ইতিহাস বিকৃতির নায়ক
ক, স্বাধীনতা ঘােষণা
১. ১৯৮১ সনের ৩রা জুন সেই সময়কার জাতীয় সংসদে মরহুম জিয়াউর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক শােক প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। শােক প্রস্তাবে বলা হয় “১৯৭১ সালে পাকিস্তান সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে তিনি বাংলাদেশ গণঅ্যুথানের নেতৃত্ব দেন এবং ২৭শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন।” বলাবাহুল্য, সেই থেকে প্রকাশ্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা প্রসঙ্গে তথাকথিত বিতর্ক এবং বিভ্রান্তির প্রয়াস চালানাে হচ্ছে।
২. জাতীয় স্বাধীনতার পিছনে আছে এক দীর্ঘ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস। পাকিস্তান জন্মের পর হতে এদেশের শাসন ও শােষণের অবাধ রাজত্ব কায়েম হয়। বাঙালী জাতি সত্ত্বার সকল সুকৃতি, আত্মপরিচয়ের সকল উপাদান, ভাষা-সংস্কৃতি এবং জাতীয় বিশ্বাস ও শক্তিকে ধ্বংস করার নগ্ন চতুর কৌশলী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে বাঙালী জাতি বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমিক সংগ্রাম করেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের বিস্তৃত পটভূমিতে রয়েছে ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাস, যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা এবং নির্বাচন, প্রাসাদ চক্রান্তে ১৯৫৪ সনের ৩০শে মে পূর্ববঙ্গ পরিষদ বাতিল ঘােষণা, ১৯৫৮ সালের ২৭শে অক্টোবর সামরিক আইন জারী এবং আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল ও শাসন, কথিত ২২ পরিবারের নগ্ন শশাষণ, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা কর্মসূচী, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উত্তাল গণআন্দোলন। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিদায় । ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা গ্রহণ। নির্বাচন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন। নির্বাচন পরবর্তী ষড়যন্ত্র। ৭১ সাল। ৬৬-এর ৬ দফা ১ দফায় পরিণত। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার উদাত্ত আহ্বান ও নির্দেশে সশস্ত্র সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা অর্জন।
৩. সংগ্রামের এই সকল স্তরে স্তরে জাতির মানস গঠন, আত্মজাগৃতির নবতর উদ্বোধন, আত্মবিশ্বাস ও প্রত্যয়ের জাতিগত উপলব্ধি জনগােষ্ঠীর সর্বস্তরে কখনাে ধীরে কখনাে দ্রুত তালে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। দীর্ঘ নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে বন্ধুর যাত্রায় বাঙালী জাতি সংগ্রামে, সাহসে, বৈশিষ্ট্যে, আত্মত্যাগের বলিষ্ঠতায় স্বাধীন। বীর্যবান সত্ত্বার স্বাপ্নিক সম্রাটের প্রতীকীরূপ বরণ করে নেয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। সেজন্যেই ১৯৭০ সনের নির্বাচনে কায়েমী স্বার্থবাদীর সকল ষড়যন্ত্র, সমস্ত প্রলােভন, ক্ষমতার দাপটকে উপেক্ষা করে বাঙালী জাতি বঙ্গবন্ধুক এক অবিসম্বাদিত নেতারূপে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। দীর্ঘ দিবস রজনী, কত একাকী আপােষহীন তেজদৃপ্ত, কখনাে নিকষকালাে রাতের ঘাতক সঙ্গীণের মুখােমুখি হয়েও যিনি বাঙালী জাতি ও তার মুক্তির লক্ষ্যে, স্বাধীনতার লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন সেই ব্যক্তিসত্ত্বার একক প্রতীকী নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
