জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সার্বভৌম জাতীয় সংসদ
১. ১৯৭৮ সনের ৩রা জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ১৯৭৯ সনে ফেব্রুয়ারী মাসে জাতীয় সংসদের নির্বাচন সামনে রেখে সামনে বলা হচ্ছিল দেশে ‘সার্বভৌম পার্লামেন্ট গঠিত হবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট সংবিধানের যে সংশােধনী ঘােষণা করেছেন সে সম্পর্কে জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যুক্ত বিবৃতিতে বলেছেন যে “প্রেসিডেন্ট সংবিধানের যে সংশােধনী ঘােষণা করেছেন উহাতে দেশে স্বৈরতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিই থাকার কথা বলা হইয়াছে। এমন ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচিত সংসদ প্রেসিডেন্টের নিকট অনুগত থাকিবে। তাহারা বলেন, প্রেসিডেন্ট জিয়ার সংবিধান সংশােধনী বাকশালের চতুর্থ সংশােধনী অপেক্ষাও বেশী অগণতান্ত্রিক ও মহাবাকশালী।১
ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত
২. পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর ৬ই এপ্রিল জেনারেল জিয়াউর রহামান সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। সরকারী দলের নেতৃবৃন্দ ও মুসলিম লীগের সবুর খান এই পদক্ষেপকে ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত’ বলে উল্লেখ করেছেন। ‘জাতীয় ঐক্য ও দুঃখী মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একক জাতীয় দল-বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলেন। এবং শােষিত মানুষের কল্যাণে জাতির জনক রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৫ সনের ১৫ ই আগস্টের পর হতে ৩ বছর ৫ মাস ২১ দিন পর্যন্ত দীর্ঘ একটানা প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার’ প্রতিষ্ঠার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘স্বৈরাচার’ বলা। হয়েছে, ‘গণতন্ত্র হত্যাকারী’, ‘বিশ্বাসঘাতক’ কত কিছুই না ‘অপবাদ হয়েছে। ১৯৭২ সনের পার্লামেন্টারী ডেমােক্রেসী হতে প্রেসিডেনশিয়াল পদ্ধতিতে রাষ্ট্র। পরিচালনার জন্য শাসনতান্ত্রিক এই পরিবর্তনকে ‘স্বৈরাচারী পদ্ধতি’ বলে অভিহিত করে জিয়াউর রহমান কমপক্ষে একহাজার দিবস রজনী দেশময় চিৎকার করেছেন।৪
জিয়ার সংবিধান ও স্বৈরাচার পদ্ধতির স্থায়ী রূপ
৩. সংবিধানই যদি একটি সরকারের চরিত্র নির্ধারণ করে থাকে চতুর্থ সংশােধনীর মাধ্যমে জাতীয় দলের হাতে যে রাষ্টীয় ক্ষমতা অর্পিত হয়েছিল ৫ম সংশােধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান তা একব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত করেছেন। জিয়াউর রহমান ৫ম সংশােধনীকে বিল হিসেবে উথাপন করে জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে পাশ করিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, মীজান। লীগ, ন্যাপ, জাসদ, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, জাতীয় একতা পার্টির নেতৃবৃন্দ ৫ম সংশােধনী পাশের বিরুদ্ধে সংসদে ওয়াক আউট করেছে। এবং আতাউর রহমান খান, সবুর খান সহ ২০ জন সদস্য ভােট দানে বিরত ছিলেন। তারা ওয়াক আউট করেনি। জাতীয় সংসদে ৫ম সংশােধনী পাশ করার মাধ্যমে স্বৈরাচারী পদ্ধতির স্থায়ী রূপ পেলাে। গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার পরিপন্থী প্রায় ৫ শত সামরিক ফরমান, আদেশ, বিধান, প্রবিধান, বিধি, বিজ্ঞপ্তি, একই সাথে পাশ হয়ে গেলাে। পাশ হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ই আগস্টে যেভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে তার বিচারের উপর নিষেধাজ্ঞা বলবকারী বিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ ও কর্ণেল (অবঃ) তাহের সহ হাজার হাজার হত্যাকাণ্ডও বৈধ হয়ে গিয়েছে।
আইয়ুব খানের পথ ধরে
৪. সামরিক শাসন তুলে নেয়ার জন্য জেনারেল জিয়া যে ‘অনন্য সাধারণ দৃষ্টিান্ত স্থাপন করেছেন বলে বলা হচ্ছে, জিয়ার পূর্বসূরী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানও নির্বাচন দিয়ে, শাসনতন্ত্র দিয়ে, মার্শাল ল তুলে নিয়ে, নিজেকে গণতন্ত্রের প্রতিভূ হিসেবে নিকট অতীতে চেষ্টা করেছেন। পার্লামেন্ট আইয়ুব খানের আমলেও ছিল। কিন্তু বাস্তবে প্রমাণিত সকল ক্ষমতা ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পাকিস্তানে যে শাসন ব্যবস্থার পত্তন হয়েছিলাে, তা কোনােক্রমেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিলােনা। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের উত্তরসূরী লেঃ জেনারেল জিয়া সেই কাজটিই করেছেন।
