You dont have javascript enabled! Please enable it!

উৎপাদনের রাজনীতি

১. প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রধান সেনাপতি ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশে উৎপাদনের রাজনীতির কথা একনাগাড়ে বলেছেন। কিন্তু উৎপাদনের রাজনীতির বদৌলতে দিন দিন দেশ বিদেষী ঋণে ডুবে গেচ্ছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বলে চলেছেন দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে। উৎপাদনের রাজনীতির উৎপাদন’ কতদূর হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত হিসেব করা যেতে পারে।

২. খাদ্যশস্য ও আউশ, আমন বােরাে ফসলের উৎপাদন ১৯৭৫-৭৬ সনে ছিলাে ১ কোটি ৩১ লক্ষ টন। ১৯৭৬-৭৭ সনে ঐ উৎপাদন হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ১৬ লক্ষ টন। ১৯৭৭-৭৮ সনে উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ২৮ লক্ষ টন। ১৯৭৮-৭৯ সালে উৎপাদন হ্রাস পেয়ে ১ কোটি টনের নীচে চলে যায়। ৭৫ সন পর্যন্ত খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৫ ভাগ। ৭৫-৮১ সনে এসে তা দাঁড়ায় ১.৭। এভাবে মাছ, ডাল, মাংসের প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। পাট : ১৯৭৫ সনে ৭০ লক্ষ বেল পাট উৎপাদিত হয়েছে। ১৯৭৭-৭৮ সনে উৎপাদিত হয়েছে ৫৫ লক্ষ ৩৪ হাজার ৫৪৯ বেল।

৩. শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। পাটশিল্পে উৎপাদনের হ্রাসের পরিমাণ ১০২% ভাগ, কাগজ শিল্পে ২.৫% ভাগ, চিনি শিল্পে ৩.৩% ভাগ এবং বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে ৫৫টি মিলের মধ্যে অনিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ১৪টি বস্ত্র। মিলে উৎপাদনই হচ্ছে না।

আয় কমেছে ও দারিদ্র্য বেড়েছে

৪. রাজধানী ঢাকার গুলশান বনানীর বাড়িঘর, বহতল ভবন, রাস্তাঘাট, মােটরগাড়ী, রঙিন টিভি, ভিসিআর, অভিজাত বিপনী বিতান- এসব দেখলে মনে হয় দেশের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ৬৯-৭০ সনে মাথাপিছু আয় ছিলাে ৭৭০ টাকা। ৭৮-৭৯ সনে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৭২১ টাকায়। বিশ্ব ব্যাংকের রিপাের্ট অনুসারে ৭৩-৭৪ সনে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৩ কোটি লােক অর্থাৎ ৪৪% শত লােক দারিদ্র সীমার নীচে জীবনযাপন করতাে। ৮১-৮২ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি অর্থাৎ ৬৬ শতাংশে।২

বিশ্ব রেকর্ড নেই

৫. উৎপাদনের রাজনীতির প্রবক্তা’ জিয়াউর রহমান দ্বিতীয় পাঁচমালা পরিকল্পনায় কৃষি উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার ৬.৩% শতাংশ ধরে খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করে রফতানীর বাণী শুনিয়েছেন। খসড়া উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুযায়ী ৫ বছরে ২ কোটি টন খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় পৌছতে বছরে ৮% ভাগ খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু এদেশে গত বিশ বছরে খাদ্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার ১.৯ ভাগ মাত্র। ৫ বছর ক্রমাগত ভাবে ৮% হারে উৎপাদন বৃদ্ধির রেকর্ড বিশ্বে নেই। দেশ বিক্রী করে হলেও খাদ্য শস্য আনা হবে

৬. প্রেসিডেন্টের ঘােষিত উৎপাদনের রাজনীতির মহাত্ম্যে ভর্তুকি তুলে দেয়া হয়েছে। সার, কীটনাশক, তেল, মবিল, পাওয়ার পাম্পের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। খাদ্য সংকট চরমে পৌঁছেছে। দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে। দেশের হাজার হাজার লােক বেকার হয়ে আছে। কর্মসংস্থানের অভাবে অনেকে না খেয়েও দিন কাটাচ্ছে। ছিন্নমূল মানুষ আর ভিক্ষুকের সংখ্যা বাড়ছে। ছিন্নমূল মানুষের যা কিছু নগণ্য সম্পত্তি জলের দামে দিচ্ছে। দেশের একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিকের রিপাের্টে বলা হয়েছে দেশের মানুষ গরু-ছাগল, জায়গা-জমি, থালা-বাটি বিক্রি শুরু করেছে। সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ ভাটি অঞ্চল ও ঠাকুরগাঁও-চুয়াডাঙ্গার দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে।। উপরন্তু ঐ অঞ্চলে মার্কেটিং অপারেশন বন্ধ থাকায় সমস্যা আরও তীব্র। পূর্ণ রেশনিং ব্যবস্থা এবং সহজ ও দীর্ঘমেয়াদী কৃষিঋণের কোনাে ব্যবস্থা নেই। এই হচ্ছে দেশের বর্তমান অবস্থা। যে দিকে চোখ যায় শুধু অভাব আর অভাব। ভূমিহীনের সংখ্যাও ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে।

খাদ্য ঘাটতি বেড়েছে

আমাদের দেশে বার্ষিক খাদ্য চাহিদার পরিমাণ হচ্ছে ১ কোট ৬৮ লাখ টন। এ বছরের প্রথম দিকে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছিলাে ১৩ লাখ টন। কিন্তু সেই পরিমাণ এখন বৃদ্ধি পেয়ে ২২ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। এ হিসেব সরকারের। বাস্তবে এই ঘাটতির পরিমাণ আরও বেশি। অনুকূল আবহাওয়ায় খাদ্যশস্যের উৎপাদন তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৭৫ সনে ও ৭৬ সনে দু’বছর ভালাে ফল পাওয়া গেছে। যার ফলে ধান-চালের। বাজারে স্থিতিশীলতা ছিলাে। সার, ডিজেল ও কীটনাশকের দাম বেড়েছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর সরকার যখন সার ও কীটনাশকের দর বৃদ্ধি করেন। বিরােধীদলের নেতৃবৃন্দ সরকারী এই নীতির তীব্র সমালােচনা করে বলেছিলেন, এ সিদ্ধান্তের ফলে কৃষি উৎপাদন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ প্রতিটি জনসভায় সার ও কীটনাশক ওষুধের দাম বাড়ানাের তীব্র সমালােচনা করেছে। কিন্তু শত সমালােচনা সত্ত্বেও সরকার তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেনি। চলতি অর্থ বছরে কৃষি উৎপাদন প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিলাে ১৯৭৭ সালের তুলনায় ৪.৩ ভাগ বেশি। কিন্তু সে লক্ষ্যমাত্রার ১.৩ ভাগ মাত্র অর্জিত

সরকার এই ব্যর্থতার জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগকেই দায়ী করছেন। কিন্তু এই ব্যর্থতার জন্য একমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগকেই দায়ী নয়। খরায় কোনাে কোনাে অঞ্চলের ফসল নষ্ট হয়েছে সত্য কিন্তু সময়মতাে সেচ সরঞ্জাম সরবরাহের ব্যর্থতা সরকারকেই নিতে হবে। তেল, ডিজেল দুষ্প্রাপ্য এবং অগ্নিমূল্য হওয়ায় ১০ হাজার পাওয়ার পাম্প অচল। ইরি ব্লকে ইরি চাষ হয়নি। সার এবং কীটনাশকের মূল্য বৃদ্ধি করায় কৃষকের পক্ষে তার ক্ষেতের ফসল পারুল পােকা, মাজরা পােকার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। কৃষি উৎপাদনের গতিবেগ সঞ্চারের জন্যে নদীমাতৃক বাংলাদেশের ভরাট নদী-খাল খনন করে একদিকে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ, অন্যদিকে অতিবৃষ্টি ও বন্যার হাত থেকে ফসল রক্ষার দীর্ঘমেয়দী পরিকল্পনা গ্রহণ করতেও সরকার শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। স্বেচ্ছাশ্রম ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর আওতায় দু’একটি নদীখাল পুনঃখনন, উলশীযদুনাথপুরে স্বনির্ভর প্রকল্পের বিস্তর প্রােপাগাণ্ডা করা হয়েছে। কিন্তু খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। সাফল্যের চেয়ে বহুগুণ অর্থ খরচ হয়েছে প্রচারে বর্তমান রাষ্ট্রপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবঃ) জিয়াউর রহমানের আমলে। ‘১৯৭৯ সালে দেশের খাদ্য পরিস্থিতি মারাত্মক। প্রতিটি পত্র-পত্রিকায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করছে।

সেচের জমি কমেছে

৭. দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি জনগণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। প্রতিটি জিনিসের দাম ‘৭৪ এর দুর্ভিক্ষাবস্থার চেয়েও অনেকগুণ বেশী। খাদ্যশস্যের দামও বেড়েছে। দাম কমার আশু সম্ভাবনা অকল্পনীয়। প্রধান কারণ খাদ্যঘাটতি। বেসরকারী হিসেবে ঘাটতি ৩২ লাখ টন। ১৯৭৪-৭৫ সালে যে পরিমাণ জমিতে সেচ করা হতাে তার। পরিমাণ কমেছে। সারা বাংলাদেশে পাওয়ার পাম্প এবং নলকূপের সাহায্যে সেচ করা হতাে এরূপ জমির পরিমাণ ছিল ৩৫,৬১৪ ৭২ একর। ১৯৭৬-৭৭ সালে তা আরও কমে গিয়ে হয় ৩০,০৩,০২০ একর। ৬ জিয়ারউর রহমানের শাসনে তিন। বছরে সেচের জমির পরিমাণ কমেছে ৫ লাখ একরের বেশি। উন্নতমানের বীজ ব্যবহার কমেছে, কেননা সেচের ব্যবস্থা নেই।

উৎপাদন বাড়েনি চাহিদা বেড়েছে

৮. চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরবরাহ বৃদ্ধি না পাবার প্রধান কারণ হচ্ছে চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন বাড়েনি। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের উৎপাদন এবং সরবরাহ মানুষের চাহিদা এবং প্রয়ােজনের সঙ্গে অগ্রসরমান সামঞ্জস্যতা ‘৭৫ পরবর্তীতে আরাে হ্রাস পেয়েছে। জিয়ার আমলে মাছ, মাংস, তরি-তরকারি, ভালাে শাকসজি, মসলা ও ফলমূলের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। সাথে সাথে হ্রাস পেয়েছে এসব জিনিসের মাথাপিছু প্রাপ্যতা। জনসংখ্যা বেড়েছে, উৎপাদন সেই তুলনায় বাড়েনি বরং কমেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ৭২-৭৩ সালের তুলনায়, এমন কি খাদ্য সংকটের বছরের তুলনায়ও বহু জিনিসের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। টাকার অংকে ‘৭২-৭৩ সালে মাছ ও মাংসের উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৮৬.৯০ ও ২২৩ কোটি টাকা। সে ক্ষেত্রে ‘৭৭-৭৮ সালে মাছ ও মাংসের উৎপাদনের পরিমাণ মাত্র ২৮৭.৯০ ও ২৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জনসংখ্যা বেড়েছে কম করে হলেও ১ কোটি। মরিচ, রসুন, পেয়াজ ইত্যাদ জাতীয় মশলার উৎপাদন ‘৭২-৭৩ সালে ছিলাে ৩,২২,০০০ টন। ‘৭৬-৭৮ সালে এর উৎপাদন হ্রাস পেয়ে ২,০৫,০০০ টন এসে দাঁড়ায়। শাকসজির ইত্যাদি জিনিসের উৎপাদন ‘৭৪-৭৫ সালের তুলনায় বর্তমানে হ্রাস পেয়েছে।

৯. উৎপাদন হ্রাসের পাশাপাশি সরকারের ঘাটতি অর্থব্যবস্থা (ডেফিসিট ফাইনেনসিৎ) মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ। দেশে মুদ্রা সরবরাহের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কাগুজে নােটে বাজার ছেয়ে গেছে। ১৯৭৩-৭৪ সালে বাজারে মুদ্রা সরবরাহের পরিমাণ ছিলাে ৮৫৯ কোটি টাকা। ১৯৭৮-৭৯ সালে এর পরিমাণ ১৫১০ কোটি টাকারও বেশী। গােটা অর্থনীতি এখন এক ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি জনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত। বাজারের ওপরে সরকারের আদৌ কোনাে নিয়ন্ত্রণ নেই। কাফনের কাপড়ের জন্য ক’গজ কাপড় দরকার

১০. ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশ সরকারের ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্টারপ্রাইজেস (ন্যাশনালাইজেশন) অর্ডার, ১৯৭২ (প্রেসিডেন্টের ২৭নং আদেশ) অনুযায়ী দেশের মৌলিক ও প্রধান শিল্পের সঙ্গে বস্ত্রশিল্পও জাতীয়করণ করা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত বস্ত্রশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলাের সুষ্ঠু পরিচালনার দায়িত্ব টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশনের ওপর ন্যস্ত করা হয়। উৎপাদন ত্বরান্বিত এবং দেশে বস্ত্রশিল্পের সার্বিক অগ্রগতির লক্ষ্যে জিয়ার আমলে ‘৭৭ সাল শােচনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনায় সরকার মাধাপিছু ১০ গজ বস্ত্র উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও বিটিএমসি (বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন) মাথাপিছু ৬ গজ কাপড় উৎপাদনও নিশ্চিত করতে পারেনি। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ‘৭২-৭৩ সালে বি.টিএম.সি’র কাপড় উৎপাদনের পরিমাণ ছিলাে ৬৬১.৮৫ লাখ গজ। ‘৭৩-৭৪ সালে ৬৬৬.৬০ লাখ গজ; ‘৭৪-৭৫ সালে ৬০১.৮৭ লাখ গজ; ‘৭৭-৭৮ সালে। উৎপাদনের পরিমাণ ৬১৭.৪৬ লাখ গজ। বস্ত্র উৎপাদনের এই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ‘৭৭-৭৮ অর্থ বছরে বি,টি,এম,সি’র বস্ত্র উৎপাদন স্বাধীনতা উত্তরকালের অর্থাৎ ‘৭২-৭৩ অর্থবছরের তুলনায়ও হ্রাস পেয়েছে। সুতাে উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বি,টি,এম,সি তেমন কোনাে সাফল্য দেখাতে পারেনি। উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জনে বস্ত্রশিল্প ‘৬৯-৭০ সালের উৎপাদন মাত্রার তুলনায় অগ্রগতির চেয়ে নিম্নগামী হচ্ছে। টাকু প্রতি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। প্রতি শিফটে টাকুপ্রতি ৩ আউন্স সুতাে উৎপাদনের ক্ষমতা বিদ্যমান। ১৯৬৮-‘৭০ সালে টাকু প্রতি উৎপাদন ছিলাে প্রতি শিফটে ২.৮৩ আউন্স। ১৯৭৭-৭৮ সালে উৎপাদন হ্রাস পেয়ে ২.৩৮ আউন্সে এসে দাঁড়ায়। ‘৭৬-৭৭ সালে ২.৪২ আউন্স। ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় টাকু প্রতি সুতা উৎপাদন হ্রাস পেয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। বস্ত্রশিল্পের উৎপাদন ব্যর্থতা এর ওপর নির্ভরশীল। দেশের তাঁত শিল্পও মারাত্মক দুর্যোগের মুখােমুখি।

