অন্তত লাশটা দাও রাসেল-এর রক্তে জিয়ার হাত
১. জাতির জনক ও নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও জিয়াউর রহমান জড়িত ছিলেন।১ খুনীদের তিনি বলেছিলেন যে আমি এসব ব্যাপারে জড়াতে চাইনা। যদি তােমরা কিছু করতে চাও তাহলে এটা জুনিয়র অফিসারদেরই করা উচিত। ২
২. নির্বাচিত সরকার ও সংবিধানকে রক্ষা করার শপথ নিয়ে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। একটি আইনানুগ নির্বাচিত সরকার উৎখাত এবং প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর হত্যা চক্রান্তের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে যে কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান তা পালন করেননি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সংগে যােগসাজশ অব্যাহত রেখে সেনাবাহিনীর নিয়মরীতি ও আর্মি এ্যাক্টের ৩১ ধারা লংঘন করেন। এসব তথ্য থেকে নিশ্চিতভাবেই একটি কথা প্রমাণ হয় যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারবর্গ ও শিশুপুত্র রাসের-এর রক্তপ্রবাহে জিয়ার হাতের স্পর্শ ছিলাে।
খুনীদের অব্যাহতি ও বৈধতা দান
৩. জিয়াউর রহমান যে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
তার প্রমাণ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে ‘৭৯ সনের পার্লামেন্টে বৈধতা। এই অধ্যাদেশে ১৫ই আগস্টের খুনীদের অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। খােন্দকার মােশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করলেও-এর কোন আইনগত ভিত্তি ছিলােনা। কেননা, খন্দকার মােশতাক সামরিক আইন প্রশাসক ছিলাে না কিংবা সংবিধানসম্মত বৈধ। রাষ্ট্রপতিও ছিলাে না। সংবিধান বহাল ছিলাে। সংবিধানে রাষ্ট্রপতির এ ধরনের কোন আইন জারীর ক্ষমতা নেই।
৪. এ কারণেই বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন তুলেছেন যে, মােশতাক সংবিধান বাতিল বা রহিত করেনি, জাতীয় সংসদও ভেংগে দেয়নি। এই অবস্থায় প্রধান সামরিক প্রশাসক না হয়েও সামরিক শাসনের আওতায় মােশতাক কিভাবে এই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করতে পারে?
৫. সংবিধান মতে উক্ত অধ্যাদেশটি ছিলাে অবৈধ ও মৃত। স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিলাে অধ্যাদেশটির।৬ জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে সামরিক শাসনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে জাতীয় সংসদ ‘তৈরী করেন’, সংবিধানের ৫ম সংশােধনী পাশ করে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সাংবিধানিকভাবে রক্ষা ও প্রটেকশন দেন।৭ জিয়াউর রহমান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের হত্যাকান্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকলে কি খুনীদের আশ্রয়দানের এই দায়িত্ব নিতেন?
৬. জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সনের ৮ই জুন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ১২জনকে কূটনৈতিক পদে নিয়ােগ দান করেন। এই খুনীদের নাম (১) লেঃ কর্ণেল শরিফুল হক ডালিম প্রথম সচিব (চীন), (২) লেঃ কর্ণেল আজিজ পাশা, প্রথম সচিব (আর্জেন্টিনা), (৩) মেজর মহিউদ্দিন, দ্বিতীয় সচিব (আলজেরিয়া), (৪) মেজর শারিয়ার, দ্বিতীয় সচিব (ইন্দোনেশিয়া), (৫) মেজর বজলুল হুদা, দ্বিতীয় সচিব (পাকিস্তান), (৬) মেজর। রশীদ চৌধুরী, দ্বিতীয় সচিব (সৌদী আরব), (৭) মেজর নূর, দ্বিতীয় সচিব (ইরান), (৮) মেজর শরিফুল হােসেন, দ্বিতীয় সচিব (কুয়েত), (৯) ক্যাপ্টেন কিসমত হােসেন, তৃতীয় সচিব (আবুধাবী) (১০) লেঃ খায়রুজ্জামান,তৃতীয় সচিব (মিসর), (১১) লেঃ নজমুল হােসেন, তৃতীয় সচিব (ক্যানাডা), (১২) লেঃ আবদুল মজিদ, তৃতীয় সচিব (সেনেগল)।
৭. শুধু তাই নয়, বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব শূণ্য করার জন্য ১৯৭৫ সনে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম, মনসুর আলী ও এ, এইচ, এম, কামারুজ্জামানকে ঢাকা কারাভ্যন্তরে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সনে হত্যাকান্ডের জন্য গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটিকে জিয়াউর রহমান কাজ করার সুযােগ দেন। এমন কি লালবাগ থানায় হত্যাকান্ডের জিডি গায়েব করা
৮. জেল হত্যাকান্ডে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাজ জিয়াউর রহমান বন্ধ করে দেন। জেল হত্যাকান্ডের উপর তৎকালীন ডি আই জি, এ কে আউয়াল লালবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করেছিলেন এবং ৬ই নভেম্বর ‘৭৫ এই হত্যাকান্ডের তদন্তে তিন সদস্যের একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিলাে। জিয়াউর রহমান এ তদন্ত কমিটি বাতিল ও মামলাটি সি আই ডির নিকট হস্তান্তরের নির্দেশ দেন। এমনকি, লন্ডনভিত্তিক বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড তদন্ত। সদস্যদের দেশে ঢুকতে দেননি। সেই থেকে আজও তা ডার্ক রুমে ফেলে রাখা হয়েছে। ১০
৯. প্রহসনমূলক গনভােট দেশ ও জাতিকে স্তম্ভিত করলাে। সামরিক বাহিনীর উচ্চাভিলাষী অফিসার ও সিপাইগণও জিয়াউর রহমানের প্রহসনমূলক ফাঁকিবাজি ধরে ফেলেন। শুরু হলাে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। জিয়ার আমলে ১৯টি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে।১১ জিয়া নির্মমভাবে হাজার হাজার সেনা সদস্যদের হত্যা করেন।
১০. ৭ই নভেম্বর সিপাহী বিদ্রোহের আসামান্য সাফল্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী অফিসারদের ও জোয়ানদের মধ্যে প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষা। জাগরূক করে। জওয়ানরা ভাবতে থাকে তারাই দেশের হর্তা-কর্তা। জিয়াউর রহমান নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য সেপাইদের অস্কারা দিতে থাকেন। ৭ই নভেম্বর ‘৭৫ সনে ‘সিপাহী-জনতা ভাই ভাই’ শ্লোগান দিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াকে তারা প্রধান সেনাপতি পদে পুনঃঅধিষ্ঠত করেছে এই ভেবে যে, জিয়া তাদের সঙ্গে যে চুক্তি করেছেন ক্ষমতায় থেকে জিয়া তা পালন করবেন। কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের ও তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জিয়াউর রহমানকে বন্দী হতে মুক্ত করেন। তাদের দাবী অনুসারে জিয়াউর রহমান ১২-দফা দাবীতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন।১২
