছাড়বেন?

৪৯. সময়ও এগিয়ে চললাে। ৩০শে সেপ্টেম্বর ও ২রা অক্টোবর বগুড়া ও ঢাকায় ব্যর্থ। সামরিক অভ্যুথান। অভ্যুথানের দু’তিন দিন পর প্রেসিডেন্ট দেশী ও বিদেশী এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘােষণা করলেন যে, ভারত হতে যে সমস্ত সশস্ত্র দুস্কৃতিকারী এসেছে, যারা সীমান্তে হামলা ও ফারাক্কায় ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার বিষয়ে টু শব্দ উচ্চারণ করে না তাদের উস্কানীতেই ব্যর্থ অভ্যুথান ঘটে। শুরু হলাে ধমূকি, হুংকার। কিন্তু তদন্তে প্রমাণিত হলাে চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ জড়িত নেই। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক বলয়ে প্রেসিডেন্ট কার্টার বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সােচ্ছার হলেন। ১৯৭৭ এর শেষে এবং ৭৮ এর প্রথমে ইউরােপীয় পত্র পত্রিকায় বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘন সম্পর্কে ফলাও করে সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। বলা হয়, বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠত না হলে বৈদেশিক সাহায্য কমে যাবে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক দলগুলাে এতদিন বিভিন্ন ইস্যুর ভিত্তিতে আওয়ামী বাকশাল রুখার জন্য মেজর জেনারেল জিয়াকে অব্যাহত ও অকুণ্ঠ সমর্থন দিচ্ছিল তারাও নির্বাচন ও প্রকাশ্য রাজনীতির দাবী উত্থাপন করে। এই সমস্ত অব্যাহত দাবী ও ঘটনার পরিপেক্ষিতে ১৯৭৭ সালেন ১৫ই ডিসেম্বর রাতে রেডিও ও টেলিভিশনে ভাষণে জিয়াউর রহমান একটি ব্যাপক ভিত্তিক রাজনৈতিক ফ্রন্ট’ গঠনের আহবান জানান, তখনও পার্লামেন্টটারী সরকারের ওয়াদা হতে জিয়াউর রহমান পিছিয়ে যাননি। তখনও ৪র্থ সংশােধনী রেখে আওয়ামী-বাকশালীদের বিরুদ্ধে প্রচন্ডভাবে সরকারী অপপ্রচার চলতে থাকে। প্রচারে প্রতীয়মান হলাে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ৪র্থ সংশােধনী বাতিল হবে। দেশে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি সরকার গঠিত হলে ‘সার্বভৌম পার্লামেন্টের ক্ষমতা কি হবে বলা হলােনা। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট জিয়া নীরব থাকলেন। একাধারে প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রধান সেনাপতি পদ আকড়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হয়ে শসনতন্ত্র সংরক্ষণ ও হেফাজত এর শপথ গ্রহণ করলেন। কিন্তু কয় বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট হলেন তাও গােপন করা হলাে। ৫০. নির্বাচন উত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে কত দিনের জন্য প্রেসিডেন্ট হলেন এই প্রশ্নের উত্তরে জিয়া পাল্টা সাংবাদিককে প্রশ্ন করেন, আপনি কত দিনের মনে করেন? রাজনীতিতে এলে কি সেনাবাহিনী কি ছাড়বেন? এই সম্পর্কে বলা হলাে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এখন আর সেনাবাহিনীর প্রধান নন, এখন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান নন, তিনি সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সুপ্রীম কমান্ডার। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর পােশাকেই বলতে থাকেন পার্লামেন্ট হবে ‘সার্বভৌম’। কেমন ‘সার্বভৌম?” সরকার পদ্ধতির রূপরেখা নির্ধারণ করতে পারবে কি? যদি আগমী ‘৭৯-এর নির্বাচন সংখ্যাগুরু এমপিরা জাতীয় সংসদে সংসদীয় সরকারের স্বপক্ষে প্রস্তাব পাশ করে তাহলে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জিয়ার অবস্থা কি দাঁড়াবে? তিনি কি পার্লামেন্টারী সরকারের অধীনে শাসনতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট হবেন? ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন?

এই প্রহসনের অর্থ কি?

৫১. জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে জনগণের কাছে ওয়াদা করেছিলেন যে, দেশ থেকে সামরিক আইন তুলে নেবেন রাজনৈতিক দলবিধি প্রত্যাহার করা হবে এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম সর্বপ্রকার নিয়ন্ত্রন মুক্ত হবে। এখন স্পষ্টতঃ মার্শাল ল উঠছে না। প্রেসিডেন্ট জিয়া নির্বাচনী ওয়াদা ভংগ করে চলেছেন। বাংলাদেশকে ‘পুলিশী স্টেট’-এ পরিণত হযেছে। বাক, স্বাধীনতা, নিয়মতান্ত্রিক বিরােধীতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সহ মৌলিক অধিকার হরণ করে জিয়াউর রহমান গণতন্ত্র ধ্বংস করে দেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লক্ষ্যে।

পার্লামেন্ট নির্বাচন ও কালাে টাকা আর ষড়যন্ত্র

৫২. জিয়াউর রহমানের নিকট জীবন মরণ সমস্যা ছিলাে জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

১৯৭৮ সনের ৮ই নভেম্বর জিয়াউর রহমান টেলিভিশন রেডিওতে ঘােষণা দিলেন ১৯৭৯ সনের ২৭শে জানুয়ারী দেশে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। টিভি বেতার ঘােষণায় তিনি আরাে বললেন, পার্লামেন্ট হবে ‘সার্বভৌম’ এবং পার্লামেন্ট নির্বাচনের পরপরই মার্শাল লৈ উঠিয়ে নেয়া হবে। নির্বাচন হবে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ। তিনি প্রতিটি রাজনৈতকি দলকে নির্বাচনে অংশ গ্রহণে অনুরােধ জানান। ৩৬ পার্লামেন্ট নির্বাচন ঘােষণার পর বিরােধী দল হতে প্রতিক্রিয়া জানানাে হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১১ দফা দাবী উত্থাপন করে। দাবীগুলাের মধ্যে

নির্বাচনের পূর্বেই সামরিক আইন প্রত্যাহার, সামরিক বাহিনী হতে জিয়াউর রহমানের পদত্যাগ, রাজবন্দীদের মুক্তি, সামরিক আইনে সাজাপ্রাপ্ত সকল বন্দীদের উচ্চতর আদালতে আপেিলর সুযােগ প্রদান, ৪র্থ সংশােধনী বাতিল করে ১৯৭২ সালের শাসনতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন, বিশেষ ক্ষমতা আইন সহ সকল কালাকানুন বাতিল ছিলাে অন্যতম। বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, জাতীয় জনতা পার্টি, জাসদ, গণআজাদী লীগ, ডি, এল, ন্যাপ (নাসের) জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, ইউ পি পি দলগুলাে নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রায় একই রকম দাবী উথাপন করে। আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে ১০ দল নির্বাচন সংক্রান্ত দাবীর সঙ্গে নির্বাচন পিছানাের দাবীও জুড়ে দেয়। মুসলিম লীগ এসব দাবীর সঙ্গে পৃথক নির্বাচনের দফাও নির্বাচনে অংশ গ্রহণের পূর্বশর্ত হিসেবে জুড়ে দেয়। মুসলিম লীগ নেতারা বায়তুল মােকাররমে জনসভা করে ঘােষণা করে ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যে এসব দাবী মানা না হলে উদ্ভূত গুরুতর পরিস্থিতির জন্য মুসলিম লীগ দায়ী থাকবে না।৩৭ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মুসলিম লীগের হুশিয়ারীতে কর্ণপাত না করে মুসলিমলীগ প্রধান খান, আবদুস সুবুর খান -র সঙ্গে গােপনে পরামর্শ করলেন। সবুর খানের মুসলিম লীগ নির্বাচনে যাওয়ার ঘােষণা দিলাে। সিপিবি, দীর্ঘ কয়েকদিন নির্বাচনে অংশগ্রহণ সম্পর্কে আলােচনা করে এবং কোনরূপ শর্ত ছাড়াই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অবশ্য পূর্ব কথা ছিলাে আওয়ামী লীগের সাথে কথাবার্তা বলে নির্বাচন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু তা না করে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে গােপনে সলাপরামর্শ করে তারা শর্তহীনভাবে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ‘৭৮ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরপরই ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা সমর্থন করেন। সে জন্য ন্যাপের পক্ষে শর্তনভাবে নির্বাচন যাওয়াই স্বাভাবিক।

