সাতই মার্চের ভাষন ও আমার বাবা৷
আমার বাবা জনাব আব্দুল ওহাব বগুড়া এস ডি ও অফিসে চাকরী করতেন ৷ আমরা বগুড়া মালতীনগর স্টাফ কোয়ার্টারের তৎকালীন চার নম্বর বিল্ডিং এর পশ্চিম পার্শ্বস্থ তিনতলা ফ্ল্যাটে বসবাস করতাম ৷ আমরা তিন বোন,মা,বাবা ৷ স্টাফ কোয়ার্টারের দক্ষিন দিকে ছিল বিহারী কলোনী ৷ সত্তুর সালের নির্বাচনের আগে থেকেই বিহারীদের নজরদারী ছিল আব্বার উপর ৷ আমার যতদুর মনে পড়ে, বড়রা মানে আমাদের অভিভাবকরা এবং যুবক সম্প্রদায় কখনও আতঙ্কমুক্ত থাকতেন না ৷ প্রায়ই শোনা যেতো,’ অমুক জায়গায় বিহারীরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, অমুক জায়গায় বিহারীরা বাঙালী ছেলেকে মেরেছে ৷ ‘ স্টাফ কোয়ার্টার সরকারী চাকিরীজীবীদের আবাসস্থল ৷ বিহারীদের সাথে কাউকে মিশতে দেখিনি ৷ এমনিভাবে সত্তুর সালের নির্বাচন এসে গেল ৷ কাহালু অথবা পাঁচবিবিতে আব্বার ভোটের কাজ পড়ল ৷ আমার বাবা দায়ীত্ব এবং কর্তব্যে সদা সচেতন ব্যক্তি ছিলেন ৷ ব্যক্তিত্ব ছিল স্বাধীনচেতা ৷ ভোটের একদিন আগেই তিনি কর্মস্থলে পৌঁছানোর জন্য তৈরী হলেন ৷ ভোরে রওনা হবেন ৷ আগের রাতে আমরা বারান্দায় রাতের খাবার খেতে বসেছি ৷ হঠাৎ সিঁড়ি বেয়ে কে যেন খুব সন্তর্পনে উঠে আসলো আমাদের দরজা পর্যন্ত ৷ আব্বার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল ৷ বড় বড় চোখে দরজার দিকে তাকাতে লাগলেন ৷ আগন্তক পুনরায় ধুপ ধুপ আওয়াজ তুলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল ৷ আমরা সবাই ভয়ে জড়োসড়ো ৷ পরদিন আব্বা কোথাও গেলেন না ৷ একেবারে ভোটের আগের দিন রওনা হলেন ৷ যাওয়ার আগে আম্মাকে বললেন,”ওরা টের নিতে এসেছিল আমি বাসায় আছি কিনা ৷ বাসায় আছি বুঝতে পেরে চলে গেল ৷ অন্যথায় আজকেই আমার বাসায় হামলা করতো ৷ তোমরা সাবধানে থাকবে ৷” অতপর আসেপাশের সবাইকে ঘটনার কথা,আতঙ্কের কথা বলে গেলেন ৷ আরও একদিন, কোনএক বিহারীর ছেলে বি টাইপ বিল্ডিংএর পেছনে এমন একটা জায়গায় প্যান্ট পরে খালি গায়ে বসেছিলো যেখান থেকে স্টাফ কোয়ার্টারে প্রবেশের রাস্তা এবং আমাদের বাসা পুরোটাই দেখা যায় ৷ এমনিভাবে সবসময় তারা আব্বার প্রতি নজরদারী করতো,আমাদের দিনগুলো আতঙ্কের মধ্যে কাটতো ৷ ভোটের ফলাফল অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলো না ৷ আমার বাবার চোখ দুটো লালে লাল হয়ে গেল ৷ আমার বাবা গুন গুন করে গান গাইতেন, ছন্দ মেলাতেন, আমাদের নিয়ে হাসতেন ৷ আমার সেই বাবা সত্তুরের নির্বাচনের পর মুক বনে গেলেন ৷ শুধু আসপাশের যুবক সম্প্রদায়ের সাথে কি যেন আলাপ করতেন আমি বুঝতামনা ৷ শুধু এটুকু বুঝতাম তিনি বলতেন,”দেশের পরিস্থিতি ভাল না ৷ দেশ এভাবে চলতে পারে না, ক্ষমতা হস্তান্তর করতেই হবে ৷” ইতিমধ্যে লাইসেন্সধারী অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিল পাকিস্থান সরকার ৷ আমার বাবা বন্ধুক জমা দিলেন না ৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কোরআন শরীফ ও বন্ধুক সাথে রেখেছিলেন ৷