১১. কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলাে এই যে, ৭ই নভেম্বর কর্ণেল (অঃ) আবু তাহেরের নেতৃত্বে জিয়া মুক্ত হওয়ার পর পরবর্তীতে কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরকে বিচারের যে অভিযােগপত্র তৈরী করা হয়, তার মধ্যে বিশেষভাবে অভিযোেগ ছিলাে ৭ই নভেম্বর কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের সৈনিকদের উস্কানী দিয়েছে, তাদের মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করেছে এবং হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। ১৩।
১২. কর্ণেল (অঃ) আবু তাহেরকে ফাঁসি দেবার ফলে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার। সেপাইগণের নিকট একটি কথাই পরিস্কার হয়ে ওঠে যে, জিয়াউর রহমান একজন বিশ্বাসঘাতক। জিয়া কর্তৃক ১২-দফা স্বাক্ষরিত হওয়ার পর জিয়া এইসব দাবীর মধ্যে সামান্য বেতন বৃদ্ধি ও ব্যাটম্যানশীপ বাতিল করেন। অন্য সব দাবী জিয়া সতর্কভাবে এড়িয়ে যান।
১৩. বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য ও বাইরে তাদের সমর্থকগণ সুযােগ খুঁজতে থাকেন। কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরের অনুগত ও সমর্থকবৃন্দ বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকে সামনে রেখে।। কিন্তু জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা বিরােধীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে প্রতিষ্ঠার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং শশাষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তােলার পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাবেদার হয়ে পড়ে এবং নিষিদ্ধ ঘােষিত সাম্প্রদায়িক দলগুলিকে রাজনীতি করার সুযােগ প্রদান করেন। গণবিরােধী ডান পন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ও কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তির সঙ্গে আতাত করেন। এ সবই ছিলাে ৭ই নভেম্বর অংশগ্রহণকারী সৈনিক সংস্থার চেতনার পরিপন্থী। ১৪
১৪. জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে রক্ষীবাহিনীকে একীভূত করার পর আইন-শৃংখলা বজায় রাখার স্বার্থে অনুরূপ এক বাহিনী গঠন করেন। স্পেশাল আমর্ড ফোর্স গঠন তাহের অনুগত সৈনিকবৃন্দ সুনজর দেখেননি। তাদের সংখ্যা ১২,৫০০ উন্নীত করা হয়। সয়ংক্রিয় অস্ত্র সরবরাহ, ভালাে পােশাক ও নতুন গাড়ী দেয়া হয়। বেতন ভাতাও ছিলাে আকর্ষণীয়। ১৫
১৫. ১৯৭৮-র অক্টোবরে আর্মি ফিল্ড সিগন্যাল ব্যাটালিয়ান সৈন্যরা এক বিদ্রোহের আয়ােজন করে। তার সঙ্গে কুর্মিটোলার এয়ার বেজ থেকে কয়েক শত ইয়ারম্যান এসে তাদের সঙ্গে যােগ দেয়। রাত পৌনে তিনটায় ৭০০ আর্মি ও ২৫ ট্রাক ভর্তি বিমান সদস্য কেন্দ্রীয় অর্ডিন্যান্স ডিপাে থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ হস্তগত করে। সকাল ৫টায় তারা রেডিও স্টেশন দখল করে বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘােষণা দেয়। তারা হাজার হাজার লিফলেট বিতরণ করে, সৈন্যদের বিদ্রোহে যােগ দিতে আহবান জানায়। ৭ই নভেম্বরে জিয়ার নামে তারা ছিল উন্মাদ, কিন্তু এবার তাকেই তারা বিশ্বাসঘাতক আখ্যায়িত করে তার শাসনের অবসান চায়। ৭ই নভেম্বরের মতাে তারা রাস্তায় শ্লোগান দেয় ‘সিপাহী জনতা ভাই ভাই’।
১৬. কিন্তু তাদের বিদ্রোহ পূর্ণতা লাভ করার পূর্বেই সি জি এস-এর দায়িত্বে নিয়ােজিত মেজর জেনারেল মঞ্জুর নির্দেশে নবম ডিভিশনকে বাইপাস করে ঢাকা বিগ্রেড কমান্ডার লেঃ কর্ণেল আমিন আহমদকে এই বিদ্রোহ দমনের ও জিয়াকে রক্ষা করার নির্দেশ দেয়া হয়। বিদ্রোহদের সঙ্গে ঢাকা বিগ্রেডের সংঘর্ষ ঘটে। ক্যান্টমেন্টে অবস্থানরত জিয়াকে বিদ্রোহীরা খুঁজে না পাওয়ায় অল্পের জন্য জিয়া বেচে যান। ইতিমধ্যে নবম ডিভিশন এগিয়ে আসে এবং বিদ্রোহ দমন করে।
বিদ্রোহীরা বিমান বাহিনীর কতিপয় অফিসারকে হত্যা করে। ১৬
১৭. বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করার পর জিয়াউর রহমান কঠোর মনােভাব গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে সন্দেহভাজন সদস্য ও অফিসারদের এবং বিমান বাহিনীর সদস্যদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। এ ব্যাপারে এ্যান্থনী মাসকার্ণহাস লিখেছেন” জেনারেল জিয়া এই অভ্যুথানের সঙ্গে জড়িত সৈনিক আর এয়ারম্যান দের উপর ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য প্রতিশােধ নিয়ে তাঁর মনে প্রজ্জলিত প্রতিহিংসার আগুন নির্বাপিত করেন। সরকারী হিসেব মত তিনি ১৯৭৭ সালের ৯ই অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র দু’মাসের মধ্যে ১১৪৩ (এগারশত তেতাল্লিশ) জন সৈনিককে ফাঁসির দড়িতে লটকিয়ে খুন করেন। তাছাড়া বহুশত সৈনিককে তিনি দশ বছর থেকে যাবজ্জীন পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করে জেলে পাঠিয়ে দেন। আইনগত পদ্ধতি আর ন্যায় বিচারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে অত্যন্ত তড়িঘড়ি করে এ শাস্তির কাজ সমাপন করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় পৈশাচিক সাজার আর কোন নজির নেই। তিন/চার জনকে একবারে বিচারের জন্যে ডেকে ফাসির দন্ডাদেশ দেয়া হতাে। জেনারেল জিয়া বসে বসে সেগুলাে অনুমােদন করতেন এবং তাঁর পরপরই তাদেরকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হতাে। উল্লেখিত পদ্ধতির সকল কাজই মাত্র ৪৮ ঘন্টা সময়ের সম্পন্ন করা হতাে। তাঁর সহযােগীদের একজন আমাকে জানিয়েছিলাে, জেনারেল জিয়া, প্রেসিডেন্ট আর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দ্বৈত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে তাঁর নিজের হাতে লিখে ঐ সকল হতভাগা সৈনিকদের দন্ডাদেশ অনুমােদন করতেন। বেসামরিক বন্দীরা স্মৃতিচারণ করে বলে, কয়েক সপ্তাহ ধরে জেল খানার রাতগুলাে সৈনিকদের আর্তচীৎকারে বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিলাে। তাদেরকে ফাঁসির মঞ্চে ঠেলে নিয়ে যাবার সময় তারা নির্দোষ বলে বুকফাঁটা চিকার ভেঙ্গে পড়তাে। এই সকল হত্যালীলার জন্যে বিমান বাহিনী বা সেনা বাহিনীর কোন প্রতিষ্ঠিত আইন কানুনকে মেনে চলা হয়নি।
