You dont have javascript enabled! Please enable it! প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের অন্তরালে - সংগ্রামের নোটবুক

প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের অন্তরালে

১. জিয়াউর রহমান বারবার প্রশাসনিক পরিবর্তনের কথা ঘােষণা করেছেন। প্রশাসনিক এই পরিবর্তন প্রশাসনকে জোরদার, দুর্নীতিমুক্ত ও সময়ােপযােগী প্রশাসন গড়ে তােলার পরিবর্তে স্বাধীনতা বিরােধীদের পুনর্বাসনে পরিণত তা করেছেন। সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও কর্পোরেশনগুলােকে তাদের গত {ত চার বছরের কাজের অভিজ্ঞতার আলাকে এবং তাদের নিয়ন্তণ ও সমন্বয় যাতে আরােও কার্যকর হয়ে উঠে সেজন্য প্রশাসনিক পুনর্গঠণ ও পুনর্বিন্যাসের কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। ২.সামরিক ঘােষণায় বলা হয় ৫ সদস্যের একটি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এই প্রশাসনিক পুনর্গঠন ও পুনবিন্যাস করা হয়েছে। প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিষদের পাঁচ সদস্যর কমিটির সদস্যরা হলেন ঃ কাজী আনােয়ারুল হক, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, কমােডার এম এইচ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল এমজি তােয়াব এবং ডঃ এম এন হুদা। আনােয়ারুল হক কমিটির আহ্বায়ক এবং বাকি চারজন্যই। কমিটির সদস্য।

প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এই কমিটি গঠন করেছিলেন অনিয়মিত নিয়ােগ, পদোন্নতি, পােষ্টিং-এর কেসগুলাে দেখা এবং প্রশাসনের। সামগ্রিক দক্ষতা বাড়ানাের ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশের দ্বারা পূর্বের অন্যায়ের প্রতিকার করার জন্য সরকারী ঘােষণায় একে পুনর্গঠনের প্রথম পর্যায় বলে, অভিহিত করা হয় এবং বলা হয় এই প্রক্রিয়া অব্যহত থাকবে। ঘােষণায় বলা হয় গত ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের ১৬ তারিখ পর্যন্ত সময়ে অবাঞ্ছিত প্রভাব খাটিয়ে ও অনিয়মিতভাবে এবং যােগ্য অফিসারদের দাবি চেপে রেখে কতিপয় নিয়ােগ, পােস্টিং ও পদোন্নতি করা হয়েছে।২

৩. ঘােষণা বলা হয় যে স্বাধীনতার পর কাজের সুযােগ ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় বিষয়ের চিন্তা-ভাবনা না করেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলােকে সম্প্রসারিত করা। হয়েছে, অসংখ্য কর্পোরেশন গঠন করা হয়েছে। এতে দারুণভাবে বিভিন্ন বিষয় জড়িয়ে গেছে, বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, জনশক্তি ও অর্থের অপচয় হয়েছে। এতে প্রশাসনিক দক্ষতা দারুণভাবে বিঘ্নিত হয়েছে এবং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে এর প্রতিক্রিয়া হয়েছে। অতএব প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন। প্রশাসক তার উপদেষ্টা পরিষদের একটি কমিটির গঠন করেন অনিয়মিত নিয়ােগ, পদোন্নতি, পােস্টিং-এর কেসগুলাে দেখার জন্যে অতীতে যে সব অন্যায় করা হয়েছে সেগুলাের প্রতিকার এবং প্রশাসনের সামগ্রিক দক্ষতা উন্নত করার ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশের জন্য। কমিটির কমপক্ষে সাতটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এসব বৈঠকে বিভিন্ন পদে নিয়ােগের যােগ্যতা সম্পর্কিত নানা প্রশ্ন জিয়ে আলােচনা করা হয় ও এই উদ্দেশ্যে কতিপয় সুর্দিষ্ট নীতি ঘােষণা করা হয়।

