You dont have javascript enabled! Please enable it!

প্রমােদ বিহার ও তালিয়া বাজাও হিজবুল বহরের প্রমােদ বিহার

১. একটি সাপ্তাহিকের রিপাের্টে হিজবুল বহর সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “হিজবুল বহর সমুদ্র সম্পদ আরহণ সম্পর্ক দু’দিন . ব্যাপী এক সেমিনারের আয়ােজন উপলক্ষে জানুয়ারীর ১৮ তারিখে সমুদ্রযাত্রা । করে। এই সেমিনার অভিযানে কয়েকশ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী, বিজ্ঞানী, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, সরকারী কর্মচারী সহ স্বয়ং প্রেসিডেন্ট অংশ গ্রহণ করেন। বঙ্গোপসাগরের বুক থেকে সম্ভাব্য খাদ্য, খনিজ, ও ওষুধ সম্পদ আহরণ এবং দেশের অর্থনেতিক উন্নয়নে সেগুলােকে কাজে লাগাবার উপায় অনুসন্ধানের নিমিত্ত এই সেমিনারের আয়ােজন করা হয়। খনিজ সম্পদ আহরণ ও তার ব্যবহার সম্পর্কে জাহাজের সেমিনারে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ডাঃ আর, এ, গণিসহ বিভিন্ন বিজ্ঞানী ভাষণ দেন।

সুন্দরী সুবেশী মহিলাদের আলুলায়িত চুল

২. ২৫-১-৮১ তারিখে টেলিভিশনে প্রতিভাবান ছাত্র-ছাত্রীদের সংক্ষিপ্ত অনুভূতি, মতমত ও সাক্ষাৎকার টেলিভিশনের পর্দায় প্রচারিত হয়। বলা বাহুল্য, এই পর্দায় সাক্ষাৎকার প্রদানকারী ব্যক্তিত্বদের চেহারা ও কন্ঠস্বরই প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁদের প্রত্যেকের কণ্ঠেই ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের বুকে বিভিন্নখাদ্য, খনিজ ও ওষুধ সম্পদ, প্রাপ্তি ও আহরণ সম্পর্কে বিপুল ও প্রবল আশাবাদ। এরই ফাকে ফাকে কচিৎ-কখনাে পর্দা জুড়ে ভেসে উঠেছে সমুদ্রের ঢেউ-খেলানাে অশেষ জলধি, আর হু-হু হাওয়ার উচ্ছাস-যা বিশেষ করে সুন্দর ও সুবেশী মহিলাদের চুল আলুলায়িত করে দিয়ে যাওয়ায় বেশ বােঝা গেছে। অংশ গ্রহণকারী ছাত্র-ছাত্রীই প্রতিভাবন ও মেধাবী সেহেতু তাদের পক্ষে সমুদ্র সম্পদ প্রাপ্তি সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিতভাবেই ভবিষ্যদ্বাণী করে দেয়া সম্ভব। সুতরাং সেক্ষেত্রে কোন ব্যবহারিক পরীক্ষার প্রয়ােজন আদৌ পরে না। জনৈক সুন্দরী সােৎসাহে এক পর্যায়ে যখন বঙ্গোপসাগরের বুকে কতাে কোটি(!) টাকার সােনা লুকায়িত আছে জানালেন, তখন হাস্যসম্বরণ করে সিরিয়াসলি সত্যিই বাহবা দিতে হলাে। সার্থক এ-সমুদ্র যাত্রা। হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন।’ এবং এই বিবিধ রতনেরা এক অভিনব ও অভূতপূর্ব সমুদ্র সেমিনারে সমবেত হয়ে সত্যি-সত্যিই অবলীলাক্রমে অনর্গল ভবিষ্যবাণী করে যেতে পারেন! সেজন্য শুরুতে বলেছি এবং আফসােস করেছি। জনৈক বিদগ্ধব্যক্তি আফসােস করেছেন এভাবেঃ হায়, আমরা কেন প্রতিভাবান মেধাবী অথবা ধুরন্ধর রাজনীতিক হতে পারলাম না। তাহলে তাে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছুটা অন্তত সােনালী মরীচিকা সদৃশ অবদান রাখতে পারতাম। পাশাপাশি আর একটি ভাবনাও চকিতে উকি দিয়েছে অনেকের মনে।”

হিজবুল বহর প্রসঙ্গ

৩, ১৯৭৭ সালের ১৮ই আগষ্ট বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন ফ্রান্স থেকে যাত্রীবাহী এই জাহাজটি ৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ক্রয় করে। জাহাজটি ছিলাে ২৭ বছরের পুরােনাে এবং ১৮১৬ জন যাত্রী পরিবহণের ক্ষমতাসম্পন্ন। হজ্ব মৌসুমে হজ্বযাত্রীদের পরিবহণ ও কয়েকটি বিলাসভ্ৰমণ ছাড়া বিএসসি কর্তৃপক্ষ একে কখনােই বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করতে পারেনি। ফলে বছরের ন’ মানই হিজবুল বহর চুপচাপ বসে থাকে। এভাবে বসিয়ে রেখে কেবল ইঞ্জিন চালু রাখতে গিয়েই বিএসসি এ-পর্যন্ত ৪কোটি ২০লাখ টাকা লােকসান দিয়েছে। অতঃপর এনইসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিপিং কর্পোরেশন জাহাজটিকে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন হিজবুল বহরকে গবেষণা জরিপ জাহাজের রূপান্তিত করা হবে। এবং এই হস্তান্তরের আগে সম্ভবত এটাই হিজবুল বহরের শেষ প্রমােদাভিসার। এতােদিন ধরে ক্রমাগত লােকসান দিতে থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিদায়ের আগে সে তার ডেকে আয়ােজিত এক সেমিনারের কল্যাণে রকমারী আশার বাণী ও সম্ভাবনার ফানুস অনাগতকালের জন্য রেখে যেতে পেরেছে। বিদায়, হিজবুল বহর।”

