২৪ শে এপ্রিল পাকসেনারা কাড়পাড়া হয়ে বাগেরহাট আসে। এসেই কাড়াপাড় এলাকাতেই ১০০ উপরে লোকে হত্যা করে। নাগের বাজার তেলপট্টি ইত্যাদি এলাকা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া শুরু করে এবং বলে দেয় লুট করার জন্য, মুসলমানের অধিকাংশ ঘরবাড়ী সব লুট করা শুরু করে।
মে মাসে এখানে শান্তি কমিটি সেই সঙ্গে রাজাকার বাহিনী গঠন হয় পরবর্তীকালে রজব আলী ফকির শান্তি কমিটির চেয়ারম্যন নিযুক্ত হয়। সমগ্র বাগেরহাট এলাকাতে পাকসেনার চাইতে রাজাকাররাই অত্যাচার চালিয়েছে বেশী।
শ্রাবণ মাসের শেষের দিকে বাগেরহাট শহর এলাকাতে যত হিন্দু ছিল কিছু হত্যা বাদে সবাইকে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত করে। এরপর গ্রামের দিতে হাত বাড়ায়। গ্রামকে গ্রাম ধরে সবাইকে মুসলমান করতে থাকে।
আমি আমার স্বামী, ছেলেমেয়ে, বাবা, মা, কাকা, কাকীমা তাদের ছেলেমেয়ে সবাই ইসলাম ধর্মে দিক্ষা নিই। কিন্তু রাজাকাররা এর পরেও অত্যাচার করতে ছাড়েনি। এরপরও অসংখ্যা লোককে হত্য করেছে।
২২শে আশ্বিন রাত তিনটার দিকে ৫০/৬০ জন রাজাকার আমাদের বাড়ী ঘিরে ফেলে। প্রথমে তারা মুক্তিবাহিনী বলে পরিচয় দিয়ে থাকতে চায় রাতের মত। অনেক অনুনয়-বিনয় করে। প্রথমে আমার ভাই প্রদীপ গুহ দেখেই চিনেছিল তারা রাজাকার। তাই সে ছাদ দিয়ে গাছ বেয়ে পিছনে নামবার চেষ্টা করেছে। উপর থেকে নিচে নামলেই রাজাকাররা ধরে ফেলে। ওকে কিছু দুর নিয়ে গিয়ে বেয়োনেট দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে। তারপর বাবা কাকা এবং পাশের বাড়ীর তিনজনকে কিছু দুর নিয়ে গিয়ে সিরাজ মাষ্টার এবং তার দল গুলি করে মাথা সব উড়িয়ে দেয়। সকালবেলা আমরা সেসব লাশ উদ্ধার করি। হত্যা করে বাড়ীঘর লুট করে সব নিয়ে চলে যায়। আমরা যারা বেঁচে ছিলাম বাগেরহাট শহরে চলে আসি। বাড়ীতে কেবল একজন কৃষাণ এবং আমার ৭০ বছরের বৃদ্ধা দিদিমাকে রেখে আসি।
কার্ত্তিক মাসের ১২/১৩ তারিখ হবে। রাজাকাররা আবার যায় আমাদের গ্রামে। দড়াটানা নদীর ওপার থেকে মুক্তিবাহিনী গোলাগুলি করতো। তাই রজব আলী অর্ডার দেয় সমস্ত এলাকা ঘরবাড়ী ভেঙ্গে ধ্বংস করে গাছপালা পরিস্কার করে ফেলার জন্য। ঐদিন আমাদের বাড়ীতে ঢোকে এবং দিদিমাকে লেপকাঁথা দিয়ে জড়িয়ে কেরোসিন তেল ঢেলে দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে। আগুন দিয়ে দিদিমা আমার কাকার নাম ধরে বার বার চিৎকার করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সমস্ত এলাকা পুড়িয়ে ধ্বংস করে । ভোলা বোসকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। রাধা বল্লভ গ্রামে মেয়েদের রাজাকাররা ধরে নিয়ে আসে। রাজাকাররা সারারাত পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে দিনের বেলা গুলি করে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রাখে। বলরাম সাহাকে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করে। তার বিরাট গদির উপরে রজব আলী বসত, চারিদিকে রাজাকার ঘিরে থাকতো। ওখানে একটি ঘরে লোকদের জবাই করতো। প্রত্যেকদিন ১০টি লোক যোগাড় করতেই হতো, ১০ টি করে জবাই করতোই। লোক না পারলে যেভাবেই হোক, ফকির হোক, এনে দিতেই হতো। আমি একদিন এক লোকের সুপারিশ করতে গিয়ে দেখলাম ঘরের ভিতর চাপ চাপ রক্ত পড়েছে। মদনের মাঠ ওয়াপদা রেষ্ট হাউসে একটি কক্ষে অসংখ্য লোককে জবাই করেছে। খাদ্দার গ্রামে এক বাড়ী থেকে সবাই ধরে এনে হত্যা করে। ডাক বাংলো ঘাটে প্রত্যেহ অসংখ্য লোককে জবাই করেছে বেয়োনেট দিয়ে।
এক বৃদ্ধ রামদা দিয়ে অসংখ্য লোককে কেটেছে। সে পিঠ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতো না। লোক ধরে বলতো ‘বাবা নীচু হও তা নইলে কাটতে আমার কষ্ট হয়। তাড়াতাড়ি বসে পড়ে তোমাদের কষ্টও কম হবে, আমারও কষ্ট কম হবে।‘
ইসহাক মিয়ার বাড়ীতে অনেক মেযে আশ্রয় নিয়েছিল। তা সত্ত্বেও কেউ রেহাই পায়নি। সমস্ত এলাকাতে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো।
গ্রাম গ্রামান্তর থেকে ব্যাপকভাবে হিন্দু মেয়ে ধরে পাকসেনাদের হাতে তুলে দিতো রাজাকাররা। এছাড়া রাজাকাররা গ্রামে গ্রামে ঢুকে অধিকাংশ মেয়ের উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে।
বাগেরহাট থানার মীর্জাপুর গ্রাম এবং সারাগ্রামে বহু মেয়ে অপমাণিত হয়ে আত্নহত্যা করেছে বিষপানে কেউ বা গলায় দড়ি দিয়ে।
রাজাকার, আল-বদর এদের মানুষ চরমভাবে ঘৃণা করতো। আমার মনে হয় সমস্ত বাংলাদেশে রাজাকাররা এমন ভাবে সন্ত্রাস আর নৃশংস অত্যাচার কোথাও চালায়নি। নদীর ঘাটে দড়ি বাঁধা অবস্থায় এক মাসে ৪/৫ টি লোককে গলা কাটা অবস্থায় পেয়েছি। গলা সম্পূর্ণ কাটতো না অল্প কেটে ছেড়ে দিতো, ছটফট করে শেষ হয়ে যেত। হাড়ি খালীতে (বাগেরহাট থানা) বিষ্ণু মহাশয়কে তার বৌয়ের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নিয়ে আরও পাঁচজনকে ধরে ওর স্ত্রীর সামনে গুলি করে হত্যা করে। অত্যাচার চালায় সারা গ্রামে। বি,এ,পাশ এক মেয়েকে ধরে অত্যাচার চালিয়ে ছুরি দিয়ে হত্যা করে। মদনের মাঠের এক ঘরে ওরা নিয়মিত মানুষ কেটেছে।
স্বাক্ষর
তাহমীনা বেগম (দিপালী)
গ্রাম-বৈতপুর
ডাকঘর ও থানা- বাগেরহাট
জেলা-খুলনা
৩/৮/৭৩