You dont have javascript enabled! Please enable it!

আমি সৈনিক ও রাজনীতিবিদ নই আমি ব্যারাকে ফিরে যাবাে

১. রাত ১২-১মিনিট। ১৯৭৬ সনের ঐতিহাসিক ২১শে ফেব্রুয়ারী। দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ। চারদিকে উদ্যত সঙ্গীণ। টিভি রেডিও-তে প্রায় প্রত্যহ প্রচার হচ্ছে সামরিক এলান। কেউ সামরিক প্রশাসক ও সামরিক শাসন সম্পর্কে কথা বললে বা আকারে ইংগিতে এর বিরুদ্ধাচারণ রাখলেও যাবজ্জীবন কারাদন্ড, এমনকি মুত্যুদন্ড। রাত দশটা থেকে ভাের পর্যন্ত কার্য্য। রাতের ঢাকা নীরব। নিশ্রুপ। থির। এই অবস্থার মধ্যে রাতের অন্ধকার ছেদ করে এগিয়ে এলাে ট্রাক-শ্রমিকের মিছিল। চীনপন্থী নেতা কাজী জাফর এদের নিয়ে এসেছেন টঙ্গীর শিল্প এলাকা হতে। মুখে তাদের শ্লোগান জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ। একুশে ফেব্রুয়ারী অমর হােক।’ শহীদ মিনারের কাছাকাছি আসতেই ওয়াকোটকিতে সংবাদ চলে গেলাে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়ার নিকট। জিয়া হাসলেন। মৃদু। সাফারী স্যুট ঠিক করে নিলেন। তারপর সামরিক প্রহরায় বের হলেন সদর্পে। শহীদ মিনারে পৌছলেন। দাড়ালেন। চারদিকে তাকালেন। তখন শ্লোগান চলছে ‘জেনারেল জিয়া, জিন্দাবাদ’। মালা হাতে এগিয়ে গেলেন। শহীদ মিনারের বেদীতে দাঁড়ালেন। আগত শ্রমিকদের মাঝে গিয়ে তাদের নিয়ে মালা প্রদান করলেন।

২. ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা। জনাব মতিউর রহমানের বাসা। একুশে ফেব্রুয়ারী উদ্যাপন উপলক্ষ্যে এক বৈঠক। বৈঠকে ২১শে ফেব্রুয়ারী মহান শহীদ দিবস : উদ্যাপন সম্পর্কে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। মহান শহীদদের প্রতি বাঙালী জাতির পক্ষ হতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ দিবস উদযাপন কমিটি গঠন করার প্রস্তাব উত্থাপন হয়। দেশের সাংস্কৃতিসেবী, বুদ্ধিজীবী ও বরণ্যে ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয় ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। এই কমিটির কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করা হয়। কমিটির প্রায় সকলের বিরুদ্ধে জারী করা হয় গ্রেফতারী পরােয়ানা। জেনারেল আইয়ুব খানের আমলেও কড়া সামরিক শাসনের মধ্যেও ২১শে ফেব্রুয়ারী মহান ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে এরূপ গ্রেফতার ও কড়াকড়ি আরােপ করা হয়নি। জেনারেল জিয়ার আমলে কেন্দ্রীয় শহীদ দিবস উদযাপন কমিটিকে কাজ করতে দেয়া হলাে না। নেতাদের গ্রেফতার করা হলাে। জারী হলাে গ্রেফতারী পরােয়ানা। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিলাে তারা শহীদ দিবস উদযাপনের নামে সমগ্র বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য উস্কানী দিচ্ছে।

৩. এ বিষয়ে পরবর্তীকালে হাইকোর্টে এক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘১৯৭৬ সনের ২১ শে ফেব্রুয়ারী শ্রমিকদের আইন শৃংখলা অবনতিতে কোন উস্কানী প্রদান করার সুযােগ ছিলােনা।২ মেজর জেনারেল জিয়া নিজে শ্রমিকদের নিয়ে এসে তাদের শ্লোগানের মধ্যে শহীদ মিনারে মালা দিয়েছেন। অন্যদের করেছেন গ্রেফতার। বলা হলাে ও সাবেক মন্ত্রী জনাব মতিউর রহমান, খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস এবং জনাব নূরুল ইসলামকে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বলে গ্রেফতার করা হয়েছে। শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির বরাত দিযে বাসস একথা জানায়। এরা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও জন নিরাপত্তার প্রতি ক্ষতিকর তৎপরতায় লিপ্ত ছিলাে। এভাবে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের রাজনীতি আগমনের দ্বৈত কৌশল!

৪. প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম বিচারপতি সাত্তারকে প্রতিশ্রুতি মােতাবেক দেশে সাধারণ নির্বাচন (পার্লামেন্ট) অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, দলগঠন ও তৎপরতা চালানাের সহায়তা করার লক্ষ্যে উপদেষ্টার মর্যাদায় বিশেষ সহকারী নিযুক্ত করেন। বিচারপতি আবদুস সাত্তার নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে আন্তরিক ছিলেন না-যদিও প্রেসিডেন্ট সায়েম তাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করে এ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু বিচারপতি সাত্তার পেসিডেন্ট সায়েম কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করেন নি। তিনি জেনারেল জিয়া ও তার সহযােগী সামরিক জান্তার চক্রান্তে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করার পূর্বে এবং এ বিষয়ে সামরিক ফরমান জারী করার পূর্বেই নির্বাচন স্থগিত করার চক্রান্তের রপ্রিন্ট অনুযায়ী দেশের স্বাধীনতা বিরােধী দলসমূহের এবং চৈনিক পন্থী দলসমূহের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন। নিরপেক্ষতা দেখানাের জন্য মাঝে মধ্যে এসব বৈঠকে আওয়ামীলীগের কোন কোন নেতৃবৃন্দকেও ডাকা হতাে।

৫. এমনি একটি বৈঠক ডাকা হয় ২৩শে জানুয়ারী ‘৭৬ সনে। দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের সাথে সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে এক বৈঠক মিলিত হন। বাসস জানায় যে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুসংহত করার জন্য নয়া ব্যবস্থাবলী পর্যালােচনা করা হয়। বৈঠকে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কেও ফলপ্রসূ আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন জনাব আতাউর রহমান খান, জনাব তােফাজ্জল আলী, জনাব আবদুস সবুর খান, জনাব হাসিমুদ্দিন আহমদ, ডঃ আলীম আল-রাজী, জনাব শফিউর রহমান, জনাব নুরুর রহমান, হাজী মােহাম্মদ দানেশ, জনাব সিরাজুল হােসেন খান, জনাব অলি আহাদ, ক্যাপ্টেন (অবঃ) আবদুল হালিম চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ আজিজুল হক (নান্নামিয়া) মওলানা সিদ্দিক আহমদ, মওলানা আশরাফ আলী, মওলানা আবদুর রহিম, জনাব আবদুল মান্নান, জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী ও মিসেস আমেনা বেগম।৪

জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক খেলা

৬. স্বাধীনতা বিরােধী ও চৈনিকপন্থী রাজনীতিবিদগণ ভালাে করেই জানতেন যথাসময়ে নির্বাচন হলে তাদের নেতৃত্বের মুখােশ খসে পরবে। সেজন্য তারা কৌশল হিসেবে ভারত বিরােধীতা ও আওয়ামী বাকশালীদের তাদের আক্রমণের মূল টার্গেট হিসেবে বেছে নেয়। সীমান্ত অঞ্চলের কর্মকান্ডকে তারা ফঁাপিয়ে প্রচার করতে থাকে। যদিও সরকারী পত্রিকায় বাসস পরিবেশিত খবরে বলা হয়েছে, সীমান্ত এলাকায় ‘দুস্কৃতকারীদের তৎপরতা’ সত্বেও সীমান্তের জীবন যাত্রা স্বাভাবিক। সরকারীভাবে ভারত বিরােধী প্রচারণায় ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ভারতের প্রতিক্রিয়া এবং বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র বালাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)য় পরিবেশিত প্রতিক্রিয়া ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া প্রণিধানযােগ্যসম্প্রতি বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় সীমান্তের ঘটনাবলী সম্পর্কে প্রকাশিত খবরে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র বিস্ময় ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বলে বাসসর খবরে উল্লেখ করা হয়। ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র যে বিবৃতি দিয়েছেন তার ওপর মন্তব্য করার অনুরােধ করা হলে পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র জানান, সম্প্রতি উচ্চপর্যায়ে প্রতিনিধিদলের দিল্লী সফরের সময় উভয়পক্ষ সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের ব্যাপারে যে সমঝােতা হয়েছিলাে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তা ভঙ্গ করা হয়নি।