রাবার স্ট্যাম্প থেকে
৫. প্রেসিডেন্ট জিয়া সার্বভৌম সংসদের নামে পার্লামেন্টকে তার স্বেচ্ছাচারী কর্মকান্ডের রাবার স্টাম্প হিসেবে ব্যবহার করছেন। বিশেষ ক্ষমতা আইন, কালাকানুন , প্রেস এণ্ড পাবলিকেশন এ্যাক্ট-এর মাধ্যমে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব । করে, জরুরী অবস্থা বহাল রেখে, মৌলিক অধিকার রহিত করে, বিচার বিভাগের। স্বাধীনতা হরণ করে যে ব্যবস্থা ও পদ্ধতি জিয়াউর রহমান কায়েম করেছেন তা গণতন্ত্র নয়; এক ব্যক্তির শাসন। স্বেচ্ছাচার ব্যক্তি বিশেষের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর রাষ্ট্র চলছে। একটি সিস্টেম প্রয়ােজন যার মাধ্যমে জনগণ হবে ক্ষমতার উৎসজনগণের নিকট জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে এবং তাদের অধিকার সদা সর্বদা সমুন্নত থাকবে তার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে।
ভূতের মুখে রাম নামক
৬. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ঘােষিত দুঃখী মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে একক জাতীয় দল গঠনকে ‘স্বৈরাচারী’ আখ্যা দিয়ে কেউ কেউ এব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক বলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় ব্যবস্থায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি বরং রাষ্ট্রপরিচালনার ব্যাপারে জনগণের অংশ গ্রহণ, জন প্রতিনিধিদের নিকট জবাবদিহী করার ব্যবস্থা, মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অধিকার নিশ্চিত কিনা তার উপরে গণতন্ত্র ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের কার্যকারিতা নির্ভরশীল। সংসদ জনগণের কণ্ঠস্বরে কথা বলে কিনা, সংসদে জবাবদিহিতা আছে কিনা- এসব বিবেচনাই দেশে গণতন্ত্র থাকা না থাকার মূল প্রশ্ন। জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ, বিশেষ ক্ষমতার আইনের প্রয়ােগ, জরুরী আইনের কঠোর ব্যবস্থা করে গণতন্ত্রের বিকাশের পথ রুদ্ধ করে রেখেছে জিয়াউর রহমান। রাজবন্দী মুক্তি, সার্বভৌম পার্লামেন্ট, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা না থাকলে ১৫ই আগস্ট পূর্ববর্তীতে যে , শাসনতন্ত্র ছিলাে, যে পার্লামেন্ট ছিলাে, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও জরুরী অবস্থা ছিলাে বহাল রেখে গণতন্ত্র ও বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা জনগণের সঙ্গে তামাশা মাত্র। শুধু তাই নয়, ‘৭৫ সনে মার্শাল ছিলাে না। মার্শাল ল’ বহাল রেখে গণতন্ত্র ও বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা যেন ভূতের মুখে রাম নাম। } সংসদের সার্বভৌমত্বঃ বিসমিল্লাহতে গলদ।
৭. প্রায় ৪ বছরের ব্যবধানে ২রা এপ্রিল ‘৭৯ জাতীয় সংসদের বৈঠক শুরু হয়। এটা ছিলাে বালাদেশের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ। সংবিধানে আছে স্পীকার সদস্যদের শপথ গ্রহণ করাবেন। জাতীয় সংসদ। সদস্যদের মধ্য হতে প্রবীণ সদস্যকে অস্থায়ী স্পীকার নিয়ােগ করে জাতীয় সংসদের ‘সার্বভৌমত্বের পতাকা তুলে ধরা যেতাে। তা না করে জেনারেল জিয়া | তার নিযুক্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য অস্থায়ী স্পীকার নিয়ােগ করেন। এতে যে কোন নির্বাচিত মর্যাদাবান জাতীয় সংসদ সদস্যরেই আত্মসম্মানে আঘাত লাগার কথা। সংসদ সদস্যের বাইরে প্রেসিডেন্টের নিয়ােগকৃত জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নয় এমন একজন ভাইস প্রেসিডেন্টকে দিয়ে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট অত্যন্ত সন্তর্পনে যে মেসসটি দিলেন, তা হলাে সংসদ নিজের কাজ নিজে করতে পারে না। প্রেসিডেন্টের রাবার স্টাম্প হিসেবেই এটিকে কাজ করতে হবে। ভাইস প্রেসিডেন্টকে অস্থায়ী স্পীকার নিযুক্ত করলে জাতীয় সংসদের ৫৩ জন বিরােধী দলীয় সদস্য উক্ত অনুষ্ঠান বর্জন করে, দলগুলাে হলাে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাসদ, ন্যাপ (মােজ ‘ফফর), গণতান্ত্রিক আন্দোলন, জাতীয় একতা পার্টি, স্বতন্ত্র ২ জন। ভাইস প্রেসিডেন্টের পরিচালনায় শপথ গ্রহণ করেন বিএনপি দলীয় সদস্যগণ মুসলিম লীগ, আই ডি এর, কৃষক শ্রমিক পার্টি জাতীয় লীগ।৫
জন্মেই স্বৈরতন্ত্র ও বিএনপি