বিধি মােতাবেক, শাস্তির সময়ে কেবল জেনারেল কোর্ট মার্শাল মৃত্যুর দন্ডাদেশ প্রদান করতে পারে। জেনারেল কোর্ট মার্শালে কমপক্ষে পাঁচজন মিলিটারী জজ থাকে। এদের মধ্যে একজনকে অন্ততঃপক্ষে লেঃ কর্ণেল হতে হবে এবং বাকী চারজনের কেউই ক্যাপ্টেনের নীচে হতে পারবে না। এবং কমিশন প্রাপ্তির পর ক্যাপ্টেনদেরকে কমপক্ষে তিনবছর . চাকুরী সম্পন্ন করতে হবে। অভিযুক্তদেরকে তাদের আত্মপক্ষ অবলম্বনের জন্যে পর্যাপ্ত সুযােগ দিতে হবে, জেনারেল জিয়া দেখলেন যে এই সকল নিয়ম কানুন তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের পথে বিরাট অন্তরায়। সেজন্যে একটি মার্শাল ল’ অর্ডার’ ঘােষণা করলেন। ঐ ঘােষণায় বিশেষ আদালতের নামে এমন কোর্ট তিনি সৃষ্টি করলেন, যেগুলােতে বিচারের জন্যে একজন লেঃ কর্ণেলের সঙ্গে হাবিলদার ও তার কাছাকাছি পদমর্যাদার লােকেরা বসূতে পারতাে। দ্রুতগতিতে মামলার কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে এভাবেই ব্যবস্থা গৃহীত হলাে। এই উপমহাদেশের কোথাও এধরনের ঘটনা ঘটানাে হয়েছে বলে নজির নেই। এক কলমের খোঁচায় জেনারেল জিয়া রাতারাতি দুই ডজনেরও বেশী এই ধরনের কোর্ট সৃষ্টি করলেন। ন্যায় বিচারের কোন প্রশ্নই সেখানে উঠতে পারে না। বিচারকের লাইসেন্স নিয়ে সৈনিকদেরকে খুন করা হয়েছিলাে মাত্র। এমন একটি কোর্টের উদাহরণ নিম্নে বর্ণিত হলাে। ঐ টির নাম মার্শাল ল ট্রাইবুনাল নং-১৮, ঢাকা। কেস নং ১/১৯৭৭, তাং-৮ই অক্টোবর, ১৯৭৭ সাল।
সংশ্লিষ্ট জজদের নাম
১। লেঃ কর্ণেল কাজী সলিমুদ্দিন মােঃ শাহারিয়ার,
২। সুবেদার মােঃ আবদুল হালিম,
৩। নায়েক সুবেদার আবদুল হাকিম,
৪। হাবিলদার আনােয়ার হােসেন,
৫। হাবিলদার এম, এফ, আহমেদ, ১৯৭৭ সালের ১লা/২রা অক্টোবর রাতে বিদ্রোহের অভিযােগে অভিযুক্তরা ছিলােঃ
১। ৬২৭৮০২৮ নায়েক এনামুল হক।
২। ৬২৮৪৫৪ সিগন্যাল কাজী সাইদ হােসেন
৩। ৬২৮১১৮৬ নায়েক আবদুল মন্নান
৪। ৬২৮৪৭৩৬ সিগন্যালার এস কে জাবেদ আলী।
তারা সবাই নিজেদেরকে নির্দোষ বলে প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু তার কোন উপায় ছিলাে না। তিনজন অভিযােগকারী, সুবেদার সিরাজুল ইসলাম, নায়েক আবুল বাসার এবং ল্যান্স নায়েক আবদুল আলী দৌড়ে এসে উপস্থিত হয়ে যায়। অভিযুক্তদের পক্ষে কোন সাক্ষী ইত্যাদি ছিলাে না। একজন সাক্ষী সাক্ষ্য দেয় যে, সে দোষী ব্যক্তিদেরকে অস্ত্রাগারে ঢুকে রাইফেল নিয়ে একটি আর্মির গাড়ীতে উঠে চলে যেতে দেখেছে। আর একজন অভিযুক্তদের ব্যারাকের বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি করতে দেখেছে। তাদের কেউ ‘বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে’ বলে চিৎকার করেছিলাে। অভিযুক্তদের একজন বলে সে ব্যারাকের সকলের শেষে ঘুম থেকে জেগে ছিলাে এবং সে সম্পূর্ণভাবে নিরপরাধ আর একজন অভিযুক্ত বলে যে, চীৎকার শুনতে পেয়ে অন্যান্যদের সঙ্গে অন্ত্রগার থেকে সেও রাইফেল হাতে নিয়েছিলাে। কিন্তু তারপরেই সে দেখতে পায় যে কোথাও কোনরকম যুদ্ধ বেধে যায় নিসুতরাং সে তার অধিনায়কের নির্দেশে পরে অস্ত্র জমা দিয়ে দেয়। এই সকল সাক্ষী প্রমাণ আর অভিযুক্তদের বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে বিশেষ সামরিক আদালত চারজনের সবাইকে দোষী বলে সর্বসম্মতিক্রমে রায় দেয় এবং মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রদান করে। পরদিন, ৯ই অক্টোবর, স্বয়ং জেনারেল জিয়া ঐ সব মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমােদন করে মন্তব্য দেনঃ “যতক্ষণপর্যন্ত ওরা না মরে’ ততক্ষণ পর্যন্ত ওদের গলায় ফাঁসি লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখাে।’ এই চারজন হতভাগ্যকে ১০ই অক্টোবর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা হরা হয়।
১৮. বিচারের নামে প্রহসন চলতে থাকে। বিদ্রোহীদের মরণ চিৎকারে কাৰাগারে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। সে সময় কারাগার হতে বেগম সুফিয়া কামালের উদ্দেশ্যে বিদ্রোহীরা একটি চিঠি লিখে পাঠায়।১৭ চিঠিটি এখানে উল্লেখ করা হলাে
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে নির্যাতিত সৈনিকবৃন্দের পক্ষ থেকে
কেন্দ্রীয় কারাগার
ঢাকা ২২-৮-৯-৮১
মা,
আপনি আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম গ্রহণ করুন। গতকল্য প্রকাশিত সংবাদ পত্রিকায় আপনার অতি মূল্যবান ও হৃদয়গ্রহী বিবৃতিখানা পড়ে আমরা খুবই প্রীত হয়েছি। বাংলাদেশের সকল মা ও বধূদের পক্ষ থেকে আপনি সদাশয় সরকারের কাছে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত অফিসারদের জীবন ভিক্ষা চেয়েছেন। আপনি স্নেহময়ী মায়ের যােগ্যতম কাজই করেছেন। আপনার এহেন গৌরবময় ভূমিকার জন্য আমরা সত্যই গর্বিত। জাতি আপনার ন্যায় মমতাময়ী বিদুষী মহিলা পেয়ে গর্ববােধ করবেই।
কিন্তু মা, আপনি কি জানেন ১৯৭৭ সালের ২রা অক্টোবরে ঢাকা সেনানিবাসে সংঘটিত দুঃখজনক ঘটনার প্রেক্ষিতে কতজন সৈনিককে ফাঁসির রজ্জতে প্রাণ দিতে হয়েছে? আপনি কি জানেন কত অভাগী মায়ের প্রাণপ্রিয় সন্তানকে ওরা বেয়নেট নিয়ে খুচিয়ে, গুলি করে, বৈদ্যুতিক শক দিয়ে, রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে? আপনি কি জানেন, কত শত সৈনিক এখনও যাবজ্জীবন কারাদন্ড মাথায় নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে দিনে দিনে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? আপনি কি জানেন মৃত ও জীবিত (বন্দী) সৈনিকদের পরিবারের সদস্যরা আজ পথের ভিখারী, পেটের জ্বালায় অনেকেই আজ ইজ্জত বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে?