শিল্প কল-কারখানার চাকা সামনের দিকে ঘুরছেনা ওর জানা গেছে, বিদ্যুৎ স্বল্পতা, ম্যানেজমেন্টের অভাব, প্রয়ােজনীয় মেশিনারী পার্টসের দুষ্প্রাপ্যতা, আন্তরিক প্রচেষ্টার অভাব ইত্যাদি কারণে অচল টাকুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘৬৯-৭০ সালে দেশে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকুর মধ্যে ৬ লাখ ৬০ হাজার। টাকু সচল ছিলাে। অচল টাকুর সংখ্যা ছিলাে শতকরা ১৩ ভাগ। ১৯৭৭-৭৮ সালে। ৯ লাখ ৭৭ হাজার টাকুর মধ্যে ৭ লাখ ৯৯ হাজার সচল অর্থাৎ ১ লাখ ৭৮ হাজার টাকু অচল ছিলাে। ৭৮-৭৮ সালে অচল টাকুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় শতকরা ১৮.২ ভাগে। এই হিসেব ১৯৭৭-৭৮ অর্থ বছরের। ‘৭৮-৭৯ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৯ লাখ ৬৮ হাজার টাকুর মধ্যে ৮ লাখ ১২ হাজার টাকু সচল রয়েছে। ‘৭৮৭৯ সালে অচল টাকুর সংখ্যা হিসেবে দাঁড়াবে শতকরা ১৭ ভাগ। উল্লেখিত হিসেবে এটা স্পষ্ট যে, শিল্প কলখারখানায় চাকা সামনের দিকে ঘুরছেনা। ঘুরছে পেছন দিকে।

পরিকল্পনা মন্ত্রীর কণ্ঠে হতাশার সুর

১১. জিয়াউর রহমান বলছেন উৎপাদন বেড়েছে। মানুষ সুখে আছে। আর পরিকল্পনা মন্ত্রীর কণ্ঠে হতাশার সুর। ২য় পাঁচশালা পরিকল্পনার খসড়া মােট ২৫,৫৯৫ কোটি টাকার। পরিকল্পনার খসড়া বইটির ওজন দুই সের। এই খসড়া পরিকল্পনার উপর সাংবাদিক সম্মেলনে পরিকল্পনা মন্ত্রী ফসিউদ্দিন মাহতাব মন্তব্য করেছেন, ‘বর্তমান। যেভাবে চলছে তাতে সার্বিক অবস্থা শিগগিরই আয়ত্বের বাইরে চলে যাবে।’ তিনি বলেন, বর্তমানে লােকসংখ্যা ন’কোটি। এর শতকরা ৮০ ভাগ লােক দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করে। তারা ভাল করে দু’বেলা খেতে পারেনা। শতকরা ৬০ ভাগ অপুষ্টিতে ভােগে। ২ কোটি ৮০ লাখ লােক শ্রমজীবী, তাদের মধ্যে শতকরা ৩৫ ভাগের কোন কাজ নেই। কৃষিজীবী মানুষের শস্থকরা ৫০ ভাগেরও বেশী। ভূমিহীন। বিশ্বব্যাংকের হিসেব অনুসারে দেশের লােক সংখ্যা শতাব্দীর শেষে ১৩ কোটিতে দাঁড়াবে। শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা হবে ৪ কোটি ৬০ লাখ হয়

সাংবাদিক মার্শাল-এর রিপাের্ট

১২. বালাদেশ প্রেরিত বৈদিশিক ঋণ ও সাহায্যের একটি বড় অংশই দুর্নীতির রন্ধ্রপথে হারিয়ে যায়।’ একথা লিখেছেন লস এঞ্জেলস টাইমস। বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে সফর করে এই প্রতিবেদনটি লিখেছেন পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক টেইলর মার্শাল। বাংলাদেশে কর্মরত কয়েকজন আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা ও অন্যদের সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে টেইলর মার্শাল লিখেছেন—“যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়ােজন সেই ভূমিহীন দরিদ্র পল্লীবাসীর হাতে বৈদেশিক ঋণ সাহায্যের শুধু অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ গিয়ে পৌছে। সাহায্যের অধিকাংশই সর্বত্র বিরাজমান দুর্নীতির মাধ্যমে

শুষে নেয়া হয় এবং এর অধিকাংশই যায় সচ্ছল ব্যক্তিদের পকেটে। এভাবে দরিদ্র এবং সংখ্যালঘু ধনীদের মধ্যে ব্যবধান আরও বাড়তে থাকে। সাহায্যের প্রয়ােজনীয়তার ব্যাপারে সেখানে কেউ প্রশ্ন তােলেনা। সমস্যা হচ্ছে, যাদের সবচাইতে বেশী প্রয়ােজন তাদের কাছে সাহায্য ও ঋণ পৌছে না। খাদ্যবাবদ বরাদ্দের মাত্র এটি ভগ্নাংশ বিতরণের জন্য পাঠিয়ে বাকি অংশ স্থানীয় কর্মকর্তারা বিক্রি করে দেয় বলে অন্তহীন কাহিনী শােনা যায়। টেইলর মার্শাল আরও লিখেছেন—ঘুষদানের প্রয়ােজনীয়তার কারণে প্রকল্প সাহায্যের অর্থের পরিমাণ। প্রায়ই সংকুচিত। বিশেষ করে প্রকল্পের সাথে নির্মাণ কাজ জড়িত থাকলে দুর্নীতি হবেই। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলাে বিরল ক্ষেত্রে ঘুষের সাথে প্রত্যক্ষভাবে। জড়িত থাকে। তবু ঠিকাদাররা মূল্যোকৃতির সময় ঘুষের অংক ও হিসেব করে নেয় এবং ফলে প্রকারান্তরে ঘুষের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের অর্থই ব্যবহার করা হয়। একটি নির্মাণ প্রকল্প মূল্যায়নের দায়িত্বে নিয়ােজিত সরকারী সংস্থার একটি দলের সদস্যদের প্রত্যেককে তাদের সরকারী অনুমােদনের জন্য সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করে। এসব লােক নিয়মিতভাবে ১০টি প্রকল্প যাচাই করতে গিয়ে বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয়ের মােটামুটি ৬শ’ গুণ পকেটস্থ করে। এছাড়া কোনাে বিদেশী সরঞ্জাম আমদানীর জন্য আবশ্যিকভাবে প্রদত্ত কমিশন পায় শহরাঞ্চলের এজেন্টরা। কার্যত কোনাে ব্যতিক্রম ছাড়াই পল্লী অঞ্চলে বড় বড় ভূস্বামী যে কোনাে নতুন কর্মসূচী নিজেদের স্বার্থে লাগানাের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের সাথে চক্রান্ত করে থাকে। যেমন সেচের জন্য নতুন নলকূপ সচরাচর বড় ভূস্বামীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ফলে ক্ষুদ্র জমির মালিকদের তুলনায় তাদের ভাগ্যের উন্নতি ঘটে।”৮ উৎপাদনের রাজনীতি বনাম কুকুর, রােটারি ও মন্ত্রীবর্গ ঃ একটি সম্পাদকীয়

১৩. “ঈদে মিলাদুন্নবীর সময় রাষ্ট্রপতি দেড় হাজার সঙ্গীসাথী নিয়ে ‘হিজবুল বহর’ নামক জাহাজে সমুদ্র বিহারে গিয়েছিলেন। সঙ্গী সাথীরা ছিলেন মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবর্গ, বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে নেতা, সমাজকর্মী নামধেয় কিছু নিমন্ত্রিত ব্যক্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেধাবীদের মধ্যে কিছু সযত্নে বাছাই করা ছাত্রছাত্রী ও একদল গাইয়ে বাজিয়ে নরনারী। এহেন প্রমােদ বিহার সংবাদপত্রে, সভা সমিতিতে ইতিমধ্যে যথেষ্ট নিন্দিত হয়েছে। গত রােববার ঢাকার ধানমন্ডি পাড়ার একটি ক্লাবের উদ্যোগে কুকুর প্রদর্শনী। হয়েছে। প্রদর্শনীর বিনিময়ে প্রবেশাধিকার ছিল। এ জাতীয় ঘটনা কিছু ধনী লােকের বিলাস মাত্র। এই আপাত নির্দোষ ঘটনায় তুলনায় আরও অনেক ধরনের উৎকৃষ্ট ও বিকৃত বিলাসে ধনিক শ্রেণী মগ্ন থাকে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় হল ঐ কুকুর প্রদর্শনীতে তথ্য ও বেতার মন্ত্রী শামসুল হুদা চৌধুরী বাণী পাঠিয়েছেন। অনুষ্ঠান উদ্বোধনকালে লেঃ জেঃ (অবঃ) খাজা ওয়াসিমউদ্দীন ‘এ ধরনের ব্যাপারে ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ঘটনা হয়ে উঠবে’ বলে আশা প্রকাশ করেছেন। প্রদর্শনীর ছবি টেলিভিশনে খবর প্রচারকালে প্রায় ১ মিনিট ধরে দেখানাে হয়েছে; একটি সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকায় সচিত্র সুদীর্ঘ রিপাের্ট বেরিয়েছে ইত্যাদি। ঐ একই দিনের ঘটনা উপরাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার রােটারি ক্লাবের সদস্যদের একটি বার্ষিক অনুষ্ঠানে যােগ দিয়েছেন। অপর একটি সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শীর্ষস্থানে ৫ কলাম ছবিসহ এটি খবর হয়েছে। বিত্তবান শ্রেণীর লােকজনদের নিয়ে রােটারি, লায়ন প্রভৃতি ক্লাবগুলি তাদের অবসর বিনােদনের জন্য গঠিত এবং মাঝে মধ্যে জনসেবায় অংশগ্রহণ করা ও তার সচিত্র রিপাের্ট সংবাদপত্রে ছাপানাে হয় বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তা সকলের জানা আছে। মন্ত্রিদের ব্যস্ততার আরও একটি নমুনা উল্লেখ করছি।

ঢাকার একটি হােটেলে জ্যোতিষ শাস্ত্র সম্পর্কিত একটি ব্যবসাভিত্তিক প্রাইভেট কলেজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বাণী পাঠিয়েছেন, পেট্রোলিয়াম ও যুব- এই দুই দপ্তরের দুই জন মন্ত্রী ও জাতীয় সংসদের স্পীকার উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। এছাড়া ফি হপ্তায় একটি করে মিনা বাজার উদ্বোধন আর তাতে উপস্থিত ঝলমলে পােষাক পরা ধনী ললনাদের বড় বড় ছবি সংবাদপত্রে ছাপা তাে চলছেই। যেন এগুলােই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ঘটনা। রাষ্ট্রপতির ‘উৎপাদনের রাজনীতি’ আর ২৪ ঘন্টা কাজের ‘বিপ্লবী’ আহবানে সাড়া দিয়েই হয়তাে তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা এ ধরনের ক্লাব, প্রদর্শনী ও মিনা বাজারের কাজে ছুটাছুটি করে এই মাঘ মাসের শীতেও ঘেমে জবজবে হচ্ছেন। আমরাও এসব তুচ্ছ ঘটনা সম্পাদকীয় স্তন্তে উল্লেখ করতাম না যদি এগুলাে আমাদের। বর্তমান সরকার ও সমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের গােটা কর্মকাণ্ডের একটা দিকনির্দেশ না হতাে। সে নির্দেশনাটি হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশবে সর্বতােভাবে ধনিক শ্রেণীর জন্য ও ধণিক শ্রেণীর আদর্শে গড়ে তােলা হচ্ছে। কোটি কোটি নিরন্ন মেহনতী মানুষকে শােষণ করে ধনিক শ্রেণীর উৎকট বিলাসের রসদ জোগানাে হবে-এটাই ওদের স্বপ্ন। সরকার ও সমাজপতিদের এই নীতিই প্রতিফলিত হচ্ছে ঐ জাতীয় নানা অনুষ্ঠানে এবং রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে। দেশের মানুষ, দেশের প্রকৃত চিত্র ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ঝলমলে পােষাক পরা সুখী রমনী ও লােমশ বিদেশী কুকুরের ছবির নিচে।”৯ উৎপাদনের রাজনীতির বড় অবলম্বন বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ। অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সর্বোপরি প্রেসিডেন্টের প্রধান কাজই হলাে বিদেশ থেকে ঋণ সংগ্রহ করা এবং সেটা ফলাও করে কাগজে প্রচার করা। জিয়াউর রহমানের আমলে ১০ হাজার কোটি টাকা বিদেশী ঋণ আনা হয়েছে। কিন্তু নতুন কলকারখানা স্থাপিত হয়নি একটিও।

উৎপাদনের নয় ঃ ধ্বংসের রাজনীতি

১৪. জিয়ার রাজত্বে জনগণের ক্রয় ক্ষমতার সঙ্গে দ্রব্যমূল্য পার্থক্য আকাশচুম্বি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক রিপাের্ট এবং অন্যান্য সরকারী রিপাের্টে জীবন যাত্রার ব্যয়ভার ক্রমাগত বৃদ্ধির উদ্বেগজনক চিত্র পাওয়া যায়। ১৯৬৯-৭০ সালে একশ’ টাকায় যা কেনা যেতাে তা ১৯৭৮ সালের শেষের দিকে এসে ৩৫৭ টাকা ২৭ পয়সায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে ঐ একশ’ টাকার জিনিসের মূল্য ৫৩৯ টাকায় ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে ৬৯০ টাকায় এবং ১৯৮১ জানুয়ারিতে ৬৭৪ টাকায় এসে দাঁড়ায়। জিয়াউর রহমান উৎপাদনের নয়, ধ্বংসের অর্থনীতি অনুসরণ করছেন। দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা কথাও এ প্রসঙ্গে ৩০শে এপ্রিল ‘৮০ সনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিশেষ সম্মেলনে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে দেশকে বহুজাতিক সংস্থার অবাধ শােষণে পরিণত করেছে। দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা, কারিগরি, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিকভিত্তিক একটা পরিকল্পনা মাত্র। এর মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর করা যাবে না।