৮. জেনারেল জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক চর্চার কথা বললেও বিএনপির
গঠনতন্ত্রে গণতন্ত্র নেই। গ্রাম থেকে জেলা পর্যন্ত কমিটিগুলাে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠনের কথা থাকলে কমিটি চাপিয়ে দেয়া হয় উপর থেকে। দলীয় সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দলের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমানের হাতে। সকল স্তরে সাংগঠনিক কমিটি হয় মনােনয়নের মাধ্যমে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দল গঠনের সুযােগ নেই। নেতৃত্বের গুণ নয়, দলের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জিয়াউর রহমান মনােরঞ্জনই পার্টিতে উন্নতির চাবিকাঠি। সর্বোচ্চ সংস্থা জাতীয় কাউন্সিলেরও করার কিছু নেই। দলের গঠণতন্ত্রে রয়েছেঃ দলের চেয়ারম্যান গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়ােজনবােধে জাতীয় কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্য থেকে কয়েকজন সদস্যের সমন্বয় গঠিত বিভিন্ন বিষয়ে কমিটি মনােনীত করতে পারবেন।’ কাউন্সিলের দায়িত্ব দলের নতি ও কর্মসূচী গ্রহণ করার বাস্তবায়ন ও কার্যকর করা। আর দলের নীতি ও কর্মসূচী নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করার অধিকার জাতীয় স্থায়ী কমিটির। কাউন্সিল সাধারণ সম্পাদকের (মহাসচিব) রিপাের্ট বিবেচনা ও গ্রহণ করতে পারে। দলের গঠণতন্ত্র সংশােধন করার ক্ষমতা কাউন্সিলের থাকলেও অগণতান্ত্রিক ধারাগুলাের অপসারণ করে আরাে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে এগিয়ে যাওয়ার কোনাে পদক্ষেপ নেবার সুযােগ ও সাহস কারাে নেই। জাতীয় কাউন্সিলেও মােট যােগদানকারী সদস্য সংখ্যার শতকরা ১০ ভাগ মনােনীত হবেন চেয়ারম্যান কর্তৃক।
“জাতীয় নির্বাহী কমিটিও গঠিত হয় চেয়ারম্যান কর্তৃক মনােনয়নের মাধ্যমে। মহাসচিব ডা বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ নির্বাহী কমিটির সকল কর্মকর্তা চেয়ারম্যান কর্তৃক মনােনীত; দলের নির্বাচিত কর্মকর্তা নন। দলের নীতি নির্ধারণ, কর্মসূচী প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, এবং ওয়ার্ড পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত সংগঠন নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ১১ সদস্যের ‘জাতীয় স্থায়ী কমিটিও চেয়ারম্যান কর্তৃক মনােনীত। চেয়ারম্যান এ কমিটির প্রধান। জাতীয় সংসদে, পার্লামেন্টারী দলের নেতা, উপনেতা, চীফ হুইপ, হুইপ বিএনপির চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান মনােনীত করেন। সংসদীয় দল বা মূল দলের গুরুত্ব নেই। গঠনতন্ত্রে আছেঃ দলের চেয়ারম্যান হবেন প্রধান কর্মকর্তা। পার্টি ইলেক্টোরাল কলেজ তাকে ২ বছরের জন্য নির্বাচিত করবেন। কিন্তু পার্টি গঠনের পর চেয়ারম্যান পদে এ পর্যন্ত কেউ নির্বাচিত হননি। পার্টিকে গণতান্ত্রিক কাঠামাে দেবার জন্য একটি অংশ সােচ্চার। অপরপক্ষ বলছেন, ‘গণতন্ত্র বাইরের জন্যেঃ দলের জন্যে নয়।’ দলের মহাসচিব ও সংসদ উপনেতা। বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন, জিয়া দেশে যে গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েছেন তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশেই এমন গণতান্ত্রিক অধিকার নেই। অথচ উপ-প্রধানমন্ত্রী ও উপ নেতা ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ ‘পার্টির অভ্যন্তরে গণতন্ত্র দিতে হবে’ একথা বলায় মন্ত্রীত্ব ও নেতৃত্ব হারিয়ে ওকালতীতে ফিরে যান। সংসদে এখন তিনি একজন সাধারণ সদস্য।৬ জিয়াউর রহমানের আমলে জাতীয় কাউন্সিল যা ছিল সর্বোচ্চ সংস্থা, তার কোন ভূমিকা ছিলােনা। বিএনপির চেয়ারম্যান হিসেবে জিয়াউর রহমানকে পর্যন্ত তারা অনুমােদন দেবার সুযােগ পায়নি। জাতীয় স্টান্ডিং কমিটি কোন সময়ই তার কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি, শুধুমাত্র জিয়াউর রহমানকে সমর্থন করা ছাড়া।
কেন্দ্রীয় অফিস ঃ স্বৈরাচারের আখড়া