গণ রায়ের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা

৫৩. ‘৭৮-এর ৩রা জুন নির্বাচনের পর মেজর জেনারেল জিয়া প্রেসিডেন্ট পদে শক্ত। হয়ে বসলেন। ৭৬-৭৭ সন পর্যন্ত কয়েকটি সামরিক অভ্যুথান নির্মমহাতে দমন করেছেন। এখন তিনি ‘সৈনিক’ হতে ‘রাজনীতিক’ হওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে এলেন। চীনপন্থী গ্রুপ, স্বাধীনতা বিরােধী দল, ব্যক্তি, সামরিক-বেসামরিক আমলাদের নিয়ে গঠিত জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টকে একটি রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত করার

লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান অগ্রসর হলেন। জুন মাস হতেই জিয়া ও তার সঙ্গীরা নতুন একটি দল গঠনের প্রকাশ্য তৎপরতা চালাতে লাগলেন। সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপােষকতায় নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া দেশব্যাপী চালু হল। দল গঠনে প্রেক্ষপট বিশ্লেষণ করে জিয়াউর রহমান বললেন- “জাতীয় ঐক্যের অভাব, বিশেষতঃ দেশপ্রেমিক শক্তি ও গােষ্ঠীর মধ্যে সমঝােতা ও মৌলিক ঐক্যবােধের অভাব বাংলাদেশের মত আপাতঃ দারিদ্র অথচ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রকে সহজেই বৈদেশিক আধিপত্যবাদ ও আভ্যন্তরীণ বিধ্বংসী প্রক্রিয়ার শিকারে পরিণত করতে পারে।”৩৯ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠনের কথা ঘােষণা করেন এবং দলের আহবায়ক হন। ২৬শে সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের মুসলিম ইনস্টিটিউটের এক জনসভায় প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অবঃ) জিয়াউর রহমান বলেন, “আমরা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মাধ্যমে বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি এবং এ কারণে আমি জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ভেঙে দেবার কথা ঘােষণা করছি।’ তিনি বলেন, “আমি আশা করি ফ্রন্টের অঙ্গদলগুলাে এই ঘােষণা মেনে নেবে।”৪০ জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টকে শুধু সঙ্গীণবিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হলেন না, বরং ফ্রন্টের মাধ্যমে জনগণকে দেয়া নির্বাচনী ওয়াদাকে বুটের তলায় চেপে ধরলেন। জিয়ার ঘােষণা ছিল অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী; জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট জিয়ার ব্যক্তিগত দল বা সম্পত্তি ছিলাে না। ৬টি দল নিয়ে গঠিত ১২ সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটি দ্বারা ঐক্যের খাতিরে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে দলনিরপেক্ষ লােক হিসেবে ফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও প্রেসিডেন্ট পদে মনােনয়ন দিয়েছিলাে। ফ্রন্ট থাকা না থাকার ব্যাপারে তার একক সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন অধিকারই ছিলাে না। ৪১ স্বৈরাচারী ডিক্টেটর হিসেবে জিয়া ফ্রন্ট বিলুপ্ত করে নতুন দল গঠন করার ঘােষণা দেন। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের প্রার্থী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের পর প্রেসিডেন্ট জিয়ার নিকট ৭৭ সনের হাঁ/না ভােটে দেয় ১৯ দফার কোন অস্তিত্ব থাকার কথা ছিলাে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য ১৯ দফাকে বলি দিয়ে তিনি ফ্রন্ট করেন ১৩ দফার ভিত্তিতে। ৪২

১৩ দফার ৪ নম্বর দফার অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল সরকার পদ্ধতি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদি পরবর্তী পার্লামেন্ট নির্ধারণ করবে। কিন্তু জাগদল, ন্যাপ (মশিউর)

ও মুসলিম লীগ নিয়ে গঠন করলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি।

৫৪. ১৯৭৮ সনের আগস্টে দলের পক্ষে ডাঃ এ. কিউ. এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রকাশিত “বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ঘােষণাপত্র শীর্ষক পুস্তিকার ৭ নম্বর দফায় বলা

হলাে “জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখার জন্য, সামাজিক অনাচার ও অসমতা দূর করার জন্য, দ্রুত সার্বিক জাতীয় উন্নয়নের সার্থক প্রয়াস চালানাের জন্য যে স্থিতিশীল ও নির্ঘন্ধ জাতীয় নেতৃত্বের প্রয়ােজন তা দেবার ক্ষমতা রয়েছে কেবল এমন এক প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারের, যেখানে রাষ্ট্রপতি নিজে সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দল, জনগণ সমর্থিত, অবিসংবাদিত, স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক নেতৃত্বে বিশ্বাস করে। সেই জন্য আমাদের দল একাধিক রাজনৈতিক দলীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণ নির্বাচিত এবং সক্রিয়ভাবে গণসমর্থিত প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারে বিশ্বাস করে।” অর্থাৎ পার্লামেন্টকে সরকার পদ্ধতি ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যে পদ্ধতি নির্ধারণের ক্ষমতা জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে দেয়া হয়েছিল, তা সরাসরি অস্বীকার করা হলাে। জিয়াউর রহমানের নিকট এসব দফার কোন মূল্যই ছিল না। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা দখল, ক্ষমতার পথ নিষ্কন্টক করা এবং ক্ষমতায় টিকে থাকা। সেজন্য ১৯৭৭ সনে হাঁ/না ভােটের সময় জনগণের রায় চেয়েছিলেন ১৯ দফা দিয়ে। ৭৮ সনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ১৯ দফা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন ১৩ দফা দিয়ে। ১৩ দফায় জনগণকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের পরপরই তা ছুঁড়ে ফেলা হলাে। পুনরায় ঘােষিত হলাে ১৯ দফা। আবার সেই ১৯ দফার পেট থেকে শিল্প বিপ্লব ঘটানাের জন্য দেয়া হলাে ৪৩ দফা।৪৩

দল ভাঙ্গাভাঙ্গির রাজনীতি

৫৫. জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলের (জাগদল) আহবায়ক ও উপরাষ্ট্রপতি জনাব বিচারপতি আব্দুস সাত্তার জাগদল সম্পর্কে বলেন যে, ফ্রন্ট ঠিকই আছে, তবে আমাদের নিজস্ব পার্টি জাগদলকে সংহত ও শক্তিশালী করার জন্য মনােযােগ দিচ্ছি। তিনি পুনরুল্লেখ করে বলেন যে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অনুপ্রেরণা ও নির্দেশে জাগদল গঠিত হয়েছে। জাগদল আহবায়ক সুস্পষ্টভাবে জানান যে, সকল বাস্তব অর্থে রাষ্ট্রপতি হচ্ছে জাগদলের নেতা।৪৪ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনায় প্রমাণ পাওয়া যায় সরকারী উদ্যোগে কযেকটি দল নিয়ে এক দল গঠনের চেষ্ট চলছে। সরকারী মহলেরই কেউ কেউ একদল গঠনের ঘােরতর বিরােধী। নর্তমানে একদল গঠনের পক্ষে এবং বিপক্ষে বামপন্থী মন্ত্রী এনায়েত উল্লাহ খান সাম্প্রতিক ভাষণে বলেছেন যে, গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে জাতীয় ঐক্য। তিনি সংগঠনের ভিতরে ও বাইরে ঐক্য গড়ে তােলার জন্য আহবান জানিয়েছেন। জনাব এনায়েত উল্লাহ খানের বক্তব্যের মূল কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পূর্বে গঠিত

জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের সকল অংশও দলকে নিয়ে একটি দল গঠন করা। জনাব। এনায়েত উল্লাহ খানের এই আহবান রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলার আহবানেরই প্রতিধ্বনি মাত্র। এদিকে জাগদলের আহবায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য ও মৎস্যমন্ত্রী জনাব ওবায়দুর রহমান সম্প্রতি চাঁদপুরে এক জনসভায় ঘােষণা দিয়েছেন যে জাগদলের কোন বিকল্প নেই। অর্থাৎ তিনি চান না যে, কতিপয় দলকে একত্রিত করে নিয়ে জাগদলের বিলুপ্তি সাধন করা হােক। ৪ঠা জুলাই ‘৭৮ সমাপ্ত জাগদলের জেলা ও মহকুমার কমিটির আহবায়কদের সম্মেলন পন্ড হয়ে যায়। এই সম্মেলনের শুরুতেই এক দল গঠনের প্রশ্নে মতবিরােধ দেখা দেয় এবং সেদিন বিকেলে হােটেল ড্যাফোডিল প্রাঙ্গণে শ্লোগান পাল্টা শ্লোগানের পর এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে ধাওয়া করে, হাত থেকে কাগজ ছিনিয়ে নেয়া এবং পরিশেষে কোন সুরাহা ছাড়া অধিবেশন শেষ হয়। ড্যাফোডিলের ঘটনা শেষ হওয়ার পরে একটি গ্রুপ জনাব। মােজাম্মেল হকের নামে এক বিবৃতি প্রচার করে। তিনি বলেন যে, তার হাত থেকে স্বার্থবাদী মহলের ভাড়াটিয়া গুঞ্জারা একটি কাগজ ছিনিয়ে নেয় এবং তাকে মারতে উদ্যত হয়। বলা বাহুল্য, এই কাগজে এক দল গঠনের সমর্থনে সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে ছিলেন।৪৫ পরদিন আরও ১৫ জন সদস্য ও ৬৪ জন আহবায়ক এক যুক্ত বিবৃতিতে অনুপ্রবেশকারীদের চক্রান্ত প্রতিহত করার জন্য আহবান জানান। বিবৃতিতে সাম্প্রদায়িক ঐক্যবিরােধী ক্ষমতা লােভী অনুপ্রবেশকারীদের চক্রান্ত প্রতিহত করে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার হাতকে শক্তিশালী করার জন্য আহবান জানানাে হয়। সিনিয়র মন্ত্রী ও ন্যাপের জনাব মশিউর রহমান তার বক্তব্যের মধ্যদিয়ে জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন। আভাষে ইঙ্গিতে তিনিও একদল গঠনের পক্ষপাতী। একদল গঠিত হলে কাজী জাফর আমাদের অসুবিধা হবে। তবে কর্মীরা একদলে। যেতে রাজী নয়। তারা তাদের পার্টির অস্তিত্ব বিলােপের বিরােধী। কাজী জাফর। যদি একদল গঠনে রাজী হয়ে নিজের দলের পৃথক সত্ত্বার বিলােপ সাধনে রাজী হন। তবে কর্মীদের হারাতে হবে। বর্তমানে কাজী জাফরের সামনে বিরাট সমস্যা। এদিকে মুসলিম লীগের সাথে এক হওয়া, তাদের সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করাটাও ইউপিপির ঘােষিত নীতির পরিপন্থী। এখন একটু তলিয়ে দেখা যাক, ঐক্য ও একদল গঠনের প্রশ্নে এই মতবিরােধ কেন? উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জনাব এনায়েতউল্লাহ খান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, এদেশের দক্ষিণপন্থী রাজনীতি উথ পিনের সম্ভাবনা খুবই কম। বামপন্থীরাই রাজনীতিতে প্রাধান্য পাবে জনাব।

খানের বর্তমান ভূমিকা ও তার উপরােক্ত বক্তব্যের অনেক মিল আছে। কিন্তু জনাব আবুল হাসানাত, জনাব মওদুদ, জনাব শাহ আজিজুর রহমানসহ মুসলিম লীগের সদস্যবৃন্দ, বিচারপতি জনাব সাত্তার, জনাব ওবায়দুর রহমান ও আরও অনেকে যারা জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে আছেন তাদের পরিচয় কি? বর্তমান সংস্কৃতি ও ক্রীড়া বিষয়ক মন্ত্রী এবং সাবেক তথ্য উপদেষ্টা জনাব শামসুল হুদা চৌধুরীও পাল্টা প্রশ্ন করেন আমাদের দেশে বামপন্থী বলে কেউ আছে নাকি? এক সাথে ফ্রন্ট করছেন, মন্ত্রীসভায় আছেণ, তাদের মধ্যে ডান-বামের লড়াই কেন? বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে যারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শরীক হয়ছেন তাদের মধ্যে আদর্শের দ্বন্দ্ব থাকতে পারে না, আছে ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারে সংঘাত অবশেষে জাগদল ২৯শে আগস্ট জিয়াউর রহমানের ঘােষিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যােগদান করে।

দলকে টুকরাে টুকরাে করাে

৫৬. বাংলাদেশে দল ভাঙ্গা এবং দল গড়ার রাজনৈতিক খেলা জমে উঠছে। আর এর

নেপথ্য নায়ক জিয়াউর রহমান। “জিয়া সাহেব সব দলই ভাঙ্গতে পেরেছেন, কিন্তু জাসদ তিনি এখনও ভাঙ্গতে পারেননি” দক্ষিণ বঙ্গের এক জনসভায় আ.স.ম. আব্দুর রবের এই উক্তির দিন পনের মধ্যেই জাসদে নাটকীয় ভাঙ্গন ধরেছে। মতাদর্শগত বিরােধ, নেতৃত্বের কোন্দল, এক শ্রেণীর নেতার লােভ-লালসা ও সুবিধাবাদী ভূমিকা ইত্যাদি ছাড়াও দেশে পাইকারী দল ভাঙ্গাভাঙ্গির আরেকটি কারণ হচ্ছে জিয়ার গােয়েন্দা বাহিনীর প্ররােচনা ও প্রয়াস। বাকশাল গঠিত হবার। আগে দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ছিল দেড় ডজনের মত। গত পাঁচ বছরে নিত্যনতুন দল গজাতে গজাতে এবং পুরানাে দলগুলাে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক দলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কম-বেশী শ’ খানেক। মুসলিম লীগ ভেঙ্গে চায় টুকরা হয়েছে, ন্যাপ হয়েছে দুভাগ, ভাসান। ন্যাপ তিন চার ভাগ, জনতা পার্টি দু’ভাগ, সাম্যবাদী দল দু’ভাগ, পিপলস লীগ দু’ভাগ, আইডিএল দু’ভাগ, জাগমুই দু’ভাগ, ইউপিপি তিন ভাগ এবং ভাসানী ন্যাপের নূরুল জাহিদ গ্রুপও আবার দু’টুকরা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ভাঙার চক্রান্ত। অব্যাহত আছে।

জিয়ার মার্শাল ডেমােক্রেসী : পার্লামেন্ট নির্বাচন

৫৭. ‘৭৯ সনের নতুন বছরের শুরু। সামরিক বাহনিী, গােয়েন্দা বাহিনী, পুলিশ, সেপশাল ব্রাঞ্চ, ডিসি এসপি এদের বিরাট বহর নিয়ে প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক

আইন প্রশাসক, সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান, প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নির্বাচনী প্রচারে অবতীর্ণ হয়েছেন। নির্বাচনী প্রচার না বলে এটা যেননির্বাচনী যুদ্ধ। সিলেটের এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বিরােধী দলের বিশেষ করে আওয়ামী-বাকশালীদের বিরুদ্ধে চিরাচরিতভাবে বলেছেন, “কয়েকটি রাজনৈতিক দল তাদের অতীত অপকর্মের জন্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সামনে হাজির হতে ভয় পাচ্ছে।” ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে পার্লামেন্টে নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন জিয়াউর রহমান অনির্দিষ্টকালের জন্য তা স্থগিত ঘােষণা করে। এবং নির্বাচন চাওয়ার অপরাধে র্যাংক এন্ড ফাইল। আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে কোনদিন ভয় পায়নি-বরং জিয়াই তখন নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভীত হয়ে তড়িঘড়ি নির্বাচন বন্ধ করেছিলাে।

