You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধের হৃদপিন্ডে ছুরি

১. বাংলাদেশ সংবিধান হঠাৎ করে রচিত হয়নি। পাকিস্তানী শাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে সমগ্র বাঙালী জাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে সংগ্রাম করেছে। লড়াই করেছে। সেই সংগ্রাম ও লড়াইয়ের মধ্য হতে জাতীয় আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানী বা মুসলিম জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাঙালী জাতীয়তাবাদ, সামরিক স্বৈরাচারের বিপরীতে গণতন্ত্র, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং শোষণ মুক্তির লক্ষ্যে সমাজতন্ত্র তথা শােষণমুক্ত সমাজ কায়েমের লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সমগ্র বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। এই সকল মহান লক্ষ্য ও আদর্শকে সামনে রেখেই বাঙালী জাতি সগ্রাম করেছে, যুদ্ধ করেছে, লক্ষ লক্ষ বাঙালী শহীদ হয়েছেন এবং দেশ স্বাধীন করেছে।১

২. দেশ স্বাধীন হবার পরপরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ও নেতৃত্বে বাঙালী জাতির এই আকাঙক্ষা ও জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি রূপে’ ১৯৭২ সনের ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হয়। এই সংবিধান স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধে মূল্যবােধের উপর ভিত্তি করে রচিত।২

৩. ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সামরিক ফরমানে সংবিধানের মৌলিক আদর্শগত পরিবর্তন আনা হয়। মূলতঃ স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধকে হত্যা করা হয়।

৪. বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র ছিলাে মুক্তিযুদ্ধের নির্যাস ও লক্ষ লক্ষ শহীদদের আত্মত্যাগের কাঙ্খিত দলিল। জিয়াউর রহমান স্বীয় স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ ও চেতনার উপর ভিত্তি করে রচিত শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে প্রকৃত প্রস্তাবে মুক্তিযুদ্ধর হৃৎপিন্ডে ছুরি চালিয়ে দেন। জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান বলে রাজনৈতিক দলগুলােকে ঘরে বন্দী করে, ৬২ হাজার নেতা-কর্মীকে কারাগারে আটক করে জনমতকে বুটের তলায় চেপে ধরে ‘জনগণের অভিপ্রায়কে সঙ্গীণে বিদ্ধ করে সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করে বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানী আদর্শে ফিরিয়ে নেন।

(ক) সংবিধানের প্রস্তাবনার শীর্ষে (পরম দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে)’ এই কথাগুলাে যুক্ত করেন।

(খ) প্রস্তাবনার অংশে যেখানে উল্লেখিত ছিল “জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে”- সেই স্থানে “জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা হয়। বাঙালী জাতি শুধুমাত্র নয় মাসে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেনি। হাজার বছরের মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় ছিলাে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ। বাঙালী জাতির সেই হাজার বছরের সংগ্রাম, অগণিত মানুষের আত্মদান ও রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে জিয়াউর রহমান শুধু মাত্র বাঙালীর জাতির সংগ্রামকে নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত করে বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসকে যেমন নাকচ করেছেন, তেমনি লাখাে শহীদদের প্রতি করেছেন অবমাননা। গ.সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদ – যেখানে লেখা ছিল বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালী বলিয়া পরিচিত হইবেন’ স্থলে “বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিতি হইবেন” যােগ করা হলাে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের বন্ধনকে ছিন্ন করা হলাে।

(ঘ) সামরিক ফরমানে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় মুছে ফেলা হলাে। ৯ম অনুচ্ছেদ যেখানে বলা হয়েছিল “ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্ত্বাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।” এই নবম অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে সেখানে প্রতিস্থাপন করা হলাে “স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান সমুহের উন্নয়ন”। কোথায় জাতি স্বত্ত্বা আর আত্মপরিচয়ের বিশাল গৌরবমন্ডিত ঐতিহাসিক ভিত্তি আর কোথায় স্থানীয় শাসনের কথা,-ভাবতে অবাক ও বিস্মিত হতে হয়! ঙ.সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করা হলাে। যে ১২ অনুচ্ছেদ ছিলাে স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধের অন্যতম মূলভিত্তি। পাকিস্তান আমলে সামরিক স্বৈরাচারী শাসক ও শােষক গােষ্ঠী পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন করেছে। সমাজ প্রগতির ধারাকে রুদ্ধ করতে চেয়েছে। সম্প্রদায়গত হানাহানি লাগিয়ে, দাঙ্গা বাধিয়ে, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, খুন ধর্ষণ হত্যা লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ করে মানবিকতাকে করেছে