মাগাে, আমরা এতই অসহায়-আমাদের কথা কেউ বলে না। আমাদের জীবনের মূল্য কারাে কাছে নেই। ‘৭৭-এর ঐ ঘটনার পর অনেককে দেখেছি মিছিল করে বলতে ‘ওদের ফাঁসি দাও’, কিন্তু আমরা কি অপরাধ করেছিলাম তা জানতে কেউ চাইল না। সত্যই কি সেদিন কেউ ক্ষমতা দখলের চেষ্টা বা জিয়াকে হত্যা করতে চেয়েছিল- তা’। কেউ চাইল না। না হয় তর্কের তিরে ধরেই নিলাম—আমরা জিয়াকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু এখন তাে জিয়াকে হত্যা করাই হয়ে গেল, হত্যাকারীদের বাঁচিয়ে রাখাটা যদি মানবতা হয়, তবে যারা হত্যা করতে চেয়েছিল কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে, তাদের মধ্যে থেকে ৪২৫ জনকে মৃত্যুদন্ড এবং ৩৫০ জনকে দীর্ঘমেয়াদী কারাদন্ড দেওয়া কোন মানবতা? মাগাে, আপনি কি ঐ সৈনিকদের বিধবা পত্নী ও এতিম শিশুদের কান্না শুনতে পান না? নিশ্চয় পান। আমরা দৃঢ় আশা পােষণ করি, আপনি এদের কথাও বলবেন। চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অভিযুক্তরা সকলেই অফিসার এবং তাঁরা সকরেই বড় ঘরের সন্তান। তাঁদের কথা আজ সকল মহল থেকে বলা হচ্ছে। তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। আমাদের সবিনয় আবেদন মাত্র এই, সেই সংগে আমাদের অসহায় পরিবারবর্গের কথাও যেন বলা হয়। আজ ৪ বছর জেল খেটে আমাদের আর কিছুই নেই। মানসিক দুশ্চিন্তায় এবং বিভিন্ন সময়ের কারা-নির্যাতনের ফলে আমাদের মধ্যে এমনও আছেন যাঁর ৫৫ বৎসর বয়স। ৮টা ছেলেমেয়ে রেখে এসেছেন। ঘরে এক মুষ্ঠি চাউল রেখে আসতে পারেন নি।
আমরা আপনার কাছে আবেদন করছি মা, আপনি এ সরকারকে জিজ্ঞাসা করুন, দীর্ঘ বৎসর কারা-যন্ত্রণা কি আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়? আমরা কি এতই সাংঘাতিক? যদি এতই সাংঘাতিক হয়ে থাকি তবে আমাদের একই মামলার আসামী ৩১নং বিশেষ সামরিক আদালতে প্রথমে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পরে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামী গাজী গােলাম মাওলা ও আমীর হােসেনকে ১০ বৎসর সাজা মাফ করে দিয়ে মুক্তি দেওয়া হল কি করে? ওদের প্রতি মানবতা দেখান হল। আমাদের প্রতি এমন বিমাতাসুলভ আচরণ কেন? একটা মিউটিনি মামলার সর্বোচ্চ সাজাপ্রাপ্ত দু’জনকে যদি ক্ষমা করা যায় তবে আমাদের বেলায় বাধা কোথায়, তা আমরা বুঝতে পারছি না। আমরা অবশ্য ঐ দু’ভদ্রলােকের ন্যায় মােটা অংকের টাকা খরচ করতে পারব না।
আপনি কবি, আপনি মা, আপনি আমাদের ন্যায় হতভাগ্যদের মনের যন্ত্রণা ভাল। করেই বুঝবেন ও মর্মস্পর্শী ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেন। আল্লাহ আপনাকে সেই তৌফিক দিয়েছেন। আমাদের কথা বলার জন্য, আমাদের মুক্তি দাবি করার জন্য আমরা বাংলাদেশের এমন কোন দল, সংগঠক ও ব্যক্তিত্বকে বাকী রাখিনি- বলতে পারবেন, আমরা তাঁদেরকে জানাইনি। কিন্তু কেউ আমাদের কথা বলেন না। বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে আমরা বর্তমানে প্রায় দেড়শত সৈনিক আছি, যাদের ৬০% জনের সাজা হল ২০ বৎসর, তারপর ১৫/১৪/১২/১০ বৎসর।
মাগাে, আপনি যার হাতে লিখা পড়ছেন, সেই হতভাগ্যের পিতা, পুত্রশােকে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত একবুক হতাশার জ্বালা নিয়ে পরকালে পাড়ি জমিয়েছেন গত ফেব্রুয়ারীতে। এবার নিশ্চয় আমাদের যন্ত্রণার গভীরতা অনুধাবন করতে পেরেছেন। অতএব, আপনাকে আর বিরক্ত করাটা সমীচীন মনে করি না।
মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রদান করে। পরদিন, ৯ই অক্টোবর, স্বয়ং জেনারেল জিয়া ঐ সব মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমােদন করে মন্তব্য দেনঃ “যতক্ষণপর্যন্ত ওরা না মরে’ ততক্ষণ পর্যন্ত ওদের গলায় ফাঁসি লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখাে।’ এই চারজন হতভাগ্যকে ১০ই।
অক্টোবর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা হরা হয়।
১৮. বিচারের নামে প্রহসন চলতে থাকে। বিদ্রোহীদের মরণ চিৎকারে কাৰাগারে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। সে সময় কারাগার হতে বেগম সুফিয়া কামালের উদ্দেশ্যে বিদ্রোহীরা একটি চিঠি লিখে পাঠায়।১৭ চিঠিটি এখানে উল্লেখ করা হলাে
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে নির্যাতিত সৈনিকবৃন্দের পক্ষ থেকে
কেন্দ্রীয় কারাগার
ঢাকা ২২-৮-৯-৮১ মা,
* আপনি আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম গ্রহণ করুন। গতকল্য প্রকাশিত সংবাদ পত্রিকায় আপনার অতি মূল্যবান ও হৃদয়গ্রহী বিবৃতিখানা পড়ে আমরা খুবই প্রীত হয়েছি। বাংলাদেশের সকল মা ও বধূদের পক্ষ থেকে আপনি সদাশয় সরকারের কাছে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত অফিসারদের জীবন ভিক্ষা চেয়েছেন। আপনি স্নেহময়ী মায়ের যােগ্যতম কাজই করেছেন। আপনার এহেন গৌরবময় ভূমিকার জন্য আমরা সত্যই গর্বিত। জাতি আপনার ন্যায় মমতাময়ী বিদুষী মহিলা পেয়ে গর্ববােধ করবেই।
কিন্তু মা, আপনি কি জানেন ১৯৭৭ সালের ২রা অক্টোবরে ঢাকা সেনানিবাসে সংঘটিত দুঃখজনক ঘটনার প্রেক্ষিতে কতজন সৈনিককে ফাঁসির রজ্জতে প্রাণ দিতে হয়েছে? আপনি কি জানেন কত অভাগী মায়ের প্রাণপ্রিয় সন্তানকে ওরা বেয়নেট নিয়ে খুচিয়ে, গুলি করে, বৈদ্যুতিক শক দিয়ে, রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে? আপনি কি জানেন, কত শত সৈনিক এখনও যাবজ্জীবন কারাদন্ড মাথায় নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে দিনে দিনে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? আপনি কি জানেন মৃত ও জীবিত (বন্দী) সৈনিকদের পরিবারের সদস্যরা আজ পথের ভিখারী, পেটের জ্বালায় অনেকেই আজ ইজ্জত বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে?