সীমান্তের ঘটনাবলী সম্পর্কে পত্র পত্রিকায় যে খবর বেরিয়েছে তা জনসাধারণ ইতিমধ্যেই যা জানে তার অতিরিক্ত কিছু নয় বলেই মনে হয়। মুখপাত্র বলেন, প্রকৃতপক্ষে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারকে বিডিআর-এর ডিরেক্টর জেনারেল এবং বিএস এফ-এর ডিরেক্টর জেনারেল মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা বলেছিলেন। ভারত বিরােধী প্রচারণা ছড়ানােয় বালাদেশ সরকার জড়িত বলে ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র যে ইঙ্গিত দিয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাংলাদেশ সরকারের নীতিই হচ্ছে তার সকল প্রতিবেশীর সাথে মৈত্রীবন্ধন দৃঢ় করা। মুখপাত্র বলেন, শান্তি ও স্থিতিশীলতা যা সারাদেশে বিরাজ করছে এবং জনসমর্থন যা সরকারের পক্ষে রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলিতে যা স্বীকৃত হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ‘আভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতার উল্লেখ বােধগম্য নয়। অন্য কোন কারণ অথবা উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে যে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত।

ভারতের প্রতিক্রিয়া

নয়াদিল্লী থেকে বাসস ও সমাচার পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ভারতবিরােধী প্রচারণায় বাংলাদেশের পত্র পত্রিকা নতুন করে ফেটে পড়ায় ভারত বিস্ময় ও বেদনা প্রকাশ করেছে। পররাষ্ট্র দফতরের একজন সরকারী মুখপাত্র গত ২৯শে জানুয়ারী শুক্রবার বলেন, দুস্কৃতকারীদের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, অর্থ অথবা আশ্রয়দানের অভিযােগ সর্ববৈ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। তিনি বলেন, বিচারপতি জনাব এ সাত্তরের নেতৃত্বে। বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের এক প্রতিনিধিদলের সম্প্রতি নয়াদিল্লী সফরকালে উভয় পক্ষ যে সমঝােতায় পৌছেছিলাে এবং যাতে উভয় পক্ষ বৈরী প্রচারণা হতে বিরত থাকা এবং তাদের জনগণের প্রগতি ও কল্যাণের স্বার্থে বন্ধুত্ব ও সহযােগিতা উন্নয়নে কাজ করে যেতে সম্মত হয়েছিলাে তারই পরিপেক্ষিতে এই ভারতবিরােধী প্রচারণা পুনরুজ্জীবিত করার প্রচষ্টা একান্তভাবেই দুঃখজনক। তিনি আরাে বলেন, ভারত সরকার এই অপরিহার্য সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে যে, ঘরােয়া বাধ্যবাধকতা অথবা অন্য কোন কারণেই ভারতের জড়িত হওয়ার অভিযােগ করা হচ্ছে। তিনি অভিযােগ অস্বীকার করেন এবং এক শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ কামনা করেন। কারণ এটা ভারতের স্বার্থেই এবং উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও সহযােগিতার একটা কাঠামাে গড়ে তােলার জন্য কাজ করে যাওয়ার ভারতীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্চস্যপূর্ণ।৬

ভুট্টোর উপছে পরা দরদ

৭. ভারত বাংলাদেশ এই ঘটনার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সুযােগ নেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টো। তুরস্ক বসেই এক বিবৃতিতে তিনি বললেন ঃ ভারতবাংলাদেশ পরিস্থিতি অবনতি ঘটলে ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতি নয়া অবস্থার সূচনা করবে। ৭ ঐদিন জিয়াউর রহমান জনাব ভুট্টো প্রতিক্রিয়ার অনুরূপ একটি বক্তব্য। প্রদান করেন। সিলেট স্টেডিয়ামে এক জনসভায় বলেনঃ যদি বাংলাদেশে শান্তি বিঘ্নিত হয় অবশ্যই তাতে গােটা উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হবে।৮ শুধু তাই নয়, এই সময়কালে জিয়াউর রহমান সরকারী অর্থ ব্যয়ে, হেলিকপ্টার ব্যবহার করে, প্রশাসনকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করে ও সামরিক বাহিনীর সমাগ্রিক সাহায্য নিয়ে সমগ্র দেশে আওয়ামী বাকশালীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করেন। একই সাথে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জেলখানায় চার জাতীয় নেতার হত্যার প্রতিবাদে দেশের সীমান্ত এলাকায় যারা প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিলাে তাদের প্রতিরােধকে সামনে রেখেই জিয়া এসব ঘটনাকে ফুলিয়ে ফঁাপিয়ে ‘স্বাধীনতা গেল’ ‘স্বাধীনতা গেল’ বলে সমগ্র দেশে ততালপাড় শুরু করেন।

প্রথম জনসভা ও রাজনৈতিক প্রতারণা

৮. ১লা মে ১৯৭৬। ঐতিহাসিক সােহরাওয়ার্দী উদ্যান রাজধানীতে মেজর জেনারেল জিয়ার প্রথম জনসভা। পূর্বেই চৈনিকপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাের নেতা ও শ্রমিকনেতাদের সর্বপ্রকার লজিস্টিক সার্পোট’ দেয়া হয়েছে। জনসভার সময় দুপুর ৩টায় ঘােষণা করা হয়েছে। প্রায় দুসপ্তাহ ধরে বিভিন্ন শ্রমিক বেল্টে প্রতিনিধি পাঠানাে হয়েছে। যােগাযােগ করা হয়েছে। জাতীয়করণকৃত শিল্পকারখানার কর্মকর্তাদের ডেকে বলে দেয়া হয়েছে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের জনসভায় শ্রমিকদের নিয়ে আসতে হবে। তদানীন্তন এসব নির্দেশ সামরিক নির্দেশ বলেই বিবেচিত হতাে। ৫-২৩ মিনিট। মেজর জেনারেল জিয়া সামরিক বাহিনীর বিরাট বহর নিয়ে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সজ্জিত মঞ্চে উঠলেন। চোখে চশমা। চারদিকে তাকালেন। হাত নাড়ালেন। শ্লোগান উঠলাে ‘জেনারেল জিয়া, জিন্দাবাদ।’ সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, আনছার বাহিনী এবং সামরিক ছত্রচ্ছায়ায় গঠিত ও অর্থানুকূল্যে পরিচালিত তথাকথিত মুক্তিযােদ্ধা সংসদ এবং স্বাধীনতা বিরােধী দল সমূহের কর্মী, চৈনিকপন্থী দলসমূহের শ্রমিক সংগঠন ও কর্মী এবং ঢাকার উত্মক জনগণ জনসভায় উপস্থিত।

