You dont have javascript enabled! Please enable it! এক দানবীয় শক্তি | জিয়ার রাজত্ব - সংগ্রামের নোটবুক

এক দানবীয় শক্তি

১. একজন ব্যক্তির ক্ষমতার উচ্চভিলাষ একটি দেশ ও জাতিকে কীভাবে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে যায় সমকালীন ইতিহাসে তার নজির জেনারেল জিয়াউর রহমান।

২. হত্যা খুন ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক চক্রান্তের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্বকে পর্যদুস্ত করতে নির্মমভাবে তিনি এগিয়ে গেছেন সামরিক পােশাকে সশস্ত্র হয়ে। ৫ শতাধিক সামরিক ফরমান, বিধি-প্রবিধান, বিধান, আদেশ-নির্দেশ জারী। করে জনগণের সকল মৌলিক অধিকার হরণ করে এবং সংবিধানের ইচ্ছাকৃতভাবে। পরিবর্তন সাধন করে রাষ্ট্রযন্ত্রের সামরিক, বেসামরিক সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে এক দানবীয় শক্তির প্রতীক হিসেবেই বাল্লাদেশের ইতিহাসে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

৩. ম্যাকিয়াভেলির ‘দ্য প্রিন্স মাথায় রেখে তিনি রাজনীতির দাবার ঘুটি চেলেছেন নিজের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে নিরংকুশ করার স্বার্থে। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন ‘শিয়ালের চেয়েও ধূর্ত এবং ব্যাঘ্রের চেয়েও হিংস্র। শত্রু নিধনে তার জুড়ি নেই, ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে।’ কোন ন্যায় নীতির ধার ধরেননি তিনি। আদর্শবাদ বলতে তার কিছু ছিলােনা- ছিলাে শুধু লােক মােহিত করার শ্লোগান। “দ্য প্রিন্স ছিলাে তার আদর্শ ও প্রয়ােগিক নির্দেশনা।

৪. বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান সেনাপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক; প্রেসিডেন্ট সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এতগুলাে কর্তৃত্বশালী ও ক্ষমতাধর পদসমূহ । দখল করার পরেও জিয়ার মনে স্বস্তি ছিলােনা-একই সাথে বাংলাদেশের। সংবিধানকে ইচ্ছেমত সংশােধন করে এক মহাকর্তৃত্বশালী দানবীয় শক্তির কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণে নিজেকে সুরক্ষিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, তারই সৃষ্ট শক্তি ও চক্রান্তে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে।।

৫. জিয়াউর রহমানের বিরল সৌভাগ্য এজন্য যে, রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ও জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক ব্যবস্থায় তার কালাে হাতের কলংক জনসাধারণের সামনে প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা কুক্ষিগত করে একচ্ছত্র, একনায়কত্ব ও স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধানে পরিবর্তন আনেন ও পরিবর্তনসমূহ বলবৎ রাখেন; তাই তাকে অনন্ত অসীম বলদর্শী সম্রাটের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি

৬. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্বার্থে ১৯৭৫ সনের জানুয়ারীতে চতুর্থ সংশােধনীর মধ্যেমে প্রসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটনাের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে। বঙ্গবন্ধুর এই শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনকে গণতন্ত্র হত্যাকারী হিসেবে প্রচার করলেও পরবর্তী শাসকগণ জিয়া-এরশাদ কেউই চতুর্থ সংশােধনীর এই প্রসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির পরিবর্তন করেননি। বরং তারা সামরিক ফরমানের শাণিত অস্ত্র দ্বারা উক্ত প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতিকেই আরাে শক্ত, কঠিন ও দৃঢ় করেছেন। সংশােধিত সংবিধানের সঙ্গে নতুন নতুন অগণতান্ত্রিক অনুচ্ছেদ ও সামরিক ঘােষণা দ্বারা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে এক দানবীয় শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। স্থাপন কবেছে নিজস্ব সাম্রাজ্য। রাজত্ব করেছেন জবাবদিহীহীন দাপটে। সংসদের কোন ক্ষমতা না থাকলেও হাস্যকরভাবে বলা হতাে সার্বভৌম সংসদ’।