ভূলুণ্ঠিত। স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করতে না পারে সেই লক্ষ্যে সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য )

ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা,

খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান,

গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে অপব্যবহার,

ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ণ বিলােপ করা হইবে”-এই অনুচ্ছেদ রহিত করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের হীন স্বার্থে জিয়াউর রহমান সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদ তুলে দিয়েছেন। সংবিধানের ৩৮ নং অনুচ্ছেদের “তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা ৷ লক্ষ্যানুসারী কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা। লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্ম ভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোন প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশ গ্রহণ করিবার কোন অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবেনা।” অর্থাৎ ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করার অপপ্রয়াসে পবিত্র ধর্মকে হীনস্বার্থে ব্যবহারের জন্য কোন রাজনৈতিক দল গঠন করা যাবে না। জিয়াউর রহমান এই অনুচ্ছেদ শর্তটুকু বিলুপ্ত করেছেন। একই সাথে স্বাধীনতা বিরােধী সাম্প্রদায়িক দল জামাত ইসলাম, শিবির, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী ইত্যাদি দলকে রাজনীতি করার সুযােগ করে দেন, মওলানা রহিম, শাহ আজিজ, সবুর খান, আলিম, মতিন, শামসুল হুদা, মওলানা মান্নান স্বাধীনতা বিরােধী। ব্যক্তিদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যে। সংবিধানে শুধুমাত্র ১২নং অনুচ্ছেদে সংযােজন করেই বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত ছিলেন না। যদিও সাধারণ ক্ষমার আওতায় অনেকেই জেল হতে বেরিয়ে এসেছিলাে, তবুও তাদের রাজনীতি করার অধিকার ছিলাে না। সংবিধানের ৬৬নং লিপিবদ্ধ হয়েছিলাে-সংসদে নির্বাচিত হবার যােগ্যতা ও অযােগ্যতা সম্পর্কে। উক্ত অনুচ্ছেদে পরিস্কারভাবে বলা হয়েছিলাে “কোন ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যােগ্য হইবেন না, যদি (গ) তিনি কোন বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা বা স্বীকার করেন;

(ঙ) তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশে যােগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীনে যে কোন অপরাধের জন্য দন্ডিত হইয়া থাকেন; একই সাথে সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদে ভােটার তালিকায় নামভুক্তির যােগ্যতার ক্ষেত্রে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল, (ঙ) তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যােগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীনে কোন অপরাধের জন্য দন্ডিত না হইয়া থাকে। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ভােটার তালিকা আদেশ (পি. ও নং ১০৪) এবং বাংলাদেশ যোগসাজশকারী আদেশকে (পি ও নং ৮) চতুর্থ তফসিলে সাংবিধানিকভাবে প্রটেকশন দেয়া হয়েছিলাে। ৬. মূলতঃ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে স্বাধীনতা বিরােধী ব্যক্তি ও দালালদের সর্বস্তরে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এক সামরিক ফরমান বলে ১৯৭৫ সনের ৭ই নভেম্বর বিচারপতি আবু সাদাত মােহম্মদ সায়েম একাধারে গণপ্রজতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে অধিষ্ঠিত হন। জিয়াউর রহমান প্রধান সেনাপতি এবং উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা এবং বাস্তবায়ন ক্ষেত্রে জেনারেল জিয়াউর রহমান নানাবিধ কৌশলে ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন।

৭. জেনারেল জিয়াউর রহমান পরিস্কার বুঝতে পেরেছিলেন তার বহু কাঙিক্ষত। প্রেসিডেন্ট পদটি করায়ত্ত করতে তিনি আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির – ও দলগুলাের নিকট হতে তেমন সহায়তা পাবেন না। সেজন্য তাকে বিকল্প শক্তির দিকে ঝুঁকতে হবে। এবং তাদের নিয়েই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে এগিয়ে যেতে হবে।

৮. স্বাধীনতা বিরােধী প্রতিক্রিয়াশীলদের সংখ্যাশক্তি যাচাই করার লক্ষ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমান তদানীন্তন এয়ার ভাইস মার্শাল এম, জি, তাওয়াবকে সক্রিয় করে। তােলেন। এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াব স্বাধীনতা বিরােধী জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ এবং দক্ষিণপন্থী দল ও গ্রুপগুলােকে একত্রিত করে একটি শক্তি মহড়ার ব্যবস্থা করেন সিরাতুন্নবী দিবসকে সামনে রেখে। সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে সপ্তাহব্যাপী সিরাত মজলিশে এয়ার ভাইস মার্শালের বক্তৃতা দেবার সময় শ্লোগান ওঠে “তাওয়াব ভাই তাওয়াব ভাই, চঁাদ তারা মার্কা পতাকা চাই।” জামাত, মুসলিম লীগ ও দক্ষিণপন্থী দলগুলাে এই সিরাত মজলিশে তাদের শক্তি সংখ্যা প্রদর্শন করতে সমর্থ হয়।৪