৪. ঐতিহাসিক ঘটনার স্বতঃসিদ্ধতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার, স্থপতি, সিহাপসালার এবং মহামানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বাংলাদেশ নাম তাঁরই দেয়া। সেজন্য বঙ্গবন্ধু, বাঙালী জাতি এবং বাংলাদেশ এক এবং অভিন্ন হয়ে আছে। যাঁর ডাকে, আহ্বানে, নির্দেশে, ঘােষণায়, অনুপ্রেরণায় বাঙালী জাতি তুলে নিয়েছে। হাতিয়ার, ঝাপিয়ে পড়েছে শত্রু নিধনে। অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবদানকে ছােট করে না দেখলেও একথা বলা যায়-স্বাধীনতা সংগ্রামের বিস্তৃত পটভূমিকায় সামরিক কোন কর্মকর্তার বিশেষ ও উল্লেখ্য অবদানের অদ্ভুতদাবী এক কথায় নাকচ হয়ে যায়। আগরতলা মামলায় যে সমস্ত সামরিক অফিসারকে জড়ানাে হয়েছিলাে সেখানেও প্রধান ও ১নং আসামী শেখ মুজিব। অন্যান্যরা এসেছে তাঁকে জড়িয়ে। তবুও স্বাধীনতার ঘােষণা প্রসঙ্গে যখন বিতর্ক এসেছে তখন বিষয়টির বস্তুনিষ্ঠ ফয়সালা হওয়া দরকার।
৫. স্বাধীনতার ঘােষণা সম্পর্কে শত্রু পক্ষের ভাষ্য কি? ক, যারা বলেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণা কেন-স্বাধীনতার জন্যই তিনি প্রস্তুত ছিলেন না ,তার জবাবে এয়ার ভাইস মার্শাল আজগর খান লিখেছেন, “১৯৭১-এর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি ঢাকা যাই। সেখানে শেখ মুজিবের সাথে দেখা করি। আমি মুজিবুর রহমানকে প্রশ্ন করলাম, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি কিরূপ নেবে এবং অচলাবস্থার অবসান কিভাবে সম্ভব? উত্তরে মুজিব বললেন, পরিস্থিতি অত্যন্ত সহজ। ইয়াহিয়া খান প্রথম ঢাকা আসবেন, এম এম আহমেদ (প্ল্যানিং কমিশনের প্রধান) তাঁকে অনুসরণ করবেন। ভুট্টো আসবেন তারপর। ইয়াহিয়া খান সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেবেন এবং তার পরেই পাকিস্তানের শেষ।” পাকিস্তানের শেষ অর্থাৎ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
৬. পাকিস্তান সামরিক গােয়েন্দা বাহিনীর মেজর সিদ্দিক সালিক ডেভিড লােশাক-এর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, When the forst short had been fired, the voice of Sheik Mujibur Rahman came faintly through on a wave length close to that of the offcial Pakistan Radio, in what must have been and sounded like a Pre-recorded message, the Sheik proclaimed East Pakistan to be the peoples Republic of Bangladesh” তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল টিক্কা খান সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছিলাে, কেননা আমি নিজে মুজিবের স্বাধীনতা ঘােষণার স্বকণ্ঠ বাণী শুনেছি। পাকিস্তানের তদানীন্তন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সদম্ভে ঘােষণা করেছিলেন “আমি শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেব। কেননা তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেছেন। শুধু তাই নয়, আজ যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবদানকে খাটো, ছােট ও উদ্দেশ্য প্রণােদিতভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে হীনউদ্দেশ্য সাধন করতে চান তাদেরকে বাংলাদেশের গণহত্যা নায়ক ও প্রধানতম শ তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চের বেতার ভাষণটি পাঠ করার অনুরােধ জানাই।