জিয়া দেশের আসল চিত্র লুকিয়ে রেখেছেন

দারিদ্র্য হ্রাসের কথা পরিকল্পনায় বলা হলেও দারিদ্রের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। খাদ্য উৎপাদন বাড়ানাের কথা সরকার বিভিন্ন মিটিং মিছিলে চিৎকার করে বললেও খাদ্য উৎপাদন বাড়ানাের জন্য প্রথমেই ভূমি সংস্কারের ব্যবস্থা প্রয়ােজন। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে একদম নীরব। দেশ দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনার রক্তশূন্য ক্ষেত্রে আটকা পড়ে গেছে। উপরন্ত দেশে অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতির সূতােয় বাঁধা। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রা ওঠা নামার প্রতিক্রিয়া সাধারণ মানুষের চেপে বসে। দৈনিক ইত্তেফাকের বরাত দিয়ে রােববার এ সম্পর্কে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ? ‘আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক চাপে শুল্কের মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের পদ্ধতিতে এবং রপ্তানী বৃদ্ধিতে উৎসাহের নামে জিয়ার আমলে এ পর্যন্ত ১২ বার বাংলাদেশী মুদ্রার মান হ্রাস করা হয়েছে। এর ফলে দেশে মুদ্রাস্ফীতি বা

জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির ফলে অর্থনীতিতে বেশি চাপ সৃষ্টি হয়েছে।’  দেশে ১৯৭৭-৭৮ সালে মুদ্রা সরবরাহ ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় শতকরা ২৬৭ ভাগ, বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে শিল্পজাত দ্রব্যাদির সামগ্রিক উৎপাদন ১৯৭৭-৭৮ সালে ১৯৬৯-৭০ এর তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ২.৬ ভাগ। কৃষি উৎপাদন ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় ১৯৭৬-৭৭ সালে শতকরা ৯.৩৬ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ মুদ্রা সরবরাহের সঙ্গে উৎপাদন তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। নয় কোটিরও বেশী লােকসংখ্যার শতকরা আশি জনের জীবন মান দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। শতকরা ষাটজন অপুষ্টিতে ভুগছে। দুই কোটি আশি লাখ কর্মক্ষম লােকের শতকরা পয়ত্রিশ জন সম্পূর্ণ বেকার। মােট জনসংখ্যার আশি জনই নিরক্ষর। দেশের এই চিত্র জিয়াউর রহমানের সরকার সচেতনভাবেই লুকিয়ে রেখেছেন তার প্রমাণ, অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের নিত্যনতুন ঘােষণার সঙ্গে বাস্তব অবস্থার আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

যুব কমপ্লেক্স ও উৎপাটনের হাতিয়ার

১৫. প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সনের ১৮ ও ১৯শে ফেব্রুয়ারী শেরে বাংলা নগরে জাতীয় যুব কনভেশন করেন প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা খরচ করে। দেশের যুব। সমাজকে সংগঠিত করে উৎপাদনের রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে যুব সমবায় কমপ্লেক্স নামে প্রকল্প গ্রহণ করেন। জিয়া সম্মেলনে বললেনঃ “সমবায় বিপ্লব-বিপ্লবই সমবায়’। থানায় যুব কমপ্লেক্স গঠিত হলাে। হাটবাজার, ইজারদারী হতে শুরু করে ঠিকাদারী মাস্তানী-গুন্ডামী ভয়ভীতির সাহায্যে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের পথ করে দেয়া হলাে। মূলতঃ উৎপাদনশীল কাজের সঙ্গে যুব শক্তিকে জড়িত না করে এদের সমাজের মাস্তান বাহিনীতে পরিণত করা। হলাে। কাঁচা পয়সা হাতে পেয়ে যুব সমাজের মধ্যে নৈতিক অধঃপতন গুরুতর হলাে। বিরােধী দল পার্লামেন্টে দাবী তুললেন, যুব কমপ্লেক্স বিলুপ্ত করা হােক। যুব। কমপ্লেক্স দুর্নীত ও মাস্তান চক্রের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কৃষকেরা সামান্য। শাকসজী, কলা, কাঠাল, বীজ ধান, ডিম, কচুর লতি, যাই বেচতে হাট বাজারে আনে তা থেকেই ‘তােলারবিএনপি’র পান্ডারা থাবা মেরে কিছু নিয়ে যায়। তােলারও কোন নিয়ম আছে। বিএনপির যুব কমপ্রেক্সের এসব পান্ডারেরর অত্যাচারে অতিষ্ঠিত হয়ে ডেমরা কান্দারহাট বাজারে হাজার হাজার কৃষক জনতা। প্রতিবাদ মিছিল বের করে।১০ দেশের বহুস্থানে এরকম প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। আমাকে সরাতে হবে।

১৬. এই সমালােচনার প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট জিয়া যুব কমপ্লেক্স সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “যুব কমপ্লেক্সে বিলুপ্তির আগে আমাকে সরাতে হবে।” ব্যক্তি বিশেষের। ক্ষমতায় থাকা না থাকার জন্য যুব কমপ্লেক্স যে গঠন করা হয়েছে এখন তা পরিস্কার। যুব সমাজের কল্যাণ চিন্তার বাইরে যুব কমপ্লেক্স গড়ে তােলা হয়েছে। সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে এই যুব কমপ্লেক্সের ছেলেদের রাজনৈতিক ট্যাঙাড়ে বাহিনী। হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, নগদ অর্থ দিয়ে তাদের চরিত্র নষ্ট করা হচ্ছে। উৎপাদন বৃদ্ধি কিংবা জনসংখ্যার বিস্ফোরণই রােধ যুব কমপ্লেক্সের কাজ না হয়ে যুব কমপ্লেক্সের প্রধান কাজ হয়েছে বর্তমানে খাজনা আদায় করা এবং আদায়কৃত অর্থের সিংহভাগ ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করা। সমবায়মন্ত্রী বলেছেন যে, যুব কমপ্লেক্সের আয় ১০ কোটি টাকা হলে তাদেরকে শতকরা ২৫ ভাগ কমিশন দেয়া হবে। গ্রাম-বাংলার হতভাগ্য বেকার যুবকদের জন্য ফলপ্রসূ কোনাে ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার পরিবর্তে তাদের ভাগ্য কাচা পয়সায় বেঁধে ফেলা হলাে। জিয়াউর রহমান যুব কমপ্লেক্সের মাধ্যমে দেশের আড়াই কোটি যুবককে সংগঠিত করার অঙ্গীকার ঘােষণা করেছেন। ভবিষ্যতে ইয়ুথ এসেমব্লি গঠন করার পরিকল্পনার কথাও বলেছেন। যুব কমপ্লেক্সের সাহায্যে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়িয়ে রফতানী করার ঘােষণা রীতিমতাে বাগাড়ম্বর।

যুব কমপ্লেক্স ও দুর্নীতি পঙ্কিলে

হাট বাজার থেকে দুই বছরে হিসেব মােতাবেক প্রায় ১২ কোটি টাকা তােলা’ আদায় হয়েছে। কিন্তু সরকারী খাতে জমা হয়েছে মাত্র ১২ লাখ টাকা। ১৯৭৮ এর ৩০শে নভেম্বর যুব কমপ্লেক্সের কাছে হস্তান্তরের আগে তালা আদায়’ বাবদ প্রতি বছর সরকারী তহবিলে প্রায় ৩ কোটি টাকা জমা হতাে। আদায়কৃত টাকার শতকরা ২৫ ভাগ জেলা প্রশাসনের পিএল একাউন্টে জমার বিধান থাকলেও ১২ কোটি টাকা তােলা আদায়ের মধ্যে ৮ কোটি টাকাই বিএনপি যুব কমপ্লেক্স আত্মসাৎ করেছে।

উৎপাদনের রাজনীতি ও নিরক্ষরতা দূরীকরণের শ্লোগান

১. খালকাটা বিপ্লবের শেষ হতে না হতেই জিয়া দ্রুতগতিতে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করার বিপ্লব ঘােষণা করেন। শুরু হলাে বিপ্লব—নিরক্ষরতা দূরীকরণ বিপ্লব। কিন্তু দেশের শিক্ষার অবস্থা কি? শিক্ষার প্রসার ব্যতীত শিল্পায়ন, জাতীয় অগ্রগতি,

প্রবৃদ্ধি অর্জন ও শ্রম-দক্ষতা বৃদ্ধি পরিকল্পনা প্রণেতারা সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের উপরে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশী করে। শিক্ষা বিস্তার, নিরক্ষরতা দূরীকরণে জিয়াউর রহমান সােচ্চার। কিন্তু বাস্তবে ঘটনা ভিন্ন রকম। ১৯৭৮-৭৯ সালে শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়নি, হয়েছে অধােগতি।

ছাত্র-ছাত্রী হ্রাস পেয়েছে

সরকারী পরিসংখ্যানে জানা যায়, ১৯৭৮-৭৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা যােগ্য ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা সারাদেশে ছিলাে ১৫০ *খ। অর্থাৎ ১৯৭৭-৭৮ সালের তুলনায় ২.৮০ শতাংশ বেশী। ৭৮-৭৯ সনে প্রাথমিক শিক্ষার ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা আনুমানিক ৮২ লাখ অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় শতকরা ০.০৮ জন বেশী। যদিও প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ০.০৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনা তা হ্রাস পেয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ। করতে পারে এ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দেশে বাস্তবে, বাড়েনি, বয়স্ক প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এ রকমের লােকের সংখ্যাও কমেছে। ‘৭৮-৭৯ সনে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত ছাত্র-চাত্রীর সংখ্যা আনুমানিক ১ কোটি ২৫ লাখ। ৭৭-৭৮ বছরের তুলনায় এই সংখ্যা শতকরা ২.৮০ ভাগ বেশী। ৭৮-৭৯ সনে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণরত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ২০ লাখ ৭ হাজার। ৭৭-৭৮ সনে এই সংখ্যা ছিলাে ২১ লাখ ৫৬ হাজার। অর্থাৎ ৭৭-৭৮ সনের। তুলনায় মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে এরূপ ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে শতকরা ৬.৯১ ভাগ। ৭৮-৭৯ সনে মাদ্রাসাসহ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯,২২৫। এর আগের বছর এই সংখ্যা ৮,৫৯৪। অর্থাৎ সংখ্যা বেড়েছে শতকরা ৭.৩৪ ভাগ, আর ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা কমেছে শতকরা ৬.৯১ ভাগ। ‘৭৭-৭৯ সনের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণরত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিলাে ১ লাখ ৬৬ হাজার। ৭৭-৭৮ সনের সংখ্যা ছিলাে আনুমানিক ২ লাখ ১১ হাজার। অর্থাৎ ৭৭-৭৮ সনের তুলনায় ৭৭-৭৯ সনে উচ্চ শিক্ষার্থী ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা শতকরা ২১ ভাগ হ্রাস। পেয়েছে। ১১

কারণ ও অর্থনৈতিক সংকট

এসব তথ্য থেকে একটি সত্য বেরিয়ে আসছে তা হলাে ক্রমশ অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার ফলে শিক্ষার পরিমাণ কমছে। মাধ্যমিক শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষার ব্যয়ভার অভিভাবকদেরই বহন করতে হয়। স্কুল-কলেজের বেতন বৃদ্ধি বই-খাতাপেন্সিলের মূল্য বৃদ্ধি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ের বর্ধিত খরচ বহন করা অনেক পিতামাতার পক্ষেই সম্ভব হচ্ছেনা। তাছাড়া জীবনযাত্রার অন্যান্য ব্যয় বাড়ছে। ক্রমান্বয়ে। এবং এই বর্ধিত ব্যয় সংকুলান করে ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ মেটানাে অসম্ভব। মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বাস্তবে যারা শিক্ষা গ্রহণ করে তাদের সংখ্যা এমনিতেই খুব কম, শতকরা প্রায় ২০% ভাগ। এই শতকরা ২০ ভাগের পক্ষেও শিক্ষার ব্যয় সংকুলান কঠিন হয়ে পড়ছে।

শুধু গলাবাজি

অথচ জিয়া সরকার জাতীয় উন্নয়নের কথা প্রতিদিনই বলে চলেছেন। বলছেন, জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতির কথা। অথচ শিক্ষার মতাে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পরিস্থিতির উন্নতির পরিবর্তে অবনতিই হয়েছে। এই অবনতি সামগ্রিক জাতীয় অর্থনীতির অধােগতি ও সংকটের লক্ষণ। শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবর্তন অর্থাৎ শিক্ষা প্রসার না ঘটাতে পারলে জাতীয় উন্নতি বা অগ্রগতিও সম্ভব নয়। কথা ছাড়া অর্থাৎ লােক দেখানাে কথা বলা ছাড়া জাতীয় অগ্রগতির ক্ষেত্রে সঠিক পদক্ষেপ নেই।

নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও বিএনপি টাউটদের হাতে

১৮, জিয়াউর রহমান এই বাস্তবতা বুঝে না বুঝেই নিরক্ষরতা দূরীকরণের শ্লোগান তুলেছেন। নিরক্ষরতা দূরীকরণের কর্মসূচীতে ক্ষমতা ভাগ করে এবং স্তর বিভক্ত হিসেবে আমলাদের কাজের সমন্বয় ও পরিকল্পনার জন্য স পদ ও নিয়ন্ত্রণ সেল রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান জাতিকে আশার বাণী শুনিয়ে বলেছেন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ স্বেচ্ছাশ্রমে হবে। সরকারী কর্মচারী, শিক্ষক, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ এবং শিক্ষিত লােকজন সবাই। অবৈতনিকভাবে শিক্ষাদান করবেন নিরক্ষরদের। নিরক্ষরদের মধ্যে বয়স্ক ও শিশুরা রয়েছেন। এদের অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন করার জন্য দেশব্যাপী উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি সামাজিকভাবে জাগাতে হবে। তা না করে জিয়াউর রহমান সংকীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থে বিএনপি কর্মীদের ডাক দিয়েছেন নিরক্ষরতা দূর করার কাজে ঝাপিয়ে পরতে। ক্ষমতার মধুচক্রের চারপাশে এসে যারা ভীড় করেছেন সেই গ্রাম্য টাউট বাটপারদের দ্বারা নিরক্ষরতা দূরীকরণের কর্মসূচী সফল হবে না। কেননা নিরক্ষরতা কর্মসুচী বাস্তবায়নের জন্য প্রয়ােজন ত্যাগী আদর্শবান নেতা কর্মী যা বিএনপির নেই। প্রয়ােজন নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ। অথচ বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ অর্থই শতকরা ৪০ ভাগ কেটে নেয়া হয়। প্রচলিত শিক্ষাই যেকানে ব্যাহত হবে, সেখানে নিরক্ষরতা দূরীকরণের কর্মসূচী সফল হতে পারেনা। অর্থ সংস্থান, শিক্ষা উপকরণ, পরিবেশ, সুযােগ সুবিধা প্রদান না করে ডেপুটি কমিশনার আর প্রেসিডেন্টের দপ্তর, শিক্ষা অর্থ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সমূহে সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ সেল স্থাপন করে নিরক্ষরতা। দূরীকরণ কর্মসূচী সফল হতে পারেনা। মাধ্যমিক শ্রেণীর ছাত্রদের পাঠক্রমে প্রতিটি ছাত্রকে একজন করে নিরক্ষর লােককে স্বাক্ষর করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলাে। শেষ পর্যন্ত এটা হাসির তামাশায় পরিণত