সমাজ বিপ্লবের ধারক বলে দাবীদার এবং ৭ই নভেম্বর ঢাকার সেনা ছাউনির বন্দীদশা হতে উদ্ধারকারী কর্ণেল (অবঃ) তাহের এবং জাসদ নেতৃবৃন্দকে ‘পাওয়ার কনটেষ্টে’-এ মাঠ থেকে বের করে দেবার এবং তাদের আচ্ছামত শাস্তি বিধানের নিমিত্তে জিয়া এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াবকে দিয়ে ডানদের দ্বারা ‘বামদের’ ঠেকানাের কৌশল গ্রহণ করেন। কর্ণেল তাহেরকে ফাসি ও জাসদ নেতৃবৃন্দকে কারান্তরালে পাঠানাের প্রেক্ষাপটে তিনি কিছুদিনের মধ্যে তাওয়াবকেও দেশ থেকে বের করে দেন স্বাধীনতা বিরােধীদের স্বীয় কবজায় আনার লক্ষ্যে।

৯. এতসব খেলায় ‘ধুরন্ধর’ রাজনীতিবীদগণের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, ক্ষমতার রশি আসলে প্রেসিডেন্ট সায়েমের হাতে নেই-ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে দাড়িয়ে আছেন জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং ক্ষমতার লাটাই তার হাতেই। সেজন্য সুবিধাবদী রাজনীতিবিদ যারা স্বাধীনতার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দালাল নামে। আখ্যায়িত হয়ে কারাগারে ছিলেন এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিলেন, তারা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে বঙ্গভবনের দিকে আগ্রহ প্রত্যাহার করে সেনাছাউনির দিকে ছুটতে থাকেন। বঙ্গভবনে বসে বিচারপতি সায়েম যিনি যথার্থভাবেই মনে করেছিলেন সামনের শীতে (৭৭ সনে) দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন দিতে সক্ষম হবেন যেহেতু জাতির নিকট এ বিষয়ে তিনি ওয়াদাবদ্ধ; তিনি অচিরেই দেখতে পেলেন যে, আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্যান্য রাজনীতিবিদগণ সেনাছাউনিতে দৌড়াচ্ছেন।” প্রধান সেনাপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান আসন্ন নির্বাচন বানচাল করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন একথা সম্ভবতঃ বিচারপতি সায়েম দৃষ্টিগ্রাহ্য হলেও তার কিছু করার ছিলাে না। তিনি ছিলেন কেবলমাত্র ঘটনার সাক্ষী, জ্যান্ত  পুতুল মাত্র।

১০. বিচারপতি সায়েমের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে তাকে সামনে রেখেই জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সনের মে মাসে তুরস্কে অনুষ্ঠিত ৪২ জাতি ইসলামিক কনফারেন্সে যােগদান করেন। তুরস্কে গিয়ে তিনি রাজনীতি করার যে আকাঙক্ষা এবং ক্ষমতার শীর্ষস্থান দখল করার যে অদম্য অথচ সুপ্ত বাসনা দীর্ঘদিন লালন করে আসছিলেন তার বাস্তবায়নের পথ খুঁজে পান। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলাে তাকে বাংলাদেশকে “ইসলামীকরণের’ পরামর্শ দেন এবং এ ব্যাপারে যাবতীয় সাহায্য সহযােগিতা করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরােধী দলগুলাের সমর্থন তার পক্ষে আদায় করে দেবার বিষয়ে তাকে আশ্বস্ত করা হয়। ঐ একই সময়ে তিনি বালাদেশ মুসলিম লীগের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে পাকিস্তান গমন করেন, বাণিজ্যক চুক্তি করেন এবং এ বিষয়ে পাকিস্তান থেকে তাকে সমর্থন দানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এই লক্ষ্যে তিনি সামরিক ফরমান বলে দালাল আইন বাতিল করেন।