সামাজিক অপরাধ

৪. বিলাসবহুল জাহাজ হিজবুল বহরের এই প্রমােদভ্রমণের দাওয়াত প্রত্যাখান করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন ছাত্র। এরাও প্রতিভাবান ও মেধাবী। তারা সম্মিলিতভাবে মন্তব্য করেছেন, দেশের ব্যাপক দারিদ্য আর অশিক্ষার পরিবেশে এই ধরনের ব্যয়বহুল সমাবেশ সামাজিক অপরাধ। এই পাঁচ জন ছাত্র কলেন, সলিমউল্লাহ খান (আইন), আহমেদ আহসান (অর্থনীতি), ফেরদৌস হােসেন (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), মাহমুদুর রহমান (মনােবিজ্ঞান), ও ইমতিয়াজ আহমেদ (আন্তর্জাতিক সম্পৰ্ক)। সম্ভবত তারা এই সফরের প্রকৃত উদ্দেশ্য বিষয়ে সচেতন বলেই, শেষ পর্যন্ত নিজেদের প্রতিভাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে দেননি। কিন্তু অনেকেই মনে করেন অংশগ্রহণকারী অন্যরা নিজেদের জ্ঞাতসারে হােক, অজ্ঞাতসারে হােক, নিজেদের প্রতিভা ও মেধাকে দলীয় রাজনীতির দূতক্রীড়ায় ব্যবহারের পদ সুগম করে দিয়েছেন। এ-কথা বলার কারণ, এ- জাতীয় প্রমােদভ্রমণে বাণী ও কথার ফানুস নানাভাবেই উড়ানাে হয়ে থাকে, কিন্তু আপামর। দেশবাসী কখনােই এ থেকে আদৌ কোনাে বাস্তব ফলাফল পায় না, শুধুমাত্র হাড়-মাংস কালি করে সরকারকে দেয়া আরাে বেশ কয়েক লাখ টাকা গচ্চা দেয়া ছাড়া!”

প্রলােভিত মেধার বিষফল

৫. প্রলােভিত মেধাকে রাজনেতিকভাবে ব্যবহার করার লক্ষ্যে জিয়ার প্রচেষ্টার জুড়ি নেই। এভাবে বাংলাদেশ মেধার আর মননকে প্রলােভিত করে গড়ে তােলা হয়েছিল চাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। অভি-নীরু সেই প্রলােভিত মেধার বিষফল। ছাত্র রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান যে বিষবৃক্ষ রােপণ করে গেছেন তার ফলশ্রুতি আজ শিক্ষাঙ্গণ রণাঙ্গণেপরিণত হয়েছে। তালিয়া বাজাও জোরে আরাে জোরে ?

৬. “হেলিকপ্তটার, সাফারী ও হাততালি” এই তিনটি জিনিসের প্রেসিডেন্ট জিয়া সম্ভবত খুব দুর্বল। হেলিকপ্টার না হলে তার চলে না। গ্রামের মানুষের সাথে দেখা করতে শহর থেকে রাজনীতি গ্রামে নিয়ে যাবার জন্য তার চেষ্টার অন্ত নেই। বাংলাদেলে খুব কম ইউনিয়ন আছে যেখানে তার পদধূলি পরেনি। গ্রামের মানুষ তার পদস্পর্শে একেবারে যে কৃতার্থ হননি, তা বলা ঠিক হবে না। তাকে দেখা গেছে গ্রাম-গ্রামান্তরে। বছরে দিনের মধ্যে ৩শ’ দিনই হেলিকপ্টার ভ্রমণ। হেলিকপ্টার তার নিত্য দিনের সাথী।

৭. উর্দি পরতে-পরতে অভ্যাস গেছে খারাপ হয়ে। হঠাৎ করে ড্রেস পাল্টানাে যায়। কি করা যায়-খুঁজে বের করা হলাে সাফারী। সাফারী রাতারাতি হয়ে গেলাে পপুলার ছােট চাই থেকে শুরু করে বড় চাই পর্যন্ত সবার গায়ে সাফারী। দেখলেই বুঝা যায় এরা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী অর্থাৎ মার্শাল ডেমােক্রেসির ক্ষুদে সমঝদার।

৮. এই হাততালির একটা ইতিহাস আছে। হাততালি লােকাল মেইড না-শােনা যায় উত্তর কোরিয়া থেকে আমদানী করা হয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় এটা বহুলভাবে প্রচলিত। প্রেসিডেন্ট জিয়া একবার গিয়েছিলেন সেদেশে সফর করতে। সফর শেষে দেশে ফিরেই চালু করলেন অবিকলভাবে। প্রথম মাদারীপুরের এক জনসভায় এই হাততালি চালু হয়। সেদিন লােকজন খুব একটা সাড়া দেয়নি। এখন জাতীয় হাততালিতে পরিণত হয়েছে। হাততালি ছাড়া কোনাে অনুষ্ঠান কল্পনাই করা যায় না। হাততালির আবার ষ্টাইলও রয়েছে। হাততালি শুরু হলে কোরাস সুরে বলা হয়-জোরে আরাে জোরে । ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমীতে কোনাে এক অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্রের কথা উল্লেখ করতে হয়। এতে লেখা হয়েছিলাে হাততালি দিয়ে মহামান্যকে (প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানাবেন।”

সূত্র : জেনারেল জিয়ার  রাজত্ব  – অধ্যাপক আবু সাইদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!