৪. এ ধরনের কমিটি গঠনই ছিলাে উদ্দেশ্যমূলক। কারণ কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত ব্যক্তিরা নিরপেক্ষ ছিলেন না। জনাব আনােয়ারুল হক পাকিস্তানের খাটি পুলিশী আমলা x হিসেবে শেষদিন পর্যন্ত দক্ষতা’-র সঙ্গে কাজ করেছে। বাঙালীদের উপর নির্যাতন ও নিপীড়ণের প্রশ্ন পাকিস্তানীদের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলেছেন। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিশ্বস্ত দালাল এবং মন্ত্রী। তিনি হচ্ছেন এই কমিটির আহবায়ক। ডাঃ এম এন হুদা আইয়ুব মােনায়েমের বিশ্বস্ত অনুচর। এম, জি, ” তােয়াব মুক্তিযুদ্ধের কনসেপ্টেই বিশ্বাস করতেন না। বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজান্ত্র’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য তােয়াবের প্রচেষ্টার অন্ত ছিলােনা।৩ এই কমিটির লক্ষ্যই ছিলাে পাকিস্তানী অফিসারদের পুনর্বাসন করা।

৫. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সামরিক ও বেসামরিক অফিসারদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দু’বছর সিনিয়রিটি প্রদান করেন। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভূট্টো। পাকিস্তানী প্রত্যাগত ১লক্ষাধিক সামরিক ও বেসামরিক অফিসারদের চাকুরী। বাতিল করেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব উদার ও মহানুভব হয়ে পাকিস্তান হতে প্রত্যাগত সামরিক ও বেসামরিক অফিসারদের চাকুরীতে বহাল করলেও তারা মুক্তিযােদ্ধাদের সিনিয়রিটি দেবার কারণে ক্ষুব্ধ ছিলেন। চাকুরী পুনর্বিন্যাসের ক্রমে তাদের পুনৃবিন্যাস করুই ছিলাে এই কমিটির উদ্দেশ্য।

৬. কমিটি দেখেছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও কর্পোরেশনগুলোর বর্তমান কাঠামাের পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যানের প্রয়ােজন। বিভিন্ন  মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহের ব্যাপারে দেখা গেছে তাদের সংখ্যা কমানাের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সেগুলাের সংখ্যা এমন সংযােজনের দ্বারা কমানাে যেতে পারে যাতে ওভারহেড ব্যয় কমে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় আরও কার্যকর হতে পারে।

৭. উপদেষ্টা পরিষদের উল্লিখিত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার প্রশাসনিক পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের জন্য কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। সরকার আশা করেন যে, এই পুনর্গঠনের ফলে যারা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, দেশের সার্বিক স্বার্থে তারা বিষয়টিকে সদয়ভাবে গ্রহণ করবেন এবং তারা যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, দেশের কল্যাণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। পুনগঠনের এটা প্রথম পর্যায়। এবং এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।

৮ . সরকারের মন্ত্রণালয় বিভিন্ন বিভাগ, পরিদপ্তর, অধিদপ্তর, স্বায়ত্ত শাসিত সংস্থা এবং কর্পোরেশনগুলাে বঙ্গবন্ধু পুনর্গঠিত করেছিলেন জাতীয় স্বার্থেই। একটি প্রাদেশিক সরকার হতে জাতীয় সরকার পরিচালনার জন্য এই পুনর্গঠন ছিলাে অত্যন্ত জরুরী। জিয়াউর রহমান এসব উপলব্ধি করলেও বাস্তবে এসব প্রতিষ্ঠানসমূহে মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের সংখ্যা ছিলাে বেশী এবং মূলতঃ তারাই উচ্চ পদগুলাে দখল করে রেখেছিলেন। এটা কোনক্রমেই পুনর্গঠন কমিটির সহ্য হয়নি। উচ্চপদ সমূহে মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের অপসারণের জন্যই প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হ্রাস ও একত্রীভূত করার ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিলাে।

৯. জিয়াউর রহমানের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠনের বিষয়টি সম্পর্কে আলােচনার পূর্বে জিয়ার উপদেষ্টা ও মন্ত্রীপরিষদ কাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল এ সম্পর্কে আলােকপাত করা যেতে পারে। ১৯৭৬-৮১ সালের মধ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা ও মন্ত্রী সভায় যে ৮০ জন ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তার মধ্যে ১৩ জন সামরিক কর্মকর্তা, ৮ জন বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ১৮ জন শিল্পপতি, এবং ৩১ জন ছিলেন রাজনীতিবিদ। এই ৩১ জনের মধ্যে মুসলিম লীগ চৈনিক পন্থী স্বাধীনতা বিরােধীদের সংখ্যা ছিলাে ১৯ জন। বাকীগুলাে দল ছুটদের নিয়ে পূরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ৫০০ শত সরকারী কর্মচারী অংশগ্রহণ করেছিলেন এর মধ্যে মাত্র ১৩ জন সিএসপি অফিসার, দু’জন পি, এস, পি, ইপিসিএস-এর কতিপয় অফিসার এবং নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের সংখ্যাই ছিল বেশী।

