You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভিত্তি প্রস্তরঃ রাজনৈতিক প্রতারণার কৌশল

১. রঙিন পর্দায় সুদর্শন মুখশ্রী। ঘােষিত হলাে ‘আজ প্রেসিডেন্ট জিয়া বুড়িগংগা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন।’ সচিত্র টিভি প্রতিবেদন। রঙিন চশমা, সাফারী সুট পরিহিত প্রেসিডেন্ট ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। স্থাপনের পর হাত তুলে মােনাজাত করা হলাে। তারপর শ্লোগান-কর্মীদের প্রেসিডেন্ট জিয়া চেয়ারম্যান জিয়া জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি। পরদিন কাগজে বের হলাে আরাে সচিত্র খবর।

২. কাগজে ছাপা হলাে; প্রেসিডেন্ট জিয়া আশুগঞ্জ সার কারখানা উদ্বোধন করবেন। হেলিকপ্টারে আশুগঞ্জ গেলেন ও সার কারখানা উদ্বোধনের বিস্তারিত প্রতিবেদনও কাগজে ছাপা হলাে। কিন্তু বাস্তবে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ‘বুড়িগংগা সেতুর প্রকল্প’ এর অস্তিত্ব যেমন ছিলােনা, আর আশুগঞ্জ সার কারখানায় উৎপাদন শুরু হয়েছিলাে উদ্বোধনের বহু পরে- জিয়া তখন বেঁচে নেই।

৩. ১, ১৯৭৯। ২১শে ডিসেম্বর১। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি লেঃ জেনারেল জিয়াউর রহমান। ভিত্তি প্রস্তর ছাড়া এক ইঞ্চি কাজ সম্পন্ন হয়নি।

৪. সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ১৯৮০ সালের ২৮ আগষ্ট। অফিসের কাজের জন্য কয়েকটি রুম করা হয়েছে। ছাত্ররা আগের সেই জরাজীর্ণ টিনের ঘরে ক্লাস করে। কোন ক্লাসে মুলি বাঁশের বেড়া খুলে পড়েছে এই হলাে অবস্থা। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়েছে। বরাদ্দ নেই।। কাজ হয়নি।

৫. খিলগাঁও মডেল কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের জানুয়ারী সালের ২৭ তারিখে। ১৯৮৬ সনে ঐ ভিত্তি প্রস্তর ভেঙ্গে আলমারীতে রাখার ব্যাপারে জানা যায় সরকার ১৯৭৩ সালে এ কলেজের জন্য সাড়ে ন’বিঘা জমি হুকুম দখল করেন। রাষ্ট্রপতি মরহুম জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সনের জানুয়ারী নব নির্মিত ভবনটি উদ্বোধন করেন এবং কলেজের একটি পূর্ণাঙ্গ কাজ বাস্তবায়ন করার ওয়াদা করেন। স্কীম বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি সচিবালয় থেকে ঢাকা মিউঃ কর্পোরেশনকে একটি পত্রও দেন। কলেজের নামে বরাদ্দকৃত নির্দিষ্ট স্থানে নবনির্মত ভবন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উদ্বোধন হওয়ার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ আশা করেছিলেন যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাদ্দকৃত জমির সেলামীর টাকা জমা দেওয়ার অনুমতি দেবেন এবং বরাদ্দকৃত স্থানটি কলেজ কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করবেন। ২১/৮/৭৮ তারিখের এক পত্রে নির্বাহী প্রকৌশলী জমি বন্টন কমিটির বরাবরে কোন কারণ না দেখিয়ে জানান যে, কলেজের নামে বরাদ্দকৃত সাড়ে ন’ বিঘা জমির বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে। এবং নব নির্মিত ভবন (রাষ্ট্রপতি জিয়া কর্তৃক উদ্বোধন) অন্যত্র সরিয়ে নেবার জন্য তিনি ঐ পত্রে নির্দেশ দেন। তারপর ভিত্তি ” প্রস্তর খুলে ঘরে রেখে সেখানে একটি নতুন ভবন তৈরী করা হয়, যাতে দখলী না হারায়।