৯. বিএনপি কেন্দ্রীয় অফিস পরিচালিত হতাে একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ও তার সহযােগী দ্বারা। যিনি জিয়ার ছিলেন ব্যক্তিগত সহকারী । পার্টির তহবিল, প্রেস, প্রচার, যােগাযােগ তার এবং তার সহযােগীদের দ্বারা পরিচালিত হতাে। বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসে ৫০ জন স্থায়ী কর্মকর্তা ছিলাে। পার্টির গঠনতন্ত্রে যদিও লিখিত ছিলাে পার্টি সদস্যদের চাঁদা, অনুদান ও সমর্থকদের। দানের টাকায় পার্টি পরিচালিত হবে, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে প্রেসিডেন্ট জিয়া ও তার মন্ত্রীবর্গ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের নিকট হতে চাঁদা আদায় করতেন। কোটি কোটি টাকা খরচ হতাে এবং খরচের কোন হিসেব হতােনা।৯ জিয়ারউর রহমান স্বৈরাচারী হিসেবে স্বৈরাচারী পার্টি কাঠামােয় বিএনপিকে গড়ে। তুলেছিলেন উঠেছিল। বিএনপি প্রকৃত পক্ষে ছিলাে ‘ওয়ান ম্যান পার্টি’। ১০ যার গঠনতন্ত্র চেয়ারম্যানকে দিয়েছিলাে অসীম ক্ষমতা, যে ক্ষমতা জিয়াউর রহমান। পার্টির অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক ধারাকে স্তব্ধ করে রেখেছিলেন।
গণতন্ত্রের বিএনপিকরণ
১০. জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করেই সামরিক পােশাক পরে সামরিক বাহিনীর বহর নিয়ে দেশবাসীকে গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, কিন্তু না পার্টিতে না প্রশাসনে অথবা রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনায় কোথায়ও গণতন্ত্র চর্চা হয়নি। গণতন্ত্র বলতে জিয়াউর রহমান বুঝতেন বিএনপিকরণ। প্রশাসনকে বিএনপিকরণের হাজারাে দলিল প্রমাণ ও উদাহরণ রয়েছে। জিয়াউর রহমানের আমলে গণতন্ত্রের নামে বিএনপির দলীয়করণের কাজ দ্রুত এগিয়ে যায়। নগ্ন দলীয়করণের একটি বিশেষ পর্যায়ে। প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়। ঢাকা, রংপুর, সিলেট, খুলনা, বরিশাল ও দিনাজপুরের ঘটনাবলির পর জনগণ প্রশাসনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। জনগণ দেখেছে প্রশাসনিক দলীয়করণের নির্লজ্জ দৃষ্টান্তসমুহ। এ-সমস্ত ঘটনা বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা যায় প্রশাসনের উপর দলীয় চাপই এর জন্য মূলত দায়ী। যেমন ঢাকায় জনৈক বিএনপি কর্মী কর্তৃক ম্যাজিষ্ট্রেটকে প্রহার করার পরও পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অস্ত্রধারী দু’জন পুলিশ ছিলাে নীরব, তারা বলতে গেলে চাকুরী হারানাের ভয়ে ঐ কর্মীকে আটক করা থেকে বিরত থেকেছে। সিলেটে তিনটা অমূল্য জীবন বিদায় নিলাে বিএনপির উস্কানীর ফল হিসেবে। কুমিল্লার জনৈক উপমন্ত্রীকে যথাযথ সম্মান দেখানাে হয়নি বলে সাসপেও হলেন কয়েকজন পুলিশ। মুন্সিগঞ্জে বিএনপির বড় নেতাকে সেলুট দেয়া হয়নি বলে বদলী হলাে জেলা ও মহুকুমা পর্যায়ের অফিসারদের। দারােগা-পুলিশ, সিওর চাকরি তাে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের দয়ার উপর নির্ভরশীল। সংস্থাপন মন্ত্রনালয়ের ফাইলে হাজার তদবির কেস। ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে এমপিদের সুপারিশ,
জেলা প্রশাসক, মহকুমা প্রশাসক, পুলিশ সুপারকে বদলী এবং চাকরিচ্যুত করার লিখিত নির্দেশ, থানার ওসি বদলানাের কেস এগুলাে। ওসিকে দিয়ে আসামির মুক্তি, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য গ্রেফতার-এর নাম গণতন্ত্র চর্চা। কোথাও নির্দেশের হেরফের হলে ঐ কর্মচারীর ভাগ্যে নেমে আসে বিপর্যয়। শতাধিক ঘটনা সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে বন্দী। সিনিয়র পলিসি পুল গঠনের কথা ঘােষণা থেকেই বিরােধ। বেসামরিক ছত্রছায়ায় সামরিক ব্যক্তিদের অবাধ প্রবেশের ব্যবস্থার ফলে বিরােধ অনেকটা বিদ্রোহের রূপ নেয়। সচিব থেকে শুরু করে এস,পি পর্যন্ত এখন প্রায় শতাধিক উর্দিপরা তােক বেসামরিক প্রশাসনে, জেলার পুলিশ সুপারের চারজন ছাড়া বাকি সবাই সামরিক লেবাশধারী। সচিবালয়ে যুগ্ম ও উপ-সচিব নেয়ার মৌখিক পরীক্ষা। অনেকটা লােকদেখানাে। পরীক্ষায় ৩৫ জন কর্ণেল ও দশ জন মেজর পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। এরা সহসাই যােগ দেবেন সচিব ও উপসচিব পদে। বাইরে দূতাবাসগুলােতেও এদের সংখ্যা বাড়ছে। রেডিও টেলিভিশনে উর্দিপরা লােক। গােটা প্রশাসনকে বি এন পি করণের মহৎ উদ্যোগ চলছে। এপ্রসঙ্গে বিবিসি’র মূল্যায়ন ছিলােঃ “বাংলাদেশের শসনব্যবস্থা এখনাে সামরিক বাহিনীর উপর নির্ভরশীল। প্রেসিডেন্ট নিজেও দ্বৈতভূমিকা নিয়েছেন। তিনি নিজে তাঁর সামরিক পদ পরিত্যাগ করলেও এখনাে ক্যান্টেনমেন্টেই আছেন।”
জিয়ার গণতন্ত্রের ভাষা ধরেঙ্গা মারেঙ্গাঃ একটি সম্পাদকীয়