৭. ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ধারা অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন সংসদ সদস্যের দ্বারা। শাসনতান্ত্রিক প্রধান হিসেবে তিনি রাষ্ট্র প্রধান। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সরকার প্রধান। ৪র্থ সংশােধনী এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র প্রধান হন। সংবিধানের সংশােধিত উক্ত ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট জনগণের প্রত্যক্ষ ভােটে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। ‘

নির্বাহী ক্ষমতা

৮. সংবিধানের ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের সকল নির্বাহী কার্য প্রেসিডেন্টের নামে পরিচালিত হবে। প্রেসিডেন্ট আইনের দ্বারা তার কোন আদেশ কিভাবে বাস্তবায়িত হবে তার দিকনির্দেশনা দেবেন এবং এই সমস্ত আদেশ যথাযথভাবে পালিত না হওয়ার কারনে কোন আদালতে মামলা করা যাবে না। প্রেসিডেন্ট সরকারী কার্যাবলী বন্টণ ও পরিচালনার জন্য বিধিসমূহ প্রণয়ন করবেন। নির্বাহী বিভাগের যে কোন কর্মকর্তাকে প্রেসিডেন্ট তার ইচ্ছেমত নিয়ােগ ও বরখাস্ত করতে পারবেন।

জাতীয় সংসদের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা কতক্ষিত

৯. জাতীয় সংসদকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া গয়েছে। প্রেসিডেন্ট প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে প্রভাব খাটিয়ে আইন বিভাগকে তার ইচ্ছেমত আইন পাশের জন্য প্ররােচিত করতে পারেন। পরিণামে দেখা যায়, জাতীয় সংসদ জনগণের কল্যাণের জন্য প্রয়ােজনীয় আইন তৈরী না করে প্রেসিডেন্টের আজ্ঞাবহ আইন তৈরী করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট উপস্থিত হয়ে ভাষণ দিতে পারেন না। সংসদকে প্রভাব মুক্ত রাখার স্বার্থেই প্রেসিডেন্টকে এই ক্ষমতা দেয়া হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পরবর্তী সংসদের প্রথম অধিবেশনে এবং প্রতি বছরের প্রথম অধিবেশনের বক্তব্য রাখতে বা বাণী প্রেরণ করতে পারেন।

১০. সংসদের সদস্যগণকে বাংলাদেশের জন্য আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, কিন্তু কার্যত এর কোনাে মূল্য নেই। সেই নির্বাচিত সংসদকে প্রেসিডেন্ট শুধুমাত্র একটি ঘােষণা দিয়ে সেই সংসদ স্থগিত বা বাতিল করে দিতে পারেন। সংবিধানের ধারা অনুযায়ী অর্থাৎ এই প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়নের সকল ক্ষমতা সংসদকে দেয়া হয়েছে, কিন্তু মূল চাবিকাঠি প্রেসিডেন্টের হাতে। কারণ সংসদে পাসকৃত কোন বিল প্রেসিডেন্ট সম্মতিদানের পরই কেবল তা আইনে পরিণত হবে। সংবিৎ সুতরাং সংসদ বিল পাশ করতে পারে, কিন্তু তা আইন হবে তখন, যখন প্রেসিডেন্ট তাতে সম্মতি দেবেন। সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে এবং সংসদকে প্রেসিডেন্টের হাতের কবজায় রাখা হয়েছে।

১১. প্রেসিডেন্টকে দেয়া হয়েছে আইন প্রণয়নের একক ক্ষমতা। কারণ সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় বা উহার অধিবেশনকাল ব্যতীত সময়ে প্রেসিডেন্ট যদি মনে করেন। আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়ােজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে, তবে উক্ত পরিস্থিতি তিনি যেরূপ প্রয়ােজনীয় বলে মনে করেন, সেরূপ অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করতে পারবেন এবং জারি হবার সময় হতে অনুরূপভাবে প্রণীত অধ্যাদেশ সংসদের আইনের ন্যায় ক্ষমতাসম্পন্ন হবে।১১ সুতরাং বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ইচ্ছেমত সংসদ ভেঙে দিয়ে তার মর্জিমাফিক আইন তৈরী করতে পারেন। অধিকাংশ সময়ই সংসদ অধিবেশনে থাকেনি। ফলে প্রেসিডেন্ট অধিবেশন না = থাকাকালীন সময়ে তার ইচ্ছেমত আইন প্রণয়ন করতে পারেন। ‘