শ্লোগান ওঠে সিপাহী জনতা ভাই ভাই।’ প্রস্তুতি চলছিল পক্ষকাল ধরে। জনসভার আয়ােজকগণ পক্ষকালের একটানা পরিশ্রমে কর্মক্লান্ত, গলদঘর্ম। অথচ মাইকে বলা হলাে ঃ একদিনের ঘােষণায় এই বিশাল জনসভা। জনসভায় জেনারেল জিয়া সামরিক পােশাক পরে, প্রথমে বগলে ব্যাটন চেপে, পরে টেবিলে ব্যাটন রেখে জনসভায় ‘উর্দুভাষী উচ্চারণে বাংলা জবানে ভাষণ দিয়ে বললেন ঃ বাংলাদেশের জনগণ বােঝে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বললেন ঃ যারা নতুন করে দেশ স্বাধীন করবে, প্রবাসী সরকার বানাবে এরা দেশের জনগণের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবেনা। তিনি বললেনঃ ইনশাল্লাহ এদের ধংস করা হবে। তিনি বললেন, “আপনারা এদের ধংস করতে চান ? হাত তুলুন।” তিনি আরাে ওয়াদা করলেন- “জনগণের অধিকার তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে। ন্যায় বিচার লাভের সুযােগ দিতেই হবে। কারণ ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার আল্লাহ তাদের দিয়েছেন। তিনি জনগণের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেবার অঙ্গীকার করেন।৯

৯. ১লা মে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করার ৯ দিনের মধ্যে ৮ই মে জনগণের অধিকারকে আরাে শৃংখলিত করার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান সমগ্র দেশকে ৯টি জোনে বিভক্ত করে ৯জন আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। ১৯৭৫ সালের ৮ই নভেম্বর ও ২০ শে আগষ্ট তারিখের ঘােষণা অনুসারে এবং ১৯৭৬ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী তারিখের আদেশ নং ১১৭-আইন রহিত করে আদেশটি জারি করা হয়। জোন-এ সমগ্র ঢাকা, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলাঃ ডিরেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ রাইফেলস; জোন বি-ঃসমগ্র সিলেট, কুমিল্লা ও নােয়াখালী জেলাঃ কমান্ডার, ৪৪-বিগ্রেড; জোন সি- চট্টগ্রাম বন্দর এলাকা ও তৎসংলগ্ন সমুদ্র এলাকা বাদে সমগ্র চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাঃ কমান্ডার ৬৫-বিগ্রেড; জোন-ডিঃচট্টগ্রাম বন্দর ও তৎসংলগ্ন সমুদ্র এলাকাঃ কমোেডর কমান্ডিং চট্টগ্রাম; জোন-ইঃ সমগ্র খুলনা জেলা ও তৎসংলগ্ন সমুদ্র এলাকাঃ ন্যাভল অফিসার ইনচার্জ; খুলনা জোন-এফঃ কমান্ডার, ৫৫ বিগ্রেড; জোন-জিঃ সমগ্র রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলাঃ কমান্ডার, ৯৩ সঁজোয়া বিগ্রেড; জোন-এইচঃ সমগ্র রংপুর ও দিনাজপুর জেলার কমান্ডার ৭২-বিগ্রেড; এবং জোন-আইঃ সমগ্র কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর জেলাঃ কমান্ডার ১০৫-বিগ্রেড। এক সরকারী তথ্য বিবরণীতে একথা বলা হয়। ১০

১০. একই সময়ে চীনপন্থী বলে পরিচিতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে ফারাক্কা ইস্যুকে সামনে রেখে উসকে দেয়া হয়। মওলানা ভাসানীর পত্রের জবাবে মিসেস গান্ধী মাওলানা ভাসানীকে একটি পত্র দেন।১১ পত্রটি নিম্নরূপপ্রিয় মওলানা সাহেব, আপনার গত ১৯৭৬ সালের ১৮ই এপ্রিল লেখা চিঠি পড়ে আমি ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছি। এটা কল্পনা করাও কষ্ট যে, এক ব্যক্তি যিনি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের সঙ্গে কাধে কাধ রেখে সংগ্রাম করেছেন এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের নিজের জাতীয় স্বাধীনতার জন্যে দুঃখ কষ্টে শরীক হয়েছেন, তিনিই আমাদের এমন গুরুতরভাবে ভুল বুঝবেন এবং এমন কি, আমাদের সম্পর্কে আন্তরিকতার প্রশ্ন তুলবেন। বরং আমি এটাই বিশ্বাস করবাে যে, আপনি প্রকাশ্য বিবৃতিতে ভারতের বিরুদ্ধে অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রাসী উদ্দেশ্যের যে হুমকি দিযেছেন তা মুহূর্তের উত্তেজনাতেই। যে ভারত দৃষ্টান্তহীন দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে তার সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে, সে তার প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে বৈরী মনােভাব পােষণ করতে পারে বলে কোন বাংলাদেশী কি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করেন? ভারত সরকার ও জনগণ। এটা কামনা করেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সগ্রামে ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের পুনর্গঠনে তাদের সমর্থন ও সহযােগিতার আলােকেই তাদের দেখা হবে। আমাদের প্রয়ােজন অনেক বেশী এবং আমাদের জনগণের উপর বােঝাও অনেক। কিন্তু আমাদের উভয়দেশের জনগণের কল্যাণ পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। উভয়ের অভিন্ন স্বার্থেই এতদাঞ্চলে স্থিতিশীলতা এবং আমাদের দু’দেশের মধ্যে সহযােগিতা ও বন্ধুত্ব থাকা প্রয়ােজন। আপনি তাে জানেন যে, ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ দীর্ঘদিন ধরেই পূর্ব ভারতের প্রাণকেন্দ্র কলকাতা বন্দরকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় বলে বিবেচিত হয়ে আসছে, কাজেই এটাও ত্যাগ করা যায় না। আপনি এটাও জানেন যে, গ্রীষ্মকালে আনুমানিক দু’মাসের মত সময়ে গঙ্গার পানি প্রবাহ কমে যায়। আমাদের উভয়ের প্রয়ােজন মেটানাের ব্যাপারে ভবিষ্যতে কোন ঘাটতি দেখা দিলে পরস্পরের মধ্যে সমঝােতা ও সহযােগিতা থাকলে অবশ্যই একটা উপায় বের করা যাবে। হুগলী নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য প্রয়ােজনীয় ন্যূনতম পরিমাণ পানিও আমাদের জন্য রেখে আমরা বাংলাদেশের প্রবাহ ঠিক রেখেছি।

আমার মনে হয়, আপনাকে ঘটনার একটা দিক এবং বাংলাদেশে ফারাক্কা বাঁধের। ফিডার ক্যানালের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অতিরঞ্জিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। আপনি চাইলে, আমাদের হাইকমিশনার আপনাকে ঘটনার অপরদিক সম্পর্কে অবহিত করবে। প্রতিবেশীদের মধ্যে সমস্যার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। সমঝোতা ও সহযােগিতার মনােভাব নিয়ে সমস্যার সমাধান কামনা করাটাই বড় কথা। মােকাবিলা ও বৈরীতার পক্ষ অনুসরণ করলে আমাদের উভয়ের ক্ষতি। আমি আবার। আন্তরিকতার সঙ্গে বলতে চাই যে, বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা সুসংহত করুক ও শান্তির মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধিশালী হােক। বন্ধুসুলভ প্রতিবেশী ও অগ্রগতির সাথী হিসেবে আমরা আমাদের অবদান রেখে যাব। আপনি হয়ত অবগত আছেন যে, খরা মওসুমে গঙ্গার পানি বরাদ্দ এবং এ সম্পর্কিত বিষয়টি নিয়ে আমাদের দু’দেশের সরকার আবার আলােচনা শুরু করেছেন। এ ব্যাপারে উভয়পক্ষের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের উৎসাহ ও সমর্থনের । প্রয়ােজন রয়েছে। আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি যে, আমরা সঙ্গত যুক্তি ও ন্যায্য বক্তব্য মেনে নিতে রাজী আছি। কিন্তু কেউ যেন এটা আশা না করেন যে, ভারত হুমকি বা অযৌক্তিক অথবা অন্যায় দাবীর নিকট নতি স্বীকার করবে। শ্রদ্ধাসহ

ভবদীয়

ইন্দিরা গান্ধী

১১. ইন্দিরা গান্ধীর এই পত্র যখন মওলানার নিকট ভারতীয় দূতাবাসের থার্ড সেক্রেটারী হস্তান্তর করেন সেই মুহুর্তে কলকাতায় ভারত বাংলাদেশের কর্মকর্তারা দ্বিতীয় দফা কারিগরি পর্যায়ের আলােচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের অতিরিক্ত সচিব শ্রী জে সি আজমানী বলেন, সাত ঘন্টা নৌবিহারে তারা পর্যালােচনা করেন। সেচ বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুৎ সংক্রান্ত প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা বি, এম, আব্বাস বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন। বৈঠক চলতে থাকে।