৫৮, পার্লামেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের দাবী ছিল পরিষ্কার। দেশ থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহার, ৪র্থ সংশােধণী বাতিল করে ১৯৭২ সনের সংসদীয় পদ্ধতির সংবিধান চালু, সেনাবাহীনীর পদ হতে পদত্যাগ জরুরী আইন প্রত্যাহার, রাজবন্দীদের মুক্তি এবং উচ্চতর আদালতে আপীলের ব্যবস্থা-এসব দাবী জনগণের দাবী। জনগণের পক্ষে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যথার্থভাবেই নির্বাচনের পূর্বে এসব দাবী উত্থাপন করেছে।

৫৯. প্রেসিডেন্ট এসব দাবী যদি মেনে নিতেন তারপরও যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করতাে তাহলে প্রেসিডেন্টের ভাষণের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যেতাে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জনগণের মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘােষণা দিয়েছেন। এই ঘােষণা যদি বাস্তব অর্থে কার্যকরী করতে হয় তবে পার্লামেন্ট নির্বাচনের পূর্বেই মার্শাল ল প্রত্যাহার করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মার্শাল ল তুলবেন জাতীয় ‘ সংসদের প্রথম অধিবেশনে। মার্শাল ‘ল আওতায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোনক্রমেই জনগণের কাঙ্খিত নয়। প্রকৃত জনমত প্রতিফলনও হবে না। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক যখন একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হয়ে রাজনৈতিক দলের পক্ষে বক্তব্য রাখেন তখন সামরিক বাহিনীর নিরপেক্ষতা।

থাকে না, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার প্রশ্নই ওঠেনা।

৬০. প্রকৃতপক্ষে জিয়াউর রহমানের মাথা গরম হয়ে আছে। ১৯৭৯ সনের ২রা জানুয়ারী নতুন দল বিএনপির জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। শত শত বাস-ট্রাক, লঞ্চ ব্যবহার করে ১০/২০ টাকা করে লােক ভাড়া করে আনার পর পল্টনের মিটিং-এ যে জনসমাবেশ হয়েছে, মিটিং কতটা সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে জিয়াউর রহমান নিজেই তা স্বচক্ষে দেখেছেন ও উপলব্ধি করেছেন। ভাড়া করা লােক এসেছে ঠিকই কিন্তু

মিটিং-এ বসেনি। এদিক ওদিক ঘােরাফেরা করেছে। শ্লোগান দেয়নি, হাততালি দেয়নি বা দিতে অভ্যস্ত নয়-এমন লােকদের জড় করা নিরুত্তাপ জনসভায় জিয়াউর রহমান ক্ষুব্ধ।

৬১. এই বিক্ষুব্দ চিত্র নিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিএনপির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান পার্লামেন্ট নির্বাচনকে ‘জনগণের জন্য এক অগ্নীপরীক্ষা” বলে অভিহিত করেছেন। জনগণের জন্য “অগ্নিপরীক্ষা না হলেও জিয়ার জন্য সত্যিই এটা অগ্নিপরীক্ষা। কেননা ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট হতে সামরিক ফরমান, বিধি, প্রবিধান, বিজ্ঞপ্তি, জারী করে যে ৫ শতাধিক গণবিরােধী আইন, নির্দেশ, বলবৎ করা হয়েছে তা সংসদে পাশ করার জন্য প্রয়ােজন দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের। পার্লামেন্ট নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ আসন লাভ না করতে পারলে জিয়াউর রহমানের সামনে ভীষণ বিপদ অপেক্ষা করছে।

জিয়া সশস্ত্রবাহিনীর পােশাক পরতে পারেন না

৬২. জিয়াউর রহমান এটা যথার্থভাবেই বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে সামনে তার সমূহ বিপদ। ২রা জানুয়ারী জনগণের চেতনা ও উপলব্ধি করে জিয়াউর রহমান সরাসরি মাঠে নেমে পড়লেন। জিয়াউর রহমান বিএনপি হতে যে সমস্ত ব্যক্তিদের মনােনয়ন দিয়েছিলেন তাদের একটাই যােগ্যতা ছিল যে, তারা ক্ষমতাসীন দলের লােক। জিয়া নিজেই প্রার্থীদের সার্টিফিকেট দিয়ে চলেছেন। সামরিক বাহিনী, পুলিশ, জেলা প্রশাসন, আনসার, ভিডিপি দ্বারা লােক জোগাড় করে এনে তিনি জনসভায় প্রার্থীর হাত ধরে উচু করে বলছেন যে, প্রার্থী সৎ ও ভালাে মানুষ। রাজাকার যে প্রার্থী হয়েছে তার সম্পর্কে সাকাই গাইতে গিয়ে তিনি বলছেনদেশের স্বাধীনতার জন্য এর অবদান ভুলবার নয়। পাশে থাকছে শাহ আজিজ, মশিউর রহমান প্রমুখ। গাড়ী, হেলিকপ্টার, জলযান ব্যবহার করে দেশের প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট নির্বাচনে ঝাপিয়ে পড়েছেন।

৬৩. ১৯৭৯ সনের নির্বাচনে প্রায় ২৫০ আসনে বিএনপি স্বাধীনতা বিরােধীদের ছেড়ে দেয়। এর মধ্যে ৮৪ জন চিহ্নিত রাজাকার।৪৬ রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা বিরােধীদের পুনর্বাসিত করা হয়।

৬৪ , নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সশস্ত্রবাহিনীর পােশাক পরা সম্পর্কে জেনারেল ওসমানী এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিটি নিম্নরূপ ও প্রেসিডেন্ট জিয়া সশস্ত্র বাহিনীর পােষাক পরতে পারেন না বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রাক্তন প্রধান সেনাপতি ও বর্তমানে জাতীয় জনতা পাটির প্রধান অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এম, এ, জি, ওসমানী এক বিবৃতিতে বলেছেন যে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি রূপে সশস্ত্র বাহিনীর পােশাক পরতে পারেন না। তিনি সশস্ত্র বাহিনীর বহুকাল হতে প্রচলিত বিধি ও ঐতিহ্য এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের রীতি অনুসারে একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সশস্ত্র । বাহিনীর পােশাক পরতে পারেন না। পােশাক পরিধান নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র বাহিনীর বিধি অনুসারে একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার বিধিতে সুনির্দিষ্ট উপলক্ষ্যে তার চাকুরিতে থাকাকালীন বাহিনীর পােষাক পরতে পারেন। তবে ইহা একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার যিনি একটা নির্বাচিত বেসামরিক পদে কাজ করছেন তার। বেলায় প্রযােজ্য নয়। এবং একজন অবসরপাপ্ত অফিসার আর এক বাহিনীর পােষাক পরতে পারেন না। নির্বাচিত বেসামরিক পদে নিযুক্ত থাকাকালীন তিনি সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিক উপলক্ষে বেসামরিক পরিচ্ছদের উপর সশস্ত্র বাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় অর্জিত ‘মেড্যাল’ বা পদক অবশ্যই পরতে পারেন। উদাহরণ স্বরূপ উপরােক্ত বিধি ও রীতি অনুসরণেই জেনারেল আইজেন হাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সশস্ত্র বাহিনীর কোন আনুষ্ঠানিক বা অন্য কোন উপলক্ষে সশস্ত্র বাহিনীর পােশাক কোন দিন পরেন নাই। অতএব, সশস্ত্র বাহিনীর জন্য একটা আইন লংঘনের অন্যায় উদাহরণ সৃষ্টি না করে রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন অবস্থায় সশস্ত্র বাহিনীর পােষাক পরা বন্ধ করা উচিত অথবা নিজেকে একজন নির্বাচিত ও বেসামরিক রাষ্ট্রপতিরূপে প্রতারণা করা বন্ধ করা উচিত।”