৭. ইয়াহিয়া খানের এই ঘােষণাটি শুধু নয়, স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা ঘােষণা সম্পর্কিত পূর্ব পাকস্তিানের সংকট সম্পর্কে ঘােষিত পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রকাশিত শ্বেতপত্র একটি প্রামাণ্য দলিল। পাকিস্তান সামরিক এবং বেসামরিক গােয়েন্দা বাহিনীর কর্তৃক প্রণতি এই দীর্ঘ শ্বেতপত্রে স্বাধীনতা ঘােষণা করার জন্য একটি ব্যক্তিকেই অভিযুক্ত করা হয়েছে বার বার-তিনি হলেন শেখ মুজিব। শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে “২৫শে মার্চের পূর্ববর্তী দিনগুলােতে সশস্ত্র অভ্যুথানের বিস্তারিত পরিকল্পনা এগিয়ে নেয়া হতে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর কাছে সরাসরি দায়ী করে সাবেক কর্ণেল ওসমানীকে বিপ্লবী বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করেন। শ্বেতপত্রে ইপি আর ইবিআর-এর ট্রান্সমিটারে যােগাযােগ স্থাপনের কথাও বরা হয়েছে। যারা এই ঘােষণাটি প্রচার করেছিলেন তাদের নাম (১) এ কে এস এম এ হাকিম এ ই ডব্লিউ (২) জালাল আহমদ টিটিআরইএম ডব্লিউ (৩) জুলহাস উদ্দিন প্রাক্তন ইপিআর টিটিআর (৪) মােহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ই এস ডব্লিউ (৫) আবুল কাশেম খান টিটিআর (6) আবুল ফজল ক্যাশিয়ার। এরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ট্রান্সমিট করেছিলেন। ভাষনটি ট্রান্সমিট করার পর তারা বঙ্গবন্ধুর নিকট জানতে চান তাদের। আর কি করণীয়। বঙ্গবন্ধু তাদের অবিলম্বে উক্ত স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দেন।
৮. স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর বক্তব্য, সাক্ষাৎকার এ প্রসেঙ্গ উপস্থাপন অত্যন্ত জরুরী। ১৯৭২ সনের স্বাধীনতা দিবসে পূর্বদেশের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জেনারেল ওসমানী বলেছেন ঃ “২৫শে মার্চ রাত দশটায় বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন আপনাকে যেন ওরা কোন অবস্থাতেই ধরতে না পারে। তিনি আমার উপর যুদ্ধ পরিচালনার করার নির্দেশ প্রদান করেন।” যিনি যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সেনাপতি নিযুক্ত করেন তিনি যুদ্ধ ঘােষণা করেননি-এ। যুক্তি কোনভাবে গ্রহণীয়? জেনারেল ওসমানী জাতীয় সংসদে স্বাধীনতা ঘােষণা প্রসঙ্গিত বিতর্কে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ১৯৮১ সনে পুনরায় দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, বঙ্গবন্ধুই, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন।”
৯. এ সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ বলেন, “১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আমি বিদেশে ছিলাম। ওমানের টেলিভিশন পর্দায় দেখেছি ভােটের ছবি। তার আগে ঝড়ের ছবি। দেশে ফিরে দেখলাম আমার দেখা বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে গেছে। চারিদিকে দানা বেঁধে উঠেছে সংগ্রাম। এবার স্বপ্ন স্বার্থক হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হবেন রাষ্ট্রনায়ক।” শেখ মুজিবের প্রতি একজন সরল প্রাণ সামরিক নেতার অকপট আত্মস্বীকৃতি, উপলব্ধির অবিকৃতি; স্বাধীনতার পরপরই সাপ্তাহিক বিচিত্রায় যা বিবৃত আছে।
১০. মেজর জেনারেল জিয়ার লিখিত প্রবন্ধ “একটি জাতির জন্ম”৬ এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযােগ্য। তিনি লিখেছেন ? “তারপর এলাে ১লা মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সারাদেশে শুরু হলাে ব্যাপক অসহযােগ আন্দোলন। তিনি লিখেছেনঃ “৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘােষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল বলে মনে হলাে।” ঐ ঘােষণার প্রেক্ষিতে তিনি ১৭ই মার্চ অন্যান্য অফিসারদের সংগে গােপন বৈঠকে মিলিত হন। লক্ষ্যণীয় জিয়াউর রহমান ঐ প্রবন্ধে ‘বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা’ হিসেবে স্বীকার করেছেন। যদিও ক্ষমতায় এসে তিনি ইতিহাসকে বারবার বিকৃত করতে চেয়েছেন স্বীয় সংকীর্ণ স্বার্থে। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর ঐ গ্রীন সিগন্যাল’ না পেলে কি করতেন? কয়েকজন লােক নিয়ে বিদ্রোহ করতেন? তিনি আরও লিখেছেন, ‘অফিসারদের মেসে যাওয়ার পথে আমি মেজর মীর শওকতকে ডাকলাম। তাকে জানালাম আমরা বিদ্রোহ করেছি। শওকত আমার হাতে হাত মিলালাে।’