১০. বাঙালী সিএসপিদের সংখ্যা ছিল ১৮০ জন। বঙ্গবন্ধুর সরকার ৬ হাজার বেসরকারী কর্মচারীকে পাকিস্তানীদের সঙ্গে দালালী করার অপরাধে চাকুরীচ্যুত করেন। এরমধ্যে নয় জন সিএসপি অফিসারও ছিলেন। জিয়াউর রহমান এসব পাকস্তিানী দালাল ও স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরােধীতাকারী ঐ নয় জন সিএসপি অফিসারকে চাকুরীতে পুনর্বহাল করেন।

১১. পররাষ্ট্রসচিব জনাব ফখরুদ্দিন আহমদকে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে বিদেশ পাঠিয়ে দেয়া হলাে এদিকে পররাষ্ট্র দফতরের অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি জনাবভােবারক হােসেনকে পররাষ্ট্র সচিব নিযুক্ত হলাে ঢাকায় সরকারীভাবে একথা ঘােষণা করা হয়েছে। তােবারক হােসেন স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে অপশন দেননি। পাকিস্তানীদের পক্ষে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করেছেন বলে জানা যায়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এম এন হুদা আর একজন বেনিফিসিযারী। ১৯৬৩ সনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগহণ করেন এবং পাকিস্তান স্পেশাল ব্রাঞ্চের পদস্থ কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৬ সনের জুন মাসে এন.এস.আই হেড কোয়ার্টারে এক সাক্ষাৎকারে হুদাকে বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা অথবা হত্যায় তারা জড়িত ছিলেন কিনা জানতে চাইলে, হুদা হেসে বলেন প্রশ্নটি অত্যন্ত পরিস্কার। এ এম আনিসুর রহমান ১৯৬৯ সনে ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ একাডেমীর গ্রাজুয়েট। ১৯৭০ সনে পাকিস্তান আর্মির প্যারা মিলিটারী ফোর্স হিসেবে আলবদর বাহিনী সংগঠিত হচ্ছিল। আল বদর বাহিনীর কমান্ড কাউন্সিলের মৌলানা মান্নানের তিনি খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ ফোর্সের তিনি কমিশনার নিযুক্ত হন। এ,কে,এম মুসলেহউদ্দিন ১৯৭১ সনে মুসলিম লীগ ও সামরিক জান্তার ঘনিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেন। তিনি ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সনে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের আইপিএ ও ইনপােলস থেকে গ্রাজুয়েশন লাভ করেন।

তিনি এন,এস,আই-এর পদস্থ ব্যক্তি হিসেবে কাজ পরিচালনা করতে থাকেন। মুসা মিয়া চৌধুরী যিনি এন, এস, আই-এর ডেপুটি ডাইরেক্টর-তার সম্পর্কে। লিফসুজ বিস্তারিতভাবে দেখিয়াছেন যে, সি, আই-এর আর্থিক সাহায্যে পরিচালিত ইপােলসে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী এই ব্যক্তিটি “রায়ট কন্ট্রোল কাউন্টার রেভ্যুলেশন ও পুলিশ টেরর’ বিষয়াদি সম্পর্কে কিরূপ উচ্ছিসিত প্রশংসায় বিগলিত ছিলেন।১০ এবং ঐ সমস্ত আইডিয়া স্বদেশে বাস্তবায়ন করতে তারা কিরূপ পরঙ্গমতায় পরিচয় প্রদান করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মুসামিয়া চৌধুরীকে প্যারামিলিটারী আর্মি ব্যাটেলিয়ান সংগঠনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সালাউদ্দিন আহমদ ১৯৬৮-৮৯ সনে আয়ুব-মােনেমের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন ও ঐ সময়ে শ্রমিক আন্দোলন দমনের জন্য কর্তৃপক্ষের সুনাম অর্জন করেন। কথাবার্তায়। অভিজাত এবং কঠোরতা সম্পন্ন এই ব্যক্তি দেশ স্বাধীন হবার পর রােমে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি (ফাও) প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর তিনি স্বরাষ্ট্র সচিবের পদে অধিষ্টিত হন এবং বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার পক্ষের হাজার হাজার অনুসারীদের কারাগারে নিক্ষেপে উৎসাহী ছিলেন।