১১. জনগণের ভাত কাপড়ের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়ে সরকার ও সরকারী দল নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য পূর্ববর্তী সরকার ও বর্তমান বিরােধী দলসমূহেকে সকল সংকটের জন্য দায়ী করছে। বিরােধী দলের প্রসঙ্গ এলেই তারা বেসামাল হয়ে পড়েন। কক্সবাজার থেকে ঢাকা ফেরার পথে বিমানে একটি দৈনিক-এর প্রতিনিধির সাথে একান্তে আলাপকালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বলেছেন, “বিরােধী দলগুলাের সংযম নিয়ে আচরণ করা উচিত১২ বিরােধী দলগুলাের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতি যে আশা করেছেন অনুরূপ আচরণ বিরােধী দলগুলাে তাঁর বা তাঁর দলের কাছ থেকে আশা করতে পারেন। সরকার ও সরকারী দল কি বিরােধী দলগুলাের প্রতি অনুরূপ আচরণ করে থাকে? সাম্প্রতিক কালে সরকার ও সরকারী দলের নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা-বিবৃতিতে সংযম তাে দূরের কথা বিন্দুমাত্র শালীনতা প্রকাশ পাচ্ছেনা। রাষ্ট্রপতি যে দিন বিমানে বিরােধী দলগুলাের প্রতি সংযমের আচরণ আশা করেছেন, সেদিনই ঢাকার বায়তুল মােকাররমে তাঁর দল জাতীয়তাবাদী দলের একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঐ সভায় ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান, পশুপালন মন্ত্রী ওযায়দুর রহমান, বিএনপি সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রমুখ। শাহ আজিজুর রহমান তাঁর ভাষণে বিরােধী দলসমূহের উদ্দেশ্যে বলেছেন যে, “আর নয়। এখন থেকে পাকড়াও করতে সরকার কাল বিলম্ব করবেনা।” বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রসঙ্গে ওবায়দুর রহমান বলেছেন যে, “আমরা এসব কাগজকে ছারপােকার মতাে টিপে মারতে পারি।” বিরােধী দলের নেতাদের সম্পর্কে বলেছেন, “বস্তাবন্দী করে বঙ্গপসাগরে নিক্ষেপ করা হবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ইতিপূর্বেও দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত প্রকাশ্য জনসভায় বিরােধীদলসমূহকে উৎখাত’ করার হুমকি দেয়া হয়েছে।
লেঃ কঃ (অবঃ) আকবর ১৫ হাজার বিরােধী দল সদস্যদের জেলে পাঠানাে উচিত বলে এক জনসভায় মন্তব্য করেছেন। রাষ্ট্রপতি যেদিন পূর্বোক্ত আশা ব্যক্ত করেছেন, সরকারী দলের জনসভা হতে যেদিন “ধরেঙ্গে, মারেঙ্গে” ধরনের হুমকি উচ্চরিত হয়েছে, সেদিনই সারাদেশে পুলিশ বাংলাদেশের কমিনিষ্ট পার্টি (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাসদ সহ বিরােধী দলের বিপুল সংখ্যক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। বর্তমান সরকারের প্রায় পাঁচ বছরের শাসনামলে জনজীবনে বিশেষতঃ মেহনতি মানুষের, নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন ধারনের সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে-এটা কেউ অস্বীকার করতে পারেন? জনগণের পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। সর্বস্তরের জনগণ। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ প্রভৃতির মাধ্যমে ন্যূনতমভাবে। খেয়ে পরে বেঁচে থাকার দাবীই তুলে ধরছে। এর ফলে সরকার বেসামাল ও দিশেহারা হয়ে পড়েছে। নিতান্তই ভাত-কাপড়ের দাবীতে বিভিন্ন শ্রেণীর জনগণ যে আন্দোলন করছে, সরকার তাকে অভিহিত করছে “রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণােদিত” বলে। এর জন্য দায়ী করছে বিরােধী রাজনৈতিক দলসমূহকে নির্যাতন চালানাে হয়েছে আন্দোলনকারী জনগণ ও বিরােধী দলগুলাের উপর। বিরােধী দলের অস্তিত্ব। ছাড়া সরকার ও সরকারী দলের সামনে কি দেশের কোন বাস্তব সমস্যার নেই? সরকারী দলসহ সকলকে আমরা এই কথাটি উপলব্ধি করার আহবান জানাই যে, ধরেঙ্গা, মারেঙ্গা করে আর যাই হােকনা কেন, দেশের সংকট ও সমস্যা, বিন্দুমাত্র লাঘব হয়নি, হবেনা। জনজীবনের বাস্তব সমস্যাগুলাে স্বীকার, তা সমাধানের পথ সম্পর্কে বিএনপির সভাগুলােতে কোন বক্তব্য রাখা হচ্ছে কি? খালকাটা ও উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। দেশের কোটি কোটি মেহনতি কৃষক নিজেদের গরজেই উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন। উৎপাদন বৃদ্ধির কথা কৃষকদের বলার কোন অর্থ নেই। কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও ভূমিহীন কৃষক, পাটচাষী, গরীব কৃষক, শ্রমিক, অল্প আয়ের মানুষ তার সুফল ভােগ করতে পারবে তার নিশ্চয়তা সমাজে আছে কি? সরকারী দল যেমন বলছে ‘শ্লোগানের রাজনতি আর চলবে না আমরাও বলতে চাই ঠিক তাই, এই প্রশ্নগুলাের জবাব না দিয়ে ধরেঙ্গা, মারেঙ্গার রাজনীতি কারও জন্যই কোন সুফল বয়ে আনবে না। ১২
গণতন্ত্রের শ্বেত সন্ত্রাস ঃ আরাে একটি রিপাের্ট