১১. মেজর মীর শওকত পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল শওকত হয়ে স্বাধীনতা ঘােষণা সম্পর্কে একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এভাবে“আপনারা বিবেককেই জিজ্ঞাসা করুন এটা অনস্বীকার্য যে ২৫শে এবং ২৬শে মার্চ ‘৭১-এর চরম মুহূর্তে প্রতিটি বাঙালীর মনেই স্বাধীনতার কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সেই হিসেবে প্রতিটি বাঙালী সেদিন হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীনতার এক একজন ঘােষক। কিন্তু কে সেই মহান নেতা যিনি সেদিন অন্তরালে থেকেও প্রতিটি বাঙালীকে জুগিয়েছিলেন এই সাহস? কার আহ্বানে বাঙালী সেদিন পেয়েছিল স্বাধীনতার প্রেরণা? ৭ই মার্চ (৭১) ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কে জাতিকে স্বাধীনতার ডাক শুনিয়েছিলেন? ২৬শে মার্চ ‘৭১ সন্ধ্যা হতে পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের মূল বেতার কেন্দ্র থেকে নিরাপদ দূরত্বে কালুর ঘাট ট্রান্সমিটারে অবস্থান করে যারা স্বাধীনতার কথা বললেন, বিভিন্ন ঘােষণা প্রচার করলেন, কে তাঁদের সেদিনের প্রেরণার উৎস ছিলেন? কার পক্ষে তারা প্রচার করেছিলেন সেসব ঘােষণা, স্বাধীনতার কথা? কাজেই বলুন কে আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি? কে বা কারা ঘােষক ছিলেন, সেটা কি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা ছিল না? এই আনুষ্ঠানিকতার বিতর্কে আমি জড়িয়ে পড়তে চাই না।
১২. সামরিক ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি বেসামরিক ব্যক্তি তদানীন্তন চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডাঃ এ আর মল্লিক বলেন, “২৬শে মার্চ আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান সাহেব সংগ্রাম পরিষদের অপিস থেকে ফোনে ডঃ আনিসুজ্জামানকে জানান যে, গতরাতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন। ঘােষণার বাণী চট্টগ্রামে পৌছে গেছে। তিনি আরও জানান চট্টগ্রাম বেতার থেকে এই ঘােষনা আজই প্রচার করা হবে। ডঃ এ আর মল্লিক বলেন ঃ বিকেলে হান্নান সাহেব স্বাধীনতার যে ঘােষণার পাঠ করেন তা আমরা শুনতে পাই।” একাত্তরের রণাঙ্গনে বইয়ের লেখক শামসুল হুদা চৌধুরী লিখেছেনঃ স্পষ্টতই চট্টগ্রাম বেতার থেকে বাংলাদেশের। স্বাধীনতা ঘােষণার পক্ষে প্রথম বিপ্লবী ভাষণ প্রচারের গৌরব অর্জন করেছিলেন জনাব এম, এ, হান্নান। চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে সংগঠিত বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম অনুষ্ঠান শুরু হয় ২৬শে মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে। তিনি লিখেছেন, এই বেতারে প্রথম সান্ধ্য অধিবেশনেই পবিত্র কোরান তেলাওয়াতের পর বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘােষণার বাংলা অনুবাদটি উপস্থাপন করেন জনাব আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। পরদিন অর্থাৎ ২৭শে মার্চ ‘৭১ সান্ধ্য অধিবেশনে সদ্য গঠিত এই বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােসণা পাঠ করলেন মেজর জিয়াউর রহমান।৮ ২৭শে মার্চে জিয়া কাগজ নিয়ে প্রথমে নিজের নামে স্বাধীনতা ঘােষনার খসড়ায় তার নিজের নাম কেটে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন।”