১২. ১৬ই মে প্রস্তাবিত ফারাক্কা মিছিল পরিচালনা কমিটিতে ফারাক্কা লংমার্চ সংগঠন পরিচালনার জন্য মওলানা ভাসানী পীর মােহসেন আলী দুদু মিয়া, মওলানা মহিউদ্দিন খান, সাবেক জমিয়ে ওলেমায়ে ইসলামী সর্বজনাব ইদু চৌধুরী, এটি বারী, এনায়েতউল্লাহ খান, শ্রী নির্মল সেন, গিয়াস শমাল চৌধুরী, কামাল লােহানী, মীর্জা গােলাম হাফিজ, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির মওলানাআবদুল সালাম ও মওলানা খন্দকার নাসির উদ্দিন, মওলানা সাইদুর রহমান, মওলানা শেখ ওবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদীকে অন্তর্ভূক্ত করেন।

১৩, স্বাধীনতা বিরােধী মুসলিম লীগ, জামাত ইসলামী, নিজামীইসলামী দলগুলােকে একদিকে, অন্য দিকে চীনপন্থী ভাসানী ন্যাপ, ইউ,পি,পি, সামাজবাদী দল-এর। নেতা-কর্মীদের ভারত বিরােধী অবস্থানে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে মওলানার ভাসানীর। উদ্যোগ সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের বুপ্রিন্টের কার্যকর করার প্রাথমিক অথচ সচেতন উদ্যোগ।

১৪. জিয়াউর রহমান ভারত বিরােধী প্রচারণাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে লক্ষ্যে ব্যবহার করতে সদা সর্বদাই সচেতন ছিলেন। চীনপন্থী ও স্বাধীনতা বিরােধী জামাত ইসলামী, মুসলিমলীগ, নেজামে ইসলামী নেতা কর্মীদের নিকট ভারত বিরােধীতা তাদের নিজস্ব দলীয় দৃষ্টি কোণ হতেই সহজেই গ্রহণীয় হয়েছিলাে। চীনপন্থী রাজনৈতিক দল, গােষ্ঠি ও শক্তি তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্য হিসেবেই কঠোর মার্শাল-র মধ্যে সামরিক সরকার অনুসৃত নীতির পাশাপাশি ভারতের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের কাজে ওঠে পরে লেগেছে।

১৫. পাকিস্তান ও মধ্য প্রাচ্যের তথাকথিত মুসলিম দেশগুলি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চারণভূমিরূপে বাংলাদেশকে পুনরায় মুসলিম বাংলার আদলে পুনর্গঠিত করার লক্ষ্যে পরাজিত স্বাধীনতা বিরােধী চক্র এই অবস্থার সুযােগ নিতে এতটুকু সময় অপব্যয় করেনি। স্বাভাবিকভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতির অধিকারী ভারতের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান ছিলাে দৃঢ়। ১৬. চীনপন্থীরা চীনের দিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মােড় ঘােরাতে ছিলাে অত্যন্ত তৎপর। সেজন্য গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি বা ব্যক্তি স্বাধীনতা, চলাফেরা, আইনে আশ্রয় লাভের মতাে মৌলিক এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তাদের ভূমিকা ছিলােনা- যৌথভাবে তারা তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ভারতের দিকে। কামান তাক করেছিলাে। অবস্থান ভিন্ন লক্ষ্য অভিন্ন। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হিসেবে ভারত বিরােধীতাকে মুখ্য ইস্যু হিসেবে দাড় করালে চীনপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি দ্ব্যর্থহীনভাবে জিয়াউর রহমানকে সমর্থন প্রদান করে যদিও সে সময় তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও গণভিত্তি ছিলাে নগণ্য। ১৭. ভারত বিরােধীতার লক্ষ্যে সীমান্তের ছােট খাটো ঘটনাকে নিয়ে এসব দল ও রাজনীতিবিদগণ তিলকে তাল করে ছেড়েছেন। সীমান্তের তুচ্ছ ঘটনা, গরু নিয়ে যাওয়া, কাউকে অপহরণ বা পুলিশী ফাঁড়ি আক্রমণ ও দখলকে অথবা থানার পুলিশের মধ্যে থেকে কাউকে ধরে নিয়ে বংলাদেশের অভ্যন্তরেই ভিন্ন স্থানে নেওয়ার মতাে ঘটনাকেও তারা ‘বিরাট’ কিছু করে ছেড়েছে একেই স্বাধীনতা। সার্বভৌমত্ব বিপন্ন বলে তারস্বরে উচুগলায় ‘চিৎকার করেছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর সময় এরাই কয়েক ডজন পুলিশ ফাড়ি দখল, আইন প্রয়ােগকারী সংস্থার সদস্যদের হত্যা ও খতমের রাজনীতি চালু রেখেছিলাে।

১৮, ভারত ও বাংলাদেশ সরকার সীমান্তের ঘটনাবলীতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এজন্য দু’দেশের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। ১৯৭৬ সনের ১১-১৩ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত তিন দিন ব্যাপী ঢাকায় এক বৈঠক হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে-যৌথ টীম সীমান্ত ঘটনা তদন্ত করবে। এবং ১৩ ই ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে একযুক্ত প্রেস বিবৃতি প্রদান করা হয়। বৈঠক শেষে যুক্ত প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশভারত যৌথটীম ময়মনসিংহ জেলার সীমান্ত এলাকায় দুস্কৃতকারীদের লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ এবং থানা ও সীমান্ত ফঁাড়ি সমূহের ওপর সাম্প্রতিক হামলার ঘটনা সম্পর্কে ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত শুরু করবে। তিন দিনব্যাপী সীমান্ত বৈঠক শেষে ১৩ই ফেব্রুয়ারী ’৭৬ বিকেলে ঢাকার রাষ্ট্রয় অতিথি ভবনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এক যুক্ত প্রেস বিবৃতি হতে একথা জানা যায়। বাংলাদেশ রাইফেলসের ডিরেক্টর ও ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ডি আইজি শিলং-এর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ তদন্ত টীম ১৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ । রাইফেলস্ ও ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেলের নিকট রিপাের্ট পেশ করবেন। প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়, তদন্তের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে টীম সীমান্তের দু’পার্শ্বের এলাকাতেই পরিদর্শন করতে পারবেন। তিন দিনব্যাপী বৈঠকে বিডিআর এর ডিরেক্টর জেনারেল মেজর জেনারেল কাজী গােলাম দস্তগীর এবং বি এস এফ-এর ডিরেক্টর জেনারেল মিঃ আসওয়ানী কুমার যথাক্রমে বাংলাদেশ ও ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করেন। বৈঠক শেষে ১৩ই। ফেব্রুয়ারী বিকালে ভারতীয় প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ বিমানে স্বদেশ যাত্রা করেন। বাসস’র খবরে বলা হয়ঃ সমঝােতা ও সহযােগিতার পরিবেশে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সীমান্ত ঘটনা ও সংশ্লিষ্ট অপরাপর বিষয়ে আলােচনা করা হয়। যৌথ প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়ঃ দু দেশের মধ্যে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের স্বার্থে নিরুদ্ৰব সীমান্তের গুরুত্ব সার্বিকভাবে স্বীকৃত হয়। বিডিআর-এর ডিরেক্টর জেনারেল বি এস এফ-এর ডিরেক্টর জেনারেলকে জানান যে, সীমান্তপারের নিরাপদ আশ্রয় স্থান থেকে এসে দুস্কৃতকারীরা সম্প্রতি ময়মনসিংহ জেলার সীমান্ত এলাকায় লুটতরাজ অগ্নিসংযােগ এবং থানা ও সীমান্ত ফাঁড়ি সমূহের উপর পর্যাক্রমিক হামলা চালায়। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বিডিআর এর ডিরেক্টর জেনারেল সীমান্তফাঁড়ি বারােমারীর ওপর হামলা ও কলমাকান্দা থানার অফিসার ইনচার্জকে সপরিবারে অপহরণের ব্যাপারে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