মাগাে, আমরা এতই অসহায়-আমাদের কথা কেউ বলে না। আমাদের জীবনের মূল্য কারাে কাছে নেই। ‘৭৭-এর ঐ ঘটনার পর অনেককে দেখেছি মিছিল করে বলতে ‘ওদের ফাঁসি দাও’, কিন্তু আমরা কি অপরাধ করেছিলাম তা জানতে কেউ চাইল না। সত্যই কি সেদিন কেউ ক্ষমতা দখলের চেষ্টা বা জিয়াকে হত্যা করতে চেয়েছিল- তা’।
কেউ চাইল না। না হয় তর্কের তিরে ধরেই নিলাম—আমরা জিয়াকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু এখন তাে জিয়াকে হত্যা করাই হয়ে গেল, হত্যাকারীদের বাঁচিয়ে রাখাটা যদি মানবতা হয়, তবে যারা হত্যা করতে চেয়েছিল কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে, তাদের মধ্যে থেকে ৪২৫ জনকে মৃত্যুদন্ড এবং ৩৫০ জনকে দীর্ঘমেয়াদী কারাদন্ড দেওয়া কোন মানবতা? মাগাে, আপনি কি ঐ সৈনিকদের বিধবা পত্নী ও এতিম শিশুদের কান্না শুনতে পান না? নিশ্চয় পান। আমরা দৃঢ় আশা পােষণ করি, আপনি এদের কথাও বলবেন। চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অভিযুক্তরা সকলেই অফিসার এবং তাঁরা সকরেই বড় ঘরের সন্তান। তাঁদের কথা আজ সকল মহল থেকে বলা হচ্ছে। তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। আমাদের সবিনয় আবেদন মাত্র এই, সেই সংগে আমাদের অসহায় পরিবারবর্গের কথাও যেন বলা হয়। আজ ৪ বছর জেল খেটে আমাদের আর কিছুই নেই। মানসিক দুশ্চিন্তায় এবং বিভিন্ন সময়ের কারা-নির্যাতনের ফলে আমাদের মধ্যে এমনও আছেন যাঁর ৫৫ বৎসর বয়স। ৮টা ছেলেমেয়ে রেখে এসেছেন। ঘরে এক মুষ্ঠি চাউল রেখে আসতে পারেন নি।
আমরা আপনার কাছে আবেদন করছি মা, আপনি এ সরকারকে জিজ্ঞাসা করুন, দীর্ঘ বৎসর কারা-যন্ত্রণা কি আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়? আমরা কি এতই সাংঘাতিক? যদি এতই সাংঘাতিক হয়ে থাকি তবে আমাদের একই মামলার আসামী ৩১নং বিশেষ সামরিক আদালতে প্রথমে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পরে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামী গাজী গােলাম মাওলা ও আমীর হােসেনকে ১০ বৎসর সাজা মাফ করে দিয়ে মুক্তি দেওয়া হল কি করে? ওদের প্রতি মানবতা দেখান হল। আমাদের প্রতি এমন বিমাতাসুলভ আচরণ কেন? একটা মিউটিনি মামলার সর্বোচ্চ সাজাপ্রাপ্ত দু’জনকে যদি ক্ষমা করা যায় তবে আমাদের বেলায় বাধা কোথায়, তা আমরা বুঝতে পারছি না। আমরা অবশ্য ঐ দু’ভদ্রলােকের ন্যায় মােটা অংকের টাকা খরচ করতে পারব না। আপনি কবি, আপনি মা, আপনি আমাদের ন্যায় হতভাগ্যদের মনের যন্ত্রণা ভাল। করেই বুঝবেন ও মর্মস্পর্শী ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেন। আল্লাহ আপনাকে সেই তৌফিক দিয়েছেন। আমাদের কথা বলার জন্য, আমাদের মুক্তি দাবি করার জন্য আমরা বাংলাদেশের এমন কোন দল, সংগঠক ও ব্যক্তিত্বকে বাকী রাখিনি- বলতে পারবেন, আমরা তাঁদেরকে জানাইনি। কিন্তু কেউ আমাদের কথা বলেন না।
বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে আমরা বর্তমানে প্রায় দেড়শত সৈনিক আছি, যাদের ৬০% জনের সাজা হল ২০ বৎসর, তারপর ১৫/১৪/১২/১০ বৎসর।
মাগাে, আপনি যার হাতে লিখা পড়ছেন, সেই হতভাগ্যের পিতা, পুত্রশােকে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত একবুক হতাশার জ্বালা নিয়ে পরকালে পাড়ি জমিয়েছেন গত ফেব্রুয়ারীতে। এবার নিশ্চয় আমাদের যন্ত্রণার গভীরতা অনুধাবন করতে পেরেছেন। অতএব, আপনাকে আর বিরক্ত করাটা সমীচীন মনে করি না।
২২. এই ন্যাক্কারজনক ঘটনায় সমস্ত বন্দী মারাত্মক ক্ষুব্ধ হন এবং ডি, আই, জি (প্রিজন) এর কাছে দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন। একই সাথে তারা অন্যান্য বহুমুখী সমস্যা নিয়ে আলােচনার জন্য ডি,আই,জি (প্রিজন)-এর সাক্ষাৎ কামনা করলে তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান হয়। অনন্যোপায় হয়ে ৩ ডিসেম্বর ‘৭৯ দুপুর ১২টা থেকে অফিস কেস টেবিল ও উৎপাদন বিভাগে নিয়ােজিত সকল সাজাপ্রাপ্ত বন্দী কর্মবিরতির মাধ্যমে অসহযােগ আন্দোলন শুরু করেন। ৫ই ডিসেম্বর, ‘৭৯ একটি দরখাস্ত জেলা প্রশাসকের বরাবর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। প্রেরণ করলেও জেলা প্রশাসকের সাক্ষাৎলাভে ব্যর্থ হয়ে সকল বন্দীরা ৭ই ডিসেম্বর ‘৭৯ জেলা প্রশাসকের কাছে আরেক দফা দরখাস্ত প্রেরণ করেন। এতে উল্লেখ করা হয় যে, সাক্ষাৎদানে ব্যর্থ হলে ৮ই ডিসেম্বর সূর্যোদয় থেকে সকল বন্দীরা পরবর্তী ২৪ ঘন্টার জন্য প্রতীক অনশন পালনে বাধ্য হবেন। তবুও জেলা প্রশাসক আসেননি।
২৩. ৮ ডিসেম্বর সূর্যোদয় থেকে পরবর্তী ২৪ ঘন্টা রাজশাহীর জেলের সকল বন্দী প্রতীক অনশন পালন করেন। এর পরও জেলা প্রশাসক কিংবা করা-কর্তৃপক্ষ বন্দীদেরসাথে সাক্ষাৎ বা আলােচনার কোনরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। জেলা প্রশাসক সাক্ষাৎদানে ব্যর্থ হলে সকল বন্দী ১৩ই ডিসেম্বর, ‘৭৯ থেকে আমরণ অনশনে যেতে বাধ্য হবেন। অভিন্ন বক্তব্য সম্বলিত চরমপত্র আই, জি, (প্রিজন)-এর বরাবরে প্রেরিত হয়। তার হাতে ১৮ দফা দাবী প্রদান করা হয়।
২৪. ১৮ দফা দাবীর মধ্যে ডি, আই জি (প্রিজন) এর অপসারণ, মধ্যযুগীয় নির্যাতন বন্ধ, খাবারের উন্নতমান, পানি, বিদ্যুৎ পায়খানার সুব্যবস্থা, বন্দীদের সুচিকিৎসা, লাইব্রেরীতে বই, দৈনিক পত্রিকা সরবরাহ, সংস্কৃতির চর্চার ব্যবস্থা, রাজবন্দীদের রাজনৈতিক মর্যাদা প্রদানের দাবী সহ ১৮ দফা দাবী জানানাে হয়।