১৩. তখন আমি পাবনার নির্বাচনী এলাকা হতে নির্বাচিত তদানীন্তন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্য। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পদ্মা যমুনার বাঁকে জড়ানাে এই অঞ্চলটি তখন উদ্বেল এবং উত্তাল। অস্থির উত্তেজনা। প্রতিরােধ মানসিকতা প্রজ্জ্বলিত। ২৫শের রাতে ঢাকায় কি ঘটেছে জানিনা। সকালে ঢাকা বেতারে ভিন্ন কণ্ঠ, উর্দু বয়ান শুনে মনে হলাে ভয়ংকর কিছু একটা ঘটেছে। বুঝলাম অসহযােগ আন্দোলন নেই। আন্দালন সশস্ত্র। লড়াই আসন্ন। থানা থেকে অস্ত্র নিয়ে নিলাম। দুপুরে সিরাজগঞ্জ থেকে লােক এলাে, সিরাজগঞ্জ ওয়ালেস স্টেশন থেকে পাঠানাে একটি মেসেস ঃ “পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিত পিলখানায় ইপিআর ঘাঁটি রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের লােকদের হত্যা করেছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি। আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শক্রদের সঙ্গে যুদ্ধ। করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চলিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ ইপিআর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপােষ নেই। জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতা প্রিয় লােকদের কাছে এ সংবাদ পৌছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয়বাংলা”
শেখ মুজিবুর রহমান
২৫শে মার্চ, ১৯৭১
১৪. এই ঘােষণাটি হাতে পেয়েই নগরবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরােধ শুরু হয়ে গেলাে। পাকবাহিনীর মােকাবিলা করে অর্ধ শত মুক্তিযােদ্ধা নগরবাড়ীর নিকট ডাববাগানে প্রাণ দিয়েছেন। একটি জাতির স্বাধীনতার পটভূমি বিরাট এবং বিস্তীর্ণ। হাজার লােকের আত্মদান, ত্যাগ তিতিক্ষা, জেল জুলুম, রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার মুকুর মুঞ্জরিত হয়। এটা কোন হঠাৎ খেয়ালী বা উচ্চাভিলাষী কোন ব্যক্তির নির্দেশে হয় না। জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম কোনাে খেলা নয়। যেন রেফারী হুইসেল দিলেই খেলা শুরু হয়ে। গেলাে। কোন এক ক্যাপ্টেন বা মেজর পাক সামরিক বাহিনীর পােষাকে আবৃত হয়ে হঠাৎ ঘােষণা দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করার দাবীদার সাজলে জাতি। 2 কেবলমাত্র তাকে করুণা করতে পারে। ভাবখানা এই যে, কোন সামরিক অফিসার 1.0 রাতারাতি বেতার কেন্দ্র দখল করে স্বাধীনতা ঘােষণা দিয়েই দেশ স্বাধীন করে। ফেললাে। একটি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা দুরূহ কাজ। সেজন্য বিভিন্ন পর্যায়ে জাতীয় মানস গঠন করতে হয়েছে। এই মানস গঠনে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সেজন্য তিনি জাতির নেতা, জাতির পিতা, স্বাধীনতার স্থপতি। ইতিহাস। একথা বলবে। জাতির পিতার এই অনন্য ভূমিকার পাশাপাশি যারা জিয়ার কল্পিত ভাষণকে স্থাপন করে ইতিহাস বিকৃতি করতে চায় আপত্তি সেখানেই। জিয়ার কল্পিত ভাষণটি সামনে রেখে স্বাধীনতার শত্রু পক্ষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণাকেই বিভ্রান্তি। করতে চায়, অবমূল্যায়ন করতে চায়, বিতর্কের ধুম্রজালে স্বাধীনতাকেই ঘােট করতে চায়, সেখানেই ঘাের আপত্তি। তারা জানে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করা মানে স্বাধীনতাকে খাটো করা, বাঙালীকে অসম্মান করা এবং তারা জিয়ার ভাষণকে সামনে রেখে ঐ কাজটিই করতে চায়। এই রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ইতিহাসের সমস্ত আয়ােজন। এবং অধ্যায়কে বাদ দিয়ে জিয়ার কথিত ভাষণ নিয়ে এত মাতামাতি পাগলামী।