১২. বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রবাসী সরকার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করলে শুরু হয়ে যায় অলিখিত প্রশাসনিক সংকট। পাকবাহিনীর সংগে যােগসাজশে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য নয় জন প্রক্তন সি, এস, পি অফিসার সহ ছয় হাজার কর্মচারী চাকুরীচ্যুত হয়। পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসার ও বাংলাদেশে চাকুরীরত ঐ সময়ের অফিসারগণ সব সময়ই আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। আমলারা বলতে শুরু করলেনঃ সংবাদ পত্র দেখে তারপর অফিসে যেতে হবে। কেননা কোনদিন পর্যন্ত  তিনি চাকুরীতে থাকবেন কি থাকবেন না তা তাদের জানা নেই। মুজিব হত্যার পর তারা প্রশাসনে জেকে বসলেন।

১৩. প্রাক্তন সি, এস, পি, অফিসার ও ই, পি, সি, এস অফিসারদের মধ্যে চাকুরীর স্তর বিন্যাস ও কাঠামাে নিয়ে বিরােধ থাকে। বঙ্গবন্ধুর আমলে ডঃ মােজাফফর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত প্রশাসন ও চাকুরী পুনর্বিন্যাস কমিটি প্রাক্তন সি, এস, পি। সিস্টেমকে ‘আর্টিফিশিয়েল ইনস্টিটিউশন’ নামে আখ্যাত করে সকল বড় বড় পদ সি এস পি অফিসারদের প্রাপ্য’ এই প্রথা ও নিয়মকে বাতিল করে দেয়। এতে সি, এস, পি অফিসারগণ ফুসতে থাকেন। তারা কোন কাজ না করে, আড্ডা মেরে, গালগল্প করে সময় কাটাতে থাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এরা নিজেদের যথাযােগ্য স্থান করে নেয়।

১৪. প্রাক্তন সি, এস, পি অফিসার শফিউল আযম। স্বাধীনতা সংগ্রামকালীন সময়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের চীফ সেক্রেটারী ছিলেন। পাক হানাদার বাহিনীর আদেশ নির্দেশ। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি পালন করেছেন। স্বাধীনতার কিছুকাল পুর্বে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলী করা হয়। পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে যােগসাজশকারী এই ‘প্রবীণ, ও মেধাবী’ সি,এস, পি অফিসার স্বাধীন বালাদেশে চাকুরী না পেয়ে গােপনে বঙ্গবন্ধু বিরােধী সি, এস, পিদের পরামর্শ দাতার ভূমিকা গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরই এই জ্ঞানী অফিসারটি’ চাকুরীতে উচ্চাসন লাভ করেন। এবং চাকুরীতে নিয়ম বিরুদ্ধ পদোন্নতি সম্পর্কিত রিভিউ কমিটির প্রধান হয়ে বঙ্গবন্ধুর আমলে পদস্থ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যথাযােগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ ও এডমিনিষ্ট্রেশনকে। ‘ক্লীন’ করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেন। অচিরেই পাকিস্তানপন্থী অফিসারদের। যথাযােগ্য আসন ও মর্যাদায় উন্নীত করে তিনি তাদের সমহিমায় পুনর্বাসিত করেন। জিয়াউর রহমানের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস শুধুমাত্র বেসামরিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিলােনা-তা ছিলাে সর্বব্যাপী। জিয়া সামরিক ক্ষেত্রেও প্রশাসনিক পুনবিন্যাস করে। তাদের সুযােগ সুবিধা বৃদ্ধি, সংখ্যা বৃদ্ধি ও কাঠামাের পরিবর্তন করেন।

১৫. সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর জিয়া তার ক্ষমতার ভিত্তি সামরিকবাহিনীকে অধিকতর শক্তিশালী করার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। ১৯৭৬ সালে সে সামরিকবাহিনরি মধ্যে বিদ্যমান অশান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১২,৫০০জন-সদস্য বিশিষ্ট একটি স্পেশাল টাস্কফোর্স গঠন করেন।১১