প্রজাতন্ত্রের উচ্চপদে নিয়ােগদানের ক্ষমতা

১২. বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারপতি, এটর্নি জেনারেল, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনের সদস্যবৃন্দ, হিসাব পরীক্ষক ও অডিটর জেনারেল, সরকারী কর্মকমিশনের সভাপতিসহ অন্যান্য সদস্যবৃন্দ নিয়ােগ করেন। ১২ এ্যাটর্নি জেনারেল ও নির্বাচন কমিশনের সভাপতিসহ অন্যান্য সদস্যবৃন্দকে প্রেসিডেন্ট যে কোন সময় নিয়োেগ করতে পারেন এবং বরখাস্ত করতে পারেন। ‘সুতরাং এ সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ তাদের পেশাহত দায়িত্বে সৎ ও নিরপেক্ষ হতে পারেন না। বরং প্রেসিডেন্টের খেয়ালখুশী মত তাদের কার্যপরিচালনা করতে হয়। সেজন্য জিয়া-এরশাদের আমলে কোন নির্বাচনই নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি।

১৩. বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে তার কার্যাবলী পরিচলনায় পরামর্শদানের উদ্দেশ্যে একজন প্রধানমন্ত্রী, একাধিক উপপ্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী সমন্বয়ে একটি মন্ত্রীপরিষদ থাকবে। ১৩ তারা সংসদের নিকট জবাবদিহী করতে বাধ্য নন, তারা । প্রেসিডেন্টের নিকট জবাবদিহী করেন। দেশে মন্ত্রী পরিষদ একটি গুরুত্বহীন। পরিষদে পরিণত হয়েছে। কারণ প্রেসিডেন্ট ইচ্ছে করলেই আজ যাকে মন্ত্রী নিয়ােগ করেছেন, কাল তাকে বিদায় দিতে পারেন।

জরুরী অবস্থা জারী করার ক্ষমতা

১৪. বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে জরুরী অবস্থা জারীর এমন একটি বাড়তি ক্ষমতা দিয়েছে১৪, যার নজীর বিরল। তিনটি কারনে প্রেসিডেন্ট জরুরী অবস্থা জারি। করতে পারেন, (১) যুদ্ধ (২) বহিঃশত্রুর আক্রমণ (৩) আভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা। লক্ষ্যণীয়, যুদ্ধ, বহিঃশত্রুর আক্রমণ কিংবা আভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা কেনাে কিছুরই দরকার নেই। সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে প্রেসিডেন্ট মনে করলেই জরুরী এ অবস্থা জারি করতে পারেন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হচ্ছে জরুরী অবস্থা জারিকালীন সময়ে নাগরিকদের চলাফেরা স্বাধীনতা১৫ সমাবেশ করায় স্বাধীনতা১৬ সভা সমাবেশ করার স্বাধীনতা১৭ চিন্তা চেতনা ও কথা বলার স্বাধীনতা১৮ এই। মৌলিক অধিকারগুলাে স্থগিত থাকবে। শুধু তাই নয়, এই জরুরী অবস্থা। চলাকালীন সময়ে প্রেসিডেন্ট যে কোন মৌলিক অধিকার বলবত্তারনের জন্য আদালতে মামলা দায়ের করার অধিকার স্থগিত রাখার নির্দেশ দিতে পারেন।১৯ স্থগিত হয়ে যায় দেশবাসীর মৌলিক অধিকার। আটক করা হয় সেইসব ব্যক্তিদের, যারা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অগ্রসৈনিক, গ্রেফতার আর । পুলিশী নির্যাতন ও নিদারুণ তান্ডবলীলা চলে স্বৈরাচারকে রক্ষা করার বেপরােয়া। রক্ত লােলুপতা। “

সরকারী অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত ক্ষমতা

১৫. সংবিধানের ধারা অনুযায়ী২০, ‘সরকারী অর্থ ব্যয়ের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে, এমন কোন অর্থবিল বা বিল রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ছাড়া সংসদে উথাপন করা যাবে না।’ এছাড়া ‘সংসদ যদি কোন মঞ্জুরী দাবি নামঞ্জুর বা হ্রাস করে, তবে সংশ্লিষ্ট বছরের আর্থিক বিবৃতিেিত উল্লেখিত ব্যয় নির্বাহের জন্য রাষ্ট্রপতি একশত বিশ দিনের মেয়াদ পর্যন্ত সংযুক্ত তহবিল থেকে অর্থ প্রত্যাহারের কর্তৃত্ব প্রদান করতে পাবেন।২১ সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচের কর্তৃত্বও প্রেসিডেন্টের হাতে কুক্ষিগত।

প্রেসিডেন্টের অপসারণ

১৬. বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে তার মেয়াদকাল পূর্ণ করার আগে সংবিধান লংঘন বা গুরুতর অসদাচরনের অভিযােগে অপসারণ করা যায়। এই অপসারণের জন্য। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে সংসদে দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের অভিযােগ আনতে হয়, এই অভিযােগ যদি তিন-চতুর্থাংশ সংসদ সদস্যের ভােটে পাশ হয় তবেই একজন প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করা যায়।২২ সুতরাং এই জটিল পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করা অসম্ভব। তাছাড়া প্রেসিডেন্টের হাতে সংসদ বাতিল করা ক্ষমতা থাকায় তার বিরুদ্ধে সংসদের দুই # তৃতীয়াংশ সদস্য অভিযােগ আনলেই সংসদ বাতিল করে তিনি তার অপসারণকে | ঠেকিয়ে দিতে পারেন।

পাকিস্তানীদের সম্পত্তি ফেরৎ দেবার জন্য সংবিধান সংশােধন

১৭. সামরিক ফরমানে বাংলাদেশ সংবিধানে যে পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে তা  জাতীয় স্বার্থকে সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করার স্বৈরাচারী নজির। ২৩ ৪৭ নং অনুচ্ছেদে “কোন সম্পত্তি বাধ্যতামূলক গ্রহণ, রাষ্ট্রায়াত্তকরণ বা দখল কিংবা সাময়িকভাবে বা স্থায়ীভাবে কোন সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্যক বা অন্যবিধ উদ্যোগসন্ন একাধিক প্রতিষ্ঠানের বাধ্যতামূলক সংযুক্তকরণ, অনুরূপ যে কোন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, ব্যবস্থাপক, এজেন্ট ও কর্মচারীদের অধিকার সম্পর্কিত, খনিজদ্রব্য বা খনিজ তৈল অনুসন্ধান বা লাভের অধিকার সম্পর্কিত ইত্যাকার অধিকার বিলােপ, পরিবর্তন, সীমিতকরণ বা নিয়ন্ত্রণকরণের যে বিধান” সংবিধানে ছিলাে এ সম্পর্কে সংবিধানের শর্তে “তবে সংসদের সেইরূপ আইনের জন্য আনীত কোন বিলে যদি এমন বিধান থাকে কিংবা তাহার এমন কার্যকারিতা থাকে, যাহার ফলে কোন সম্পত্তি হইতে রাষ্ট্র বঞ্চিত হন, কিংবা রাষ্ট্র কর্তৃক দেয় যেখানে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বৃদ্ধি হয়, তাহা হইলে অনুরূপ বিল সংসদের মােট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই তৃতীয়াংশ ভােটে গৃহীত না হইলে সম্পতির জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইবেনা।” এই শর্তযুক্ত কথাগুলি জিয়াউর রহমান বিলুপ্ত করেন এজন্য যে, ৪৭নং অনুচ্ছেদের অধীনে রাষ্ট্রায়ত্তকরণের মাধ্যমে যে পাকিস্তানী কলকারখানা রাষ্ট্রায়াত্ত করার যে বিধান বলবৎ ছিলাে সে বিধান থাকলে পাকিস্তানী শিল্পপতিদের এসব শিল্পকারখানা ব্যবসা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ফেরৎ দেয়া যাবে না।

‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’-এর আওতায় পাকিস্তানী নাগরিকদের শিল্প প্রতিষ্ঠান ফিরিয়ে দেবার জন্য একটি চুক্তি করেছিলেন। সেই চুক্তির শর্তানুসারে জিয়াউর রহমান (১) ন্যাশনাল আয়রণ এন্ড স্টীল ইন্ডাষ্ট্রিজ লিঃ (কালুরঘাট), (২) জেনারেল কোং লিঃ (চট্টগ্রাম), (৪) আল মােস্তফা ইন্ডাষ্ট্রিজ লিঃ (চট্টগ্রাম), (৫) আহমদিয়া ওয়েল মিলস লিঃ (চট্টগ্রাম), (৬) বাংলাদেশ টায়ার্স (ঢাকা), (৭) বেঙ্গল গ্লাস ওয়ার্কস লিঃ (ঢাকা), (৮) স্টীল ওয়ার্কস লিঃ (ঢাকা) (৯) রহমান মেটাল ইন্ডাষ্ট্রিজ (ঢাকা), (১০) বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজেস লিঃ (ঢাকা), (১১) ইষ্ট বেঙ্গল ট্রেডিং এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিয়াল করপােরেশন (চট্টগ্রাম), এই প্রতিষ্ঠানগুলি পাকিস্তানী শিল্পপতিদের ফিরিয়ে দেন। এই ১১টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ৬০ কোটি টাকা মূলধন নিয়ােজিত হয়েছিলাে। ২৪