চমক দিয়ে লোক ভুলানাে

১৯. নিরক্ষরতা দূরীকরণের মত জাতীয় কর্মসূচী বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাের অংশগ্রহণ আন্তরিকভাবে আবশ্যক ছিলাে। কিন্তু জিয়াউর রহমানের আহ্বানটা একটা মামুলী ধরনের। যদি জিয়া সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকতাে তবে। আগেই আলাপ-আলােচনা করে জাতি গঠনের কাজে সকলকে নিয়ে একযােগে নেমে পড়া যেত। সহযােগিতা গ্রহণের মনােভাব হত সেটাই। সকাল বিকেল রাজনৈতিক বিরােধী দলকে শত্রু বলে, বাকশালী গালি দিয়ে, বিদেশী আদর্শের ধূয়া তুলে দেশ বিক্রি করার অভিযােগ করে ধোঁকা দিয়ে মহৎ কিছু অর্জিত হতে পারেনা। আসল কথা হল, সবকিছুকেই বিপ্লব বলে চালিয়ে দেয়ার প্রবণতা। চমক দিয়ে, ভংগী দিয়ে লােক ভােলাবার এই কৌশল জনগণের চোখে ধরা পড়ে গেছে। নিরক্ষরতা দূরীকরণের কর্মসূচী গ্রহণের ক্ষেত্রে ও শিশুদের কিভাবে তার সরল সহজ বাস্তবভিত্তিক পদ্ধতি ও পথ-নির্দেশ আবশ্যক। বয়স্ক নিরক্ষরদের শিক্ষা দিতে হবে, আর্থিক সমস্যা এবং বিভিন্ন অসুবিধার আশু মােকাবিলার পথ বের করতে হবে। যে দেশে শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ শিশুর দু’বেলা পেট ভরে খাদ্য জোটে না, তার হাতে বই-শ্লেট তুলে দেয়ার কথাটা বাস্তবভিত্তিক হতে হবে। যে দেশে কোটি লােক পেটভরে খেতে পায় না, সেদেশে নিরক্ষরতার অবসান মুখের কথা বা শ্লোগান তারা সম্ভব নয়। বেসরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপক প্রবর্তন নিরক্ষরতা দূরীকরণের পথে সহায়ক। কিন্তু প্রাথমিক স্কুল বাড়েনি। ছাত্র কমেছে। প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা হতাশাব্যাঞ্জক। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে নিরক্ষরতা দূর করার একটা সম্পর্ক আছে, ক্ষমতার আসন থেকে তাও কাটছাট করা হয়েছে।

২১. নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য জিয়া সরকারের সদিচ্ছার কেউ বিরােধিতা করেনি। কেউ করবে না, সবাই নিরক্ষরতা দূরীকরণ চায়। কিন্তু জিয়া সরকারের শিক্ষা খাতের বাজেট কেটে নেয়ার পর, আন্তরিকতা কথায় ও কাজের মিল বরাদ্দকৃত টাকার সুষ্ঠু ব্যবহারের ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে, বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায় বলে কথিত নিরক্ষরতা দূর করার সরকারী কর্মসূচী কেবলমাত্র রাজনীতির স্কুল প্রচারণা। দুর্দশাগ্রস্ত প্রাথমিক স্কুল, সরকারী শিক্ষকদের ধর্মঘট, বাজেট থেকে শিক্ষার বরাদ্দ অর্থ কেটে নেওয়া, বই-খাতাপত্র শ্লেটের অগ্নিমূল, বৈষম্যমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব বহাল রেখে বিপ্লবের সীলমােহর দিয়ে নিরক্ষরতা দূরীকরণ সম্ভব নয়।

গ্রাম সরকারই আমার সব

২২. জিয়াউর রহমান একটি বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে! স্বপ্নটার সঙ্গে তিনি দর্শনও যােগ করতে চেয়েছেন।১২ জিয়াউর রহমানের অনেক দর্শনের মধ্যে সবচেয়ে বড় দর্শন ক্ষমতায় থাকার ভিতকে পাকাপাকি করা। তা যেভাবে, যে কোন পন্থাতেই হােক না কেন। ক্ষমতার ভিত ব্রিটিশ গড়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানও ক্ষমতার ভিত চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী সৃষ্টি করেছিলেন। তাদের গম দিয়েছিলেন। অর্থ দিয়েছিলেন। অডিটের বালাই ছিলাে না। দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে এদের হাতে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। জিয়াউর রহমানও অনুরূপভাবে ‘গ্রাম সরকার গঠন করার জন্য দিনরাত ভাষণ দিয়ে চলেছেন। বলেছেন, “গ্রাম সরকারই আমার সব।” ১৯৭৬ সনে সামরিক শাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান গ্রাম পরিষদ-এর কথা ঘােষণা করেন। ১৯৮০ সনে পার্লামেন্টে স্বনির্ভর গ্রাম সরকার পরিকল্পনা অনুমােদিত হয়। ১৯৮০ সনের ৩০শে এপ্রিল জিয়াউর রহমান ঢাকার অদূরে সাভার জিরাবােতে গ্রাম সরকার এর উদ্বোধন করেন। ১৯৮১ সনের ৭ই জানুয়ারি। গ্রাম সরকার প্রধানদের রাষ্ট্রীয় খরচে এক মহাসম্মেলন করেন। প্রতি গ্রামে ৯টি মন্ত্রণালয়ের ১১ জন মন্ত্রী। তারাই সব করবে। গ্রাম ছারখার

২৩. গ্রাম সরকার গঠন নিয়ে গ্রামে দলাদলি লাঠালাঠি সংঘর্ষ হয়েছে। আহত ও নিহত হয়েছে অগণিত। প্রাধান্য বজায় রাখতে গিয়ে গ্রামীণ টাউটদের কদর ও দৌরাত্ম্যও বেড়ে যায়। গ্রামীণ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এক অমােঘ অস্ত্র হিসেবে গ্রাম সরকার হচ্ছে। প্রচলিত গ্রামীণ জীবনকে বিভক্ত করে সংঘর্ষমুখী করে তােলার ক্ষেত্রে জিয়ার গ্রাম সরকারকে অনেকে ‘গ্রাম ছারখার কর্মসূচী বলে আখ্যায়িত করেছে।

জিয়ার এক ভাষণের মূল্য ৪ কোটি টাকা

২৪. ৭ই জানুয়ারী ঢাকা অনুষ্টিত ‘গ্রাম সরকার প্রধানদের মহাসম্মেলন’-এ উপস্থিতি হয়েছিল ৭০ থেকে ৮০ হাজার লােক। এর মধ্যে ২ জন সড়ক দুর্ঘটনার আর একজন হাঁপানি রােগে প্রাণত্যাগ করেছেন। আর খাদ্যে বিস্ক্রিয়ায় ৩ হাজার ৪২৫ জন মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসাধীনের মধ্যে ২৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ঢাকার ডেপুটি কমিশনারের বসার জন্য প্যান্ডেল বানিয়েছিলেন ৩৭ লক্ষ বর্গফুট এলাকা জুড়ে। তাছাড়া আনুষঙ্গিক ব্যাপক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিলাে। সরকারী টাকায় গ্রাম প্রধানরা ঢাকা মহানগরীতে এলেন। প্রতি গ্রাম থেকে একজন গ্রাম সরকার প্রধান, প্রতি ইউনিয়ন থেকে একজন চেয়ারম্যান গ্রাম সরকারের মহিলা প্রতিনিধি, এছাড়া থানা সার্কেল অফিসার, মহুকুমা অফিসার ও একজন করে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। আর এদের সঙ্গী সাথী মিলিয়ে জনসংখ্যা লক্ষাধিক। মাথাপিছু তিনশ’ টাকা বরাদ্দ। সব মিলে জনগণের তহবিল থেকে ৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এবং এই টাকা ‘উৎপাদনের রাজনীতিতে আত্মনিবেদিত প্রেসিডেন্টের জন্য কিছুই নয়। কেননা ১০০ লােকের জনসভায় ভাষণ দিতে যান তিনি হেলিকপ্টারে পাঞ্চাশ ষাট হাজার টাকার জ্বালানী খরচ করে। এই মহাসম্মেলনে রাষ্ট্রপতির দুই ঘন্টার ভাষণ ব্যতীত অন্য কোন কর্মসূচী ছিলাে ঐ ভাষনও ছিল চিরাচরিত রাষ্ট্রপতির বহু বক্তৃতার পুনরাবৃত্তি মাত্র। গ্রাম সরকার প্রধানদের মহাসম্মেলনে জিয়ার জীবনেও মহাভাষণ। এই ভাষণের দাম ৪ কোটি টাকা। ১৩

পুলিশ, সরকারী কর্মচারী দুর্নীতিবাজঃ গ্রাম সরকারই ভরসা

২৫. রাষ্ট্রপতি বলেছেন, পুলিশ ও সরকারী কর্মচারীরা দুর্নীতিবাজ। তাই গ্রাম সরকারই তার ভরসা। দুর্নীতিবাজ প্রশাসনে গ্রাম সরকার প্রধানদেরকে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তােলার আহ্বান চমৎকার। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনকে গ্রাম সরকার গড়ে তােলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সার্কেল অফিসার, মহকুমা প্রশাসকের পছন্দসহ লােকেরাই গ্রাম সরকারে থাকছে। ঐ প্রশাসন এবং গ্রাম সরকার মিলে এক নতুন দুর্নীতির চক্র

প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গ্রাম সরকার পরিচালনার জন্যও টাকা বরাদ্দ করা হবে বলে রাষ্ট্রপতি বলেছেন। শুধু তাই নয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেম্বরদের মতাে গ্রাম সরকার প্রধান এবং সদস্যরাও মাসিক মাসােহারা দেয়া হবে বলে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁর বিভিন্ন ভাষণে গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন। গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠা একটি সরকারী কর্মসূচী। সরকারী কর্মকর্তাগণ গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়ােজিত। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বহু গ্রামে গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

কেন গ্রাম সরকার?

২৬. গ্রাম সরকার সম্পর্কে বিএনপি’র জাতীয় সংসদ সদস্যরাও খুব একটা জানেন না। খােদ রাষ্ট্রপতি গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অর্ডার দিয়েছেন কিন্তু পার্লামেন্ট এ সম্পর্কে কিছুই জানে না। ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংকও প্রায় সকল বিদেশী সাহায্য সংস্থা এবং বিদেশী বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের গ্রামগুলােয় উন্নতি এবং অধিক কৃষি উৎপাদনের উপর জোর দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অধিক কৃষি উৎপাদনের সাথে সাথে সুষম বন্টনেরও নীতি নিয়ে ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তাঁর ঘােষিত ‘সবুজ বিপ্লব’ নামে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা ছিলাে সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রণীত একটি কর্মসূচী। সবুজ বিপ্লবের’ কর্মসূচী সম্পূর্ণটাই ছিল জনগণের অংশ গ্রহণ ও আমলাচক্র মুক্ত। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চলতে থাকে বৈদেশিক সহায্যপুষ্ট এবং দেশীয় উদ্যোগে কৃষি সমবায় সমিতিসমূহ। সবুজ বিপ্লবের পথ ধরে আওয়ামী লীগেরই কয়েকজন নেতৃস্থানীয় স্বনির্ভর’ আন্দোলনের সূচনা করেন। যদিও স্বনির্ভর আন্দোলনের কর্মধারা চট্টগ্রামের কোনাে কোনাে স্থানে পাকিস্তানী আমলা থেকেই চলে আসছিলাে স্বাধীনতার পর এক একটি জেলা এক একটি নামে এ আন্দোলনে নিয়ােজিত হয়েছিল। যেমন ঢাকাঃ স্বনির্ভর, চট্টগ্রাম সােনালী ‘স’ ইত্যাদি।

ঢাকার সরকারের দিকে তাকাতে হবেনা .