কোলাবােরেটর্স আদেশ বাতিল

১১. জেনারেল জিয়ার অব্যাহত চাপে এবং জাতীয় ঐক্যের’ যুক্তিতে পরাস্ত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি জনাব সায়েম এক অর্ডিন্যান্স জারী করে ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ কোলাবােরেটর্স (বিশেষ ট্রাইবুন্যাল) আদেশটি (১৯৭২ সালের ৮ সম্বর প্রেসিডেন্ট আদেশ) বাতিল করে দেন। বাসস পরিবেশিত এক খবরে প্রকাশ, ১৯৭৫ সালের বাংলাদেশ কোলাবােরেটর্স। (বিশেষ ট্রাইবুন্যাল) (বাতিল) অর্ডিন্যান্স নামে অভিহিত এই অর্ডিন্যান্সেটিতে বলা হয়েছে যে, উক্ত আদেশটি বাতিল হওয়ায় কোন ট্রাইব্যুনাল, ম্যাজিষ্ট্রেট বা আদালত সমীপে এই আদেশ বাতিলের অব্যাবহিত পূর্বে মুলতবী থাকা সমস্ত বিচারকার্য বা অন্যান্য মামলা এবং উক্ত আদেশ বলে কোন পুলিশ অফিসার বা অপর কোন কর্তৃপক্ষ দ্বারা বা সমীপে পরিচালিত সমস্ত তদন্ত কার্য বা অন্যান্য মামলা বাতিল হয়ে যাবে এবং সেগুলি আর চালানাে হবে না। এতে উক্ত আদেশ বলে কোন ট্রাইব্যুনাল, ম্যাজিষ্ট্রেট কিংবা আদালত কর্তৃক প্রদত্ত কোন দণ্ড বা সাজার বিরুদ্ধে দায়েকৃত কোন আপীল ব্যাহত হবে না বলে। অর্ডিন্যান্সটিতে উল্লেখ করা হয়। অর্ডিন্যান্সটিতে আরও বলা হয় আদেশটি বাতিল হওয়ায় মুলতবী থাকা বিচার, তদন্ত ও অন্যান্য মামলা রদ হওয়া ছাড়া ১৮৯০ সালের সাধারণ উপধারা আইন “(১৮৯৭ সালের দশম আইন) এ ৬ নম্বর ধারার প্রয়ােগও ব্যাহত হবে না।”

১২. জিয়াউর রহমানের নিজস্ব পর্যালােচনায় এ বিষয়টিও বেরিয়ে এসেছিলাে যে, শুধুমাত্র জামাত-মুসলিম লীগের সমর্থন নিলে তার মুখে শুধু কলংক লেপনই হবে -মুক্তিযােদ্ধার বাহিরাবরণ যা তিনি ধারণ করে আসল চেহারা আড়ল করে রেখেছেন তাও খসে পড়বে। এতে জনগণ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে দেখা দেবে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া। সেজন্য তার প্রয়ােজন ছিলাে চীনপন্থীদের সমর্থন আদায়।। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চীনপন্থীরা ছিলাে কোণঠাসা, রাষ্ট্রক্ষমতা হতে বহু দূরে। অন্তর্কলহে ছিন্নভিন্ন চীনপন্থীদের সংগঠিত করার বয়স ও ক্ষমতা মাওলানা ভাসানীর ছিলাে না। চীনপন্থীদের এক বিরাট অংশ স্বাধীনতা বিরােধী ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলাে- কেননা চীন বালাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি’ হিসেবে গণ্য করেছিলাে। স্বাধীনতার পর এদেশীয় চীন অনুসৃত রাজনীতিবিদদের অবস্থান সুখপ্রদ ছিলাে না, সাংগঠনিক বা রাজনীতি ক্ষেত্রে। জিয়াউর রহমান জামাত-মুসলিম লীগের সমর্থন আদর করার পর বিপ্লবী চীনা নেতাদের দিকে হাত বাড়ালেন। এই লক্ষ্যকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সনে জানুয়ারীতে চীন সফর করেন। এভাবে জিয়াউর রহমান উগ্র ডান এবং উগ্র বামদের এক মেরুতে দাঁড় করাতে ‘জাতীয় ঐক্যের’ শ্লোগান দিতে ভুল করেন নি। পরিস্থিতির উর্বর সময়ে ২১শে এপ্রিল ১৯৭৭ সনে সামরিক ফরমান বলে প্রেসিডেন্ট পদটি বিচারপতি সায়েমের নিকট হতে কেড়ে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি-যদিও ইতিপূর্বে ১৯৭৬ সনের ২৯শে নভেম্বর তিনি সামরিক প্রশাসকের পদটি দখল করতে ভুল করেন নি।

১৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ বিশেষ করে সৌদি আরব, তুরস্ক, জর্দান, সুদান, সংযুক্ত আমির আমিরাত দেশগুলাের পক্ষ হতে পূর্ণ সাহায্য ও সহযােগিতা প্রাপ্তির লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান সংবিধান হতে ধর্মনিরপেক্ষতার বিধানাবলী ১২ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে পাকিস্তানী ধারার শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে দাঁড় করালেন এবং একই সাথে ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করার অধিকার সম্বলিত ফরমান জারী করলেন এবং সংবিধানের ৩৮নং ধারার শর্তসমূহ বাতিল করলেন।