২৫. ১১ ডিসেম্বরের আলােচনা বৈঠকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সাধারণ) ১৮ দফা দাবী থেকে কিছু দাবী মেনে নেন। এছাড়া তিনি বন্দী প্রতিনিধিদের এ বক্তব্যের সাথে নীতিগতভাবে একমত হন যে, কারাসংস্কার কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে এ-দাবীর আনুষ্ঠানিক ও সরকারী স্বীকৃতি মিলেছে যে, বর্তমান জেলকোড সময়ােপযােগী নয়। সুতরাং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ব্রিটিশ প্রণীত জেলকোডের হুবহ প্রয়ােগ হতে পারে না। সর্বোপরি তিনি এ অভিযােগ বলে মেনে নেন যে, ডি,আই,জি (প্রিজন), এর আচরণ অমানবিক এবং তিনি তাকে মানবিক আচরণ করতে নির্দেশ দেন। উক্ত বৈঠকে তিনি কিছু-কিছু বিষয় তদন্তের জন্য গ্রহণ করেন। এবং অন্যান্য বিষয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে বন্দী প্রতিনিধিদের আলােচনার জন্য ১৫ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন। কিন্তু ১৫ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসক আসেননি। ২৬. এসময় কনকনে ঠাণ্ডা পড়ে। কম্বলের অভাবে বন্দীরা ভীষণ অসুবিধায় পরেন। তিন শতাধিক বন্দীদের একটিও কম্বল নেই। শতাধিক বন্দীর একটি চটও নেই। এব্যাপারে জেলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে বারংবার বলা সত্ত্বেও কোনাে ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কর্তৃক স্বীকৃতি দাবিসমূহও বাস্তবায়িত করেনি, বরং জেল কর্তৃপক্ষ চরম নির্যাতনমূলক কথবার্তা ও আচরণ করতে থাকে।
২৭. বিনা বিচারে আটক বন্দীদের ক্ষেত্রে একটি গুরুতর সমস্যা সৃষ্ট হয়। জরুরী আইনে আটক বন্দীগণ মুক্তির লক্ষ্যে অনশন শুরু করেন। আইনগতভাবে তারা। মুক্তি পাওয়ার অধিকারী। কিন্তু তাদের যথাসময়ে মুক্তি না দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে নতুন করে আটকাদেশ এলে বন্দীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
২৮. ৩০ জানুয়ারী সন্ধ্যায় লক-আপের পর ৮টার দিকে Indian Ward থেকে তিনজন সাজাপ্রাপ্ত বন্দী কর্পোরাল শামসুল হক, মােজাফফর হােসেন ও আক্কাস আলীকে বলপূর্বক ওয়ার্ড থেকে বের করা হয় এবং দৈহিক নির্যাতন করতে করতে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সাথে সাথে সমস্ত কারাগর শ্লোগান প্রকল্পিত হয়ে ওঠে। ‘অন্যায়ভাবে বদলি করা চলবে না, ভি, আই, জি (প্রিজন)-এর অপসারণ চাই’ প্রভৃতি। রাত ৮টা থেকেই অনশন শুরু হয়ে যায়। গভীর রাত পর্যন্ত শ্লোগান অব্যাহত থাকে।
২৯. ৩১ জানুয়ারী ১৯৮০ জেলকোড অনুযায়ী ভােরবেলা সেলসমূহের তালা খােলার নিয়ম থাকলেও সেদিন তালা খােলা হয়নি। এসময় বন্দীরা তালা খুলে দেয়ার জন্য কারারক্ষীদের অনুরােধ জানায়। কিন্তু রক্ষীরা জানায় যে, তাদের সেলের তালা না খােলার আদেশ দেয়া হয়েছে। বন্দীদের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সকাল নয়টার দিকে জেলের বিভিন্ন কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রায় দেড়শ’ কারারক্ষী লাঠি, লােহার রড ও বিভিন্ন মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জেলখানায় প্রবেশ করে এবং দোমহলায় বেপরােয়া হামলা চালায়। এমনি বেপরােয়া হামলা সময়ই হঠাৎ করে এলার্ম বেজে ওঠে। এলার্ম বাজার সাথে সাথে জেলের প্রধান গেট দিয়ে আরাে ২৫/৩০ জন কারারক্ষী ভেতরে প্রবেশ করে। এসময় নিরাপত্তার আশায় বন্দীরা সেলের দরােজা খােলা পেয়ে মেডিক্যাল সেন্টারের (জেলের ভেতরেই) দিকে দৌড়ােতে শুরু করে। জেল কর্মকর্তারা এ-সময় একদল কারারক্ষীকে সাথে নিয়ে দ্রুত জেলের প্রধান গেটে চলে যায় এবং বিনা হুশিয়ারিতে অসহায় বন্দীদের লক্ষ্য করে গুলীবর্ষণ শুরু করে। গুলীবর্ষণ চলতে তাকে প্রায় একঘন্টা। গুলীর আওয়াজে সারা রাজশাহী শহরে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।
৩০. বিক্ষুব্ধ জনতা জেলের কাছে জমায়েত হয়ে গুলীবর্ষণের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এক ঘন্টায় প্রায় সাড়ে আটশ’ রাউণ্ড গুলীবর্ষণ করা হয়। গুলীতে ঘটনাস্থলেই দু’জন নিহত ও অন্য একজন হাসপাতালে মারা যান। গুলীবর্ষণ থামার প্রায় আধ ঘন্টা পর গুরুতর আহত কয়েকজনকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে স্থানান্তরিত করা হয় এবং অন্যদের ভর্তি করা হয় জেল হাসপাতালে। নিহত ” আবদুর রহিম (ঈশ্বরদী, পাবনা), মােঃ শাফি (শিবগঞ্জ, বগুড়া) ও আবদুর গান (গবিন্দপুর, বগুড়া)।
৩১. সরকার জেল হত্যা তদন্ত করার জন্য এক সদস্যবিশিষ্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেছিলেন। কমিশনের সদস্য- রাজশাহীর জেলা ও দায়রা জজ জনাব শামসুদ্দিন আহমদ। তদন্ত রিপাের্টে বিডি আর, রিজার্ভ পুলিশ ও জেলা পুলিশ কর্তৃক গুলী চালানাের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা হয়।
জিয়া নিজেই মাঠে নামেন