১২. সরকার এবং সরকারী দল সারাদেশে শ্বেত-সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। কারা প্রাচীরের অভ্যন্তরে, প্রকাশ্য রাজপথে, রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে, কলে-কারখানায়, শিল্প প্রতিষ্ঠানে চলছে এই শ্বেত-সন্ত্রাসের তাণ্ডবলীলা। দেশ পরিচালনায় ও জনগণের সমস্যা-সংকট সমাধানে ব্যর্থ হয়ে সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। বিনা প্ররােচনায় রাজশাহী কারাগারে কয়েকজন বন্দীকে গুলি করে হত্যা করেছে এই সরকার। এই নিমর্ম হত্যাকন্ডে দেশবাসী স্তস্তিত। এর প্রতিবাদে দেশের ১০টি বিরােধী রাজনৈতিক দল ৯ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা শহরে হরতাল আহবান করেছিলাে।
হরতাল ঠেকাতে জিয়া
১৩. এই হরতাল বানচাল করার জন্য সরকার এবং সরকারী দল সকল প্রচেষ্টাই গ্রহণ করে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বয়ং রাজধানীর পাড়ায়-মহল্লায় ঘুরে ঘুরে হরতাল বানচালের আহবান জানিয়েছেন। অভিনব কৌশলে হরতাল বানচালের জন্য বিএনপি রাত বারােটায় বিরােধী দলের নামে সারা ঢাকা শহরে প্রচার করে যে, আগামীকল্য বিরােধীদল হরতাল প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কিন্তু জনগণ এই মিথ্যা প্রচার ধরে ফেলে।
১৪. জনগণ এতে বিভ্রান্ত না হয়ে পরদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করে। সরকারী নীতির প্রতি প্রকাশ করে প্রতিবাদ। দিশেহারা ও ক্ষুব্ধ সরকার তাই প্রতিবাদী জনগণের উপর লেলিয়ে দিয়েছে সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিনী। সরকার দলীয় এই সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিনী হরতালের দিন প্রকাশ্য দিবালােকে দু’জনকে গুলি করে হত্যা করেছে। এরা হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগ, জাসদ ও কমিউনিস্ট পার্টির কার্যালয়ে। রাতের অন্ধকারে বিএনপি যুব সংগঠনের সশস্ত্র গুন্ডারা বিরােধী দলের কার্যালয়ে হামলা ও লুটতরাজ করে অগ্নিসংযােগ করেছে। এরা অস্ত্রের মুখে অপহরণ করেছিলাে তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে বাংলাদেশ টোব্যাকো কোম্পানীর শ্রমিক নেতাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্র ও একটি ছাত্রীবাসেও সরকারী দলের। সমর্থকরা হামলা চালিয়েছে। ১২ ই ফেব্রুয়ারী এরা ডেমরার লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে তিন তিন বার হামলা করে চালিয়ে কয়েকজন শ্রমিককে হাসপাতালে পাঠিয়েছে।
উপরােক্ত ঘটনাবলী কোন বিছিন্ন ঘটনা নয়। সাম্প্রতিককালে অনুরূপ বহু ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। কাঞ্চন, টংগী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চল এবং ময়মনসিংহ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা জনগণ বিস্মৃত হয়নি। অত্যন্ত সুপরিকল্পিভাবে এই শ্বেত সন্ত্রাসের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে সরকার ও সরকারী দল। সরকারই যে এই শ্বেত-সন্ত্রাস সৃষ্টির নায়ক তার প্রমাণ, সরকার প্রধান ও সরকারের কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক ভাষণ বিবৃতি। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী সকলেই প্রকাশ্য জনসভায় বিরােধীদলসমূহকে উৎখাত’ ও ‘নির্মূল করার আহবান এবং প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণায় সরকারী দল ও তাদের। গণসংগঠনসমূহ দেশ জুড়ে এই হত্যা, হামলা, অগ্নিসংযােগ ও লুট শুরু করেছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের অভাব বিশেষতঃ জনগণের উপর আস্থাহীনতা,ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীলতার অভাব থেকেই ওই মনােভাবই এইরূপ শ্বেত-সন্ত্রাসের জন্ম দেয়। ষাটের দশকের দ্বিতীয় ভাগে দেশবাসী আইয়ুব-মােনেমের শ্বেত-সন্ত্রাস প্রত্যক্ষ করেছে। দেশ স্বাধীন হলেও মূল্যবােধের ক্ষেত্রে আইয়ুব-মােনেম যে। বিষবৃক্ষ রােপন করেছিল তা পুরােপুরি উৎপাটিত হয়নি। ১৩
জিয়ার ‘সার্বভৌম সংসদ’-এর নমুনা
১৫. জিয়াউর রহমান ও তার সরকারের মন্ত্রী ও এমপিগণ অত্যন্ত জোরালাে ভাষায়