২৭. পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের পরপরই দেখা গেলাে ক্ষমতা দখলকারী রাষ্ট্রপতি মােশতাক আহমেদ স্বনির্ভর আন্দোলনটিকে সরকারী কর্মসূচীতে রূপান্তরিত করলাে। পত্রপত্রিকাগুলােয় স্বনির্ভর আন্দোলনের পক্ষে একটি না একটি খবর থাকতােই। খুব ‘হৈ চৈ’ এর কান্ড। ১৯৭৫ সালে ২৪/২৫শে সেপ্টেম্বর স্বনির্ভরের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং জাতীয় আন্দোলনে রূপে ‘স্বনির্ভর বাংলাদেশ’ ঘােষণা দেয়া হয়। ১৯৭৬ সনে ৩-৫ই জানুয়ারী স্বনির্ভর বাংলাদেশ এর দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। স্বনির্ভর সংগঠন ও সমবায় বিদেশী সাহায্য ও সরকারী অনুদানের উপর নির্ভর করতাে। জিয়াউর রহমান এই আন্দোলনকেই এগিয়ে নিয়ে যান, গ্রাম সরকার। প্রতিষ্ঠার কর্মসূচীর দিকে। ১৯৭৮সালের জানুয়ারীতে টাঙ্গাইল জেলার বেশ কটি ইউনিয়নে ইউনিয়ন ও গ্রাম সরকার গঠনের উপর ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। টিভি ও রেডিওতে গ্রাম সরকারের উপর বিভিন্ন কর্মসূচী প্রচারিত হতে থাকে। ১৯৭৮ সালের ৫ই জুলাই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান টাঙ্গাইলের কালিহাতী থানার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রাম সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে মিলিত হন। প্রেসিডেন্ট এখানে গ্রাম ও ইউনিয়ন সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে বেশ সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তিনি এখানে তার প্রদত্ত ভাষণে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার ও জনগণের মধ্যে আর কোন পার্থক্য নেই, কেননা আপনারা এখন গ্রাম সরকার গঠন করেছেন, আপনারা মন্ত্রী বানিয়েছেন, এখন আপনাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনুযায়ী নিজেদের সমস্যা সমাধান করলে ঢাকার সরকার-এর দিকে আর তাকিয়ে থাকতে হবে না। প্রেসিডেন্ট জিয়া গ্রাম সরকার এর স্বীকৃতি দিয়ে কাজ করার সুযােগ প্রদান করেন। ক্ষমতা ও সম্পদ বিকেন্দ্রীয়করণ না করে জিয়ার এসব ভাষণ ছিলাে। নিছক ভাওতাবাজী।

গ্রাম সরকারের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী

২৮. ১৯৮০ সালের প্রথম ভাগে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হঠাৎ করে গ্রাম সরকার

কর্মসূচীকে স্বীকৃতি প্রদান করে জাতীয় আন্দোলন রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া সর্বত্র গ্রাম সরকার কর্মসূচী বাস্তবায়নের আহবান জানালেও গ্রাম সরকার জনগণের কাছে একটি রহস্যময় অধ্যায়। গ্রাম সরকার সংগঠনের গঠণ প্রণালী ও কার্যকারিতা ক) ইউনিয়ন সরকারঃ থানা পর্যায়ের সরকারী বিভাগগুলােকে ১১টি সম কার্যভিত্তিক ১১টি বিভািগে ভাগ করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, নির্বাচিত ৯জন সদস্য এবং মনােনীত দুইজন সদস্যের মধ্যে মােট ১১টি বিভাগের ১১টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বন্টন করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যারা থাকবেন তাদের মন্ত্রী নামে আখ্যায়িত করা হবে। দপ্তরগুলাে হলােঃ (১) আইন শৃংখলা ও নিরাপত্তা (২) অর্থ, রাজস্ব ও ভূমি প্রশাসন (৩) পরিকল্পনা, যােগাযােগ, পূর্ত কর্মসূচী ও স্বেচ্ছাশ্রম (৪) কৃষি, খাদ্য, সেচ ও বন (বৃক্ষ রােপণ) (৫) পশু পালন (৬) মৎস্য (মজা পুকুর) (৭) শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম-যুবক ও কিশাের (৮) সমবায়, ভূমিহীন ও আই আর ডিপি (৯) সমাজ কল্যাণ ও কুটির শিল্প (১০) স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য (১১) পরিবার পরিকল্পনা ও মহিলা। ইউনিয়ন পরিষদের ১১ জন সদস্য যেমন ১১ জন মন্ত্রী, তেমনি চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী। গ্রাম সরকারের অধীনেও এমনি ১১টি মন্ত্রনালয় রয়েছে, তবে গঠন পদ্ধতি একটু ভিন্নতর। ইউনিয়নের মত গ্রাম পর্যায়ে নির্বাচিত সদস্য পাওয়া যাবে তাই গ্রামের জনগণকে ৫টি দলে ভাগ করে যথাঃ (১) কৃষক (২) ভূমিহীন (৩) যুবক (৪) মহিলা (৫) অন্যান্য পেশার প্রত্যেক দল থেকে ২জন করে মন্ত্রী নিয়ে এবং সংখ্যাগরিষ্ট দল থেকে আর ১ জন নিয়ে মােট ১১টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বন্টন করা হয়।

গ্রাম সরকারের দফারফা

২৯. জিয়ার মৃত্যুর পর গ্রামসরকারের আসল চেহারা বের হয়ে পড়ে। যে সব ইউনয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং স্বনির্ভর গ্রাম সরকারের গ্রাম প্রধানরা আউশ ও আমন ধান সংগ্রহের জন্য নেয়া অগ্রিম অর্থ এখনও জমা দেননি তাদেরকে ৩রা এপ্রিল ‘৮৩ ইস্যুকৃত সামরিক আইনের এক নম্বর নির্দেশের অধীনে ৩০ শে এপ্রিলের মধ্যে ট্রেজারী চালানের মাধ্যমে উক্ত অর্থ জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই চালানের। একটি কপি সংশ্লিষ্ট মহকুমা প্রশাসকের কাছে দাখিল করতে হবে। মহকুমা প্রশাসক জাতীয় পর্যায়ে এই অগ্রিম অর্থের চূড়ান্ত হিসাব নিকাশ যথাযথ পরীক্ষার পর খাদ্যমন্ত্রণালয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি পেশ করবেন এবং আগামী ৭ই মে তারিখের মধ্যে নির্ধারিত প্রােফর্মায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিসমূহ স্থানীয় মহকুমা প্রশাসক এবং সার্কেল অফিসারদের (রাজস্ব) সাথে এই অর্থ জমা দেওয়ার ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য ও ব্যাখ্যার জন্য * যােগাযােগ করতে পারেন। এতে ধান ক্রয়ের টাকা ও ধানের হিসেব নেই

৩০. গ্রাম সরকার প্রধান ও ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের বিরুদ্ধে সহস্রাধিক মামলা দায়ের হয়েছে। ১৯৮০ সালের ২২শে আগষ্ট গ্রাম সরকার প্রধান ও ইউনিয়ন সদস্যদের আমন ও আউশ ধান ক্রয়ের জন্য ৬০ কোটি ১০ লাক্ষ ৯০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছিলাে। প্রত্যেক ইউ, পি সদস্য ও গ্রাম সরকার প্রধানকে ৫০০ মণ করে ধান কেনার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলাে। ৬৫ হাজার ২৯৩ জন গ্রাম সরকার এবং চেয়ারম্যান সহ ৪৩ হাজার ৫২০জন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের অধিকাংশই ধান

কিনে অর্থ অন্য কাজে ব্যবহার করেছেন। ডিসেম্বর মাসেই স্থানীয় প্রশাসন নিশ্চিত হয় যে, ৬০ কোটি ১০ লক্ষ ৯৩ হাজার টাকার সিংহভাগই গায়েব হয়ে গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধানের হিসেব ভূয়া। যে সব গ্রাম সরকার প্রধান ও ইউনয়ন পরিষদ সদস্য নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান কেনার টাকা এবং ধানের হিসেব দিতে পারেননি তাদের বিরুদ্ধে ৪০৬ ধারায় মামলা দায়ের ও গ্রেফতারি পরােয়ানা জারীর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলাে। মামলা দায়েরের কথা জানা গেছে। ‘৮২ জানুয়ারীতে যে, দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযােগে দেশের তিন শতাধিক চেয়ারম্যানকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কাজের বিনিময়ে খাদ্যকর্মসূচীর গম অথবা সরকারী ও ইউনিয়নের অর্থ আত্মসাতের অভিযােগে এক বা একাধিক ফৌজদারী মামলা দায়ের করা হয়েছে। এদিকে ধান কেনার টাকার হিসেব অপর দিকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপােষকতার অভাবে গ্রামে গ্রামে একদা তাওবসৃষ্টিকারী গ্রাম সরকার প্রধানগণ এখন ভীত, সন্ত্রস্ত ও দিশেহারা। বান্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া ১৯৮১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএনপির তাবেদারীতে ৬৫ হাজার ২৯৩ টি গ্রাম সরকার গঠিত হয়। গ্রাম সরকার গঠনের পর মাত্র ৪টি সম্মেলনে ব্যয় হয় প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

খালকাটা বিপ্লব

৩১. জিয়াউর রহমানের সূচিত বিপ্লবের প্রথম ধাপ খালকাটা বিপ্লব। ১৯৭৯ সনের ১লা ডিসেম্বর এই বিপ্লব ঘােষিত হয়। এই কার্যক্রম মনিটর করার জন্য প্রেসিডেন্ট সচিবালয়ে সমন্বয় সেল গঠিত হয়। প্রচার করা হয় ‘৭৯ সন ও ১৯৮১ সনের মধ্যে ২৪৭৫.১৮ মাইল স্বেচ্ছাশ্রমে খালকাটা হয়েছে। এর ফলে ১৬ লক্ষ একর জমি সেচ সুবিধার আওতায় এসেছে। ফলে বার্ষিক ১৬ লক্ষ টন খাদ্য শস্য বেশী উৎপাদিত হবে। ১৪ ‘৮৫ সনের মধ্যে ৬০ লক্ষ টন অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন করে রপ্তানী করা হবে। ১৫ প্রেসিডেন্ট ঘােষণা করেছেনঃ খাদ্য শস্যের উৎপাদন দ্বিগুণ করবেন। কিন্তু খাদ্য শস্য উৎপাদনের চিত্রটা কি? ১৯৭৫ সনে আমন আউস বােরাে ফসলের উৎপাদন ছিলাে ১ কোটি ৩১ লাখ টন, ১৯৭৬-৭৭ সনে তা হ্রাস পেয়ে ১ কোটি ১৬ লক্ষ টনে দাঁড়ায়, ১৯৭৭-৭৮ সনে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিলাে ১কোটি ২৮ লাখ টন ১৯৭৮-৭৯ সনে তা হ্রাস পেয়ে ১ কোটি টনের নীচে নেমে আসে। ১৬ ঘঘাষিত খালকাটা বিপ্লবঃ বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই

৩২. জিয়াউর রহমান যেখানেই খাল খনন উদ্বোধন করতে যান সেখানেই হাজার হাজার

লােক। কোদাল ওঠে শত-সহস্র হাতে। কেউ আসে উৎসাহে, কেউ আসে প্রেসিডেন্টকে এক নজর দেখতে। বিএনপি কর্মীদের ও ইউপি চেয়ারম্যানদের দক্ষতায় সব মিলিয়ে উৎসুক দর্শকের ভীড়। প্রগতিশীলরাও একদিন মাটি কাটার স্বেচ্ছাশ্রমে অংশ নিয়েছিলেন এখন তাদের খাল কাটার বিপ্লব শেষ। ১৭

৩৩. জিয়াউর রহমান স্বেচ্ছাশ্রমের কথা জোরেশােরেই বলছেন, কিন্তু কার্যত খাল কাটার বিপ্লবে বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ ব্যয় করে চলেছেন। স্থানীয় প্রশাসনযন্ত্রকে এই কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত করে এস ডি ও, ডি সি গণ প্রাইভেট কার, জীপ, গাড়ি। রিকুইজিশন করে চেয়ারম্যান মেম্বরদের উপর চাপ সৃষ্টি করে, তেল খড় পুড়িয়ে এই খাল খননের কাজের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হচ্ছেন। এবং এস, ডি, ও; ডি, সি সাহেবরা এই খাল খননের কাজে জেলা এবং মহকুমা পর্যায়ে ব্যস্ত। তার ফলে। সরকারী কাজকর্ম প্রায় অচল। এতাে হৈ-চৈ আর সৌখিন কোদাল ধরার বাহারী উৎসবে উৎসাহের অন্ত ছিলােনা। দেদার খরচ হয়েছে দু’হাতে। কিন্তু ধীরস্থিরভাবে খাল খননের এই কার্যক্রমকে পরিচালনা করলে বর্তমান খরচের তুলনায় ৪ গুণ কম খরচে ‘এই মহা উৎসব’ সম্পন্ন করা সম্ভব হতাে। স্বেচ্ছাশ্রমের নামে মাটি কাটা শ্রমিকদের নিয়ে খাল কাটানাে হচ্ছে এবং তাদের। মজুরির টাকা জবরদস্তি করে স্থানীয় লােকদের নিকট থেকে আদায় করা হচ্ছে। ১৮ – খাল কাটা বিপ্লবঃ খাল কাটতে হবে নতুবা মানুষ কাটা হবে ঃ একটি রিপাের্ট

৩৪. উপ-প্রধানমন্ত্রী জামালউদ্দিন আহমেদ একটি খালকাটা প্রকল্প উদ্বোধন করেন। প্রশাসনের তরফ হতে বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী ও ছাত্রীদের উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলাে। সেদিন অসুস্থ থাকা সত্বেও কয়েকজন শিক্ষয়িত্রী চাকুরী হারানাের ভয়ে উপস্থিত হয়ে মাটি কাটায় অংশ নিয়েছিলেন। এরপর চট্টগ্রাম মহকুমার এসডিও এবং ম্যাজিষ্ট্রেট পটিয়া থানার অধীন ২২টি ইউনিয়নে প্রাইমারি পিটি স্কুল, হাই স্কুল, ও কলেজের শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী এবং সরকারী কর্মচারীদের ওপর এই হুকুম জারি করেন যে, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট পরিমাণ মাটি কেটে দিতে হবে নতুবা কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পিটি স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের বাধ্যতামূলকভাবে কয়েকবার মাটি কাটাতে নেওয়া হয়। কোন কোন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরাও কয়েক দিন মাটি কাটেন। কিন্তু দ্রুত এই হুকুম তামিলের ‘স্বেচ্ছাশ্রমে’ ভাঁটা পরলে পূর্বোক্ত সরকারী কর্তা ব্যক্তিরা নতুন নির্দেশ জারি করেন। তা হলাে স্বেচ্ছাশ্রম নয়, নির্দিষ্ট পরিমাণ মাটিকাটার খরচা বাবদ নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হবে। আর তারপরই শুরু হয় জবরদস্তি টাকা আদায়। কেলিশহর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান টাকা দিতে না পারায় ম্যাজিষ্ট্রেট তাদের গ্রেফতার, রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপের দায়ে অভিযুক্ত করার ভয় দেখান এবং পদত্যাগ করতে বলেন। ইউনিয়নে কে কে টাকা দিচ্ছে না তার। নামের তালিকা ম্যাজিষ্ট্রেট দাবী করেন এবং গ্রেপ্তারের ভয় দেখান। ১৯ বলঘাট ইউনিয়নের গৈড়সা গ্রামের ইউপি সদস্য তাজুল ইসলামকে পটিয়ায় আটকে রেখে খালকাটার খরচের দোহাই দিয়ে তার এলাকার একটি পাওয়ার। পাম্প বাবদ পাঁচ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। ২৬শে ডিসেম্বর ‘৮০ পটিয়ার চেয়ারম্যান, গ্রাম সরকার প্রধান ও পাওয়ার পাম্প ম্যানেজারদের সভায় পটিয়ার এস, ডি ও এই বলে ধমক দেন যে, এবার। খালকাটা, নতুবা মানুষ কাটা হবে। এভাবে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল কাটার নামে এক আমলাতান্ত্রিক ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে।