দেশের পরিস্থিতি ক্রমেই আরও খারাপ হতে থাকলো ৷ চতুর্দিকে মিছিল আর মিছিল ৷ পাকি এবং বিহারীদের অতর্কিত হামলার খবর ৷ আব্বা বাসায় বেশি কথা না বললেও বাইরে প্রতিবেশিদের সাথে অনেক কথা বলতেন ৷ আমার একটা অভ্যেস ছিল, অফিস টাইম ছাড়া সবসময়ই আব্বার সাথে থাকতাম ৷ বড়দের কথা বেশি না বুঝলেও একটা কথা বুঝতাম, “দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ ৷” স্টাফ কোয়ার্টারের প্রতিটি পরিবারে গৃহকর্তার নির্দেশ হলো,’যখনই গোলাগুলি শুরু হবে,তখনই নিচতলার যে কোন বাসায় গিয়ে সবাই একসাথে থাকতে হবে এবং মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে হবে ৷ তারও দু একদিন পর ৷ আমি এখন বুঝি, পঁচিশে মার্চের পর একদিন ৷ বগুড়া পুলিশলাইনে প্রচন্ড গোলাগুলি শুরু হলো ৷ আব্বা অফিসে ৷ আম্মা আমাদের তিনবোনকে নিয়ে একদৌড়ে নিচে নেমে গেলেন ৷ নিচতলার সেই বাসায় তখন অনেক মহিলা এবং শিশুরা জড়ো হয়েছে ৷ বড়রা দোয়া পড়ছেন ৷ আমাদের নিচতলা বাসার সালাম ভাই এবং আরও কয়েকজন দৌড়ে এসে বললেন,”খালাম্মা পুলিশ লাইনে যুদ্ধ শুরু হয়েছে,মুক্তিযোদ্ধারা না খেয়ে যুদ্ধ করছেন ৷ তাঁদের খাবার দিতে হবে ৷ ” আজ সালামভাই কোথায় আছেন আমি জানিনা ৷ যাহোক, আম্মারা কয়েকজন মিলে অনেক রুটি বানালেন,আলুভাজি করলেন ৷ টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি করে দিলেন ৷ স্টাফ কোয়ার্টারের যুবকদল সেগুলি নিয়ে তড়িৎ গতিতে চলে গেলেন ৷ পরে শুনেছি উনারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ভিড়তে পারেননি ৷ দুর থেকে টিফিন ক্যারিয়ার ছুঁড়ে দিয়ে খাবার পৌঁছিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ৷ আমি তথা আমরা উৎকন্ঠিত ৷ আব্বা তখনও বাসায় আসেননি ৷ সন্ধের আগে আব্বা আসলেন ৷ খবর আসলো, আজ রাতেই বিহারীরা স্টাফ কোয়ার্টার আক্রমন করবে ৷ আমার বাবা আশপাশের সকল যুবকদের নিয়ে মিটিং করলেন ৷ আমাদের বিল্ডিংএর সামনেই মিটিং হলো ৷ সবকিছুই হচ্ছিল খুব গোপনে ৷ তখন সন্ধের আবছায়া দুর হয়ে রাতের আঁধার নেমেছে ৷ পশ্চিমের প্রাচীরের ওপারে ঘন বাঁশের ঝাড় ছিল ৷ সেখান থেকে অনেক বাঁশ কেটে এনে দেড় হাত দুই হাত করে কেটে একদিক সুঁচালু করা হলো ৷ অনেক ইট জোগাড় করা হলো ৷ অতঃপর সেগুলি খুব সন্তর্পনে বি টাইপ বিল্ডিং এবং আমাদের বিল্ডিং এর ছাদে উঠানো হলো ৷ আব্বা সবার উদ্দেশ্যে বললেন,” আমার বন্ধুক আছে, আপনারা এগুলি নিবেন ৷ ওরা আক্রমন করলে আমরা ছেড়ে দিবোনা,কাপুরুষের মতো মরবো না ৷ ” অতপর সারারাত ছাদের উপর পাহারা চললো ৷ কিন্তু সেদিন বিহারীরা স্টাফ কোয়ার্টার আক্রমন করেনি ৷ আমি আগেই লিখেছি বিহারীরা সবসময় টের নিতো ৷ সেরাতেও খবর নিয়েছিলো ৷ তবে সেদিন থেকে আমার বাবার উপর তাদের ক্রোধ আরও বেড়ে গিয়েছিলো ৷ কিন্তু আব্বা সেটা গুরুত্ব দিতেন না ৷ কারন আমার বাবার চোখে স্বাধীনতার লাল সূর্যটা তীর্যক বেগে আলো ছড়াচ্ছিলো ৷ তাই সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তার সামান্য বাত্যায় ঘটেনি ৷ হাতের কাছে যা ছিল তাই নিয়ে স্টাফ কোয়ার্টার প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ৷৷