সামরিক প্রধান নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে ১৯৯

১৮, সংবিধানের অনুচ্ছেদে২৫ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এবং লাভজনক পদে বহাল থেকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করা যাবে না”। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রধান সেনাপতি, সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান পদে বহাল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অংশগ্রহণ করার লক্ষ্যেই ব্যক্তিস্বার্থে সংবিধানে পরিবর্তন করে। ২৬ বলা হলাে, আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযােগ্য একটি ঘােষণা করিতেছে না, এমন পদ ব্যতীত তিনি প্রজাতন্ত্রে কর্মে কোন লাভ জনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন তাহলেও তিনি নির্বাচন করতে পারবেন। জিয়াউর রহমান শুধু নিজের জন্য তার নিয়ােগকৃত মন্ত্রী পরিষদের বেলায়ও একই সাথে এই আইনের প্রযােজ্যতার কথা বলে সংবিধানে২৭ ধারা যুক্ত করে। সেখানে বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি কেবলমাত্র প্রধান মন্ত্রী, উপ-প্রধান মন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপ-মন্ত্রী হইবার কারণে প্রজাতন্ত্রের কার্যে কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলিয়া গণ্য হইবেন ।” ক্ষমতায় টিকে থাকা ও ব্যক্তি স্বার্থে সংবিধান কে ব্যবহার, সংবিধান কর্তন PY করার এমন নজির সম্ভবতঃ পৃথিবীতে আর নেই। তার বিদেশের সঙ্গে গােপন চুক্তি

১৯. আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সনের ২য় সামরিক ঘােষণাপত্র দ্বারা সংবিধানে২৮ সংযােজন করলেন যেক্ষেত্রে দেশের প্রকৃত ক্ষমতার উৎস জনগণকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। জনগণের কর্তৃত্বকে খর্ব করা হয়েছে। বিদেশের সঙ্গে যে কোন চুক্তি যা দেশের স্বার্থ হানি ঘটিয়েছে বলে কোন ব্যক্তির নিকট প্রতীয়মান হলে তিনি ইতিপূর্বে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করার অধিকারী ছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আমলে সীমান্ত চুক্তির অন্তর্ভূক্ত তিনবিঘা সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ নিয়ে হাইকোর্টে মামলা দায়ের হয়েছিলাে। এবং হাইকোর্ট এর যথাযথ রায় ও পর্যবেক্ষণ প্রদান করেছিলেন। এমনকি ভারতের সঙ্গে ২৫ বছর চুক্তিও ছিলাে প্রকাশ্য চুক্তি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দলিল দস্তাবেজে দেশে বিদেশে যা প্রকাশিত হয়েছে। এই ২৫ বছর চুক্তির বৈধতা বা দেশ জাতির স্বার্থহানি ঘটে থাকলে যে কোন ব্যক্তি তা চ্যালেঞ্জ করে আদালতের স্মরণাপন্ন হতে পারেন, পারতেন। কিন্তু জেনারেল জিয়া সামরিক ফরমান জারী করে সংবিধানে ১৪৫(ক)নং ধারা সংযােজনপূর্বক বিদেশের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে জনগণকে অবহিত করার বিষয়ে বা চুক্তি বা চুক্তির মর্মকথা সম্পর্কে জনগণকে অন্ধকারে রাখার পথ বেছে নিলেন। সংবিধানে সংযােজিত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “বিদেশের সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ কোন চুক্তি এইরূপে পেশ করা হইবে না যদি রাষ্ট্রপতি মনে করেন যে, এইরূপ করা জাতীয় স্বার্থ বিরােধী হইবে।” জাতীয় সংসদ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা গঠিত এবং এই সংসদের মাধ্যমে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়। সেই জাতীয় সংসদে কোন চুক্তি উথাপন বিষয়ে জাতীয় স্বার্থ বিরােধী হবে কেন তা বােধগম্য নয়। রাষ্ট্রপতি [#] জিয়াউর রহমান জনগণকে বা জন প্রতিনিধিদের বা জাতীয় সংসদকে কোন সময়ই ১ আস্থায় নেননি, সেজন্যই আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রে এই শর্তারােপ করা হয়েছে।