১৬. ১৯৭৭ সালের জানুয়ারী মাসে প্রাপ্ত এক হিসাবে প্রকাশ, ক্ষমতা দখল করার এক বছরের মধ্যেই জিয়া সামরিক ডিভিশনের সংখ্যা ৪ থেকে বাড়িয়ে ৯ ডিভিশনে পরিণিত করে।১২ (সানরাইজ”, লণ্ডন, বর্ষ ঃ ১, সংখ্যাঃ ৬, জানুয়ারী, ১৯৭৭) ১৯৭৭ সালের মে মাসের বিশ্ব ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত এক রিপাের্টে বলা হয়, ১৯৭৩ আর্থিক সালে “ডিফেন্স, জাস্টিস ও পুলিশ” (দেশরক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা ও পুলিশ) খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৫১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা, অর্থাৎ মােট জাতীয় ব্যয়ের শতকরা ১৭ দশমিক ৬ ভাগ। ১৯৭৬ আর্থিক সালের জন্য মুজিব সরকার। উক্ত খাতে ১৪৭ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে। জিয়া-এর পরিমাণ বৃদ্ধি করে। ২০৬ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা, অর্থাৎ মােট জাতীয় ব্যয়ের শতকরা ৩১ দশমিক ১ ভাগ বরাদ্দ করে। ১৯৭৭ সালের বরাদ্দের পরিমাণ ছিলাে ২২৭ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা। ১৩

১৭. ১৯৮১ সালে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে (অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর) ন্যৈবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদস্য সংখ্যা শতকরা ৩০০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে (অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর আমলে) সৈন্যবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৫ হাজার, ১ হাজার ও ১হাজার ৫শ’। ১৯৮০ সালের আগস্ট মাসে (জিয়ার আমলে) এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে সৈন্যবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদস্য সংখ্যা দাড়ায় যথাক্রমে ৭০ হাজার, ৩ হাজার ৫শ’ ও ৪ হাজার।

১৮. জিয়ার আমলে “প্যারা মিলিটারী ফোর্স” অর্থাৎ আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। বঙ্গবন্ধুর আমলে জাতীয় রক্ষীবাহিনী ও বাংলাদেশ রাইফেল্স-এর সদস্যসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২০ হাজার ও ১৫ হাজার। জিয়া রক্ষীবাহিনী ভেঙ্গে দিয়ে বাংলাদেশ রাইফেলস সদস্যসংখ্যা ৩০ হাজারে উন্নীত করে এবং ৩৬ হাজার সদস্যবিশিষ্ট সশস্ত্র পুলিশ-রিজার্ভবাহিনী, ৮ হাজার সদস্যবিশিষ্ট আনসারবাহিনী ও ৯ লক্ষ ৬০ হাজার সদস্যবিশিষ্ট গ্রাম প্রতিরক্ষাবাহিনী সৃষ্টি করে। ১৪ শৃংখলাবাহিনীর বিভিন্ন উচ্চপদে এই সুবাদে জিয়াউর রহমানে পাকিস্তানী সেনা অফিসারদের জায়গা করে দেন।

১৯. জিয়াউর রহমান এই সবই করেছিলেন তার পাওয়ার বেজ’-কে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে। সামরিক অধিনায়ক হয়ে সামরিক বাহিনীর উপর নির্ভরশীল হওয়া ব্যতীত জিয়াউর রহমানে গত্যন্ত ছিলােনা। প্রশাসনিক প্রশাসনকে সামরিকী করণের সুপকিল্পিত পদক্ষেপ নিয়ে অগ্রসর হন। তিনি প্রশাসনিক শৃংখলা ভংগ করে সচিবালয়, কূটনৈতিক পদে, কর্পোরেশন ব্যাংক বীমা আর্থিক ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সামরিকবাহিনীর লােকদের ঢুকিয়ে দেন। এইভাবে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রে এইসব চাপিয়ে দেয়া বহিরাগতদের আগমনে প্রশাসনিক কাঠামােয় বিশৃংখলা দেখা দেয়। যার পরিণাম শুভ হয়নি।

সূত্র : জেনারেল জিয়ার  রাজত্ব  – অধ্যাপক আবু সাইদ