৩৫. স্বেচ্ছাশ্রমে খাল কাটার জন্য টাকা ধার্য করা হচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত সাধারণ কৃষক ও জনগণকেই তা বহন করতে হচ্ছে। প্রতি পাওয়ার পাম্প পিছু খাল কাটার চাঁদা বাবদ ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। পটিয়া রেজিষ্ট্রার অফিসে দলিল রেজিষ্ট্রি করার সময় দলিল প্রতি ১০ টাকা এ কারণে বেশি নেয়া হচ্ছে। লবণ ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। লবণের ব্যবসায়ীরা মণ প্রতি ১ টাকা দাম বাড়িয়ে সেটা পুষিয়ে নিচ্ছে। এভাবে অফিসসমূহে বা ব্যবসায়ীদের ওপর ধার্য টাকা সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ১৯৮০-৮১ সালে খালকাটার প্রহসন নিখুতভাবে বর্ণনা করেছেন। পাবনা সরকারী এডওয়ার্ড কলেজের ঐ সময়ের ১ম বর্ষের ছাত্র এবং ছাত্র সংসদের সহকারী আমােদ-প্রমোেদ সম্পাদক। পত্রটি নিম্নরূপঃ ‘সরকার খালকাটা কর্মসূচী বাস্তবায়িত করার জন্য কলেজকে কয়েক লাখ টাকা। দেওয়া হয়েছিলাে। প্রথম দিন কলেজের সব ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা মিলে। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে প্রায় তিন মাইল দূরে বাজিতপুর ঘাটে পদ্মার একটি শাখা নদী খনন করতে যান। উচ্চ পর্যায়ের একজন সরকারী অফিসারও সঙ্গে ছিলেন। দেখা গেল, খালকাটার চেয়ে ছবি তােলার প্রতিযােগিতা। এরপর কলেজের প্রত্যেকটি ক্লাস জনপ্রতি ৩০ টাকার বিনিময়ে দু’দিন করে খালকাটার সুযােগ পেয়েছিল। অর্থাৎ প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর জন্য ৩০ টাকা ব্যয় করে খালকাটানাের চেষ্টা করা হয়। তারপরও কলেজ কর্তৃপক্ষের হাতে কিছু টাকা থাকায়, কলেজ প্রাঙ্গণে একটি পুকুর খনন করার চিন্তা করা হয়। ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে তখন নতুন পুকুর খনন না। করে পুরাতন দু’টি পুকুরের সংস্কার করে, তাতে মৎস্যচাষের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে কলেজের আম বাগানের মধ্যে খাল। খনন করলেন মৎস্য চাষের আশায়। কিন্তু সেখানে মৎস্য বা কিছুই আর নেই। পত্র লেখক তাঁর গ্রামের একটি খালকাটা কর্মসূচীর কথাও উল্লেখ করেন। খালটি করতােয়া নদী হতে শুরু করে বিল পর্যন্ত প্রায় এক মাইল দীর্ঘ। এই খালের উদ্দেশ্য খরা মওসুমে অধিক ফসল উৎপাদন। কিন্তু এই খাল কাটতে গিয়ে বিপুল পরিমান ফসলী জমি নষ্ট হয়েছে এবং ঐ জমিতে যে ফসল উৎপাদন হতাে, খালকাটার পর সে পরিমাণ ফসলও হয় নি। কারণ, খালে কোন পানিই নেই।”২২

১. জিয়াউর রহমানের প্রিয় শ্লোগানের মধ্যে একটি ছিলাে ‘মানি ইজ নাে প্রব্লেম।’ পাকিস্তানের সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানও এরূপ কথা মাঝে মধ্যে বলতেন। আইয়ুব খানের সেই কথাকেই জিয়া রূপান্তরিত করেছেন রাষ্ট্রীয় দর্শনে। আইয়ুব খান নিজের ক্ষমতার ভিত গড়ার লক্ষ্যে সমগ্র দেশকে বাইশ পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এই বাইশ পরিবারই পাকিস্তানের অর্থনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য ব্যাংক বীমা আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করতাে।

২. সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান, “মানি ইজ নাে প্রব্লেম” শ্লোগান দিয়ে ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্ট পূর্ববর্তী ২ জন কোটিপতির জায়গায় শতাধিক কোটিপতি তৈরী করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাধীন ব্যাংকগুলাে জিয়ার রাজত্বে ২২ হাজার। কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে, শিল্প ও বাণিজ্য খাতে। এর মধ্যে ৬ হাজার কোটি টাকা আদায়ের অযােগ্য।

৩. জাতীয় পার্টির নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ বলেছেন-“খেলাপী ঋণের যে বড় অংশ এখন মাথা ব্যাথার কারণ, তার সিংহভাগ জিয়ার আমলে দেয়া’। তিনি আরাে বলেছেন, “এমনকি সার্কিট হাউসে বসে দরখাস্তের উপর লিখে দেয়া হতাে ঋণ দিন।” জিয়ার আমলে শিল্পায়নের নামে দলীয় লােক দেখে দেখে আর্থিক সুবিধা দিতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত মূল্যের মাত্র ১০% শতাংশ মূল্যে পানির দামে রাষ্ট্রায়াত্তকৃত শিল্প দলীয় সমর্থকদের মধ্যে বেচে দেয়। সেই বিক্রির কিস্তির টাকা এখনাে আদায় হয়নি, যার পরিমাণ ২৪০ কোটি টাকা। ঋণ নিয়েছে, কিন্তু কেউ শিল্প গড়েনি। ঋণের টাকায় বাড়ি, গাড়ি, ভােগ বিলাস, বিদেশে পুজিপাচার, অন্যখাতে বিনিয়ােগ করেছে। বিএনপি আমলে ‘শিল্পপতি’ নামে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা গােষ্ঠীর মধ্যে বেশীর ভাগই ‘ফ্রড’। এটা শাসকদের প্রশ্রয়েই হয়েছে।

৪. জিয়ার আমলে বিদেশী দাতা সংস্থার নির্দেশে শিল্প স্থাপনে শর্ত বেধে দেয়া হয় যে, বৈদেশিক মুদ্রায় প্রদত্ত ঋণ বৈদেশিক মুদ্রার পরিবর্তিত দামে পরিশােধ করতে হবে। পরিশােধের এই বিধান প্রকৃত শিল্পোদোক্তাদের গলায় ফাঁস হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, ১৯৮১ সনেই মুদ্রামান হ্রাসের ফলে ১ ডলারের মূল্য ২০ টাকায় ওঠে। শিল্প মালিকদের বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যবহৃত ঋণ পরিশােধ অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৮২ সনে সামরিক তদন্ত কমিটির সূত্রে অনুযায়ী জিয়ার আমলে শিল্প ব্যাংক, শিল্প ঋণ সংস্থার ঋণ মঞ্জুরী বেঙ্গল কার্পেট, সােনালী পেপার এন্ড বাের্ড, আফতাব অটো মােবাইল, হাইস্পীড শিল্প বিল্ডিং এন্ড হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং, কাশেম টেক্সটাইলস, আরজান কার্পেট এন্ড জুট উইভিং মিল লিঃ, হাওলাদার ডাক পাইপ, ইসমাইল কার্পেট, নর্দান ডিস্টিলারিজ, চিটাগাং জুট মিলসসহ অন্যান্য শিল্প কারখানার বিনিয়ােগকৃত প্রায় ৪০০০ কোটি টাকার মধ্যে অধিকাংশের ক্ষেত্রে মালিকের বিনিয়ােগের গড় পড়তা হিসাব ছিলাে মাত্র ১০% ভাগ। ইসমাইল কার্পেট-এর মালিকের বিনিয়ােগ ছিলাে বেশী তাও মাত্র শতকরা ১৪.৮৮ ভাগ। এ সম্পর্কে একজন অর্থনীতিক বিশ্লেষক বলেছেন, “বাংলাদেশ বণিক পুজি শক্তিশালী করার মাধ্যমে কোটিপতি সৃষ্টির ক্ষেত্রেই এই পরিস্থিতি সহায়ক হয়েছে-শিল্পপতি সৃষ্টিতে নয়।”

৫. ১৯৮১ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার দাড়ায় শতকরা ২০% ভাগে, অথচ জাতীয় আয় বৃদ্ধি হয় শতকরা ১.৬ ভাগ। ১৯৮০-৮১ অর্থ বছরে দেশের রফতানী থেকে আয় হয়েছে সাড়ে ১১শ’ ৬০ কোটি টাকা, আমদানী ব্যয় সেখানে ছিল প্রায় ৫ হাজার ২শ’ ১৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯শ’ ৭৯ কোটি টাকা।৭

৬. বিশ্বব্যাংক জিয়ার আমলের ৮১ সনের এক রিপাের্ট বলেছে “বাংলাদেশ তার ক্ষমতার বাইরে আর্থিক লেনদেন, আমদানী ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করার ফলে বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে সংকটাপূর্ণ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে।” জিয়াশাহীর লাগামহীন এবং স্বৈচ্ছাচারী আর্থিক পদক্ষেপের ফলেই বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পেতে পেতে জুন মাসের শেষ দিকে ৮ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের নীচে নেমে এসেছে। আই এম এফ মনে করে ‘আমদানী ও রফতানী বাণিজ্যে ২৯৭৯ কোটি টাকা ঘাটতি সত্বেও বৈদেশিক মুদ্রার সুষ্ঠু ব্যবহার ও মূল্যায়ন করা হচ্ছেনা। মানি ইজ নাে প্রব্লেম’- শ্লোগানটি ছিল বিদেশ থেকে যে কোন শর্তে ঋণ এনে দেশে একনায়ক সুলভ ক্ষমতার ভিতকে শক্ত করা। স্বভাবতই বাংলাদেশের মত একটি গরীব দেশের জন্য সাহায্য প্রয়ােজন। প্রয়ােজন উৎপাদন ঘাটতি দূর করার জন্য, সীমাহীন দারিদ্র বিমােচনের জন্য। কিন্তু জিয়াউর রহমান নিজেই বেপরােয়াভাবে ঋণের অর্থ অপচয়ে উৎসাহ দিয়েছেন। জনগণের সার্বিক কল্যাণ চিন্তা না করে মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য অনুৎপাদনশীল খাতে অর্থ ব্যয়িত হয়েছে।

৮. ৩০ কোটি টাকা ঋণ করে সাদা-কালাে টেলিভিশনকে রঙিন করার যন্ত্রপাতি আমদানী খাতে ব্যবহৃত হয়েছে। ৫৭ কোটি টাকা ঋণ করে সােনারগাঁও হােটেল নির্মিত হয়েছে। কোটি কোটি বিদেশী ঋণে নির্মিত হচ্ছে গােল্ড হিল কমপ্লেক্স। কিন্তু এসব অর্থ ব্যয় করে স্থাপন করা হচ্ছে না কলকারখানা যা উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। যা কোটি কোটি মানুষের বেকারত্ব দূরীকরণ ও জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারে ঋণ বাড়ছে। কিন্তু দারিদ্য ঘুচছে না। ৭৩-৭৪ সনের ঋণের পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি ১৪ লাক্ষ ডলার। ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে তা পৌছে ৩৩৬ কোটি ১৫ লক্ষ ডলারে অর্থাৎ বেড়েছে ৭ গুণ। সরকারী পরিসংখ্যাণে দেখা যায় খাদ্য সংকটের সময়েও (৭৪-৭৫) বছরে গড়ে প্রতিটি মানুষ খাদ্য পেয়ে ৩৫৬ পাউন্ড, কিন্তু ৭৮-৭৯ সনে পেয়েছে ৩২৯ পাউন্ড। ১৯৭৫-৭৬ সনে খাদ্য আমদানী। করতে হয়েছে ১৪.৪০ টন ৭৯৮০ সনে ২৭.৭৮ লক্ষ টন। দিন দিন ভাতের থালা থেকে ভাত কমে গেছে। জিয়াউর রহমান শর্তহীনভাবে বাংলাদেশকে দাতা দেশগুলাে, আই এম,এফ ও বিশ্ব ব্যাংকের নিকট দায়বদ্ধ করে ফেলেছে। বিশ্ব ব্যাংকের নীতিই হলাে, ‘ঋণ কর, উড়াও, আবার ঋণ কর।’ এই নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জোরালে কণ্ঠেই বলেছেন, ‘মানি ইজ নাে প্রব্লেম।

১০. জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে লাভজনক শিল্প কারখানাকে বিরাষ্ট্রীয়করণ করে এবং পানির দামে দলীয় সমর্থকদের মধ্যে তা বেচে দেন। বাহ্যত এসব করা হচ্ছিলাে রাষ্ট্রায়াত্ত খাতে লােকসান, অদক্ষতা ইত্যাদি অজুহাত তুলে; সর্বোপরি জনগণের কল্যাণের দোহাই দিয়ে। কিন্তু বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতির অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে বাস্তবে যা ঘটেছে তা হলাে9 এই সুবিধাজনক বিনিময় সময়ে পাটকল মালিকরা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা এবং বস্ত্রকল মালিকরা প্রায় ১৫০ কোটি টাকা লাভ করেছিলেন বা সঠিক অর্থে বললে জনগণকে ফাঁকি দিয়েছেন, যদিও তা সরকারের অজানা ছিলােনা। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রায় ১৫০ কোটি টাকার পাটকলগুলি ব্যক্তিগত খাতের মালিকরা লাভ করেছেন মাত্র ৫ কোটি টাকায় এবং তাও পাওনা অর্থের মাত্র এক পঞ্চমাংশ প্রদানের মাধ্যমে। বাকী অর্থ অনেক কমসুদে ৯টি কিস্তিতে পরিশােধের কথা ছিলাে। সেটুকুও করতে তারা গররাজি, এসব মালিকরা আরাে নতুন সুবিধার জন্যে দাবি উত্থাপন করেছে। আগে রাষ্ট্রীয় খাতকে ভর্তুকী দিয়ে বাংলার পাটচাষীকে বাঁচাননা হতাে, এখন ভর্তুকী দিয়ে মুষ্টিমেয় ধনিককে পােষা হচ্ছে।