হত্যা-খুনের অব্যাহতি

২০. সামরিক ফরমানের সকল অগণতান্ত্রিক আইনের শাসন পরিপন্থী ধারাসমূহকে ক. সংবিধানের চতুর্থ তফশিলের ও অস্থায়ী বিধানাবলী২৯ প্রটেকশন দেয়া হয়েছে। “বিধানে ধারাসমূহ৩০ যুক্ত করে ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট হতে ১৯৭৯ সনের ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত সকল অগণতান্ত্রিক আদেশ, সামরিক ফরমান, বিধি-বিধান সব কিছুকেই আইনের এক্তিয়ার বহির্ভূত করা হয়। এর সঙ্গে সংবিধানে “বাংলা ও ইংরেজী পাঠের মধ্যে কোন বিরােধ, বৈপরীত্য অথবা অসামঞ্জস্যতার ক্ষেত্রে ইংরাজী পাঠ প্রধান্য পাইবে”-যুক্ত হয়। অথচ ইতিপূর্বে এ ক্ষেত্রে ছিলাে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে। ২১. ৫ম সংশােধনীর মাধ্যমে অন্যায় অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল, হত্যা কু ষড়যন্ত্র চক্রান্তের রাজনীতি, বেআইনী ও অসংবিধানিক কার্যক্রমকে বৈধতা দানের IT উদ্দেশ্যে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ট জাতীয় সংসদ সদস্য প্রয়ােজন।

সেজন্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে পেশীশক্তি কালাে টাকা, ভােট কারচুপি ও ভােট জালিয়াতির নির্বাচন প্রক্রিয়া চালু হয়। জিয়াউর রহমান কোন প্রকার নিয়মনীতির তােয়াক্কা না করে, আদর্শকে ছুঁড়ে ফেলে, স্বীয় দুষ্কর্য ও অপকর্মকে ঢাকা দেবার জন্য দেশে “১০টি হুন্ডা, ২০ জন গুন্ডা, সব ঠান্ডা” এই ধারার রাজনীতি প্রচলন করেন। রাজনীতিতে আত্মত্যাগ, আদর্শবাদ এসব যেন কথার কথা হয়ে দাড়ায়। রাজনীতিকে আদর্শহীন কালাে টাকার মালিকদের নিকট ইজারা দেয়া হয়। If জিয়াউর রহমানের আমল হতেই রাষ্ট্রীয়ভাবে ভােট কারচুপির বিশেষ ব্যবস্থা গৃহীত। ৭৩ সনের নির্বাচনে খন্দকার মােশতাক ভােট জালিয়াতি করে জয়লাভ করেছিলাে ব্যক্তিক পর্যায়ে। জিয়াউর রহমানের আমলে রাষ্ট্রীয় ব্লু প্রিন্ট অনুসারে রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে ভােট কারচুপির ব্যবস্থা গৃহীত হয় । জিয়াউর রহমান ভােটে জয়লাভের জন্য রাষ্ট্রীয় যন্ত্র, গােয়েন্দাবাহিনী, সশস্ত্রবাহিনীসহ সকল শৃঙ্খলাবাহিনী বেসরকারী প্রশাসনকে কাজে লাগানাে হয় এবং নির্বাচন কমিশনকেও প্রভাবান্বিত করেন।

২২. নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন পরিষদ, অর্থ বরাদ্দ, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নিয়ােগ, বদলি, অপসারণ, সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান হিসেবে পুরাে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বক্ষেত্রে জেনারেল জিয়া সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তার নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করেন। একচ্ছত্র সম্রাটের মতাে জিয়াউর রহমান তার রাজত্বকালে প্রমাণ করেছেন “আই অ্যাম দি স্টেট।”

সূত্র : জেনারেল জিয়ার  রাজত্ব  – অধ্যাপক আবু সাইদ