You dont have javascript enabled! Please enable it! পাকিস্তান সরকারের সাথে চাকরী করা বাঙালিদের ব্যাপারে তাজউদ্দীনের পদক্ষেপ কী? - সংগ্রামের নোটবুক

পাকিস্তান সরকারের সাথে চাকরী করা বাঙালিদের ব্যাপারে তাজউদ্দীনের পদক্ষেপ কী?

তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে আমার প্রথম দেখা এক ঝলকের। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের তিন তারিখে আমি শেখ সাহেবের সাথে তাঁর ৩২ নম্বর রােডের বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে উপস্থিত সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে তাজউদ্দীন সাহেব এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ছিলেন। এরপর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেব বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। তার পরদিন ১৩ তারিখে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে জরুরী বার্তা পেয়ে আমি তার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি জানালেন, আমাকে অর্থ সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারির সেই এক ঝলকের দেখা ছাড়া আমার আর কোন যােগাযােগ, পরিচয় কিছুই ছিল না এবং প্রধানমন্ত্রী যখন আমাকে এই নিযুক্তির কথা বললেন তখন আমার মনে হল, তিনি এই বিষয়ে তাঁর অর্থমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে হয়ত সময় পাননি। আমার প্রশাসনিক কাজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, মন্ত্রীর নিবিড় সহযােগিতা, সক্রিয় সমর্থন, বিশ্বাস এবং আস্থা যদি তাঁর সচিবের উপর না থাকে তবে কোন সচিবই ফলপ্রসূভাবে কাজ করতে পারেন না। আমার এই ধারণার পেছনে আরাে জোরালােভাবে হয়ত কাজ করেছিল একটা নতুন দেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি। সেই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সেক্টর ছিল সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত ।
অর্থনৈতিক সেক্টরকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে প্রতি মুহূর্তে দ্রুত এবং কার্যকর প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের প্রয়ােজনীয়তার কথা আমার চিন্তায় বিশেষভাবে ছিল। তখন সরকারি কোষাগার খালি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শূন্য (বাংলাদেশ সরকারের নামে ভারত সরকার যে পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তাদের বম্বে রিজার্ভ ব্যাংকে জমা রেখেছে এটি বাদ দিয়ে)। পাকিস্তান সরকার ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত এই অংশের (বাংলাদেশের) রপ্তানি আয়ের সম্পূর্ণ অংশ সরিয়ে নিয়েছিল। আমদানি-নির্ভর নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসের ব্যবস্থা করা, শিল্প প্রতিষ্ঠানে, কাঁচামালের অভাব দেখা দেয়ার আগেই এর ব্যবস্থা করা, তারপর সরকার চালাবার যাবতীয় খরচ, নতুন মন্ত্রণালয় এবং শাখা, বিদেশে দূতাবাস খােলা, ১ জুলাই ১৯৭২ থেকে শুরু হতে যাওয়া নতুন অর্থবছরের জন্য বাজেট তৈরি করার প্রস্তুতি ইত্যাদি বিষয়গুলাে তখন দিগন্তবিস্তৃত হয়ে ছিল। এই অবস্থায় আমি অর্থ সচিব হিসেবে কাজে যােগ দেবার আগেই অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে দেখা করতে ১৭ জানুয়ারি তাঁর হেয়ার রােডের বাড়িতে গেলাম। সেখানে তখন তাঁর দেখা পাওয়ার জন্য বহুসংখ্যক দর্শনার্থী অপেক্ষা করছিলেন। আমি আমার পরিচয় দিয়ে কিছু জরুরী সমস্যা সম্পর্কে তাঁর মতামত এবং নির্দেশনার কথা বললাম। আমরা আলােচনা শুরু করতেই একজন মহিলা বিলাপ করে কাঁদতে কাঁদতে সেই ঘরে এসে বললেন, রাজাকার ভেবে ভুলক্রমে মুক্তিযােদ্ধারা তাঁর স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছেন—তাজউদ্দীন সাহেব যেন তাঁর স্বামীকে বাঁচান, উদ্ধার করে দেন। তাজউদ্দীন সাহেব সেই মুহূর্তে আই.