৩২. রাজশাহী কারাগারে তিনজন বন্দীকে গুলী করে হত্যার খবর ছড়িয়ে পরার সাথে সাথেই সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। গুলী চলাকালীন সময়ই বিপুল জনতা রাজশাহী জেলের সামনে ভিড় করে বিভিন্নরকম শ্লোগান দিতে থাকে। অল্পক্ষণের মধ্যেই বিরাট-বিরাট প্রতিবাদ মিছিল ও বিকেলে রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ভুবনমােহন পার্কে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরদিন রাজশাহী শহরে পালিত হয় পূর্ণ হরতাল। টাকায় দশ দলের পক্ষ থেকে হরতাল আহবান করা হয় প্রায় সব দলই প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে হরতালেরর প্রতি সমর্থন জানায়। হরতাল পালন একটি গণতান্ত্রিক অধিকার হলেও সরকারী দল হরতাল বানচালের জন্য সর্বশক্তি নিয়ােগ করে। বিএনপি’র শুধু কর্মকর্তারাই নয়, প্রেসিডেন্ট জিয়া নিজেও মাঠে নামেন এবং একটি সভায় ঘােষণা করেন- “কোন মতেই হরতাল হতে দেয়া যায় না। প্রেসিডেন্ট জিয়া নিজে হরতালের আগের দিন সন্ধ্যায় ঢাকার বিভিন্ন বাজারসমূহ পরিদর্শন করে দোকানপাট খােলা রাখার অনুরােধ জানান। এছাড়া জাতীয়তাবাদী যুবদলের সদস্যরাও ট্রাক ভর্তি করে সন্ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা চালায়।
হরতাল বন্ধে জালিয়াত
৩৩. সবচেয়ে বড় জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয় গভীর রাতে। সরকারী দলের পক্ষ থেকে মাইকে প্রচার করা হয়-আগামীকাল অনিবার্যকারণে হরতাল স্থগিত রাখা হয়েছে। সরকারী দলের সব রকম চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ৯ই ফেব্রুয়ারী সারা ঢাকা শহরে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। স্বাধীনতার পর এমনি পূর্ণ হরতাল পালন এই প্রথম। হরতালে সন্ত্রাস ঃ আরাে লাশ
৩৪. হরতালের দিন ভাের থেকে সরকারী দলের পক্ষ থেকে দারুণ ত্রাস সৃষ্টি করা হয়।
ভাের বেলায় বেপরােয়াভাবে হামলা চালানাে হয় আওয়ামী লীগ, কমুনিস্ট পার্টি ও জাসদ অফিসে। সারা শহরে এক শ্রেণীর যুবক মাইকোবাস ও জীপে করে পুলিশের সাথে বেরিকেড ভাঙার কাজে অংশ নেয় এবং ফঁাকা গুলী করে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। হকিষ্টিক ও লাঠিসোটা নিয়ে যুবকরা বিভিন্ন স্থানে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলের ওপর হামলা চালায়। হরতালের দিনে প্রাণ হারায় মােহাম্মদ শাহজাদা বাদশা ও নূরুল আলম। নুরুল আলম ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে এবং শাহজাদা আজিমপুরে গুলী বিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে মারা যায়। আহত হয় প্রায় শতাধিক। শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় তিনশ’ লােককে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত অনেকের বিরুদ্ধেই ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অভিযােগ এনে মামলা দায়ের করে জিয়াউর রহমানের সরকার।
খুলনা জেল হত্যাকাণ্ডঃ আরাে লাশ
৩৫. জেলখানার সমাগ্রিক কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নিয়ে জেলভেঙে কয়েদীদের পালিয়ে যাবার ছিলাে অপূর্ব সুযােগ। কিন্তু পালিয়ে যাওয়া তাদের উদ্দেশ্য ছিলাে না। জেলবন্দীদের কতগুলাে মৌলিক অীধকারের প্রশ্ন, সেই অধিকারবােধ নিয়ে জেলকর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনমহলের সঙ্গে কয়েদীদের বিবাদ-বচসা এবং সর্বশেষে তার জের হিশেবে ৫০ জন বন্দীকে হত্যা, সংক্ষেপে এই ছিলাে ২১শে অক্টোরের খুলনা জেলের নির্মম ঘটনা বলির সংক্ষিপ্ত পরিচয়। খুলনা জেলখানার কয়েদী ধারণ ক্ষমতা ছিলাে ২৪৫ জন, ঘটনার সময়ে সেখানে অবস্থান করছিলেন ৯১০জন জেলবন্দী ও ১০৬ জন জেলকর্মচারী। প্রতি সপ্তাহে বিচারাধীন অসংখ্য বন্দীকে নিয়মমাফিক নিয়ে যাওয়া হতাে আদালতে, সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তাদের বসিয়ে রাখা হতাে কোর্ট-হাজতে। বিচার বা চার্জশীট ছাড়াই সন্ধ্যার সময় আবার তাদের ফিরিয়ে হতাে জেলখানায়। বিচারের এই নিত্য নৈমিত্তিক প্রহসন বিচারাধীন বন্দীদের মানসিক ও শারীরিক চাপ সৃষ্টি করে।
৩৬. এই অবস্থায় কয়েদীদের পেশকৃত ২৩ দফা দাবিগুলাের মধ্যে ছিলাে জেলার, ডেপুটি জেলার ও জেল-ডাক্তার সহ কতিপয় অসৎ কর্মচারীর অপসারণ, উন্নততর আহার ও চিত্তবিনােদনের ব্যবস্থা, বিচারাধীন বন্দীদের মামলা অবিলম্বে নিষ্পত্তিকরণ, তিন বছরের বেশি বিচারাধীন অবস্থায় আটকে রাখা বন্দীদের বিনাশর্তে মুক্তিপ্রদান, সামরিক আদালতে সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের উচ্চতর আদালতের আপিলের সুযােগ প্রদান, ইত্যাদি। ২৩-দফা দাবি আদায় করাই হলাে তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য।
৩৭. ২১শে অক্টেবর সকাল। কয়েদীদের সঙ্গে স্থানীয় আইন রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের প্রায় ঘন্টাব্যাপী একটি সুদীর্ঘ লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটে, যার ফলে ১১৪ জন পুলিশ ৬ জন দমকলবাহিনী সদস্য এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়নের ৫জন সৈনিকও আহত হয়।
৩৮. সরকারী প্রেসনােটে এই ঘটনাকে দু’ দল বিবদমান কয়েদীর মধ্যে সংঘর্ষে জের বলে অভিহিত করে দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চায়। জেল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনের নিরুদ্বিগ্ন অসহযােগিতা এ কথাই প্রমাণ করে দেয় যে, এর পেছনে ছিলাে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ। রংপুর, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী জেলের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার ফলে ৫০ জন কয়েদীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা এবং প্রায় দেড়শ’ কয়েদীকে মারাত্মকভাবে আহত করতে জিয়া শাহীর প্রচেষ্টার কোনাে ঘাটতি ছিলাে ।
ঢাকা জেল রক্তের দাগ শুকায়নি ?
