You dont have javascript enabled! Please enable it! 1963.08 | আওয়ামী লীগের পুনরীজ্জিবন ও রাজনীতি আগস্ট ১৯৬৩ – জানুয়ারী ১৯৬৪ - সংগ্রামের নোটবুক

আওয়ামী লীগের পুনরীজ্জিবন ও রাজনীতি আগস্ট ১৯৬৩ – জানুয়ারী ১৯৬৪।
সোহরাওয়ারদীর প্রতিষ্ঠিত দল বিহীন জোট এনডিএফ শেখ মুজিবের একেবারেই পছন্দ ছিল না। আওয়ামী লীগ তখন দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দল। জোটে আওয়ামী লীগের গুরুত্ব সে রকম করে দেখা হত না। তা ছাড়া সাবেক মুসলিম লীগ নেতা নুরুল আমীন এবং হামিদুল হক চৌধুরীকে শেখ মুজিব মোটেও পছন্দ করতেন না। খাজা নাজিম উদ্দিনকে কোন মতে সহ্য করে নিতেন। অবশ্য নাজিমুদ্দিন প্রাদেশিক রাজনীতিতে তেমন নাক গলাতেন না। জোটের এক নেতা ছিলেন আতাউর রহমান খান কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগার হিসেবে আর পরিচয় দিতে চান না বা দল আবার নতুন করে পুনরীজ্জিবিত হোক তাও তিনি চাইতেন না। সোহরাওয়ারদী দেশে থাকতেই শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ পুনরীজ্জিবিত করতে চাইতেন। এ ব্যাপারে তিনি সোহরাওয়ারদীর সাথে কথা বলে তেমন সাড়াও পাননি। আতাউর রহমান খানের মত সোহরাওয়ারদীও দল বিহীন জোটে বিশ্বাসী। এর মধ্যেই জোটকে দলে পরিনত করার তোড়জোড় শুরু হয়। দল যদি হয়েই যায় তবে সোহরাওয়ারদী কেন্দ্রের নেতা আর নুরুল আমীন প্রাদেশিক নেতা বনে যান। শেখ মুজিব অনেকটাই গৌণ হয়ে যান। এর মধ্যে সোহরাওয়ারদী চিকিৎসার জন্য জুরিখ চলে যান তিনি ফিরবেন কবে তা নির্দিষ্ট নেই। তাই দলীয় এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে শেখ মুজিবের সোহরাওয়ারদীর সাথে আলাপ আলোচনা জরুরী হয়ে পরে। তাই তিনি লন্ডন রওয়ানা হন এবং ১০ আগস্ট ১৯৬৩ লন্ডন পৌঁছেন। সোহরাওয়ারদী এর মধ্যে চিকিৎসা শেষ করে লন্ডন যান এবং তার পুত্রের বাসায় অবস্থান করতে থাকেন। লন্ডনে উভয়ের মধ্যে আলাপ আলোচনা হয় কিন্তু মুজিব সোহরাওয়ারদীর এবারো মন গলাতে পারেননি। দেশে ফিরে এসে মুজিব বাসাইল, খুলনা, গোপালগঞ্জের উপ নির্বাচনে মনোনিবেশ করেন। বাসাইলে এনডিএফ প্রার্থী খোদা বক্স আওয়ামী লিগার ছিলেন না। খুলনায় মমিন উদ্দিন এবং নিজের এলাকা গোপালগঞ্জে মোল্লা জালাল উদ্দিন ছিলেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী। সকল নির্বাচনে এনডিএফ প্রার্থী গোহারা হারেন। কারন একটাই সরকারী প্রভাব খাটিয়ে ভোট নেয়া। নির্বাচনের ফলাফলে শেখ মুজিব ব্যাথিত হয়ে এনডিএফ এর প্রোগ্রামের বাহিরে সাবেক আওয়ামী লীগের জেলা মিটিং ডেকে নেতাদের দল পুনরীজ্জিবিত করার জন্য প্ররোচিত করতেন। সোহরাওয়ারদী বিদেশ থাকায় এটি তিনি সাচ্ছন্দে করতে পেরেছিলেন কিন্তু দলের অনেক প্রভাবশালী নেতা তা মানতেন না। এসকল নেতারা এনডিএফকেই প্রাধান্য দিতেন এর মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান(৭১ এর শেষ ৩ মাস দালাল), রফিকুল হোসেন (পরে পাক দালাল) মনসুর আহেমদ (মন্ত্রী