জি. পুলিশকে ফোন করলেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে উদ্ধারের নির্দেশ দিলেন। এই পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আলােচনা করা যায় না। অফিসেই দেখা করব ভেবে আমি চলে এলাম। এরপর থেকে প্রায় দু’বছর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে আমার কাজ করবার সুযােগ হয়েছিল। তাঁর কাজের ধরন সম্পর্কে প্রথমেই যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমার নজরে পড়েছিল তা হচ্ছে, যদিও তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন পরিপূর্ণভাবে একজন রাজনীতিবিদ কিন্তু প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিষয় যখন সামনে আসত তখন তিনি নিজেকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে পারতেন।মুক্তিযুদ্ধে যারা সরাসরি অংশ নিয়েছেন অথবা দেশের ভেতরে থেকেছেন এই যে দুটো ভাগ এই বিষয়ে তাজউদ্দীন সাহেবের বক্তব্য ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। এই দু’ভাগের মধ্যে তিনি কখনই বিভেদ সৃষ্টি করতে চাননি এবং আমি শুনেছি তাজউদ্দীন সাহেব ২২ ডিসেম্বর ‘৭১-এ ঢাকায় ফিরেই ২৩ তারিখে সচিবালয়ে সর্বস্তরের কর্মচারিদের উদ্দেশে একটি ভাষণ দেন। সেখানে তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আগে আপনারা পাকিস্তানের জন্য কাজ করেছেন, এখন থেকে বাংলাদেশ সরকারের জন্য কাজ করবেন। এখন আমরা সবাই মিলেমিশে কাজ করব।’ তিনি কোন সময় এমন কোন মনােভাব দেখাননি যাতে কোন বিভেদ সৃষ্টি হয়। তবে এটা ঠিক, যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, ঢাকাতেও তারা গুরুত্বপূর্ণ পদেই ছিলেন। যেমন সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল কুদ্দুস, সংস্থাপন সচিব নূরুল কাদের খান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব হােসেন তওফিক ইমাম এবং এস. এ. করিম, খন্দকার আসাদুজ্জামান, পুলিশের আইজি খালেক। আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় সরকারে কাজ করেছে বলে কাউকে পদোন্নতি দেয়া বা বিশেষ সুবিধা দেয়া—এ জাতীয় কোন কাজের জন্য বা এ জাতীয় কোন কথা তিনি কখনও বলেননি। যেমন একটি উদাহরণ দেই : এক ভদ্রলােক ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টস্ অফিসার। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশ সরকারে যােগ দিয়েছিলেন এবং সরকারের চীফ অ্যাকাউন্টস অফিসার ছিলেন। দেশ স্বাধীন। হবার পর দেশে ফিরে তিনি বললেন, তাঁকে অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেলের পদ দিতে হবে। আমি বললাম, ‘দুঃখিত, এই পদের জন্য যেমন যােগ্যতার প্রয়ােজন সে অনুযায়ী এই পদে আপনাকে নিয়ােগ দেয়া যায় না। এ ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্তই বহাল রইল । তাজউদ্দীন সাহেব কোনদিনও কিন্তু এই সমস্ত বিষয়ে আমাদেরকে কিছু করার জন্য অনুরােধ করতেন না। এমন বলতেন না যে, এই লােক প্রবাসে আমাদের সরকারে ছিল, একে একটু দেখবেন। অর্থাৎ তিনি কোনদিনই এ দেশের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাননি। তাঁর সাথে আমার দু’বছরের কাজের সময়ে একটিমাত্র ঘটনা ছাড়া আর কোন উদাহরণ নেই। ঘটনাটি ছিল বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়ােগ সংক্রান্ত। এই পদে নিয়ােগ দেবার জন্য আমি ফাইল নিয়ে তাঁর কাছে গেলে তিনি সম্পূর্ণ ফাইলটি পড়লেন। আমার সুপারিশ দেখে বললেন, এই অফিসার পাকিস্তানিদের সহযােগী ছিলেন কিনা সেটি কি আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি ? আমি সাথে সাথে বললাম, আমার সুপারিশএই ব্যক্তির যােগ্যতা ও অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে তৈরি এবং আমি মনে করি এই কাজের জন্য এই ব্যক্তি