বিএস এফ-এর ডিরেক্টর জেনারেল “ভারতীয় এলাকার অভ্যন্তর থেকে কোন দুস্কৃতকারীদের নিরাপদ আশ্রয় দানের কথা বিশেষ জোরের সাথে অস্বীকার করেন। তবে তিনি নিশ্চয়তা প্রদান করেন যে সীমান্তে শান্তি বজায় রাখতে জোরালাে প্রচেষ্টা নেয়া হবে। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়ঃ আরও ঐক্যমতে পৌছানাে হয় যে, ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র সচিবদের সম্মেলনে সীমান্ত ঘটনা মােকাবিলার জন্য গৃহীত ঐক্যমতের নীতিমালার আদর্শ অনুসরণে সেক্টর কমান্ডার ও উইং কমান্ডারদের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ভারত কর্তৃক নীতিমালাসমূহের অনুমােদনের জন্যও জরুরি পদক্ষেপ নেয়া হবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই তার। অনুমােদনের বিষয় ভারত সরকারকে অবহিত করেছেন।” আলােচনাকালে ভারতীয় প্রতিনিধি গারােদের সীমান্ত পার হয়ে ভারতীয় এলাকায় গমনের বিষয় উল্লেখ করেন। বিডিআর এর ডিরেক্টর জেনারেল বলেন যে, দুস্কৃতকারীদের প্রলােভনে পড়ে কিছু সংখ্যক গরাি ভারতে গিয়ে থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশের যে কোন প্রকৃত নাগরিক অবাধে ফিরে আসতে পারে। বিবৃতিতে বলা হয়ঃ ‘সীমান্ত পারাপারে যাতে কোন বেআইনী চলাচল না হয় তার জন্য সীমান্তের উভয় পার্শ্বেই তেমন অবস্থার নিশ্চয়তার বিধানে উভয় পক্ষই তাদের আপ্রাণ চেষ্টা করতে একমত হয়। এব্যাপারে বি এস এফ ও বিডিআর কড়া সতর্কতা পালন ‘ করবে।” বিএসএফ -এর ডিরেক্টর জেনারেল আরও উল্লেখ করেন যে, সীমান্তের অপর পারে ভারতীয় এলাকায় বুলেট নিক্ষিপ্ত হওয়ায় সংলগ্ন ভারতীয় এলাকায় অসুবিধা সৃষ্টি হয় এবং স্থানীয় লােকজন সীমান্ত এলাকা হতে অন্যত্র সরে যায়। বিডিআর এর ডিরেক্টর জেনারেল পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে বলেন যে, বিডিআর এর লােকেরা দ্রুত দুস্কৃতকারীদের পশ্চাদ্ধাধাবণকালে এসব বুলেট সীমান্ত পেরিয়ে গিয়ে পরতে পারে।

আলােচনা বেঠকে উভয় পক্ষই সন্তুষ্ট হয়েছে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতা মিঃ আসওয়ানী কুমার বলেন, “আমরা খুবই সন্তুষ্ট হয়েছি এবং সৎ প্রতিবেশীসুলভ মনােভাব নিয়ে আলােচনা করেছি। বাংলাদেশ। প্রতিনিধিদের নেতা মেজর জেনারেল কাজী গােলাম দস্তগীর উক্ত প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘চুক্তির ব্যাপারে তিনি খুশি হয়েছেন। তবে তিনি বলেন, এ চুক্তি যখন ফলপ্রসূ হবে তখন আমি আরও খুশি হব।’ বাংলাদেশ সীমান্তের অপর পাশে ভারতীয় সীমান্ত এলাকা বরাবর বিপুল সংখ্যক বিএসএফ মােতায়েনের বিদেশী সংবাদপত্রের খবরের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে, বিএস এফ এর ডিরেক্টর জেনারেল মিঃ আসওয়ানী কুমার এ ধরনের খবরকে জোরের সাথে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, “সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী কোথাও মােতায়েন করা হয়নি।”১২

লাইফ ইজ নট আওয়ার্স।

১৮. বাংলাদেশের জন্য নিরবচ্ছিন্ন এবং উদ্বেগজনক ঘটনাটি ছিলাে পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্রুত ক্রম অবনতিশীল ঘটনাবলী। ১৯৪৭ সনে পাকিস্তান হওয়ার মুহূর্তে রাঙ্গামাটিতে ভারতীয় পতাকা এবং বান্দরবনে বার্মার পতাকা উত্তোলিত ছিলাে। ১৭ই আগস্ট র্যাডক্লিফ রােয়েদাদ প্রকাশিত হলে অঞ্চলটি তদানীন্তন পূর্ববঙ্গে, পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্ত থাকে। ১৯৭৫ সনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে সশস্ত্র জন সংহতি সমিতি এবং শান্তি বাহিনী গঠিত হয়। তারা স্বায়ত্তশাসনের দাবী জানায়। ১৯৭৬ সনে পার্বত্য চট্টগ্রামের আলােক দেওয়ানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের দাবী জানালে জিয়াউর রহমান তাদের আশ্বস্ত করেন। বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে তাদের বিদায় দেয়া হয়।

১৯. কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তারা অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেলেন ভারী ভারী সামরিক যান তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। লরী ভর্তি হয়ে সৈন্য নামছে। নতুন ক্যান্টনমেন্ট তৈরী হচ্ছে। গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে। মারমা ও চাকমাদের সব জায়গা থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। গভীর অরণ্যের দিকে নতুন নতুন রাস্তা তৈরী হচ্ছে। শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমান সমতলের বাসিন্দা বাঙালীদের পাহাড়ী এলাকায় বসতি স্থাপনের উৎসাহ প্রদান ও তাদের যাতায়াতের জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করেন। তাদের আবাদের জন্য জমি দেন। নগদ টাকা দেন। রেশন প্রদানের ব্যবস্থা করেন। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সনে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বাের্ড গঠন করেন। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক হতে টাকা আনেন। কিন্তু বাের্ডের চেয়ারমান এর দায়িত্ব দেন চট্টগ্রাম ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসারকে। বেসরকারী প্রশাসন অচল হয়ে পড়ে। প্রশাসনের গােটাটাই সামরিকীকরণ হয়ে পড়ে। সামরিক বাহিনীর। হাতে রাস্তা ঘাট নির্মাণ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, ছাত্রদের বৃত্তি প্রদান, উপাসনালয় নির্মাণ স্থানীয় কুটির শিল্প এবং উন্নয়নের দায়িত্ব পর্যন্ত দেয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন, নারী ধর্ষণ, লুটপাট, মন্দির পুড়িয়ে দেবার মতাে ঘটনা। ঘটতে থাকে। এ সময় বিশ হাজার অনুপ্রবেশকারীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করে। ১৩

২০. জিয়াউর রহমানের অনুসৃত নীতি ও পদক্ষেপের ফলে পাহাড়ী এলাকার চাকমা, মগ ও মারমা উপজাতিরা হত্যা খুন, নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের মধ্যে অনেকেই দেশ ত্যাগ করে। ভারত, বার্মা ও আরাকানে চলে যায়। অস্ত্র সংগ্রহ করে গেরিলা। যুদ্ধ শুরু করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ৫০৯৩ বর্গ মাইল এলাকা সমগ্র বাংলাদেশের আয়তনের ১০% ভাগ প্রায়। এত বিরাট এলাকায় সশস্ত্র গেরিলা বাহিনীর আক্রমণ এবং প্রতিনিয়ত খুন হত্যার ঘটনাবলী এবং একটানা সশস্ত্র সংঘটিত বিষয়টিকে জিয়াউর রহমান দেশবাসীর নিকট হতে আড়াল করে রাখেন। তিনি ময়মনসিংহ এলাকার ছােটখাট সীমান্ত ঘটনাকে বিরাট ব্যাপক করে দেখিয়েছেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের মতাে বিশাল এলাকায় সশস্ত্র ঘটনাবলীর বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন রাজনৈতিক কারনে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয় নিয়ে হৈ চৈ করলে রাজনৈতিক সুবিধা বা ফায়দা লুটবার সম্ভাবনা হ্রাস পেত বলে জিয়ার নিকট মনে হয়েছে। অথচ এসব ঘটনা ছিলাে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত।