এবং সাদামাটা দালাল), দেলদার আহমেদ (মন্ত্রী, দালাল), আব্দুল খালেক (মন্ত্রী), জসিম উদ্দিন (৭১ এ মন্ত্রী) আব্দুল জব্বার খদ্দর (৭১ এ শান্তি কমিটি নেতা ও পিডিপি ভাইস প্রেসিডেন্ট), খয়রাত হোসেন সহ বেশ কয়েকজন জাঁদরেল সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা। একই দিন ২৮ আগস্ট শেখ মুজিব ঢাকা ফেরেন। বিমানবন্দরে শেখ মুজিব বলেন সোহরাওয়ারদী সুস্থ আছেন অক্টোবরেই তিনি দেশ ফিরবেন। মুজিব দেশে ফিরে আবুল মনসুর আহমেদের বাড়ীতে দলের বৈঠক ডাকেন। সভার তারিখ বেশ কয়েকবার বদল হয়। কারন বার বার বলা হচ্ছিল নেতা দেশে ফিরছেন। একসময় শেখ মুজিব বলেই ফেললেন নেতার জন্য তো আর বসে থাকা যায়না। পরে মনসুর আহমেদের বাসায় সভা হল। সভায় তিনি লন্ডন সফরের বিবরন পেশ করে বলেন নেতার ইচ্ছা এনডিএফ চলমান থাকুক। কিন্তু তিনি দলের পুনরীজ্জিবন চান। এ ব্যাপারে কার্যনির্বাহক কমিটির সদস্যদের সমর্থন চান। তিনি তাদের বুঝান দল বলতে আছে একটি সেটি আওয়ামী লীগ আর কর্মীও সব আওয়ামী লীগ। এনডিএফ হওয়াতে জনসমর্থনহীন অন্য দলের নেতারা এখন জেলা ও কেন্দ্রে নেতা। এটা হতে পারেনা। তিনি এর আগেও এনডিএফ এর বৈঠকে জেলায় তার দলের প্রাধান্য চেয়েছিলেন। কিন্তু হামিদুল হক চৌধুরীর বাধায় কিছুই করতে পারছিলেন না। কেন্দ্রীয় সভায় ৩ এনডিএফ নেতার পর শেখ মুজিব এর সিরিয়াল ছিল যা অত্যন্ত অপমান জনক ছিল। সিনিয়র নেতারা কেউ দলের পুনরীজ্জিবিত চাচ্ছিলেন না। দল পুনরীজ্জিবন করার বিষয়টি সোহরাওয়ারদির কানে গেলে তিনি লন্ডনে অবস্থানরত যশোরের এমএনএ রশিদ নামে এক নেতার কাছে শেখ মুজিবের কার্যক্রম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বললেন মুজিব এটা করলে দল ও জনগনের সমর্থন পাবেন না। রশিদ সোহরাওয়ারদিকে সমর্থন না করলেও নেতার অবস্থান চিঠির মাধ্যমে আতাউর রহমান খান সহ কয়েকজনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তাই না শেখ মুজিব যদি দল পুনরীজ্জিবিত করে তবে তিনি আর পাকিস্তান ফিরে যাবেন না এ কথাও পত্রে লিখেছিলেন।
শেখ মুজিব দল পুনরীজ্জিবিত করলে নেতা সঙ্কটে পড়তে পারেন এ চিন্তায় তিনি বাধ্য হয়ে তিনি কিছু দক্ষিনপন্থী নেতাদের দলে জায়গা প্রস্তুত করেছিলেন। অপর দিকে পুরাতন দক্ষিনপন্থীরা দলের বাইরে রয়ে গেলেন।
১৯৬৪ সালের ৩০ জানুয়ারী তিনি নতুন রুপে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। শেখ মুজিবের ধানমণ্ডির বাসভবনে দুপুর আড়াইটায় মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের সভাপতিত্তে আওয়ামী লীগের পুনরিজ্জিবিত করার সাবেক আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কমিটির ৩১ জন সদস্য এর মধ্যে ২৩ জন উপস্থিত ছিলেন। ১৭ জেলার মধ্যে ১৬ জেলার প্রতিনিধি, ৪ এমএনএ, কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী অংশ গ্রহন করেন। সভায় আতাউর রহমান খান, মনসুর আহমেদ, আব্দুল জব্বার খদ্দর, খয়রাত হোসেন, জহুর আহমেদ চৌধুরী অনুপস্থিত ছিলেন। সভায় এনডিএফ এর আন্দোলনে সমর্থন, সোহরাওয়ারদির মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব গ্রহন ,ভারতে মুসলমান হত্যার নিন্দা, এবং এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য হিন্দুদের উপর হামলার নিন্দা করা হয় এ ছাড়া সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রনের সরকারী কার্যক্রমের নিন্দা করা হয়। অতঃপর জনাব তাজউদ্দিন আওয়ামী লীগ পুনরিজ্জিবনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। যশোরের মশিউর রহমান প্রস্তাব সমর্থন করেন। ৪ ঘণ্টা আলোচনার পর দলের পুনরিজ্জিবনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। পরে সভা একদিনের জন্য মুলতবী ঘোষণা করা হয়। এর পর দলের নেতার শহীদ মিনারে যেয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। লন্ডনে সোহরাওয়ারদির সাথে সাক্ষাৎকারী এমএনএ আব্দুর রশিদ, এমএনএ বেগম রোকেয়া আনোয়ার (ঢাকা,সরাসরি), এমএনএ কামরুজ্জামান (রাজ), এমএনএ আমজাদ হোসেন (মাদারীপুর, ৭১ এর দালাল, ৭২ এ বহিষ্কৃত)। পরে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ সোহরাওয়ারদির কবর জিয়ারত করেন।
পরদিন আতাউর রহমান পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে তার অবস্থান জানালেন। আকার ইঙ্গিতে প্রকাশ করলেন তিনি আওয়ামী লীগের সাথে নেই। আওয়ামী লীগের পুনরীজ্জিবনে তিনি দুঃখ পেয়েছেন। ইহা দুর্ভাগ্যজনক।
শেখ মুজিবের লন্ডন সফরকালে শেখ মুজিব সোহরাওয়ারদী যখন আলোচনা করছিলেন ঠিক তখনি এনডিএফ এ নামে মাত্র থাকা সাবেক ন্যাপ নেতা মওলানা ভাসানী আইউবের সাথে দেখা করে ৩ ঘণ্টা বৈঠক করে আরেক ষড়যন্ত্র শুরু করেন। মওলানা পরে প্রেসকে জানান তিনি বন্দী মুক্তি, আসাম থেকে বিতারিত মুসলিম পুনর্বাসন ও পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকদের দাবী নিয়ে আলোচনা করেছেন কিন্তু তিনি যতদিন পশ্চিম পাকিস্তান ছিলেন বিভিন্ন সভা সমাবেশে আইউবের প্রশস্তি গাইতেছিলেন। অপর দিকে মওলানা আকার ইঙ্গিতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করলেন। মুলতানের এক সভায় তিনি বলেই ফেললেন সিআইএ পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চাচ্ছে বেবস্থা না নিলে ৩-৪ মাসের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাবে। ২৭ আগস্ট মারীতে গভর্নর সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গভর্নর গন ভাসানীর সাথে গোপন জোটের কথা স্বীকার করেন। ভাসানীর সাথে সরকারের মধ্যস্থতার ব্যাপারে কালাবাগের নবাব দূতিয়ালি করেন। ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছেই বলেন ন্যূনতম কর্মসূচীর ব্যাপারে শয়তানের সাথে সহযোগিতা করতে রাজী আছি। তিনি বলেন মুজিব বিদেশ থেকে ফিরে আসলেই রাজনীতি সুশৃঙ্খল হবে।
নোটঃ মওলানা কি একটা যেন সিআইএ দলিল পেয়েছিলেন যে দলিলটি পরে ইয়াহিয়াকে দিয়েছিলেন।

  • Salah Uddin