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ’৭৯

৬৫. ১৮ ফেব্রুয়ারী দেশের পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। ৩,৮৪, ১৬,৫৯৪ জন ভােটারের মধ্যে ১,৯১,০৬,১২৫ জন ভােটার অর্থাৎ শতকরা ৪৯.৭৩ জন ভােটার এই নির্বাচনে তাদের ভােটাধিকার প্রয়ােগ করেছেন। এবং প্রদত্ত ভােটের শতকরা ৪১ থেকে ৪৩ ভাগ ভােট পেয়ে সরকারী দল বিএনপি ৩০০টি আসনের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ভােটের শতকরা ২৮ থেকে ৩০ ভাগ ভােট পেয়ে ৪০টি আসনে বিজয়ী হয়েছে। অন্য দলের মধ্যে মুসলিম লীগ-আই,ডি,এল ১০টি, জাসদ ৯টি, আওয়ামী লীগ (মিজান) ২টি, ন্যাপ (মােঃ) ১টি, জাতীয় একতা পার্টি ১টি, এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৭টি আসনে জয়লাভ করেছে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ১৭টি রাজনৈতিক দল আদৌ

কোনাে আসন লাভে সক্ষম হয়নি।

৬৬. নির্বাচনী রায়ে জনমতের যে প্রতিফলন ঘটেছে তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যারা নির্বাচনী রাজনীতিতে আদৌ বিশ্বাস করেন না অথচ আগে ভাগেই নির্বাচন নিয়ে চক্রান্ত করেছে এবং যেসব দল সরকারী সমর্থনে গড়ে উঠেছিলাে তার অধিকাংশ দলকেই সচেতন নির্বাচকমন্ডলী প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর যে দলগুলাের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট জিয়া নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তেও সােচ্চার ছিলেন সেই দলগুলােই তুলনামূলকবাবে ভালাে করেছে। আওয়ামী লীগ এবং জাসদের নির্বাচনী ফলাফল এই সত্যেরই প্রমাণ বহন করে।

৬৭. প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং তার সরকারের মন্ত্রীরা বিগত ৩ বছর যাবৎ আওয়ামী বাকশাল’-বিরােধী চিৎকার করা সত্ত্বেও নির্বাচনে বাকশালপন্থী আওয়ামী লীগ দেশের দ্বিতীয় জনপ্রিয় পার্টিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। অবশ্য দলপ্রধান জনাব আবদুর মালেক উকিল দু’টি নির্বাচনী এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, কিন্তু একটিতেও জয়লাভ করতে পারেননি।

৬৮, আওয়ামী-বাকশাল বিরােধিতার কারণে প্রেসিডেন্ট জিয়ার জনপ্রিয় ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে বলে যারা বিশ্বাস করতেন, তারা নিশ্চয়ই পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফল দেখে উপলব্ধি করেছেন যে, প্রেসিডেন্ট জিয়ার জনপ্রিয়তা ঘাটতির পথে। নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষ হয়নি, বিরােধী দলের কর্মীদের ভয়-ভীতি দেখানাে হয়েছে। নির্বাচন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বিজয়ী প্রার্থী এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বির ভােটের ব্যবধান খুবই সামান্য। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে দু’চার শ’ বা হাজার ভােটের ব্যবধানে বিএনপি প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। এছাড়াও প্রেসিডেন্ট জিয়া নির্বাচনের পূর্বে যে জাসদকে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীর সৃষ্ট দল বলে চিহ্নিত করেছিলেন সেই জাসদও জাতীয় সংসদে ৯টি আসন লাভ করেছে। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে জিয়ার আক্রমণ ছিলাে অত্যন্ত চড়া গলায়, উচ্চ মার্গে।

৬৯. রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিমাত্রেই লক্ষ্য করেছেন বিরােধী দল কি অবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলাে। অতীতের কীর্তি-অপকীর্তির কথা বাদ দিলেও বিরােধী দলগুলাে নির্বচনের প্রাক্কালে যে অসংগতিপূর্ণ কথা ও কাজের এবং দলভাঙাভাঙির নজির স্থাপন করেছিলাে; তাতে দেশবাসী বিরােধী দলীয় প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করলেও বিস্ময়ের কিছু ছিলাে না। বিরােধী দলের সুবিধাবাদী রাজনীতির কারণে অনেক বিএনপি প্রার্থী নির্বাচনে জয়ী হতে পেরেছেন। পরিকল্পিত ব্লু-প্রিন্টের বিজয় %, জাতীয় সংসদের নির্বাচনী ফলাফল ঘােষিত হওয়ার পর বিএনপি এবারের। নির্বাচনকে যেভাবেই চিহ্নিত করুক না কেন বিএনপির এ বিজয় পূর্ব-পরিকল্পিত র- প্রিন্টের হুবহু বাস্তবায়ন। সরকারী দল কয়েকটি জায়গায় তাদের নির্বাচনী বিজয় নিয়ে বেশ বেকায়দায় গিলতেও পারছে না, ফেলতেও পারছে না। জামালপুর-৫ নির্বাচনী এলাকার ঘটনাটি। ১৮ই ও ১৯শে ফেব্রুয়ারী—এই দু’দিনের নির্বাচনী ফলাফল ঘােষণায় বিজয়ী বলে বেসরকারীভাবে উল্লেখ করা । হয়েছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মেজর জেনারেল (অবঃ) খলিলুর রহমানের নাম। কিন্তু। এরপর হঠাৎ জেনারেল (অবঃ) খলিল বা তার মনােনীত এজেন্টের সম্মতি ও অংশগ্রহণ ছাড়াই বিধান বহির্ভূতভাবে ঐ এলাকার ভােট পুনর্গণনা হয়। পূর্বেই বুপ্রিন্ট অনুসাবে ঐ আসনে জেনারেল (অবঃ) খলিলের বদলে বিএনপি প্রার্থীকে নির্বাচিত বলে ঘােষণা করা হয়। জেনারেল (অবঃ) খলিলুর রহমান এক সাংবাদিক সম্মেলনে গােটা বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। এই ব্যাখ্যার বিপক্ষে বিএনপি পাথরের মত নিশ্রুপ, একটা কথাও বলেনি। ভাবখানা এই যে কাজ হয়ে গেছে, কথা বলে। লাভ কি। বিএনপির নির্বাচনী ক্রেডিবিলিটি বা বিশ্বাসযােগ্যতা গুরুতরভাবে বিপদের সম্মুখীন আরাে একটি জায়গায়, নােয়াখালী-৫ আসনে; সেখানে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন আওয়ামী লীগ প্রধান আবদুল মালেক উকিল এবং বিএনপি প্রার্থী ডাক ও তারমন্ত্রী জনাব মওদুদ আহমদ। এই আসনে মন্ত্রী মওদুদ পেয়েছেন ৪৮ হাজার ৩০২ ভােট এবং প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল মালেক উকিল পেয়েছেন ৯ হাজার ১৪২ ভােট। জনাব আবদুল মালেক উকিলের জামানতও খােয়া গেছে।

মওদুদের বিজয় ও মালেক উকিলের পরাজয় পর্যবেক্ষক মহলে দারুণ বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। তরুণ ডাক ও তারমন্ত্রী যে তার এলাকায় জনগণের এতােখানি ‘প্রিয়’ এবং আওয়ামী লীগের মতাে বিশাল এক রাজনৈতিক সংগঠনের প্রধান প্রবীণ জননেতা জনাব আবদুল মালেক উকিল যে এতােখানি ‘গণনিন্দিত’ ও ‘প্রত্যাখ্যাত’, তা দেশবাসী পূর্বে অনুমান করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ জনাব মওদুদের এই বিজয়কে কারচুপি, দুর্নীতি ও পেশীবলের বিজয় বলে অভিহিত করেছে। বিএনপি ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রায় সব দলই উল্লেখিত প্রবীণ রাজনীতিবিদ জনাব আবদুল মালেক উকিলের হেরে যাওয়াকে ‘পূর্বপরিকল্পিত ব্লু-প্রিন্টের বাস্তবায়ন বলে মন্তব্য রেখেছে। যেমন ইউপিপি’র রাশেদ খান মেনন আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব আবদুল মালেক উকিলের পরাজয় সম্পর্কে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বরেন, “আমি জনাব মালেক উকিলের বিবৃতি দেখেছি এবং সেগুলাে সত্য বলেই মনে হয়।” অবশ্য এ ব্যাপারে মুসলিম লীগ নেতা কাজী কাদেরের বক্তব্যটি স্পষ্ট। তিনি এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিএনপি’র ব্যাপক দুর্নীতির কথা বলতে গিয়ে এক জায়গায় মন্তব্য করেন, “জনাব মালেক উকিলের সাথে আমার মতপার্থক্য থাকতে পারে। তিনি ফেল করেননি। তাঁকে ফেল করানাে হয়েছে। প্রবীণ রাজনীতিবিদ মালেক