জিয়ার আরেক খেলা

২১. ১৯৭৭ সনে জাতির নিকট প্রতিশ্রুত নির্বাচন যাতে যথাসময়ে অনুষ্ঠিত না হয় তজ্জন্য জিয়াউর রহমান ধীর গতিতে, সতর্ক পদক্ষেপে নিজেকে আপাতঃ আড়াল করে অগ্রসর হয়েছিলেন। মওলানা ভাসানীকে তিনি ব্যবহার করেছেন। ব্যাবহার করেছেন স্বীয় স্বার্থে চীনপন্থী তােয়াহা কাজী জাফর এদের। আসন্ন নির্বাচন বানচাল করার লক্ষ্যে ফারাক্কা ইস্যু নিয়ে তােলপাড়, সীমান্ত ঘটনা নিয়ে লম্ফঝম্প, নির্বাচন বানচাল করার লক্ষ্যে ভারত, আওয়ামী-বাকশালী এদের একনম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে চীনপন্থী এসব নেতারা জেহাদ শুরু করে। তারা আওয়ামী বাকশালীকে এক নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে এদের ‘উৎখাত’ ‘নিমূল’ ও ‘প্রতিরােধ করার আহবান জানিয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়। ‘৭৬ সনের ২৮শে জুলাই রাজনৈতিক দলবিধি জারী হওয়ার পর ঘরােয়া রাজনীতি শুরু হলে তারা সামরিক শাসনের অবসান, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিার লড়াইয়ের পরিবর্তে আওয়ামী বাকশালী’ স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকে ‘উত্থাত’ ও ‘নির্মূল করার অভিযান চালায়। পিপি আর-এর মাধ্যমে দলগঠন শুরু হলে আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীগণ অত্যন্ত দূরদৃষ্টি নিয়ে আওয়ামীলীগের পুনরুজ্জীবন ঘটান। আওয়ামীলীগের পুনরুজ্জীনের পর আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহমদ, বেগম সাজেদা চৌধুরী, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মালেক উকিল, আব্দুল মমিন তালুকদার, আবদুল মোেমন, রফিক উদ্দিন ভূইয়া, সালউদ্দিন ইউসুফ, ফনীভুষণ মজুমদার, ফজলুল করিম, জহিরুল কাইয়ুম ফজলুল হক বিএসসি প্রমুখ নেতা কর্মী এবং পরবর্তীতে বেগম জোহরা তাজউদ্দিন যখন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘরােয়াভাবে কর্মী সভা ও দল গঠনের জন্য গিয়েছেন তখন হাজার হাজার কর্মী। সমাগম দেখে এসব উগ্রপন্থী চৈনিক নেতা-কর্মী এবং উচ্চাভিলাষী জিয়াউর রহমানের মাথা গরম হয়ে যায়। আওয়ামী বাকশালী কে ঠেকানাের জন্য চীনপন্থী ও ডানপন্থী ১০টি দল এবং এদের ৫৪টি অঙ্গদলসমূহ একত্রে মিলে “জাতীয় সংহতি ও প্রতিরােধ কমিটি” গঠন করে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হাসিলের জন্য ‘জাতীয় ঐক্যের অঙ্গীকার ও আহবান নিয়ে তারা সংগঠিত হয়। ন্যাপের মশিউর রহমান, জাতীয় গণতান্ত্রিক মুক্তি পার্টির হাজী মােহাম্মদ দানেশ, ইউনাইটেড পিপলস পার্টির কাজী জাফর আহমদ, সাম্যবাদী দলের তােয়াহা সহ এসব চৈনিকপন্থী দল একত্র হয়ে আওয়ামী লীগ ঠেকাও রাজনীতিতে সামরিক সরকারের পক্ষে প্রকাশ সমর্থন জোগায়।

২২. তাদের বক্তব্য, প্রথমে আওয়ামী বাকশালীদের উচ্ছেদ করতে হবে, কেননা তারা দেশপ্রেমিক নন-স্বাধীনতা এরা চায়না। জনাব তােয়াহা ইতিপূর্বে ঘােষণা করেছিলাে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস নয় ‘দখল দিবস’। সেই তােয়াহা গং জিয়াউর রহমানকে নসহিৎ করেন যে, আওয়ামী লীগকে ‘নিমূল ও উচ্ছেদ করতে পারলে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব থাকবেনা। আওয়ামী বাকশালীদের প্রতিরােধ করার লক্ষ্যে জাতীয় সংহতি ও প্রতিরােধ কমিটি’ প্রস্তাব দেয় যে, আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে দেশপ্রেমিক দল নিয়ে ‘জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। এই দেশপ্রেমিক দলের মধ্যে মুসলিমলীগকে নিতেও তাদের আপত্তি ছিলােনা।

২৩, তাদের বক্তব্য হলাে নির্বাচন পরে হােক, আগে দেশ বাঁচাও। সামরিক শাসন বহাল থাক। জনগণের মৌলিক অধিকার, ভাত ও ভােটের অধিকার না থাক, মিটিং মিছিল সমাবেশ জনসভা করার ও গণতান্ত্রিক অধিকার না থাক; এতে কি আসে যায়-আগে দেশ বাঁচাতে আওয়ামী-বাকশালীদের ঠেকাও।

২৪.. তাদের মতে নির্বাচন এখন প্রয়ােজন নেই। ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রতিশ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে দেশের ঐক্য ও সংহতি’ বিপন্ন হবে। সুতরাং নির্বাচন স্থপিত ঘােষণা করা হােক। জিয়াউর রহমান ও দেখলেন সাধারণ নির্বাচন অর্থাৎ পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সামরিক পােষাকে ক্ষমতায় যাওয়ার সাধ তার স্বপ্নই থেকে যাবে।

২৫. ১৯৭৬ সালে ২১শে নভেম্বর জিয়াউর রহমান “জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষার্থে ১৯৭৭ সনের প্রতিশ্রুত সাধারণ নির্বাচন স্থগিত ঘােষণা করতে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহামদ সায়েমকে বাধ্য করেন।

নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।

২৬. জাতীয় ঐক্য ও সংহতি’, ‘স্বাধীনতা রক্ষা’ এসব ছিলাে জনগণের উদ্দেশে ছুঁড়ে দেয়া কথামালা। শ্লোগান। এর অন্তরালে ছিলাে ভিন্ন উদ্দেশ্য। ভিন্ন প্রক্রিয়া। ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ এন,এস, এফ এবং প্রাক্তন ছাত্র শক্তির নেতৃবৃন্দ যারা বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ পােশায় নিয়ােজিত ও বিশেষজ্ঞ তারা একটি কার্যপত্র তৈরী করে এ কথা প্রমাণের চেষ্টা চালায় যে পার্লামেন্ট নয়, প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারই বাংলাদেশে উপযােগী। তাদের রাজনৈতিক তত্ত্ব ও যুক্তি জিয়াউর রহমানের মানসিক চিন্তা ও ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত এবং নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে জিয়াউর রহমানের উচ্চাভিলাষ বরাবরই ছিলাে বেপরােয়া। ১৯৭১ সনের ২৭শে মার্চ কালরঘাট বেতার কেন্দ্রে আকস্মিক এক ভাষণে তিনি নিজেকে ‘হেড অব দি স্টেট’ বলে ঘােষণা করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে পিছে এসে জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন। অনুরূপভাবে ১৯৭৫ সনের ৭ই নভেম্বর ভােরে তিনি নিজেকে প্রধান সারিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘােষণা দেন এবং ঐদিন বিকেলে নভেম্বর উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিজেকে গুটিয়ে আনেন। কিন্তু মূল টার্গেটে পৌছতে বিরত ছিলেন না।