১৫. ‘৭১-এর ৩রা মার্চ পল্টনের ছাত্র জনসভায় ঘােষিত হয়েছিলাে স্বাধীনতার ইশতেহার, যেখানে বলা হয়েছিলাে, “৫৪ হাজার ৫ শত ৭৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের জন্য আবাসভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ। বলা হয়েছিলাে, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও সর্বাধিনায়ক। তারপর ৭ই মার্চের বজ্রকণ্ঠে ঘােষিত হলাে “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” মূলতঃ স্বাধীনতার ঘােষণা, স্বাধীনতা সংগ্রামের রণকৌশল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চই ঘােষণা করেছিলেন। আর ১৯৭১ সালের মুজিব নগরে পঠিত স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে বলা হয়েছে ? “বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখন্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। উক্ত ঘােষণায় আরও বলা হয়েছে ? এই ঘােষণা দ্বারা আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বে যে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন, সেই পবিত্র ঘােষণাকে অনুমােদন করছি।১০ সেজন্য স্বাধীনতার ১ম ঘােষণার উল্লেখ আমরা পাই ৩রা মার্চের ছাত্র জনসভায় দ্বিতীয় ঘােষণা ৭ই মার্চ লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে, ২৬শে মার্চের ঘােষণা যা দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রেরিত ও প্রচারিত এবং আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পঠিত হয় ১৭ই এপ্রিল মুজিব নগর। যার উপর ভিত্তি করে সরকার। গঠিত হয়। যুদ্ধ পরিচালিত হয় এবং যার ফলে আজ বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। খ. বাঙালী জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ।
১৬. জিয়াউর রহমান ১৯৭২ সনে বিচিত্রায় “একটি জাতির জন্ম” শীর্ষক একটি নিবন্ধ লেখেন। সেই নিবন্ধের একাংশে লিখেছেন “পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই ঐতিহাসিক ঢাকা মহানগরীতে মিঃ জিন্নাহ যে দিন ঘােষণা করলেন, উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, আমার মতে ঠিক সেই দিনই বাঙালী হৃদয়ে অঙ্কুরিত, হয়েছিলাে বাঙালী জাতীয়তাবাদ, জন্ম হয়েছিলাে বাঙালী জাতির।১১ ১৯৭৭ সনের ২০শে এপ্রিল পর্যন্ত জিয়াউর রহমান ছিলেন বাঙালী, তিনি বিশ্বাসী ছিলেন বাঙালী জাতীয়তাবাদে। ১৯৭৭ সনের ২১শে এপ্রিলে সামরিক ফরমান বলে সংবিধান সংশােধন করে তিনি হয়ে গেলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। অবশ্য বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের জনক পাকিস্তানী দালাল খান্দকার আবদুল হামিদ। তিনিই ১৯৭৬ সনের ১৫ই ফেব্রুয়ারীতে সামরিক সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সুযােগ নিয়ে বাংলা একাডেমীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উপর ক্ষুদ্র নিবন্ধ পাঠ করেন। সেই থেকে ১৯৭৭ সনের ২১শে এপ্রিল সামরিক ফরমান বালাদেশী জাতীয়তাবাদ সংবিধান-এর অন্তর্ভূক্তি। বাঙালী জাতীয়তার পরিবর্তে পাকিস্তানী আমলে বাংলাদেশী জাতীয়তবাদ সমগ্র বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়কে বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে। স্বাধীনতা বিরােধীরা যা চায় তাহলে জাতিসত্ত্বাকে ধ্বংস করা ও জাতীয় ঐক্যসূত্রকে প্রশ্নের মুখােমুখি করা। জেনারেল