লােকসানের অজুহাতে লাভজনক/অলাভজনক সমস্ত শিল্পই নাম মাত্রমূল্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ব্যক্তিগতখাতে। অধ্যাপক রেহমান সােবহান ও এ আহমেদ আহসান প্রদত্ত তথ্যাবলী থেকে এটাও প্রমাণিত যে, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পগুলির ক্ষেত্রেও বিরাষ্ট্রীয়করণের পর ব্যক্তিগত খাত তাদের অবস্থা উন্নয়নে ব্যর্থ হয়েছে। ২৪টি কারখানার বিরাষ্ট্রীয়করণের জরীপ থেকে জানা যায় যে, এর মাত্র ৮টির ক্ষেত্রে বিরাষ্ট্রীয়করণের পর আগের তুলনায় লাভ বেড়েছে বা লােকসান কমেছে। পক্ষান্তরে, বাকি দুই তৃতীয়াংশে কারখানারই পরবর্তী পারফরমেন্স’ পূর্বের তুলনায় আরাে অবনতি হয়েছে। ৫টি কারখানা তাে একদম বন্ধই হয়ে গেছে, ৭টিতে নতুন করে লােকসানের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পূবের ৪টি লাভজনক। কারখানা বর্তমানে লােকসান দিতে শুরু করেছে। বিরাষ্ট্ৰীয়করণের পর প্রায় সর্বত্রই ব্যাপক সংখ্যক শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে এবং সর্বত্রই নিয়মিত শ্রমিকের বদলে বদলী শ্রমিক নিয়ােগ প্রচন্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিরাষ্ট্রীয়কৃত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ইউনিটগুলি টেন্ডারে বিক্রি করা হয়েছিলাে এবং ক্রেতা মালিকরা এখন ধার্যকৃত দামের মাত্র এক পঞ্চমাংশ টাকা প্রদান করে মিল ইউনিটগুলাের মালিক হয়ে বসেছিলেন। বাকি টাকা বার্ষিক ৮ শতাংশ সুদে কিস্তিতে শােধ করার নিয়ম ঠিক হয়। কিন্তু ইউনিটের নমুনা জরীপের হিসাব অনুযায়ী নতুন মালিকদের কাছে এখন পর্যন্ত সুদসহ মােট পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪৩ কোটি টাকা। তদুপরি, এর মধ্যেই ৮১ কোটি টাকা মেয়াদ উত্তীর্ণ ঋণের তালিকাভুক্ত হয়েছে। | তদানীন্তন শিল্পমন্ত্রী শফিউল আজম নিজেই এক সভায় ঘােষণা করেন যে, জিযার আমলে ব্যক্তিগত খাতে অনুমােদিত মােট শিল্পের শতকরা ৩০% ভাগই বাস্তবায়িত হয়নি। ১০

১২. ব্যক্তিখাতে ঋণ কেলেংকারি উদঘাটিনের জন্যে সরকার জনৈক বিগ্রেডিয়ারের নেতৃত্বে যে সামরিক তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন, তার রিপাের্টের যে সামান্য অংশ প্রকাশ পেয়েছে তা থেকে জানা যায়, ১১ বছরে বি.এস.বি এবং বি.এস.আর, এস, যে ১২৪৮টি শিল্প প্রকল্পের অনুমােদন দিয়েছিলাে তার মাত্র ৩৬% শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। তাও এগুলাের অধিকাংশ এখনাে সাইনবাের্ড সর্বস্বই বলে জানা গেছে, উৎপাদন শুরু হয়নি। আরাে বলা হয় যে, রাষ্ট্রীয়ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলি মাত্র ১১ জন শিল্পতিকে মােট ৩৮৯ কোটি ৫১ লাখ ৬১ হাজার টাকা ঋণ দিয়েছে এবং এর মধ্যে ২০৭ কোটি ১৬ লক্ষ ৮২ হাজার টাকার ঋণ এখনই তামাদি হয়ে গেছে। উল্লেখিত দুটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ কেলেংকারী বর্তমানে এমন এক মাত্রা যােগ করেছে যে বিদেশী দাতা দেশগুলিরও তা নজরে এসেছে।

১৩. জিয়ার আমলে মুষ্টিমের ধনীকরা রাষ্ট্রীয়ও খাত থেকে যে ঋণ নিয়েছেন সেগুলি তারা আরা পরিশােধ করেননি। একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা পরিবেশিত খবর থেকে জানা যায় যে, মাত্র ৯টি ধনীক পরিবার ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এসব গ্রুপের নামধামও প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এদেরকে খারাপ দেনাদার (bad borrowar) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে মামলাও দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু ‘সর্বোচ্চ মহলের সঙ্গে এদের যােগাযােগ, প্রভাব ও ঘুষ প্রদানের ব্যবস্থা থাকায় কাউকেই শাস্তি ভােগ করতে হয়নি।১১

১৪. শুধু শিল্পোদ্যোগই নয় জিয়াউর রহমানের সরকার ব্যক্তিগত খাতে ব্যাংক স্থাপনের , অনুমতি দেয়ার পর সেখানেও চালু হয়েছে এক অবিশ্বাস্য তােঘলকি কান্ড। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এ যাবৎ প্রতিষ্ঠিত ৬টি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ব্যাংকের ১৫ জন ডিরেক্টর নিজেরা তাদের ব্যবসার নামে ৮২ সাল পর্যন্ত ১২৫ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ধার নিয়েছেন, অথচ সমস্ত ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের মােট মূলধনই হল মাত্র ৪৮ কোটি টাকা। ১২। এই সংক্ষিপ্ত চিত্র থেকেই একটা বিষয় স্পষ্ট যে, ৭৫ পরবর্তীকালে বিরাষ্ট্রীয়করণের নামে যথেচ্ছা লুণ্ঠনের পথ অবারিত করা হয়েছে। মুষ্টিমেয় এসব ধনীক গ্রুপের পক্ষে এরূপ অর্থ আত্মসাৎ করেও সুনাম ও যশ রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। কারণ একটাই, সেটা হলাে জিয়ার শাহীর সঙ্গে রয়েছে এদের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ। বস্তুতঃ এটিই তাদের অন্যতম পুজি। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তীকালে জিয়া সরকারের নীতিমালা প্রণীত হয়েছে এইসব ধনীক শ্রেণীর স্বার্থে। প্রকৃতপক্ষে ভর্তুকী, লুটপাট, ও, ডি, এবং ঋণ নিয়ে দেশকে ‘লুটে-পুটে ফোকলা করে দিয়েছে দেশের লুটেরা ধনীক গােষ্ঠী। কিন্তু প্রভাবশালী প্রচার মাধ্যমগুলি এদের পক্ষে কাজ করায় জনগণ এসব তথ্য জানতে পারেনি। জনগণকে সঠিক তথ্য জানতে দেওয়া হয়নি। পক্ষান্তরে, গণতান্ত্রিক অধিকার না থাকায় দেশের জনগণও তাদের সঠিক নিরপেক্ষ অভিমত ব্যক্ত করার সুযােগ পায়নি। জিয়ার আমলঃ ক্যালােরী চিত্র ১৫. ওজনের হিসেবে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষ দৈনিক গড়পরতা ৮৮৬ গ্রাম খাদ্য দ্রব্য গ্রহণ করতেন। ১৯৭৫-৭৬ সালেও এই খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ছিল ৮০৭ গ্রাম। কিন্তু ১৯৮১-৮২ সালে এই ভােগের পরিমাণ মাত্র ৭৬৪ গ্রামে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের দৈহিক গড়ন ও কাজের হিসেবে প্রতিদিন ২২৭৩ ক্যালােরীর প্রয়ােজন। ১৯৭৫-৭৬ সালেও এদেশের মানুষের দৈনিক গড়পরতা ক্যালােরী গ্রহণের পরিমাণ ছিল ২০৯৪। আর ১৯৮১-৮২ সালে ক্যালােরী গ্রহণের গড়পরতা পরিমাণ ছিল মাত্র ১৯৪৩ যা নিম্নতম প্রয়ােজনের তুলনায়ও শতকরা ১৫ ভাগ কম। ১৯৭৫-৭৬ সালে। বাংলাদেশের শতকরা ৫৯ ভাগ মানুষ প্রয়ােজনীয় খাদ্যভােগ করতে সক্ষম ছিলাে। আর ১৯৮১-৮২ সনে এই পরিমাণ শতকরা ৭৬ ভাগে এসে ঠেকেছে অর্থাৎ জিয়ার রাজত্বে শতকরা তিন চতুর্থাংশের বেশী নাগরিকরাই পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। প্রােটিনের হিসেবে ১৯৭৫-৭৬ সালে শতকরা ৭২ ভাগ পরিবারের লােকেরা প্রয়ােজনীয় প্রােটিন ভােগ করেছেন। কিন্তু ১৯৮১-৮২ সালে মাত্র শতকরা ৪৮ ভাগ পরিবারের পক্ষে প্রয়ােজনীয় প্রােটিন ভােগ করা সম্ভব হচ্ছিল। ১৩ উপরিউক্ত তথ্য থেকেই বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংকট উত্তরােত্তর ঘনীভূত হওয়ার বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়। এই সংকটের একটা দিক হলাে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও মানুষের আয় ক্ষমতা। হ্রাস। ফলে বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর আস্থা এই সময় উন্নতির বদলে দ্রুত অবনতির দিকে ধাবিত হয়েছে। মানি তাদের নিকট প্রব্লেম হয়েই থেকেছে।

জাতীয় আয় বৃদ্ধি হয়নি

১৬. অনুৎপাদনশীল খাতে মুষ্টিমেয় ধনীক গােষ্ঠীকে কোটি কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হলেও সেক্ষেত্রে কর্মক্ষম এই বিশাল জনগােষ্ঠির জন্যে কর্মসংস্থানের কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং বিভিন্ন রাষ্ট্রয়াত্ত প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তরের ফলে হাজার হাজার কর্মরত শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। এবং এটাও হয়েছে সরকারী নীতিমালার বদৌলতে। কর্মপ্রার্থী ও কর্মে নিয়ােজিত শ্রমিকদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান আমাদের অর্থনীতির ভয়াবহ বিপর্যয়ের সুদূর প্রসারী ইঙ্গিত বহন করে। আয় স্বাধীনতার পরবর্তী তিন বছরে বাৎসরিক গড়পরতা জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ৯ ভাগ। জিয়ার আমলে তা দ্রুত গতিতে হ্রাস পায়। উপর তলার শতকরা ১০ভাগ ব্যক্তিরা মােট আয়ের ৪৫% ভাগ ভােগ করেন, আর নীচু তলার শতকরা ৪০ জন মাত্র ১৫% ভােগ করে থাকেন। ১৪

জিয়ার আমলে ঃ দ্রব্যমূল্য

১৭. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালেই দ্রব্যমূল্যকে একটা স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসতে সক্ষম হন। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয়, তখন খাদ্য উৎপাদন, বিশ্ব বাজার, দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক

অবস্থা সবকিছুই ছিল একটা অনুকূল স্থিতিশীল পর্যায়ে। তা সত্ত্বেও, ১৯৭৫-এর তুলনায় ১৯৭৮-৭৯ সন থেকে আরম্ভ করে ৮১ পর্যন্ত সময়ে দ্রব্যমূল্য প্রতিবছর শতকরা ১২ থেকে ১৫ ভাগ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৫ উপরে উল্লেখিত করুণ চিত্র থেকে মানি ইজ নাে প্রব্লেম’ শ্লোগানের নগ্ন দিক বেরিয়ে এসেছে।

নব্য পরগাছা ধনী

১৮, জিয়াউর রহমানের ‘মানি ইজ নাে প্রব্লেম’ শ্লোগানের নেপথ্যে দেশের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কোন গতিশীলতা না এসে দেশে ব্রীফকেসধারী নব্যধনী সম্প্রদায়ের বিকাশ হতে থাকে। নব্য ধনী সম্প্রদায়ের বিকাশের মূল প্রক্রিয়া মুৎসুদ্দি হলেও এই প্রক্রিয়ার সংস্কৃতি স্বভাবতই দেশের ভেতরের সম্পদও বিভিন্ন নীতি বিবর্জিত উপায়ে আত্মসাৎ করতে উৎসাহ দেয়। এইভাবে দেশের নিজস্ব সম্পদও পুনবন্টিত হয়ে এক ‘পরগাছা’ সম্প্রদায়ের কাছে চলে যেতে শুরু করে।”১৬, এই লুটেরা ধনীকদের মােড়ল জহিরুল ইসলাম। জিয়াউর রহমান কর্তৃক তার পৃষ্ঠপােষকতার দলিল প্রকাশিত হয় এক সামরিক তদন্তে।

১৯. জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের লুটেরা ধনীক শ্রেণীকে জনগণের টাকা ও জনগণের জন্য সংগৃহীত বিদেশী ঋণ অনুদানের টাকা লুট করার যে সুযােগ দিয়েছেন ১৯৮২ সনে সামরিক তদন্ত কমিটির রিপেৰ্টে তার কিছু বিবরণ রয়েছে। জিয়া অকারণে এদের টাকা লুট করতে দিয়েছে এমন নয়। এসব লুটেরাও জিয়াকে দিয়েছে কোটি কোটি টাকা। কোটি কোটি টাকা হাতে পেয়ে জিয়া বলে বেড়াতেন “মানি ইজ নাে প্রব্লেম।” জিয়া কীভাবে ধনীক লুটেরাদের সাহায্য করেছে। এ প্রসঙ্গে শুধু বাল্লাদেশের অন্যতম ধনী জহুরঙ্গ ইসলামের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জহুরুল ইসলাম যুৎসই অবস্থানে চলে আসেন। আসলে চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যে জিয়াউর রহমান আর জহুরুল ইসলামরা এক, জিয়া তার ক্ষমতাগ্রহণের বিভ্রান্ত কৌশলটি থেকে শুরু করে পরবর্তী রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরকেই দুর্নীতিগ্রস্ত করেন। রাজনীতিবিদদের চরিত্রকে টাকা দিয়ে কিনে নেয়া, দল ভাঙ্গানাে, প্রতিটি গণতানিক ইনস্টিটিউশনকে ভেঙ্গে ফেলা বা নিজের স্বার্থের অনুকূলে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে-জিয়াউর রহমান ছিলেন অদ্বিতীয়। অন্যদিকে দুর্নীতির শিকড়কে জহুরুল ইসলাম মন্ত্রী, সচিব, রাষ্ট্রদূত আর ব্যাংকগুলাের উচ্চমহলে অবাধে বিস্তার করে রাখেন। জিয়ার ক্যাবিনেটে জহুরুল

ইসলামের বেতনভুক্ত দু’জন কর্মচারী মন্ত্রী ও ছিলেন। হাবিবুল্লাহ খান ও জাকারিয়া চৌধুরী। ১৭ ফর।