৩৯. ১৯৭৭ সালের ২২শে জুন ঢাকা জেলের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক বন্দীদের উপর অত্যাচার চালানাে হয়। ভােরবেলা জেল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ‘পাগলা ঘন্টা বাজিয়ে কারারক্ষী ও পুলিশ বেপরােয়া আক্রমণ করে। ‘৭৫-এর চার নেতার রক্তের দাগ শুকায়নি জেল অভ্যন্তরে। আক্রমণে আবদুল মমিন তালুকদার, মাহবুব উদ্দিন, আবদুল কুদ্স মাখন, আতিকুর রহমান প্রমুখ আহত হয়েছেন। দেশব্যাপী জেলের মধ্যে এই আক্রমণের তীব্র প্রতিবাদ ওঠে। ১৯ ঢাকা জেলের ঘটনা নিয়ে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ১৯৭৭ সনের ১ জুলাই এক জরুরী তারবার্তা প্রেরণ করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নিকট। এর জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন ও কমিশনের রিপাের্ট প্রকাশের অনুরােধ জানায়।
মুক্তিযােদ্ধার লাশ
১৯৭৫ পূর্ববর্তী খুনের ঘটনাকে কেন্দ্রকরে একটি মামলা দায়ের হয় বাজিতপুর থানায় ১৯৭৬ সনে। ঘটনার বিবরণ অস্পষ্ট। অনেকটা বানােয়াট। ঘটনায় যারা নিহত হয়েছিলেন তারা সর্বহারা পার্টির লােক। ‘৭৫ পরবর্তী সামরিক শাসন জারীর পর এই ঘটনা নিয়ে মামলায় আসামী করা হয় ৫ জন মুক্তিযােদ্ধাকে। আসামীরা হলেন আবুলাল, শামসুদ্দিন, আবদুর রউফ, কাঞ্চন মিয়া, ও চান মিয়া। এরা মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর সদস্য ছিলেন। ‘৭৬ সনে এই মামলার আসামী আবুলাল ও শামসুদ্দিকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭৬ সালে আগষ্ট মাসে আবদুর রউফ এবং কাঞ্চন মিয়া সামরিক আদালতে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭৭ সালে ২৮শে সেপ্টেম্বর জিয়া কর্তৃক গঠিত ঢাকার দুই নম্বর সামরিক আদালত ৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত ৫ জনের মধ্যে চাঁদ মিয়া পলাতক ছিলাে। ৩রা জুন ‘৮০ দিনগত মধ্যরাতের পর বিশেষ সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ৪ জনের ফাঁসি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সম্পন্ন হয়। সরকারী মুখপাত্রের মতে এরা সকলেই ছিলেন মুজিব বাহিনীর সদস্য।
সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যা
৪১, ৪ঠা জুন বুধবার সন্ধ্যায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ প্রধান আবদুল মালেক উকিল ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক চারজন মুক্তিযোেদ্ধার ফাঁসির প্রতিবাদে দেশব্যাপী তিনদিন দলীয় পর্যায়ে শোেক পালন ও ৭ জুন অর্ধদিবস হরতালের কর্মসূচী ঘােষণা করেন। তারা বলেন, ফাসির আগেও আমরা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করেছিলাম এবং তিনি ৪৮ ঘন্টা ফাসি স্থগিত রাখেন। ফাসির দুই ঘন্টা আগেও রাত ১২টায় আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের নেতা। জনাব আসাদুজ্জামান খান ও সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুর রাজ্জাক বঙ্গভবনে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে আরেক দফা সাক্ষাৎ করেন এবং ফঁসির আদেশ মওকুফ করার জন্য তারা একটি লিখিত আবদনপত্র পেশ করেন। বাজিতপুর হত্যা মামলাকে সামরিক আইন জারি হওয়ার আগেকার ঘটনার অস্পষ্ট অভিযােগের ভিত্তিতে সাজানাে হয়েছে বলে তারা উল্লেখ করেন। জনাব মালেক উকিল স্বাধীনতাবিরােধীদের দণ্ডাজ্ঞা মওকুফ ও মুক্তিদানের কথা উল্লেখ করে বলেন, . “মুক্তিযােদ্ধাদের ফাসিদান সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যা।” দেশবাসীকে রাজনৈতিক হত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার আহবান জানান।
৪২. ৪টি লাশ কফিনবদ্ধ করে সন্ধ্যা সােয়া ৬টায় বায়তুল মােকররমে প্রাঙ্গণে আনা হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও বহু লােকের উপস্থিতিতে আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ নামাজে জানাজা পড়ান। জানাজাশেষে ৪টি কফিন নিয়ে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলকারীরা ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবাে না’, স্বৈরাচারীর গদিতে আগুন জ্বালাে একসাথে’ ইত্যাদি শ্লোগান সহকারে শহরের কয়েকটি রাস্তা প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনারে পৌছে। সেখান থেকে লাশ বাজিতপুরে নিয়ে যাওয়া হয়।
রঙিন চশমার আড়ালে নিষ্ঠুর জিঘাংসা
৪৩. জিয়াউর রহমান আমলে দেশের জেলখানাগুলিতে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। বিনা কারণে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার বন্দীদের আটক, তাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালানাে হয়। দেশের প্রতিটি কারাগারে স্থান সংকুলান না হওয়ায় এদের ‘গাদাগাদি করে রাখা হয়। খাবার ছিলাে অত্যন্ত নিম্নমানের। চিকিৎসার ব্যবস্থাও ছিলােনা তেমন। বন্দীদের অধিকাংশই ছিলাে মুক্তিযােদ্ধা। তারা চোখের সামনে দেখছে স্বাধীনতা বিরােধীদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে—আর তাদের দিয়ে জেল ভর্তি করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে তাদের ক্ষোভ ছিলাে প্রচন্ড। ১৯৭৮ সন থেকে ১৯৮০ সনের ২২শে জুন পর্যন্ত জেলের অভ্যন্তরে ৫১টি ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। ২০।
মুক্তির আদেশ ঃ পুনরায় গ্রেফতার
রঙিন চশমার অন্তরালে নির্মম নিষ্ঠুর জিঘাংসায় উন্মত্ত জিয়ার হৃদয় ছিলাে সীমারের চেয়েও কঠিন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য হত্যা ও নিপীড়ণে তার বিবেককে দংশন করেন। সামরিক প্রতিপক্ষকে যেমনভাবে রক্তের বদলায় শায়েস্তা করেছেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতিও করেছেন অনুরূপ আচরণ। অনেক নেতাকর্মী হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু জেলগেট থেকেই তাদের করা হয়েছে। পুনরায় গ্রেফতার। এর সংখ্যা একজন নয়-হাজার হাজার।
নির্মম অত্যাচার আর হিংস্রতা
৪৪. , রাজনৈতিক ব্যক্তিদের গ্রেফতার করার পর তাদের উপর চলতাে নির্মম অত্যাচার। আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের উপর যে কিভাবে অত্যাচার হতাে তার বর্ণনা দেয়া দুঃসাধ্য। জেরা করার সময় বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতন, গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে পেটানাে, শরীরের গুপ্ত স্থানে বরফ ঢুকানাে, অন্ডকোষের সঙ্গে ইট বেধে ঝুলিয়ে দেয়া, খাবার না দেয়া, পানির বদলে মগে পেশাব করে খেতে বলা, এসব অভিযােগ ছিলাে হাজার হাজার।২১
মাহফুজ বাবু কোথায় ঃ অন্ততঃ লাশটা দাও
৪৫. রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করার জন্য জিয়াউর রহমান ব্যবহার করেছেন গােয়েন্দা বাহিনীকে এরা সাদা পােশাকে ঘুরে বেড়াতাে। বিভিন্ন গাড়ী ব্যবহার করতাে। যখনই নির্দেশ আসতাে তখনই তারা তৎপর হয়েছে। এসব সাদা পােশাকধারী বাহিনীর সদস্যগণ যাকে গ্রেফতার করেছে তাদের অত্যাচারে হত্যা করা হয়েছে অথবা তাদের লাশ গুম করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের বলিষ্ঠ নেতা মাহফুজ বাবুকে ‘৭০ সনে পুরনাে ঢাকা হতে দিনের বেলা প্রকাশ্যে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় সাদা পােশাকধারীরা। মাহফুজ বাবু আজো ফিরে আসেনি। তার মা কাদতে কাদতে অন্ধ হয়ে গেছেন। তার কাছে যেই দেখা করতে যেতে তার মায়ের প্রশ্ন ছিলাে আমার মাহফুজ বাবু কোথায়? হয় তাকে এনে দাও-না হলে অন্ততঃ তার লাশটা দাও। মাহফুজ বাবু-র এই নির্মম অদৃশ্যতা’-একটি নয়। একাধিক। হাজার হাজার। এই ছিলাে জেনারেল জিয়ার গণতান্ত্রিক (1) বাংলাদেশের চিত্র।
সূত্র : জেনারেল জিয়ার রাজত্ব – অধ্যাপক আবু সাইদ