৬. রাজনৈতিক কারণে প্রতিশ্রুত বেশিরভাগ প্রজেক্টের ভাগ্য অনিশ্চিত। ‘৮২-৮৩ অর্থবছরে মাত্র দশটি প্রজেক্ট উন্নয়ন কর্মসূচীতে স্থান পেয়েছে। মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ৬০০টি প্রকল্পের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর সব ক’টি প্রকল্পই সড়ক ও জনপথ বিভাগের। ৮২৮৩ সালের অর্থবছরে পরিকল্পনা কমিশন ৩৬২ টি প্রজেক্ট অনুমাদন করে। এর মধ্যে মরহুম জিয়া প্রতিশ্রুত ৮০টি প্রজেক্ট স্থান পায়। কিন্তু মেজর জেনারেল শাসসুজ্জামানের নেতৃত্বে গঠিত প্রকল্প বাছাই কমিটি মাত্র ১৯৯টি প্রজেক্টের অনুমােদন দিয়েছে। এই প্রজেক্টের মধ্যে ১০টি প্রজেক্ট রয়েছে রাজনৈতিক কারণে প্রতিশ্রুত।

৭.প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশায় ১৯৮০ সালের ৫ই মে তার প্রতিশ্রুত প্রজেক্টগুলাের মূল্যায়নের জন্য বঙ্গভবনে একটি বৈঠক বসে। বৈঠকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান যে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে সড়ক ও জনপথ বিভাগে যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করা হয় তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে প্রেসিডেন্টের প্রতিশ্রুত প্রজেক্ট বাস্তবায়নের ৬২ বছর সময় লাগবে। রিপাের্টটির উপসংহারে উল্লেখ করা হয় যে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রকল্পগুলাে পরীক্ষা করেছেন। রিপাের্টটিতে সার্ভে রিপাের্টের যে মন্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অবাস্তব। রাজনৈতিক ফায়দা তােলার জন্যই এই প্রজেক্ট গুলাে খাতাপত্রে স্থান পেয়েছিলাে এবং নির্বাচনের সময়ই বেশির ভাগ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

৮. প্রতিশ্রুতির সংখ্যা, উদ্দেশ্য এবং অবাস্তবতা-সব মিলিয়ে গােটা দেশের চিত্র সত্যিই বিস্ময়কর। জিয়াউর রহমানের আমলে প্রতিশ্রুতির বহর লক্ষ্যণীয়। প্রেসিডেন্ট জিয়া হেলিকপ্টারে করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং যেখানেই তিনি গেছেন, সেখানেই তার দলীয় কর্মীরা এবং স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বিপুল অর্থ ব্যয়ে সমাবেশ করারর্সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। আর ‘মানি ইজ নাে প্রােরেম’-এর প্রবক্তা মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জনগণের করতালি আর সমর্থন পাবার জন্য একাধিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। করেছেন ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন।

৯. হিশেব করা হচ্ছে প্রতিশ্রুতির বাস্তবতা-অবাস্তবতা এবং এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কতটা সময় দরকার হতে পারে ইত্যাদি। এর সাথে আর, একটা বিষয় হিসেব করে দেখা দরকার যে, সাড়ম্বর সংবর্ধনা এবং বিভিন্ন প্রকল্পে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের আনুষ্ঠানিকতার কি পরিমাণ সরকারী অর্থ ব্যয় হয়েছে। বিদেশ থেকে স্বাধীনতার পর কম অর্থ আসেনি। দশ বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে বৈদেশিক সাহায্য এসেছে। এই অর্থ জাতীয় উন্নয়নের কাজে যথাযথভাবে ব্যবহার করা হলে এদেশের শিল্প, কৃষি, শিক্ষা এবং যােগাযােগ ব্যবস্থার দৈন্যদশা অনেক আগেই দূর হয়ে যেতাে। কিন্তু দেশ ও জাতির দূর্ভাগ্য, এই বিপুল পরিমাণ অর্থের সিংহভাগই ক্ষমতাসীনদের একটা কৃত্রিম রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টির কাজে অপচয় করা হয়েছে।

১০, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে এরকম কয়েক হাজার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। যেখানেই গেছেন স্থাপন করেছেন এক একটি ভিত্তিপ্রস্তর। জিয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যে অর্থ প্রয়ােজন তার হিসেব নিকেস করে দেখা গেছে এটি ছিল প্রতারণা ও চমক সৃষ্টির রাজনীতি। তার ১৯ দফার মতােই এগুলাে ছিলাে রাজনৈতিক প্রতারণার শতাব্দীর ফমূলা।

সূত্র : জেনারেল জিয়ার  রাজত্ব  – অধ্যাপক আবু সাইদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!