২৭. প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি সায়েমের বক্তব্য ছিলাে স্পষ্ট এবং ঋজু। তিনি জাতিকে বারবার বলেছেন, তার সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ৭৭ সনের ফেব্রুয়ারীর মধ্যে তিনি সাধারণ নির্বাচন দেবেন। জন প্রতিনিধিরা ঠিক করবেন সরকার পদ্ধতি কি হবে। এর পূর্বে তিনি তার উপদেষ্টা পরিষদে শাসনতন্ত্রের ৪র্থ সংশােধনী যেটাকে প্রচার করা হতাে ‘অগণতান্ত্রিক তার পুরােটা বাতিলের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে জিয়াউর রহমান এ বক্তব্য একমত হতে পারেননি। তারপরেও প্রেসিডেন্ট সায়েম যখন সাধারণ নির্বাচনের জন্য এগুতে লাগলেন তখন ফারাক্কা সমস্যা, সীমান্ত সমস্যা, জাতীয় স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব। রক্ষার ধূয়াতুলে এবং আওয়ামী বাকশালীদের দুঃশাসনের অজুহাত তুলে নির্বাচন বানচাল, স্থগিত করার কাজে চৈনিকপন্থী ও স্বাধীনতা বিরােধী চক্রকে মাঠে নামান।

২৮. নির্বাচন স্থগিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়া তার পকেটে। লুকায়িত অস্ত্র এবার সরাসরিভাবে বের করে আনলেন। সামরিক বাহিনীর মধ্যে ‘সমন্বয় ও শৃঙ্খলাজনিত কর্মকান্ডের সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুহাতে তিনি প্রেসিডেন্ট সায়েমের হাত থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি কেড়ে নেন। সামরিক ফরমানে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছিল এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটিই ছিলাে রাষ্ট্রযন্ত্রের সামগ্রিক কর্মকান্ডের মূল শক্তি ও কেন্দ্র বিন্দু।

২৯. প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি দখল করে সামরিক আইন কড়াকড়িভাবে বলবৎ করা হয়। ঘরােয়া রাজনীতির যে প্রক্রিয়া বিগত ২৮শে জুলাই হতে শুরু হয়েছিলাে ‘অদৃশ্য শক্তি তাদের উপর খবরদারী শুরু করে। মৌলিক অধিকারের ফাঁকফোকর গলে যাতে রাজনীতির বাতাস জনগণের মধ্যে সঞ্চালিত না হতে পারে – সে জন্য সুযােগের সামান্য বাতাবরণকে ঢেকে দেয়া হয়। নির্বাচন স্থগিত ঘােষণার প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ভীষণভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের সংখ্যা ৬২ হাজারকে ছাড়িয়ে যায়।

৩০. এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ‘৭৬এর ১লা ডিসেম্বর জরুরী তারবার্তা প্রেরণ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং অবিলম্বে নেতৃবৃন্দকে ছেড়ে দেবার আবেদন জানান। ১৬ জিয়াউর রহমান মুখে মিষ্টি কথা বললেও এসবের পাত্তা তার নিকট ছিলাে না।

৩১. প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে জিয়াউর রহমান সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও বিচারকার্য অনুষ্ঠানের জন্য মার্শাল ল কোর্ট সমূহের কার্যপরিধি বাড়িয়ে দেন। এমনকি, সামরিক ফরমানে যে কোন অপরাধের শাস্তি এসব মার্শাল ল কোর্টে করা যাবে। বিশেষ সামরিক আদালত গঠন করা যাবে। গােপনে বিচার সম্পন্ন করা যাবে। সামরিক আদালতে গৃহীত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন আদালতে আপীল করা যাবে না। আপীলের বিবেচনার ক্ষমতা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়া নিজের হাতে রেখে দেন। ১৯৭৬ সনের ১৮ই জুলাই কর্ণেল তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হয়। বিশেষ সামরিক আদালতে গােপন বিচারে ২৯শে জুন ৭৬ সনে কর্ণেল তাহেরকে ফঁসি দেয়ার আদেশ দিলে প্রেসিডেন্ট বরাবর ক্ষমা প্রদর্শনের জন্য আবেদন জানান হয়। কিন্তু দেশবাসী আজো অজ্ঞাত, যে, কেন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম তাহেরের ফঁসির আদেশ

রহিত করলেন না। ১৭

৩২. বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নির্বিচার গ্রেফতার, হত্যা ও নিপীড়ণেবিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে-১৯৭৭ সনের ৪-১২ এপ্রিলে স্যান ম্যাক ব্রাইডের নেতৃত্বে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিনিধি দল প্রেসিডেন্ট বিচারপতিসায়েমও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা দেশের আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে

সাক্ষৎ করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষ করে মানবাধিকার লংঘন বিষয়ে ১৯৭৭ সনের ২৩শে জুন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান বরাবরে একটি বিস্তারিত রিপাের্ট পেশ করেন। উক্ত রিপাের্টে সামরিক শাসন দীর্ঘায়িত করার, রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের গ্রেফতার ও তাদের উপর নিপীড়ণের বিষয়ে বিশেষভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

৩৩. এ্যামনস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রতিনিধিদের নিকট প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মৌখিক আশ্বাস বাক্য উচ্চারণ করে বলেন যে, শীগ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ছেড়ে দেবার বিষয়ে বিবেচনা করা হবে। এবং গণতান্ত্র প্রতিষ্ঠার যাবতীয় উদ্যোগ নেয়া হবে। জিয়াউর রহমান তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বে। তার পক্ষ হতে প্রতিনিধিদেরকে বলা হয়, মাত্র দশ হাজার থেকে পনের হাজার রাজনৈতিক বন্দী কারাগারে আটক আছে। বছরের প্রথম দিকে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে প্রকাশিত হয় যে, দেশে ৩৬,৬৮৫ জন রাজবন্দী কারাগারে আটক রয়েছে। ১৯ জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা বিরােধী যে সমস্ত ব্যক্তি হত্যা, ধর্ষণ, লুট ও অগ্নি সংযােগের মত অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলাে তাদের কারাগারে হতে ছেড়ে দিয়ে প্রতিনিধি দলকে দেখানাের প্রয়াস পায় যে, রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক বন্দীদের ছেড়ে দেবার বিষয়ে এটি ছিলাে ছলনাপূর্ণ কৌশল। ৩৪. এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রতিনিধি বাংলাদেশ ত্যাগ করার ১০দিনের মধ্যেই অর্থাৎ ২১ শে এপ্রিল ‘৭৭ সনে জিয়াউর রহমান বিচারপতি সায়েমের নিকট হতে প্রেসিডেন্টের পদটি পর্যন্ত কেড়ে নেন। প্রেসিডেন্টের পদ দখল করেই মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ২২শে এপ্রিল জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ও টিভিতে ভাষণ দিয়ে বললেনঃ তার নীতির প্রতি দেশবাসীর আস্থা আছে কিনা-এই লক্ষ্যে ৩০শে মে ১৯৭৭ সনে হাঁ/না গণভােট অনুষ্ঠিত হবে।

.