উকিল ‘চ্যারিটি বয়’ মওদুদ আহমদের কাছে হেরে যাবেন, তা বিশ্বাস করা যায় ।” যদি মার্শাল ল’ না থাকতাে, যদি নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকার পদত্যাগ। করতেন, যদি প্রশাসনকে রাজনীতির বাইরে রাখার ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হতাে, তাহলে বিএনপি শতকরা ১০টি আসন পেতাে কিনা এনিয়ে গণমনে সন্দেহ ছিলাে এবং এখনাে আছে।৪৭

৭১. বহু নির্বাচনী এলাকার ফলাফল বিশ্লেষণ করা যায়, এসব ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জয়লাভ নিশ্চিত ছিল। আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, জাসদ বা ইউপিপি জানতাে দেশে মার্শাল ‘ল যেখানে বহাল, প্রধান সামরিক শাসক একই সাথে দেশের প্রেসিডেন্ট এবং বিএনপি’র চেয়ারম্যান, যেখানে অর্থ ও প্রশাসন ক্ষমতাসীন। সরকারের হাতের মুঠোয়, সেখানে নির্বাচনের ফলাফল নিরপেক্ষ হতে পারেনা। পার্লামেন্ট নির্বাচনঃ সেনা বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যগণের হুমকি

৭২. ইসলামী ডেমােক্রেটিক লীগের চেয়ারম্যান মওলানা আবদুর রহিম সাংবাদিক। সম্মেলনে বলেন, বগুড়া ২ আসনে সেনাবাহিনীর পােশাক পরিহিত সশস্ত্র লােকজনসহ ঘরে ঘরে গ্রামে-গ্রামে ধানের শীষে ভােট না দিলে পরিণতি খারাপ হবে বলে হুমকি দেয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রিসািইডিং অফিসারদের নিজ গ্রামের ভােট কেন্দ্রে নিয়ােগ করা হয়। নির্বাচনের দিন প্রার্থী নিজে ভােটারসহ ভােট। কেন্দ্রে পােলিং বুথে ঢুকে নিজে হাতে ব্যালট পেপারে সিল মারেন। নির্বাচনের একদিন পূর্বে খালিশপুর শিল্প এলাকার শ্রমিক ৫,০০০ টাকা করে এডভ্যান্স দেওয়া হয়। শ্রমিকদের মতে, এটা ইলেকশনের ফি। বিএনপি প্রার্থীকে ভােট দেওয়ার ঘুষমাত্র।৪৮

জিয়ার প্রাসাদ চক্রান্তের বিজয়

৭৩, পূর্বশর্ত পূরণের শর্তে নির্বাচন বর্জন করার জন্য আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ। | (মিজান) সহ বিরােধী দল যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাে এবং দাবী দওয়া আদায়ের। জন্য দেশব্যাপী দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তােলার লক্ষ্যে সংগ্রামের প্রাথমিক । কর্মসূচী ও দাবী সপ্তাহ ঘােষণা করেছিলাে এবং কর্মসূচী মােতাবেক জনসভা, জনসংযােগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাে। এতে জিয়া প্রমাদ গুণতে থাকেন। জিয়াউর রহমান ও তার গােয়েন্দা বাহিনীর চেষ্টায় জনগণের আশা আকাঙক্ষার। পিঠে ছুরিকাঘাত করে দশ দলের পাঁচ দল, মিজান চৌধুরীর আওয়ামীলীগ ও মস্কো

পন্থী কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ (মােজাফফর) নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার নিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। জিয়ার প্রাসাদ চক্রান্ত জয়ী হয়। ৪৯

মিজান লীগের জন্ম রহস্য

৭৪. মিজান আওয়ামী লীগ-এর জন্মই রহস্যময়। বঙ্গভবনে ক্ষমতার উচ্চস্তরে সলাপরামর্শের পরে এই দলটি ভূমিষ্ট হয়। প্রাসাদ রাজনীতির ব্লু-প্রিন্ট মােতাবেক শক্তিধর ব্যক্তির সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা এবং এক পর্যায়ে পরিকল্পনা মােতাবেক একদিনে দুটি কাজ সম্পূর্ণ করা হয়। একদিকে অস্ত্র উদ্ধরের নামে সারাদেশব্যাপী আওয়ামী লীগ কর্মীদের বাড়ি বাড়ি যখন পুলিশী তল্লাশ হয়রানী, গ্রেফতার চলছে তখন একই দিন এক সাংবাদিক সম্মেলনে জনাব মিজান চৌধুরী আওয়ামী লীগের বিভক্তির কথা ঘােষণা করেন। মিজান লীগের জন্মই ষড়যন্তের এই কুটিলঅন্ধকারে ঢাকা।৫০)

৭৫. জন্মের পর হতেই দলটি একটি স্ববিরােধী ভূমিকা গ্রহণ করে। জিয়ার ব্লু-প্রিন্ট

অনুযায়ী বাকশাল বিরােধীতা করে, অন্য দিকে আবার গণতান্তিক বঙ্গবন্ধুসােহরাওয়ার্দী আওয়ামীলীগের কথায় সােচ্চার হয়ে থাকে। এক দিকে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের প্রবক্তা, অন্যদিকে জিয়ার প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারকে স্বীকার করে নেয়। বিরােধী দল নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিলে মিজান লীগ বেকায়দায় পরে। জিয়া শাহীর বিরােধীতার ভান করলেও আসলে সরকার বিপদে পড়ুক এটা তাদের কাম্য ছিল না। উল্লেখ্য যে, মিজান চৌধুরী সহ অন্যান্য প্রভাবশালী নেতা সর্ব জনাব শামসুল হক, অধ্যাপক ইউসফ, নূরে আল সিদ্দিকী, ময়েজ উদ্দিন, আবদুস সুলতান, আবদুর রউফ প্রমুখ একাধিকবার আতাউর রহমানের দশ দলের বৈঠকে উপস্থিত হয়েছেন, নির্বাচন বর্জনের কথা জোরেশােরে বলেছেন। মিজান লীগের নেতৃবৃন্দ রাত তিনটা পর্যন্ত ক্ষমতাশীন মহলের সঙ্গে পরামর্শ করেন, ঐ গােপন সলাপরামর্শ মােতাবেক মিজানুর রহমান চৌধুরী তাড়াহুড়া করে এক সাংবাদিক সম্মেলন করেন। এবং বিরােধী দলগুলিকে আর একবার আলােচনা বৈঠকে ডাকবার জন্য সরকারের কাছে অনুরােধ জানান।

কোটি টাকার ওভার ড্রাফটের জনসভা

৭৬. স্বীয় অপকীর্তির কারনে মুজিব আমলে কি ভাবে মিজান চৌধুরী উপেক্ষিত হয়েছেন বায়তুল মােকারমে অনুষ্ঠিত দলীয় জনসভা মিজান চৌধুরী তাকে বাকশাল

বিরােধীচার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ঐ সময়ে তিনি রাজনীতি ছেড়ে ব্যবসায় নামলেন। ঔষধ কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু মুজিব সরকার সুযােগ-সুবিধা দেয়নি। সুযােগ-সুবিধা দিয়াছে জিয়াউর রহমান। কোটি টাকার ওভার ড্রাফট মঞ্জুর হয়েছে। নির্বাচন বর্জনের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে আয়ােজিত জনসভায় জিয়া সরকারকে সুন্দর সার্টিফিকেট প্রদান করেন। আওয়ামী লীগ মিজান এর উক্ত জনসভা ওভার ড্রাফট এর জনসভা। মিজান চৌধুরী। নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করলে আওয়ামী লীগ বিপদে পরে। নির্বাচনে অংশ গ্রহণ ব্যতীত আওয়ামীলীগের যে উপায় থাকবে সে হিসেবে জিয়ার মাথায় ছিলাে।

