কালুরঘাটের লড়াই
১৯৭১ এর ২৬ মার্চ বিকেলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার(ইবিআরসি) এর রিক্রুট এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদেরকে চট্টগ্রাম বন্দরে আগেরদিন আসা “এম ভি সোয়াট” এর সামরিক মালামাল জাহাজ থেকে খালাস করার জন্য নিয়ে আসা হয়। মাল খালাস করার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে ই বি আর সি এর কর্মী এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদেরকে ১৭ নম্বর জেটিতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয়। আচমকাই এম ভি সোয়াটের ডেক থেকে লাইট মেশিনগানে লাইনে দাঁড়ানো সৈন্য ও অন্যান্যদের উদ্দেশ্যে গুলি ছোঁড়া হয়। এ হামলায় ঘটনাস্থলেই অনেক সৈন্য ও ই বি আর সি কর্মী নির্মমভাবে নিহত হন। হামলার শিকার হওয়া মানুষগুলোর মধ্যে মাত্র ৬-৭ জন কর্ণফুলীতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে সক্ষম হন।
২৮ মার্চ’৭১ তারিখে লেফটেন্যান্ট শামসুর মবিন চৌধুরীর নেতৃত্বে এক প্লাটুন সৈনিক এবং ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে আরেক প্লাটুন ইপিআরকে চট্টগ্রামের চক বাজার এলাকায় প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিতে বলা হয়। প্রতিরোধের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় ২৯ মার্চে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানী সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে অবস্থান নেয়। ২৯ মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রথম আক্রমণ চালায় যেটি ব্যাহত হয়। শহরের মধ্যে গোলাগুলি এতোটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে ১ এপ্রিল ’৭১ এ সৈন্যদেরকে পিছু হটে ওই রাতেই কালুরঘাটে আশ্রয় নিতে হয়।
তৎকালীন ইপিআর এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি কর্ণফুলী-কক্সবাজার হাইওয়ের পাশে কালুরঘাটে অবস্থান নেয় ।এদের সদরদপ্তর ছিল কালুরঘাটের পার্শ্ববর্তী গ্রাম গোমদন্ডীতে।
কর্ণফুলী নদীর পূর্বপ্রান্তে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনটি কোম্পানি এবং পশ্চিম প্রান্তে ইপিআরের এক কোম্পানি সৈন্যের মাধ্যমে কালুরঘাটে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে ইপিআরের সৈন্যরা অ্যাডভান্সড পজিশন থেকে শত্রুপক্ষ সম্বন্ধে খোঁজ খবর দেওয়া, শত্রুপক্ষের বিলম্ব ঘটানো এবং তাদেরকে হতাহত করে কালুরঘাট ব্রিজ দিয়ে নদীর পূর্ব প্রান্তে আশ্রয় নেয় ।
মূল প্রতিরোধ গড়ে ওঠে ডান দিক থেকে আলফা কোম্পানি, পেছনে ব্রাভো কোম্পানি এবং বামে চার্লি কোম্পানির সাহায্যে যাদের নেতৃত্বে ছিলেন যথাক্রমে ক্যাপ্টেন চৌধুরী খালিকুজ্জামান,লেফটেন্যান্ট শমশের মবিন চৌধুরী এবং ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী। ইপিআরের দলটি একজন জুনিয়র কমিশনড অফিসারের নেতৃত্বে অ্যাডভান্সড পজিশন থেকে কাজ করছিল।
৩০ মার্চ তারিখে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়ে সামনে থাকা দলটি নদীর পশ্চিম তীর হতে মাইলখানেক সামনে ইস্পাহানি বিল্ডিং এ অবস্থান নেয়। পশ্চিম তীরেও কিছু যোদ্ধাকে রাখা হয় যাতে আগের দলটিকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে পারে।
৩য় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের এক প্লাটুন সৈন্য কালুরঘাটের দিকে অগ্রসর হয়ে কর্ণফুলির এক মাইল দক্ষিণে থাকা কৃষি ভবন দখল করে নেয়। ৩১ মার্চ ভোরে লেফটেন্যান্ট মাহফুজুর রহমানকে নির্দেশ দেওয়া হয় শত্রুপক্ষকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে। তিনি এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে বীরত্বের সাথে আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং ভবনটি দখলে আনতে সক্ষম হন।
কালুরঘাটের যুদ্ধ লাগাতারভাবে চলতে থাকে এবং ব্রিজের দখল নেওয়ার জন্য শত্রুপক্ষের একাধিক প্রচেষ্টাকে সাহসীকতার সাথে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়। কালুরঘাটের এলাকার এ লড়াই কয়েকদিন অব্যাহত থাকে। এক পর্যায়ে ১১ এপ্রিল’৭১ এ , শত্রুপক্ষ অ্যাডভান্সড টিমের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। তারা ইস্পাহানি বিল্ডীং এর দখল নেয়। তবে পশ্চিম প্রান্তে থাকা সৈন্যরা অ্যাডভান্সড টিমের পিছু হটে আসাকে কভার দিতে সেখানেই থেকে যায়। যুদ্ধ চলতে থাকায়, ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী পরিখা থেকে উঠে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এগিয়ে যান। কয়েকশ’ গজ যাওয়ার পরপরই শত্রুপক্ষকে এগিয়ে যেতে দেখা যায়। আচমকাই চারদিক থেকে গুলি ছুটতে শুরু করে এবং ক্যপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী পাকস্থলীতে মর্টার শেলের স্প্লিন্টার বিঁধে মারাত্মকভাবে আহত হন। লেফটেন্যান্ট মাহফুজুর রহমান একজন স্বেচ্ছাসেবী ছাত্রের সহায়তায় এবং লেফটেন্যান্ট শমশের মবিন চৌধুরীর গুলি চালিয়ে গিয়ে কভার করার মাধ্যমে ক্যাপ্টেন হারুনকে ব্রিজ দিয়ে বয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। লেফটেন্যান্ট শমশের মবিন চৌধুরী এরপরই মারাত্মকভাবে আহত হন এবং শত্রুসেনার হাতে বন্দী হন।
শত্রুপক্ষের প্রবল আক্রমণে পূর্ব প্রান্তে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরোধ ভাঙতে শূরু করে। অ্যাডভান্সড পজিশনে থাকা দলটির সমন্বয়হীনভাবে পিছু হটার সুযোগ নিয়ে সহজেই পাকিস্তানীরা ঢুকে পড়ে এবং পশ্চিম তীরে প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে তোলে।শত্রুপক্ষের শক্তি ও সামর্থ্যের কারণে পূর্বপ্রান্তে থাকা প্রতিরোধ আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। কালুরঘাটের লড়াই এর এভাবেই সমাপ্তি নামে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানিদের সরঞ্জাম ও লোকবলের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়।
অনুবাদ- সিরাজুল আরিফিন
Reference: Bangladesh Fights For Independence Lt Gen ASM Nasim (Retd) Bir Bikrom