মার্শাল ল ইনভেস্টিগেশন রিপাের্ট

জহুরুল ইসলাম গ্রুপের ১২টি প্রতিষ্ঠান। বলাবাহুল্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই মালিক। জহুরুল ইসলাম নিজে এবং বিরাট পরিমাণ টাকা এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক। থেকে তােলা হয়েছে। মিলনার্স লিমিটেড,২. ঢাকা ফাইবারস লিমিটেড,৩. নাভানা স্পাের্টস লিমিটেড,৪. ইসলাম শিপিং লিমিটেড, ৫. নাভানা লিমিটেড, ৬. ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ৭. আফতাব অটোমােবাইলস লিমিটেড, ৮. এসেনশিয়াল প্রােডাক্টাস, ৯, বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট (আরব আমিরাত) লিঃ, ১০. ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড, ১১. নাভানা এন্টারপ্রাইজ (যুক্তরাজ্য) লিমিটেড, ১২. আল হামারা গ্লাস ইন্ডাষ্ট্রিজ। 9 ‘লুটেরা ধনিক গােষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র জহুরুল ইসলামই নিজস্ব লুটপাটের সীমা দেশসহ দেশের বাইরে পর্যন্ত ব্যাপক বিস্তৃত। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলাের বৈদেশিক শাখাসমূহ থেকে জহুরুল ইসলামের তথাকথিত বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট ও নাভানা লিমিটেডের নামে বিরাট পরিমাণ ঋণ অনুমােদন করা হয়েছে। জহুরুল ইসলামের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের অনাদায়ী এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ ঋণের টাকার পরিমাণটা সামরিক তদন্ত কমিটির সূত্র মতে ১১২ কোটি ৪২ লক্ষ। সামরিক তদন্ত কমিটি জহুরুল ইসলাম গ্রুপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ অনাদায়ের এরকম বর্ণনা দিচ্ছে । মিলনার্স লিমিটেডঃ ২৮-২-১৯৮১ সালে অগ্রণী ব্যাংক তাদের ৫০ লক্ষ টাকা ঋণ। মঞ্জুর করে। নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ পরিশােধ না করায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ১৮-৫-১৯৮২ তারিখ পর্যন্ত ৬১.৩৩ লক্ষ টাকা। জনতা ব্যাংকও প্রতিষ্ঠানটিকে ৪৪ লক্ষ টাকা ঋণ দেয়। তাও অপরিশােধিত। ইসলাম শিপিং লিমিটেড ১৯৮০ এর মার্চে সােনালী ব্যাংক ইসলাম শিপিং লিমিটেডের নামে ২৭ লক্ষ টাকার ঋণ অনুমােদন করে। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে আরাে ১ লক্ষ টাকা পরিশােধ করা হয়। সুদসহ অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ থেকে যায় ২২.০৯ লক্ষ টাকা। নাভানা লিমিটেড ঃ গাড়ী আমদানী করার জন্য জহুরুল ইসলাম নাভানা লিমিটেড। স্থাপন করেন। সােনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে এক বছরের জন্য ১৯৮০ সালে ৫০ লক্ষ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। সামরিক তদন্তকালীন সময় পর্যন্ত যা মূলতঃ অনাদায়ীই রয়ে গেছে।

ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডঃ প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণদাতা ব্যাংক হচ্ছে পূবালী ও সােনালী। পূবালী ব্যাংক দেয় তিন কোটি সাড়ে বার লক্ষ টাকা। ১ কোটি ৭১ লক্ষ টাকার অংক অনাদায়ী রয়েছে। সােনালী ব্যাংকও অজ্ঞাত পরিমাণ টাকার কাঁচা পাট বন্ধক রেখে ১৯৭৬-৭৭ সালে ৬০ লক্ষ টাকা ঋণ দেয়। বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিঃ প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৬ সালে আবু ধাবিতে ৫০০০ গৃহ তৈরীর অর্ডার পায়। জনতা ব্যাংক আবুধাবি শাখা হতে ঋণ মঞ্জুর করা হয়। ৩০ এপ্রিল ১৯৮২ এই ঋণের অনাদায়ী পরিমাণ ১৫ কোটি ৮৯.৮০ লক্ষ দিরহাম। উল্লেখ্য বেঙ্গল ডেভেলপমেন্টের এই কাজটির মূল্যমান ছিল ৪৭৩.৭৫০ মিলিয়ন দিরহাম। ১৯৭৬ সালের এপ্রিলে কাজ শুরু করার কথা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে তা ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরে শিফট করা হয়। সময় নির্ধারণ করা হয় তিন বছর। সেই হিসেবে ১৯৮০ সালের মধ্যে সব কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবার কথা। এবং ব্যাংকের ঋণও পরিশােধ হবার কথা। ১৯৮১ সালে ২০ এপ্রিল তৎকালীন অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নূরুল ইসলামের সভাপতিত্বে একটি দল আবুধাবীতে পৌছেন। আরাে ১ লাখ ৩০ হাজার দিরহাম ঋণ অনুমােদনের সুপারিশ করেন। যথা সুপারিশ তথা কার্য। মধ্যপ্রাচ্যের এই কাজটির জন্য শ্রমিকদের যাতায়াত ও বেতন ভাতার নাম দিয়ে জনতা ব্যাংকের ঢাকাস্থ শাখা থেকে ১ কোটি ৬৬.৯৩ লক্ষ টাকা ঋণ গ্রহণ করে। ১৯৭৭ সালের এপ্রিলে ঋণটি বিতরণ করা হয়। এবং ১৯৮২ সালে সেটা নবায়ন করা হয়। আফতাব অটোমােবাইলস চট্টগ্রাম জহুরুল ইসলামের গাড়ী এসেম্বলী করার কারখানা। ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সহ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে আফতাব অটোমােবাইলসের আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছিল ৭কোটি ৭ লাখ। পরে পুননির্ধারণ করা হয় ৭ কোটি সাড়ে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। এই হিসাবের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠানটিকে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ১৯৮১ সালের মধ্যে এপ্রিলে ৩ কোটি টাকার এল/সি ঋণ মঞ্জুর করে। সাথে ২ কোটি ২.৭১ লক্ষ টাকার নগদ ঋণ অনুমােদন করে। নাভানা এন্টারপ্রাইজ (যুক্তরাজ্য) লিঃ জহুরুল ইসলামের এটি একটি নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। অবস্থান লন্ডনে। ১৯৭৯-এর এপ্রিলে সােনালী ব্যাংকের লন্ডন শাখা জহুরুল ইসলামকে নাভানা লিমিটেডের বিপরীত ৫.৫০ লক্ষ পাউন্ড ঋণ প্রদান করেন। সর্বশেষ ওভার ড্রাফটের পরিমাণ ৩৪ লক্ষ পাউন্ড। আর ৩১.১২.১৯৮১ তারিখ পর্যন্ত অনাদায়ী ঋণ ৪১.১৬ লক্ষ পাউন্ড। বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৬ কোটি ৫৪ লক্ষ টাকা। এছাড়া মুদ্রা পাচার করে জহুরুল ইসলামের লন্ডনে কিনেছে ৩০ লক্ষ পাউন্ডের দু’টি বাড়ি। সামরিক তদন্ত কমিটির মতে জহুরুল ইসলামের ঋণ পরিশােধের ক্ষমতা সীমিত। এবং ব্যাংক একজন মাত্র ব্যক্তিকেই এই বিরাট পরিমাণ ঋণ দিয়ে প্রচলিত নিয়মের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে। যেখানে বিভিন্ন ব্যাংকে জহুরুল ইসলামের আরও বিরাট অংকের ঋণ রয়েছে।

জহুরুল ইসলাম নয়ঃ জিয়ার

পাঠকের একথা মনে করার কারণ নেই যে, ব্যক্তি জহুরুল ইসলামের ফিরিস্তি। দেয়া হচ্ছে। আসলে ঘটনাটি তা নয়। জিয়াউর রহমানের আমলে যে বিপুল পরিমাণ বিদেশী ঋণ আনা হয়েছে তা কিভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তার এটি একটি উদাহরণ। অভিযােগে বলা হয়, জিয়াউর রহমানের তিনটি নির্বাচন ও বিচারপতি সাত্তারের নির্বাচনে জহুরুল ইসলাম কোটি কোটি টাকা তুলে দিয়েছিলেন। ১৮

বৈদেশিক সাহায্য ঃ মানি ইজ নাে প্রব্লেম

২০. বহিঃসম্পদ বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যসমূহের পর্যালােচনা করলে দেখা যায় জিয়াউর রহমানের রাজত্বে ১৯৭৫-৭৬ থেকে ১৯৮০-৮১ অর্থবছর পর্যন্ত মােট ১০৮১৪ কোটি টাকার বৈদেশিক সাহায্য এদেশে এসেছে। উল্লেখিত সময়ের মধ্যে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বিনিময় হার অনুসারে ১৯৭৫-৭৬ সালে পেয়েছে ১২২৩ কোটি টাকা, ১৯৭৭-৭৮সনে পেয়েছে ১৫৫৬। কোটি টাকা, ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে ২৩৫০ কোটি টাকা ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে পেয়েছে ২৯০৯ কোটি টাকা। ১৯৮০-৮১ সালের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার। অনুসারে জেনারেল জিয়ার শাসন আমল (১৯৭৫-৭৬ থেকে ১৯৮০-৮১) পর্যন্ত। মােট বিদেশী সাহায্য (ঋণ ও অনুদান) হিসাবে মােট ১১,৬৩৩ কোটি টাকা গ্রহণ। করেছে। ১৯ এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সঠিক ও বাস্তব সম্মত ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে একটি সুষ্ঠু ভিত্তির সূচনা করা যেত। কিন্তু বস্তুতঃ এই সাহায্যের মূল অংশই রাজনৈতিক ক্ষমতায় টিকে থাকার হাতিয়ার। হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। বৈদেশিক সাহায্যের প্রায় পুরােটাই জিয়াউর রহমান কিছু। মুষ্টিমেয় লােকের হাতে তুলে দিয়ে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান সুসংহত করতে চেয়েছেন। ২১. বৈদেশিক সাহায্যের একটি উল্লেখযােগ্য অংশ বৈদেশিক ঋণ, যা সুদসহ একটি নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরৎ দিতে হয়। জিয়ার আমলে বৈদেশিক ঋণের বােঝা শুধু বেড়েছে। ১৯৭৩-৭৪ সালে যেখানে বৈদেশিক ঋণ ছিলাে ৫১৭ কোটি টাকা তা। ১৯৮১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৮৯৩৭ কোটি টাকা। এত বিপুল পরিমাণ ঋণ তিনি এদেশের সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। ঋণের সময় তিনি সুদের হারের দিকেও দৃষ্টি দেননি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুদের হারের উল্লেখযােগ্য বৃদ্ধি সত্বেও অপ্রয়ােজনীয় ঋণ গ্রহণ করেছেন। যার সুদূর প্রসারী প্রভাবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যয়ের মধ্যে পরেছে। রাপ্তানী আয়ের বিরাট অংশ এই ঋণ পরিশােধে ব্যয় করা হচ্ছে। ৮০-৮১ সালে বৈদেশিক সুদ সহ ঋণশােধের দায় দায়িত্ব মােট রপ্তানী আয়ের ৩৮% ভাগে এসে দাঁড়ায়। যাহা ১৯৭৩-৭৪ সালে ছিলাে মাত্র ৪% ভাগ।২০

২২. বৈদেশিক অর্থে পরিচালিত উন্নয়ন কর্মকান্ড যথাযথ সমাপ্তিও সময় মত করতে পারেননি। অনেক অপ্রয়ােজনীয় প্রকল্পে অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে কিন্তু জাতীয় অর্থনীতির অগ্রাধিকারকে প্রধান্য দেয়া হয়নি। ব্যক্তি বিশেষের বাণিজ্যিক সুবিধা প্রসরের দিকে বেশী নজর দেয়া হয়েছে।

২৩. প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের দু’টি প্রধান অংশ একটি অনুদান অপরটি বৈদেশিক ঋণ। অনুদানের অর্থ ফেরত দিতে হয় না। কিন্তু ঋণ এর অর্থ পরিশােধ করতে হয়। জিয়ার আমলে অনুদানের এবং ঋণের অনুপাতে ব্যাপক বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। শতকরা হিসাবে জিয়ার আমলে গড় বৈদেশিক সাহায্যের ঋণের অংশ ৬৫%। আর অনুদান ৩৫% বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় ২০% ছিলাে ঋণ এবং অনুদান ছিলাে ৮০%। বিশেষগােষ্ঠীদের অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়ায় অপ্রয়ােজন খাতে ব্যপক দুর্নীতি বেড়ে যায়। রাজনৈতিক স্বার্থে পরিচালিত জিয়ার বৈদেশিক সাহায্য নীতির ফলে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অতি দ্রুত কমে আসে। বাংলাদেশে পরিসংখ্যানে ব্যুরাের প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় জিয়ার মৃত্যুর সময় বাংলাদেশ ব্যাংকে মাত্র ৮ কোটি ৩৬ লক্ষ ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিলাে। এটা ছিলাে জিয়ার মানি ইজ নাে প্রব্লেম এর রাজনৈতিক মাহাত্ম্য। এই রিজার্ভ দেশের একমাসের চাহিদাও মেটাতে অক্ষম।২১ বৈদেশিক সাহায্যের সাথে দাতা দেশ দেয় বিভিন্ন শর্ত, যা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে থাকে বিদেশী পণ্যের জন্য দেশের বাজারকে খুলে দেয়া। জিয়াউর রহমান এই প্রক্রিয়ার শর্তে দেশকে উৎপন্ন নির্ভর না করে আমদানী নির্ভরতার দিকে পরিচালিত করেছেন। রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরাে পরিকল্পনাগুলাে কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, জিয়ার আমলে আমদানী ব্যয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। আমদানী ও রপ্তানীর পার্থক্য ক্রমে বেড়েই গিয়েছে। ১৯৭৩-৭৪ সালে যেখানে পন্য বাণিজ্যের ট্রেডিং ব্যালান্স ছিলাে ৪৩৫ কোটি টাকা, সেখানে ১৯৮০৮১ সালে হয়েছে ২,৯৭৯ কোটি টাকা। দেশকে এই প্রক্রিয়ায় ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতির দিকে ঠেলে দিয়ে দেশের উৎপন্ন ব্যবস্থাকে করে ফেলেছে ছিন্নভিন্ন।

সূত্র : জেনারেল জিয়ার  রাজত্ব  – অধ্যাপক আবু সাইদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!