গণভােট ঃ বাংলাদেশে ভােটজালিয়াতির প্রথম পাঠ।

৩৫. প্রসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম দেশে দ্রুত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু এবং ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচনে অনুষ্ঠানে তাকে সহায়তা করার জন্য বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে উপদেষ্টা পদমর্যাদায় প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী নিযুক্ত করেছিলেন। জাতির নিকট প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি মােতাবেক নির্ধারিত সময়ে পার্লামেন্ট নির্বাচন করার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট সায়েম ভােটার লিস্ট তৈরী করান, জাতীয় সংসদের সীমানায় নির্ধারণ এবং নির্বাচন বিধি জারী করেন, রাজনৈতিক দলবিধি জারী করে ঘরােয়া রাজনৈতিক তৎপরতা শুরুর

মাধ্যমে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার একটি বিশেষ পর্যায়ে যখন অগ্রসর হচ্ছিলেন, সেই সময় জিয়াউর রহমান চক্রান্তের মাধ্যমে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্থগিত ঘােষণা করতে বিচারপতি সায়েমকে বাধ্য করেন। নির্বাচন স্থগিত ঘােষণার এক সপ্তাহের মধ্যে ১৯৭৬ সনের ৩০ নভেম্বর জিয়াউর রহমান সশস্ত্রবাহিনীর কতিপয় অধিনায়কদের সঙ্গে নিয়ে বঙ্গভবনে গমন করেন এ বং বিচারপতি সায়েমের নিকট হতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি কেড়ে নেন। মার্শাল ল জারী থাকায় সামরিক ফরমান বলে দেশ শাসিত হচ্ছিল এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকই ছিলেন প্রকৃত প্রস্তাবে দেশের মুখ্য ব্যক্তি।

৩৬. প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুবের পদাংক অনুসরণ করেন। জেনারেল আইয়ুব যেমনভাবে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলাে, ইতিহাসের গতিধারায় ২০ বছর পর বাংলাদেশে প্রাসাদ চক্রান্তের পালায় একই নাটকের পুনরাবৃত্তি ঘটলাে। ১৯৭৭ সনের ২১শে এপ্রিল মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সদল বলে বঙ্গভবনে ঢুকে প্রেসিডেন্ট সায়েমকে বললেন যে, আপনি অসুস্থ’ এবং রাষ্ট্রপতির পদ জিয়াউর রহমানের বরাবরে ছেড়ে দিতে হবে। প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম সংবিধানিক ও আইনগত বৈধতার প্রশ্ন তুললেন। তিনি পরিস্কারভাবে বললেন যে, যেহেতু তিনি এখন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নন যে ফরমান জারী করে জিয়াউর রহমানের বরাবরে প্রেসিডেন্ট পদ হতে পদত্যাগ করতে পারেন অথবা ভাইস প্রেসিডেন্টও নেই যার বরাবরে তিনি পদত্যাগ করতে পারেন। শাসনতান্ত্রিক ও আইনগত জটিলতার এই বিষয়টি সমাধান না করেই জিয়াউর রহমান বললেন যে, আপনার পদত্যাগে কোন অসুবিধা হবে না। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে পদত্যাগের এই সংকটকে আমি ম্যানেজ করে নেব।২০

৩৭. বলাবাহল্য, বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট পদ হতে পদত্যাগ করতে হলাে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান একাধারে প্রধান সেনাপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং প্রেসিডেন্ট-একাই এই তিনটি পদের অধিকারী হয়ে বাংলাদেশকে তার নিজস্ব জমিদারী হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। এসব পদ একত্রে কবজা করে জিয়াউর রহমান ২২শে এপ্রিল ৭৭ সনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে বললেন ঃ ৩০শে মে সারা দেশে গণভােট অনুষ্ঠিত হবে। গণভােট হবে, জনগণ তাকে চায় কিনা। হাঁ বা না। তার প্রতি জনগণের সমর্থন আছে কিনা বা জনগণ তার অনুসৃত নীতি অনুমােদন করে কিনা?

গণভােট ঃ ভােটের তামাশাপত্র

৩৮. দেশে মার্শল ল’। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। রাজনৈতিক তৎপরতা নেই। প্রাসাদ চক্রান্ত। হত্যা খুনের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত বাংলাদেশ। সন্ধ্যা-প্রভাত নিরবচ্ছিন্ন কার্য্য। এর মধ্যে গণভোেট ভােটের তামাশা মাত্র। গণভােটের পক্ষে সাফাই গাওয়া হলাে। আতউর রহমান খান, ইউ পিপি নেতা ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী, জাতীয় গণমুক্তির হাজী মােহাম্মদ দানেশ বিবৃতিতে বললেন “গণভােট দিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিয়েছে। নির্মম পরিহাস এই যে, জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হবে এই দোহাই তুলে এ ধরনের নেতৃবৃন্দই (!) ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের নির্বাচন স্থগিত ঘােষণাকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু মাত্র তিন মাস পর মে মাসে গণভােট অনুষ্ঠানে তারা সমর্থন করতে লজ্জা পান নি।

৩৯. নির্ধারিত তারিখে গণভােট হলাে। ৩ কোটি ৮৩ লক্ষ ৬৩ হাজার ৮৫৮ জন ভােটারের মধ্যে বৈধ ভােট পড়ল ৩ কোটি ৩৭ লক্ষ ৭৯ হাজার ৭৬৮ টি। এর মধ্যে জিয়াউর রহমানের পক্ষে হাঁ সূচক ভােট পরে ৩কোটি ৩৪ লক্ষ ৮৭০টি অর্থাৎ বৈধ ভােটের ৯৮.৮৮% ভাগ। এবং ‘না’ পরে ৩ লক্ষ ৭৮ হাজার ৮৯৮ টি। যা বৈধ ভােটের ১.১২% মাত্র।

গণভোেট সম্পর্কে বিদেশী পত্রিকার মতামত

৪০. “দি গার্ডিয়ান”-এর সংবাদদাতা সাইমন উইনচেস্টার বলেন, জিয়ার পক্ষে প্রদত্ত

ভােটের সংখ্যা ঢাকার কূটনৈতিক মহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। একটি পশ্চিমা দূতাবাস সুত্র থেকে বলা হয়, জিয়া সম্পর্কে উৎসাহ ভােটারদের কর্মরত সূত্র থেকে বলা হয়, নির্বাচনী অফিসারদের অনেকেই অব্যবহৃত ভােট দিয়ে “হ্যা” চিহ্নিত বাক্স ভর্তি করেছে। একটি ভােটদান কেন্দ্রে জনৈক নির্বাচনী অফিসার। সবগুলি ভােটপত্র “হ্যাঁ” চিহ্ন বাক্সে দিয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছেন।২৪ বিবিসি’র সংবাদদাতা মার্ক টালী সাধারণতঃ জিয়ার সামরিক শাসনকে সমর্থন করেন তা সত্ত্বেও ৩১শে মে তারিখে প্রেরিত সংবাদে তিনি বলেন, সরকারী অফিসার ও দুর্নীতিপরায়ণ গ্রাম্য মাতব্বররা জিয়ার পক্ষে ভােট সংগ্রহ করে।

গণভােটে আর কারাে কোন ভূমিকা ছিলাে না।” ৪১. জেলা প্রশাসকদের বলে দেয়া হয় যেন ব্যাপক ভােটে জিয়াউর রহমান জয়যুক্ত হন। পাবনার নির্বাচনী এলাকার নাগডেমরা ভােট কেন্দ্রের একজন প্রিসাইডিং

অফিসারকে শতকরা ৯০%ভাগ প্রদত্ত ভােট সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বললেন ঃ গণভােট? জনগণ আসেনি, ভােটও দেয়নি। আমরাই ব্যালটে সিল মেরে ছিড়ে বাসে ঢুকিয়েছি। ভােটারদের কষ্ট করে আসতে হয়নি।’ বলা বাহুল্য গণভােটে-এ হাঁ-এ পক্ষে প্রচারণা চালানাে যাবে। কিন্তু ‘না’ এর পক্ষে প্রচারণা চালালে শাস্তি নির্ধারণ করা হয়। জিয়ার মৃত্যুর পর জিয়াউর রহমানের পথ ধরে তার নিযুক্ত প্রধান সেনাপতি ও প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল এরশাদ বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নিকট হতে প্রেসিডেন্ট পদ কেড়ে নেয় এবং ১৯৮৫ সনে ২১শে মার্চ জাতিকে পুনরায় জিয়ার অনুরূপ গণভােটের সামনে দাঁড় করায়।২৪

সূত্র : জেনারেল জিয়ার  রাজত্ব  – অধ্যাপক আবু সাইদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!