বলতেন ‘এই সংসদ সার্বভৌম’। কিন্তু সংসদের ক্ষমতা সম্পর্কে সরকারী দলের একজন সাংসদ দেশের মানুষের সামনে আসল কথাটি প্রকাশ করেছেন। বিরােধীপক্ষের জবাবে তারা বলেছেন : মন্ত্রী পরিষদ সংসদের কাছে দায়ী নয়।’১৪ ১১ই এপ্রিল ৮০ থেকে ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত অধিবেশন চলেছে। অধিবেশনে প্রেসিডেন্টের ভাষণের ওপর ধন্যবাদ সূচক বক্তৃতার মধ্যেই ছিলাে সীমাবদ্ধ। সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী বছরের প্রথমে প্রেসিডেন্ট ভাষণ দেন। এই অধিবেশনও ছিলাে তাই। ৯ই এপ্রিল প্রেসিডেন্ট সংসদে ভাষণ দেন। প্রেসিডেন্ট বলেন ঃ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সুষ্ঠু বিকাশের জন্য জাতীয় সংসদের দায়িত্বশীল ও সক্রিয় বিরােধীপক্ষের অস্তিত্ব অপরিহার্য। পরমমত সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবােধের পরিচয় দিয়ে আমরা যদি একটা সুষ্ঠু সংসদীয় কর্মপদ্ধতি ও ঐতিহ্য গড়ে তুলতে পারি, তাহলে প্রকৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিকাশে বিপুল সহায়ক হবে।” তিনি বলেন, “সার্বভৌমত্ব রক্ষাই আমাদের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য।”
১৬. প্রেসিডেন্ট যেন গ্রাম সরকার প্রধানদের সামনে ভাষণ দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে, প্রেসিডেন্টের ভাষণে “সংসদীয় কর্মপদ্ধতি ও ঐতিহ্য গড়ে তােলার কোন সুযােগই নেই এই জাতীয় সংসদে। বিরােধী দলের নেতা জনাব আসাদুজ্জামান খান বলেনঃ কতকগুলাে গণবিরােধী আইন পাশ করা ছাড়া এই সংসদের কোনাে ক্ষমতা নেই। রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট। মুসলিম লীগৈর খান এ সবুর বলেন ঃ “প্রেসিডেন্টে এমনভাবে বক্তৃতা করেছেন মনে হলাে তিনি যে গ্রাম সরকার প্রধানদের সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছেন।” জনাব খান এই সংসদকে নপুংসক পার্লামেন্টা’ বলেও আখ্যায়িত করেন। জাতীয় লীগের জনাব আতাউর রহমান খান বলেনঃ এই সংসদে কিছু বলে লাভ নেই। কেউ কারাে কথা শুনে না। আইন-শৃঙ্খলা প্রসঙ্গে বলেছেন, “দেশে আইনও নেই, শৃঙ্খলাও নেই-আছে শুধু শৃঙ্খল।”১৫)
ক্ষমতা আছে তবে গােপনে
১৭. প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সম্পর্কে বিরােধীপক্ষের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ক্ষমতাছে-তবে সবই গােপনে। মন্ত্রী পরিষদের বিরুদ্ধে মিঃ সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত অনাস্থা প্রস্তাব আনেন ও সরকারী দলীয় একজন সদস্যদের সাথে জনৈক পুলিশ। অফিসারের অশােভন আচরণকে কেন্দ্র করে অধিকার প্রস্তাব আনেন। অনাস্থা প্রস্তাবের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উপপ্রধানমন্ত্রী জনাব জামালউদ্দিন আহমদ বলেছেনঃ “বর্তমান মন্ত্রী পরিষদ জাতীয় সংসদের কাছে দায়ী নয়। সংসদ শুধু মাত্র প্রেসিডেন্টের কাছে দায়ী। এ প্রসঙ্গে তিনি সংবিধানের ৫৬ ও ৫৮ অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করেন। স্পীকার রুলিং এ বলেন, সংবিধানের কোনাে ধারা লংঘন করা হয়নি। পুলিশ অফিসারের অশােভন আচরণে সরকার দলীয় সদস্য মুর্শেদ আলী খান পন্নি। স্মরণাপন্ন হয়ে ছিলেন সংসদের কাছে। অধিকার ভঙ্গের অভিযােগ এনে পন্নি পুলিশ অফিসারের শাস্তি দাবি করেন। ৩ ঘন্টা আলােচনার পর এ্যাসিস্টেন্ট পুলিশ কমিশনার সাসপেণ্ড হয়েছেন। পুলিশ-কমিশনারকে সংসদে যেতে হয়নি। পার্লামেন্ট তার বিচারের ব্যবস্থা করতে পারেনি। মুর্শেদ আলী খান পন্নি তার অধিকার প্রস্তাবে বলেন ঃ গত ২১শে এপ্রিল রাতে তার বাসায় চুরি হয়। ভােরবেলা তা টের পেয়ে তিনি মােহাম্মদপুর থানায় টেলিফোন করেন। কিন্তু যদিও তার বাসভবন থানার অত্যন্ত কাছে ছিলাে তা সত্ত্বেও পুলিশ আসতে দেরি হওয়ায় তিনি ঢাকা। মেট্রোপলিটন পুলিশের কন্ট্রোল রুমে টেলিফোন করেন। সেখানে উপস্থিত সরকারী পুলিশ কমিশনার সাফায়াত আলীকে তিনি চুরির ঘটনা এবং মেহাম্মদপুর থানার পুলিশের আসতে দেরি করার কথা জানান। এই নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে উক্ত সহকারী পুলিশ কমিশনার বলেনঃ “ইউ ব্লাডি এমপি, এটা তােমার বাপের কোম্পানী নয়। যাও না পার্লামেন্টে দেখি কি করতে পারাে? এমপি হয়ে তােমরা বাস্টার্ডরা আমাদের কাজ শেখাতে এসেছে। প্রেসিডেন্টের নাম উচ্চারণ
করেও পুলিশ অফিসার নানা ধরনের ব্যঙ্গোক্তি করেছেন, যা এ সংসদের জন্য অবমাননাকর।” কিন্তু সংসদ সদস্যের অবমাননা অর্থাৎ সংসদকে কটাক্ষ করার পরও বিচার না হওয়ায় সংসদ যে রাবার স্ট্যাম্প তা আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও চীপ হুইপ উপস্থিত না থাকায় স্পীকারকে দিনের কার্যসূচীর কয়েকটি বিষয় স্থগিত রাখতে হয়েছে। প্রশ্নোত্তরপর্বে অসত্য তথ্য পরিবশেন রীতিতে দাঁড়িয়ে গেছে। এই হলাে ‘সার্বভৌম সংসদ’-এর নমুনা!