জিয়া তাদের পাতা ফাঁদেই পা রেখেছেন। বাঙালী হয়েও মুসলমান হওয়া যায়-হিন্দু বা অন্য সম্প্রদায়ের পরিচয়ে কোন অসুবিধা হয়না। এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য কৃষ্টি ও সংগ্রাম সংস্কৃতি সব কিছুকেই বিসর্জন দিতে হয়। শেকড়হীন যেমন বৃক্ষ হয়না, ঐতিহ্যহীন তেমন জাতিও হয়না। এই জন্যই ডক্টর । মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছিলেন, “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তারচেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙালী।” জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা বিরােধী জাতিদ্রোহী শক্তির সমর্থন আদায়ে এই ইতিহাস বিকৃতির আশ্রয় নিয়েছেন।
গ. মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’র পরিবর্তে জিন্দাবাদ।
১৭. পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে দ্বিজাতি তত্ত্বের মৌল প্রেরণার কণ্ঠধ্বনি ছিলাে ‘জিন্দাবাদ।’ ‘জিন্দাবাদ’ বিদেশী শব্দ এবং পাকস্তিানী আদর্শের ধারক। ১৯৬৬ সনে জাতীয় দুর্যোগ মুহুর্তে বাঙালী জাতি সত্তার উদ্বোধনে বাংলাদেশের মানুষের বিজয় ‘বালার। জয়’ এই আকাঙক্ষার ‘জয়বাংলা’ বাস্তবায়নে উচ্চারিত হয়। তারপর হতেই “জয়বাংলা’ পাকস্তিানী জিন্দাবাদ-এর পরিবর্তে তদানীন্তন সাড়ে সাত কোটি। মানুষের হৃদয়-নিঃসৃত ধ্বনি হয়ে দাঁড়ায়। স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘জয় বাংলা’ শব্দটি ছিলাে। মুক্তিপাগল মানুষের রণধ্বনি। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ও তার দালালরা ‘জিন্দাবাদ ধ্বনি নিয়ে বাংলার মানুষকে হত্যা করেছে নিষ্ঠুর পশবিকতায়। তেমনি বাংলার মুক্তিযােদ্ধাদের মুখে উচ্চারিত হয়েছে জয়বাংলা। সমগ্র বাঙালী জাতির ও মুক্তিযুদ্ধের বলদর্পী রণধ্বনি ছিলাে ‘জয়বাংলা’। স্বাধীন বাংলা ১৯৭৫ সনে জাতির জনককে হত্যা করে দেশকে পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নেবার কৌশলে পুনরায় স্বাধীনতা বিরােধী আত্মস্বীকৃত খুনীদের মুখে উচ্চারিত হলাে ‘জিন্দাবাদ’। পাকিস্তানী মানসকিতায় আচ্ছন্ন ও চেতনায় লালিত সেনা অফিসার ও আমলা এবং স্বাধীনতা বিরােধীদের ঐক্যের যােগসূত্রে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোেধকে মুছে ফেলার লক্ষ্যে রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রচার মাধ্যমে পুনরায় ‘জিন্দাবাদ’ চাল করলেন।
ঘ. বাংলাদেশ বেতার-এর পরিবর্তে রেডিও বাংলাদেশ
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিলাে দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রচার মাধ্যমের নাম হয় বাংলাদেশ বেতার। কিন্তু ‘৭৫ পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান চক্র পুনরায় রেডিও পাকিস্তানের অনুরূপ বাংলাদেশ বেতার-এর নাম পরিবর্তন করে রেডিও বালাদেশ চালু রেখেছে। এসবই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মূল্যবােধের বিকৃতি যে কাজটি জিয়াউর রহমান করেছেন সদর্পে ও স্বীয় স্বার্থে।
ঙ. ‘স্বাধীনতা দিবস’-এর পরিবর্তে “জাতীয় দিবস’ জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে উদ্ধতপূর্ণ পদক্ষেপ ছিলাে ২৬শে মার্চ বাঙালী জাতির ‘স্বাধীনতা দিবস’কে জাতীয় দিবস’ হিসেবে ঘােষণা। তিনি ১৯৮১ সনে ঘােষণা করেন যে, অতঃপর ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস’ ‘জাতীয় দিবস’ হিসেবে পালিত হবে। এই ঘােষণার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘােষণা, ঐ ঘােষণার প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সনের ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র এবং সর্বোপরি বাংলদেশের স্বাধীনতার আইনানুগ ভিত্তিতে কুঠারাঘাত করতে চেয়েছেন। অন্য সমগ্র দেশে আন্দোলন শুরু হয়। আওয়ামী লীগের আহ্বানে সারাদেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সকল শক্তি ও পক্ষে মধ্যে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে জিয়াউর রহমান তার পূর্ব সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়ে ২৬শে মার্চকে স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস’ হিসেবে পুনরায় ঘােষণা করতে বাধ্য হন। ‘স্বাধীনতা দিবস’-সম্পর্কে ইতিহাস বিকৃতির এই নজির বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।
চ, মুক্তিযুদ্ধের পরিবর্তে স্বাধীনতা যুদ্ধ
প্রকৃত পক্ষে জিয়াউর রহমান অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বাঙালী জাতির ইতহাস ও ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার চক্রান্তে লিপ্ত ছিলেন। এক সামরিক ফরমান বরে ১৯৭২ সনের মূল সংবিধানের যেখানে লিখিত ছিলাে “জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের” সে শব্দগুলাে পরিবর্তন করে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে কথাগুলাে যােগ করেন। বাঙালী জাতি শুধুমাত্র নয় মাসে ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেনি এর পেছনে রয়েছে হাজার বছরের সংগ্রাম ও ইতহািস। জিয়াউর রহমান। বাঙালী জাতির সেই সংগ্রাম বিশেষ করে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে ২৪ বছরের সংগ্রাম মুছে ফেলার লক্ষ্য এই ইতিহাস বিকৃতি ঘটান। শুধু তাই নয়, বাঙালী জাতি শুধু জাতীয় স্বাধীনতার সগ্রাম করেনি; করেছে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ যাতে পেট ভরে খেতে পায়, সুচিকিৎসা পায়, শিক্ষা পায়, গায়ে কাপড় পায়, বাসস্থান পায়, সর্বোপরি যথাযােগ্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা পায় এবং বৈষম্যহীন শােষণমুক্ত সমাজে ভদ্রভাবে বসবাস করতে পারে।
ছ. পতাকা বদলের ষড়যন্ত্র ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। ১৯৭৮ সনের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে গাঢ় সবুজ জমিনের উপর লাল রঙের পরিবর্তে কমলা রঙের একটি বৃত্ত সম্বলিত পতাকা ঢাকার কিছুসংখ্যক সরকারী ভবনের উপর উত্তোলনের নির্দেশ দেন। সেদিন এ উপলক্ষ্যে বলা হয়েছিলাে গাঢ় সবুজের পটভূমিতে কমলা রঙের একটি বৃত্ত থাকবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাকমুহূর্তে ২৩শে ‘৭১ মার্চ সবুজ রঙের পটভূমিতে বাংলাদেশের ম্যাপ সম্বলিত লাল বৃত্ত খচিত পতাকা নিয়ে বাঙালী জাতি। সগ্রাম করেছেন। এই পতাকা হাতে ৩০ লক্ষ লােক শহীদ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সরকার বাংলাদেশ ম্যাপ তুলে দিয়ে সূর্যের প্রতীক হিসেবে ঐ পতাকাই গ্রহণ।
জাতীয় পতাকার অবমাননার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদের পর জিয়াউর রহমান তার পতাকা পরিবর্তনের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন।১২ জিয়াউর রহমান সচেতনভাবেই ইতিহাস বিকৃতির আশ্রয় নিয়েছেন। বাঙালী জাতির ইতিহাস সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ ও স্বাধীনতার চেতনা লালন ও ধারণ করার মতাে মানসিক গড়ন তার ছিলাে না। এছাড়া ইতহািস ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ ও চেতনা অবলুপ্তির পদক্ষেপগুলাে মুক্তিযুদ্ধের হৃৎপিন্ডে ছুরি বসিয়ে দিয়েছিলাে-যা পূর্বে আলােচিত হয়েছে।
সূত্র : জেনারেল জিয়ার রাজত্ব – অধ্যাপক আবু সাইদ