জাসদের হট লাইন

পি পি আর অধীনে জাসদের লাইসেন্স প্রাপ্তিদের পিছনে ডাক তার মন্ত্রী জনাব মওদুদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ১৯৭৭ সনের ১৪ই অক্টোবর ব্যর্থ অভ্যুথানের পর জিয়াউর রহমান তিনটি দলকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। এই তিনটি দল হচ্ছে ডেমােক্রেটিক লীগ, বাংলাদেশের কমুনিষ্ট পার্টি ও জাসদ। ১৮ই নভেম্বর ‘৭৮ সরকার পি পি আর প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে দলগুলির উপর আরােপিত নিষেধ প্রত্যাহৃত হয়। কিন্তু যখন কমুনিষ্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিলাে তখনও জাসদ রহস্যজনকভাবে রাজনীতির অনুমতি পায়। নির্বাচন বয়কট প্রেসিডেন্ট জিয়ার জিংহাসনই ধ্বসে যেতে পারে সে কারণে জনাব মওদুদ জাসদের উপর চাপ ও লােভনীয় টোপ ফেলেন। এই সমস্ত টোপের মধ্যে রয়েছে জনাব আ, স, ম, আবদুর রব এর মুক্তি ও চিকিৎসার জন সরকারী সাহায্যে বিদেশে প্রেরণ এবং অন্যান্য নেতা কর্মীদের মুক্তি।

জিয়ার রাজনীতিতে কোটি টাকার খেলা

৭৭. জিয়াউর রহমান দেশে কোটি টাকার রাজনীতি চালু করেছেন। একই সঙ্গে আইয়ুব • খানের পথ ধরেছেন রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র হননে। তার চক্রান্ত্রের খেলায় জাতীয় উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, নীতি ও আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা দলগুলি ও তার নেতাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে চলেছেন। একই সাথে কালাে টাকা ছড়িয়ে রাজনীতিকে পণ্য হিসেবে কেনাবেচার সামগ্রীতে পরিণত করেছেন। মুসলিম লীগ প্রধান খান সবুরের বিরুদ্ধে এক কোটি টাকা পাওয়া এবং তা ভাগাভাগির ব্যাপারে অভিযােগ উঠে। এই অভিযােগ উত্থাপন করেছে তার

দলেরই সদস্য জনাব শারাফত হােসেন চৌধুরী। তিনি মুসলিম লীগের কার্যনির্বাহী। পরিষদের সদস্য। গত ১৩ই জানুয়ারী তার একটি বিবৃতি স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে তিনি বলেন আসন্ন নির্বাচনে মুসলীম লীগের পক্ষ থেকে সর্বসম্মতিক্রমে মনােনীত কয়েকজনের নাম আকস্মিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি ফরিদপুর-১১ আসন হতে গত ৬ই জানুয়ারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে টাকা জমা দেই। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আমার নমিনেশন প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই সংবাদে আমার অবাক হওয়ার কথা ছিলাে। কিন্তু তা হইনি। জনাব খান এ সবুরের অগণতান্ত্রিক ও খামখেয়ালী সিদ্ধান্ত আমাকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছে প্রাণপ্রিয় মুসলীম লীগের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। খান এ সবুর মুসলীম লীগকে পকেট লীগ করতে সচেষ্ট। এ দেশের রাজনীতিতে জনাব খান এ সবুর একজন গণধিকৃত ও ডিগবাজী বিশারদ ব্যক্তি একথা কার না জানা। এই স্বেচ্ছাচারী কপট রাজনীতিবিদের হাত হতে মুসলীম লীগকে রক্ষা করা এবং পার্টি প্রধানের পদ হতে জনাব সবুরকে সরিয়ে দেয়া আশু কর্তব্য হয়ে পড়েছে। তাহা ছাড়া ইতিমধ্যে আলাউদ্দিনের প্রদীপের মত এক কোটি টাকা যে কোন তরফ হতে মুসলীম লীগ সংগঠনের নামে যােগাড় করা হয়েছে, তার ভাগাভাগি রেটে আমাদের ন্যায্য প্রাপ্য তাও আমরা বুঝে পেতে চাই ।৫২ টাকার ব্যাপারটি গুরুতর অভিযােগ। কিন্তু এ সম্পর্কে খান এ সবুর মুখ খুলেন নি। যেহেতু জনাব সবুর এ সম্পর্কে একেবারে নীরব সেহেতু তা অনেক কথারই জন্ম দিয়েছে। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথা হতে আসলাে। শারাফত চৌধুরীর ‘আলাউদ্দিনের প্রদীপের মতাে” এবং “যে কোন তরফ হতে” এবং এই তরফ তা কি তা দেশবাসীর জানার কথা। জিয়াউর রহমান পি পি আর এর মাধ্যমে দলীয় তহবিলের উৎস সম্পর্কে যে শর্ত আরােপ করেছিলেন, সামরিক সরকারের প্রধান হয়ে সেই জিয়াউর রহমানও একেবারেই নীরব। প্রথমে নির্বাচন বর্জন এবং পরে ঐ বর্জনের সিদ্ধান্ত বাতিল করে জনাব খান সবুরের নির্বাচনে অংশ গ্রহণের ঘােষণার সঙ্গে ঐ এক কোটি টাকার যােগসূত্র আছে। প্রকৃত প্রস্তাবে জিয়াউর রহমানই এই টাকা দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন।

সুবিধাবাদের রাজনীতি ও জিয়া নিজেই টাকা গুনেছেন

৭৮. জিয়ার আমলে বাংলাদেশে সুবিধাবাদের রাজনীতি চালু হয়েছে। এক ব্যক্তি একদল-ধরনের রাজনীতিক যারা আছেন সুযােগ-সুবিধার আদায়ে তারা তড়িঘড়ি করে জিয়ার দলে ঢুকে পরছেন। এই সুযােগ-সুবিধা, লাইসেন্স পারমিট, নগদ অর্থ

এবং বিবিধ ধরনের। জিয়া দু’হাতে সুবিধা বিতরণ করে চলেছেন। তার উদার চিত্ত ও উন্মুক্তদ্বার হতে কেউ বিফল হয়ে ফিরে আসছেন না। জিয়া পূর্ব হতেই টাকা “গােনায় অভ্যস্ত। জিয়া নিজেই স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলদেশ সরকারের নিকট হতে বেতন ভাতা নিয়েছেন অন্য দিকে ঐ সময়েই ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তাদের নিকট হতেও টাকা গুনেছেন। বিগত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচারাভিযানের অন্যতম প্রার্থী জেনারেল ওসমানী তার প্রতিদ্বন্দ্বী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ভারতে থাকাকালীন সময়ে (১৯৭১ সালে) ব্রিগেডিয়ার পান্ডের দফতরে টাকা গুণবার অভিযােগ আনেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানের পক্ষ হতে তার কোন সদুত্তর পাওয়া যায় নি। ৫৩

জিয়ার মিথ্যাচার

আওয়ামী লীগ বাকশালীদের সম্পত্তির হিসেব নিকাশের আদেশ জারী করে প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে জানে মেরে ফেলার এটে ছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া আওয়ামী-বাকশালীদের ‘বিদেশের গােলামীর রাজনীতি’ ‘হত্যার রাজনীতি’, ‘দুর্নীতির রাজনীতি’, ‘গণতন্ত্র হত্যার’ ও স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার রাজনীতির অন্তহীন অভিযােগ নিয়ে মাঠ গরম করেছিলেন। কিন্তু এসব অভিযােগের একটিও প্রমাণ করতে পারেন নি। সব চেয়ে দুর্নীতিবাজ বলে প্রচারিত গাজী গােলাম মােস্তফার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সাতটি কেসের একটিও প্রমাণিত হয়নি। তার পরেও জিয়া এসব মিথ্যাচার থেকে কোন সময়ই ক্ষান্ত হননি।