১৪. ১৯৭৬ সনের ২৮ শে জুলাই রাজনৈতিক দল বিধি নিয়ন্ত্রণ (পি,পি,আর) জারী করেন। অনুমােদনপ্রাপ্ত ২২টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ধর্মীয় দলগুলাের ৬টিকে নিয়ে গঠিত আই ডি এল কে রাজনীতি করার অনুমতি দেন। বাংলাদেশে পুনরায় ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করার দরজা খুলে দেয়া হয়। অনুমতি প্রদান করলে এই দলগুলাে একযােগে ১৯৭৭ সনের ৩০শে মে অনুষ্ঠিত হাঁ না ভােটে জিয়াউর রহমানকে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ্য সমর্থন দান করেন। শুরু হয় জামাত-মুসলিম লীগ, ঘাতক দালালদের ব্যাপক পুনর্বাসন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে। শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকার অভিলাষে ক্ষমতার দাপটে সামরিক শাসনের আওতায় জনগণকে বুটের তলায় রেখে স্বাধীনতা বিরােধীদের ক্ষমতায় অংশীদারিত্বে আনার ক্ষেত্র ‘মুক্তিযােদ্ধা’ প্রস্তুতে জিয়াউর রহমান ইতিহাসে ‘ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখিত হবেন সন্দেহ নেই।

১৫. জিয়াউর রহমান মুক্তিযােদ্ধাদের পােশাকে মন্ত্রী সভায় স্বাধীনতা বিরােধীদের নেতৃস্থানীয় শাহ আজিজুর রহমান, মশিউর রহমান, মীর্জা গােলাম হাফিজ, শামসুল হুদা চৌধুরী, শফিউল আযম এবং আবদুল আলীমের মতাে ব্যক্তিবর্গকে নিতে সাহসী হয়েছিলেন। এমন কি স্বাধীনতার সরাসরি বিরােধকিারী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন।

১৬. বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক যে সমস্ত স্বাধীনতা বিরােধী নেতৃবৃন্দের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিলাে জিয়া স্বাধীনতা বিরােধী সেই সকল ব্যক্তিদের নাগরিত্ব ফিরিয়ে দেবার জন্য ১৯৭৮ সনের ১১ই ফেব্রুয়ারী নাগরিকত্ব আইনের সংশােধনী আনয়ন করেন। স্বাধীনতা বিরােধীদের রাজনৈতিকভাবে, সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হচ্ছিলেন। ১৯৭৮ সালের ১৮ই জানুয়ারী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এক প্রেসনােটের প্রেক্ষিতে অধ্যাপক গােলাম আজমও তার নাগরিকত্ব ফিরে পাবার আবেদন জানালে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা বিরােধী ঘৃণ্য কার্যক্রমে অধ্যাপক গােলাম আজমের স্থূপীকৃত ফাইলের হাত দিতে সাহসী হন নি। ১৯৭৮ সনে ১১ জুলাই অসুস্থ মাতাকে দেখার জন্য পাকিস্তানী নাগরিক হিসেবে পাকিস্তানের পাসপাের্টে তিন মাসের ভিসা নিয়ে গােলাম আজম বাংলাদেশে আসেন এবং বালাদেশে এখন পর্যন্ত অবস্থান করছেন।

১৭. এমনিভাবে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে স্বাধীনতা বিরােধীদের পুনর্বাসন করেন। স্বীয় ক্ষমতাকে স্থায়ী করার স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের দলিল শাসনতান্ত্রিক বিধানকে হেঁটে ফেলেন। জিয়াউর রহমানকে ‘এ কাজটি করতে হয়েছিলাে তার পাওয়ার বেজ’ ঠিক রাখার স্বার্থে। কেননা, সামরিক বাহিনীর প্রায় পুরােটাই ছিলাে পাকিস্তানী মানসিকতায় আচ্ছন্ন। চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্চপদে তাদের বসিয়ে জিয়াউর রহমান ভেবেছিলেন তার ক্ষমতা চিরস্থায়ী কাঠামােয় দাড়িয়ে গেছে। সেজন্য মুক্তিযােদ্ধার ‘মুখােশে’ জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের হৃৎপিন্ডে শাণিত ছুরি বসিয়ে দিতে এতটুকু কুণ্ঠিত হননি।

সূত্র : জেনারেল জিয়ার  রাজত্ব  – অধ্যাপক আবু সাইদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!