পরদিন সকাল থেকে কোয়ার্টারে প্রায় প্রতিটি পরিবার বাক্স প্যাটরা যার যেটুকু সম্ভব সাথে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছে ৷ আমার বাবার চোয়ালদুটো আরও শক্ত এবং আমার মায়ের চোখে সমুদ্রের জলরাশি ৷ যা এখনও বিদ্যমান ৷ আব্বা আমাদের নিয়ে কোথাও গেলেন না ৷ একদিন সারিয়াকান্দি থানার আওলাকান্দী গ্রামের ডা, কোবাদ হোসেন এর ছেলে তারা ভাই আমাদের নিতে আসলেন ৷ উনাদের সাথে আব্বার আত্মায়ের মতোই চলাফেরা ছিল ৷ তারাভাই বললেন,”মামা দেশের পরিস্খিতি খারাপ ৷ আপনাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য আব্বা আমাকে পাঠালেন ৷ ” আমার বাবা নিজে গেলেন না ৷ আমাদের পাঠিয়ে দিলেন ৷ বগুড়া শহর থেকে বিশ মাইল দুরে আওলাকান্দী গ্রাম ৷ সেখান থেকে শহরের উপর বোম্বিং এবং মেশিনগানের গুলির শব্দ শোনা যেতো ৷ চব্বিশে এপ্রিল মতান্তরে পঁচিশে এপ্রিল একাত্তর ৷ বগুড়ার তৎকালীন এস ডি ও মহোদয় এবং মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান মহোদয় দুজন আব্বার ডেথ সার্টিফিকেটে দুটো তারিখ উল্লেখ করেছেন ৷ তখন শহর ফাঁকা ৷ স্টাফ কোয়ার্টার ফাঁকা ৷ আমার বাবা বাসায় ছিলেন ৷ আর তিন নম্বর বিল্ডিংএ বরিশালের একটা হিন্দু পরিবার ছিল ৷ আগের রাতে পরিবার প্রধান আব্বার কাছে এসে বললেন,”বাবা রাস্তাঘাট বন্ধ ৷ এখন আমার যুবতী মেয়ে নিয়ে আমি কোথায় যাবো??? আমাদের তো বিহারীরা মেরে ফেলবে ৷ ” আমার উদার হৃদয়,নির্ভীক বাবা বললেন,”আমার বাসায় থাকেন ৷ ” আব্বার কলিগ সালাম চাচাও সেরাতে আব্বার সাথে ছিলেন ৷ পরদিন চব্বিশ অথবা পঁচিশে এপ্রিল ফজরের নামাজ পড়ে কোরআনশরীফ পড়ছিলেন আমার বাবা ৷এমন সময় শতশত বিহারী হৈ হৈ করতে করতে স্টাফ কোয়ার্টারে ঢোকে ৷ আমাদের বাসা আক্রমন করে ৷ সালাম চাচা দৌড়ে ছাদে উঠে পেছনের কার্নিশ বেয়ে পালিয়ে যান ৷ রশিক বিহারী নামে এক বিহারীর নেত়ৃত্বে বিহারীরা আমার বাবা এবং ঐ হিন্দু পরিবারের তিনজনকে আমার বাবার নিজের হাতে তৈরী স্টাফ কোয়ার্টার মসজিদের সামনে প্রথমে গুলি করে ৷ তারপর ছুরি দিয়ে জবেহ করে বি টাইপ বিল্ডিং এর পেছনের সেফটি ট্যাংকির মধ্যে ফেলে দেয় ৷ এসবই জীবন নিয়ে পালিয়ে বেঁচে যাওয়া সালাম চাচার মুখে শুনেছি ৷সালাম চাচা যা বললেন,” বিহারীরা স্টাফ কোয়ার্টারে ঢুকে পড়লো ৷ আমি ওহাব সাহেবকে বললাম,চলেন তাড়াতাড়ী পালাই৷ ওহাব সাহেব বললেন,”আপনি যান আমি পালাবোনা ৷ ” তারপর দৌড়ে যখন পিওন কোয়ার্টার পর্যন্ত গেছি তখনই প্রতন্ড গুলির আওয়াজ পেলাম ৷ ” রশিক বিহারী নেতৃত্ব দিয়েছিলো একথা আব্বার আরএকজন কলিগের কাছে আমি শুনেছি একানব্বই সালে ৷ সেফটি ট্যাংকিতে ফেলেছিলো একথা শুনেছি স্টাফ কোয়ার্টারের একজনের কাছে ৷ স্বাধীনতার পর সেফটি ট্যাংকি পরিষ্কার করার সময় মানুষের মাথা উঠেছিলো ৷ সবাই দৌড়াদৌড়ি করে দেখতে গিয়েছিলো এই বলে যে,”সীমার আব্বার মাথা উঠেছে,সীমার আব্বার মাথা উঠেছে৷ “অনেকদিন পর্যন্ত স্টাফ কোয়ার্টারবাসি জানতো এখানে সীমার আব্বাকে মেরে ফেলা হয়েছে একাত্তরে ৷ এখন হয়ত কারো জানার ইচ্ছাটুকুও নেই ৷ কে সীমার বাবা ৷ কার রক্তের বিনিময়ে একদিন গোটা স্টাফ কোয়ার্টার বেঁচে গিয়েছিলো ৷ অতি সংক্ষেপে আমার একাত্তর লিখলাম ৷ ছবিটা নিচে দিচ্ছি ৷
- Sima Hoque