আওয়ামী-বাকশালীরা স্বাধীনতা চায়নিঃ জিয়া

৭৯. জিয়ার কণ্ঠে আওয়ামী বাকশালীদের বিরুদ্ধে অভিযােগের অন্ত নেই। প্রেসিডেন্ট

জিয়া বিগত ৩০শে মে পল্টন ময়দানে জনসভায় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেন যে, আওয়ামী-বাকশালীরা কোনদিন স্বাধীনতা চায়নি। তারা চেয়েছিলাে পরাধীনতা। আরাে এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে তিনি বললেন ও আওয়ামী-বাকশালীরা আজও স্বাধীনতা নস্যাতের চেষ্টা করছে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার এই উক্তির অর্থ এই যে, আওয়ামী-বাকশালীরা অতীতে স্বাধীনতা চায় নি, এখনও তারা স্বাধীনতা বিপন্নের চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার দুশমন, বিদেশের এজেন্ট, রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশদ্রোহী। প্রেসিডেন্ট জিয়া যখন আওয়ামী-বাকশালীদের বিরুদ্ধে এই গুরুতর অভিযােগ উত্থাপন করেন তখন দেশে চালু আছে পূর্ণ সামরিক শাসন। প্রেসিডেন্ট জিয়া এই সরকারের প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক স্টান্ট বাজির জন্য এসব কথা বলা হচ্ছে। জিয়া ভালাে করেই জানেন, আওয়ামী লীগের অধীনে স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি ছিলেন

কেবলমাত্র একজন সেক্টর কমান্ডার। আওয়ামী লীগের সরকারের অধীনে সাড়ে তিন বছর শুধু চাকুরী করেননি-তােয়াজ করে চলেছেন, এমনকি বাকশালকে সমর্থন জানিয়েছেন, বাকশাল সদস্য হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ী দৌড়িয়েছেন। বাকশাল গভর্ণর ডেজিগনেটদের শুভেচ্ছাপত্র পাঠিয়েছেন। [পরিশিষ্ট-৯) সেই জিয়ার মুখে আওয়ামী-বাকশালীদের সম্পর্কে এমন বেপরােয়া উক্তি সত্যের মাপকাঠিতে আদৌও টিকে না।

হত্যাকারীরা কোথায়?

৮০, ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্টের পর হতে বিগত ৩ বছর ধরে বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় হতে প্রেসিডেন্ট জিয়ার তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা আওয়ামী বাকশালীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী হত্যার অভিযােগ এনে বাংলাদেশের মাঠ ময়দান সংবাদপত্রে। প্রেসিডেন্ট জিয়া আওয়ামী-বাকশালীদের বিরুদ্ধে বিশ ত্রিশ হাজার ব্যক্তিকে হত্যা গুম ও খুনের লােমহর্ষক অভিযােগ এনেছেন, পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী কর্ণেল আকবর হােসেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বে বায়তুল মােকারমে দু’টি জনসভায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে ঠান্ডা মাথায় হত্যার অভিযােগ আনেন। অথচ বামপন্থী সর্বহারা পার্টি বলছে মুজিব আমলে ১১৬ জন সশস্ত্র ক্যাডার সংঘর্ষে নিহত হয়। ৫৪

দশ হাজার অস্ত্র গেলাে কোথায়?

৮১. শুধু তাই নয়, তিনি এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে আরও অভিযােগ করেন যে বিরােধী রাজনৈতিক শক্তিকে খতম করার জন্য স্পেশাল ব্রাঞ্চ দশ হাজার অস্ত্র আওয়ামী লীগ কর্মীদের মাঝে বিতরণ করেছে। সেই দশ হাজার অস্ত্র গেলাে কোথায়? তা উদ্ধার হয়েছে? না হয়ে থাকলে কাদের নিকট অস্ত্র তাদের নাম ঠিকানা পরিচয় কি? আর বাইশ হাজার লােককে খুন করেছে, যারা সেই ঘাতকরা আজ কোথায়? প্রকৃত প্রস্তাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনের সামনে এসব মিথ্যা অভিযােগের মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজার আওয়ামী লীগ কর্মী। নেতাকে গ্রেফতার করার ও পুলিশী হয়রানির এটি ছিলাে কৌশল। এবং জনগণকে বিভ্রান্ত হাতিয়ার মাত্র।

আওয়ামী-বাকশালীদের সম্পত্তির হিসাবের ফলাফল

৮২. সামরিক ফরমান বলে ঘােষিত ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর হতে ১৯৭৫ সালের • ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার,প্রধানমন্ত্রী, এমপিসহ যে সমস্ত ব্যক্তি অফিস অব প্রফিট হােন্ড করেছেন সেই সমস্ত ব্যক্তি ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর হতে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত অর্জিত অর্থ ও সম্পত্তির হিসাব ও সম্পত্তির অর্জনের উৎস সম্পর্কে সরকারের নিকট নির্ধারিত ফরমে জমা দিয়েছে। ১৬ই ডিসেম্বরের আগে ও পরে ১৯৭৫ সালের ১৪ই আগস্ট পর্যন্ত সময়ে কি সম্পত্তি ছিল এবং নতুন করে কার সম্পদ, সম্পত্তি হয়েছে তার তুলনামূলক হিসাবও দেওয়া হয়েছে। হিসাব দাখিলের শেষ তারিখ ছিল ১৯৭৮ বছরের ৩১শে মে। তাহার পরে আট মাস অতিক্রান্ত। দুই একজন ছাড়া সমস্ত আওয়ামী নেতারাই সম্পত্তির হিসাব দাখিল করেছেন।

প্রেসিডেন্ট সম্পত্তির হিসেব মেনে নিয়েছেন

৮৩. প্রেসিডেন্ট আওয়ামীদের ঐ হিসাবে মেনে নিয়েছেন। কেননা, ঐ রাষ্ট্রীয় ফরমানে বলা হয়েছে যে, যাদের হিসাবে গরমিল থাকার অথবা সম্পদের উৎসের সহিত প্রকৃত আয়ের গরমিল থাকবে তাদিগকে আগামী বছরের জন্য কোন প্রকার নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অযােগ্য বলে ঘােষণা করা হবে। সম্পত্তির হিসাব জনিত কারণে আওয়ামী লীগের কোন এমপি বা মন্ত্রীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাপারে অযােগ্য ঘােষণা করা হয়নি। পক্ষান্তরে, আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যক পুরাতন এম,সিএ ও এমপি আসন্ন সংবাদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কেননা তাদের বিরুদ্ধে জিয়া সরকার শত চেষ্টা করেও কোন অভিযোেগ দাড় করাতে পারেননি।

প্রধান মুক্তি পেলেন কিন্তু সাথীরা

৮৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের কোহিনূরসহ ৭ জন ছাত্রকে হত্যার অপরাধে ছাত্রলীগের এককালীন প্রেসিডেন্ট সফিউল আলম প্রধানসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রের দীর্ঘ মেয়াদী কারাদন্ড হয়। অভিযুক্তরা ঐ হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছিলাে। কিন্তু এই হত্যাকান্ডের প্রধান আসামী জনাব সফিউল আলম প্রধান। অন্যরা ছিলাে তার সহযােগী। সেই সফিউল আলম প্রধানকে গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বে হঠাৎ করে মুক্তি দেওয়া হলাে কিভাবে? দেশবাসী তা জানতে পারেনি। সাজা কি মওকুফ বা মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে, না কি ক্ষমা প্রার্থনার প্রেক্ষিতে মুক্তি দেয়া হয়েছে? খুনের মামলার প্রধান আসামীকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আইনের হাতে ন্যায় বিচারের জন্য গ্রেফতার করেছিলাে। কারাগারে পাঠিয়ে ছিলাে এবং মামলা রুজু করেছিলাে। সাজা দিয়েছিলাে। কিন্তু জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক স্বার্থে তাকে ব্যবহার করার লক্ষ্যে সাত খুনের মামলার আসামী মুক্তি পায় জিয়ার নির্দেশে। কেননা রতনে রতন চেনে।

সূত্র : জেনারেল জিয়ার  রাজত্ব  – অধ্যাপক আবু সাইদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!