উপদ্রুত এলাকা বিল ঃ ভিন্নরূপে মার্শাল ল
১৮, ১৯৮০ সালের উপদ্রুত এলাকা বিল জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ‘ লেঃ কর্ণেল (অবঃ) এ,এস,এম, মুস্তাফিজুর রহমান সংসদে এই বিল উত্থাপন করেন। এই বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের কোনাে অংশে বিরাজমান অস্বাভাবিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বা বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপ যা দেশে বিদ্যমান আইন দ্বারা সফলতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, সে সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশের সে অংশকে উপদ্রুত এলাকা ঘােষণা করা এবং তৎসংক্রান্ত ও তদানুষঙ্গিক বিষয়ে বিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে এই বিল আনা হয়েছে।” বিলের ৩নং অনুচ্ছেদে কোন এলাকাকে উপদ্রুত এলাকা ঘােষণা করিবার ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, সরকার যদি এইরূপ মত পােষণ করেন যে, বাংলাদেশের কোন অংশে এইরূপ উপদ্রুত বা বিপজ্জনক অবস্থা বিরাজ করিতেছে যে, গণশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও তাহা রক্ষার জন্য বেসামরিক ব্যক্তি সাহায্যার্থে প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্যবহার প্রয়ােজন, তাহা হইলে সরকার সরকারী গেজেটে বিজ্ঞপ্তি দ্বারা বাংলাদেশের সেই অংশকে উপদ্রুত এলাক বলিয়া ঘােষণা করিতে পারিবেন। বিলের ৪নং ধারায়, গুলী করা, তল্লাশী চালানাে, গ্রেফতার করা, বিনষ্ট করা ইত্যাদির ক্ষমতা শীর্ষক অধ্যায়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীর কোনাে অফিসার বা কোনাে ম্যাজিষ্ট্রেট অথবা পুলিশের অন্যূন সাবইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কোনাে অফিসার বা বাংলাদেশের রাইফেলসের অন্ন হাবিলদারের পদমর্যাদার কোনাে অফিসার কি পরিস্থিতিতে গুলী ছুড়তে পারবেন, কোনাে আস্তানা বা কাঠামাে ধ্বংস করতে পারবেন, বিনা পরােয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবেন, বিনা পরােয়ানায় কোনাে গৃহাঙ্গণে প্রবেশ ও তল্লাশী চালাতে এবং এর জন্যে প্রয়ােজনীয় শক্তি প্রয়ােগ করতে পারবেন তার বিধানসমূহের বিবরণ দেয়া হয়েছে। এই আইনের অধীনে পুলিশ অফিসার বলতে পুলিশ বাহিনীর অঙ্গীভূত আনসার বাহিনীর অফিসারকেও বােঝাবে। ১৭
বিরােধীদলের নেতা জনাব আসাদুজ্জামান খান এই বিলকে মার্শাল ল’র চেয়েও জঘন্য আইন বলে অভিহিত করেছেন। গণতন্ত্রের কণ্ঠরােধ ও রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যা করার জন্য এই বিলটি আনা হয়েছে। বিল সংবিধান, মৌলিক অধিকার ও প্রচলিত সকল মানবাধিকারের পরিপন্থী। এই বিল সম্পর্কে ‘দৈনিক সংবাদ’ একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। এতে তাঁরা বলছেন ‘উপদ্রুত এলাকা বিলটিতে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ তথা পুলিশ-বিডিআর-এর হাতে যে ঢালাও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তা কোনােক্রমেই গণতন্ত্রের নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিংবা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অনুকুল নয়। সরকার দেশের কোনাে অঞ্চলকে একবার ‘উপদ্রুত’ বলে ঘােষণা করলে সে এলাকার জনসাধারণের আর মৌলিক অধিকার তথা আইনের আশ্রয় গ্রহণের সুযােগ বলতে কিছু থাকবে না। এমনকি নিম্নপদস্থ পুলিশ ও বিডিআর কর্মচারীরাও নিজ নিজ বিচার বুদ্ধি বা খেয়ালখুশি মােতাবেক গুলীবর্ষণ, নিছক সন্দেহবশে বিনা পরােয়ানায় গ্রেফতার ও খানা তল্লাশী করতে পারবেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মারফত স্বাভাবিক আদালতকে পাশ কাটিয়ে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেয়া যাবে। সরকারী কর্মকর্তারাই সর্বদাই যে সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন এর কোনাে নিশ্চয়তা নেই। বরং অভিজ্ঞতা এ কথাই বলে যে, এ ধরনের অস্বাভাবিক আইনের অপ্রয়ােগের আশঙ্কাই অধিক।’১৮ কেন “দৈনিক ইত্তেফাক’ এ সম্পর্কে লিখেছে, বিশেষ ট্রাইব্যুনালের কোন আদেশ, রায়। এ বা দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে কোন আপীল করা যাইবে না এবং উক্ত আদেশ, রায় বা দন্ডাদেশ সংশােধন করিবার কর্তৃত্ব কোন আদালতের থাকিবে না। ১৭ নম্বর ধারায় ‘ এই কথা সন্নিবেশের দ্বারা দেশের প্রচলিত কোর্ট আদালতের প্রতিচরম অনাস্থা প্রকাশ করার মাধ্যমে দেশে আইনের শাসনের নীতিমালা বানচাল করার ব্যবস্থা করা হইয়াছে।”১৯ এই সংক্ষিপ্ত আলােচনা, রিপাের্ট ও সম্পাদকীয় মন্তব্যের মাধ্যমে এটা পরিস্কারভাবে প্রতীয়মান যে, দেশে গণতন্ত্র ছিলাে না, ন্যায় বিচার ও আইনের শাসনের পথ রুদ্ধ ছিলাে এবং সার্বভৌম সংসদের’ নামে ‘রাবার স্ট্যাম্প’ বহাল ছিলাে।
সূত্র : জেনারেল জিয়ার রাজত্ব – অধ্যাপক আবু সাইদ