উপযুক্ত। আর তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে খোজ রাখা আমার আয়ত্তের বাইরে। তবে এ বিষয়ে জানা যদি প্রয়ােজনীয় হয় তা অর্থমন্ত্রী করতে পারেন। এই কথার পর তাজউদ্দিন সাহেব আর কিছু না বলে সেই নিয়ােগপত্র অনুমােদন করে দিলেন। এই ঘটনার আগেও আমরা ৬টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়ােগ করেছি। কিন্তু কখনই তিনি সেই বিষয়ে কিছু বলেননি। কোন প্রশ্নই তােলেননি যে তার অতীত কী ছিল। পরবর্তীকালে সমস্ত ব্যাংকগুলাের জেনারেল ম্যানেজার পদে নিয়ােগ দেবার আগে প্রধানমন্ত্রী বললেন, এই কেসগুলাে যেন তাঁর কাছে পাঠান হয়। সাধারণভাবে এই নিয়ােগগুলাে যদিও আমাদেরই করবার কথা, কিন্তু যেহেতু প্রধানমন্ত্রী বললেন তাঁর কাছে পাঠাতে, তাই অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে সেই কেসগুলাে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠান হল। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং আমি মিলে যে সুপারিশগুলাে করেছিলাম তাজউদ্দীন সাহেব তার কোন কিছুই রদবদল করলেন না। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফাইলগুলাে পাঠিয়ে দিলেন। ওই পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী আমাকে বললেন, আমি সব অনুমােদন করেছি, শুধু একটি ছাড়া।’ আমি বললাম, “কোটি, স্যার? প্রধানমন্ত্রী বললেন, “তােমরা সুপারিশ করেছ, কিন্তু অনুমােদন দেয়া বােধ হয় ঠিক হবে না—এটি নূরুল আমিন সাহেবের ছেলে আনােয়ারুল আমিনের বিষয়টি। তাজউদ্দীন সাহেব কিন্তু আনওয়ারুল আমিনকে চিনতেন এবং জানতেন যে তিনি নূরুল আমিন সাহেবের ছেলে। নূরুল আমিন সাহেব তখন পাকিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট, কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব কোন সময়ই এসব ব্যাপারে প্রশ্ন তুলতেন না বা তুলতেও চাননি। তারপর হাফিজুল ইসলাম ছিলেন ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের জিএম। তিনি শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলায় রাওয়ালপিন্ডিতে গিয়ে সাক্ষি দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ হবার পর পাকিস্তানের ব্যাংকগুলাে যখন বাংলাদেশের ব্যাংক হল তখন সেই হাফিজুল ইসলামও স্বাভাবিকভাবেই ওই ব্যাংকের জিএম হলেন। শেখ সাহেব ফিরে আসবার পর ওই লােককে চাকরি থেকে সরিয়ে দিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব জানতেন ওই লােকের কথা, কিন্তু কিছু বলেননি বা নাক গলাননি, অর্থাৎ তাজউদ্দীন সাহেবের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা রকমের।আর একটি ঘটনার কথা মনে আছে: নূরুল কাদের খান তখন সংস্থাপন সচিব। এবং প্রধানমন্ত্রীর হাতে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়। ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট যারা পাকিস্তানি খেতাব পেয়েছিলেন—সেতারে পাকিস্তান, সেতারে কায়দে আযম, প্রভতি—তাঁদের সবাইকে এক দিনের নােটিশে চাকরি থেকে সরিয়ে দেয়া হল। প্রধানমন্ত্রী ফাইলে সই করে দিলেন এবং নূরুল কাদের অর্ডার ইস্যু করে দিলেন। এই তালিকায় বেশ অনেক সিনিয়র অফিসার ছিলেন, যেমন ওয়ালিউল ইসলাম, ওয়াজেদ আলি খান। এই অর্ডারটি তাজউদ্দীন সাহেব দেখেছিলেন খবরের কাগজে। আমি অফিসে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি দেখেছেন এই অর্ডারটি ? তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, দেখেছেন এবং এর ফলে তিনি বিচলিত বােধ করছেন। গতরাতে এই বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, এটা আপনি কী করেছেন এবং কেন করেছেন? প্রধানমন্ত্রী জ্ঞানী মানুষ, তিনি বললেন, “দেখ আমি করে ফেলেছি, এখন এটাকে কোন পদ্ধতিতে না ফেলে তাে উঠিয়ে নেয়া যায় না। তখন তাজউদ্দীন সাহেব বলেছেন, “ঠিক আছে, চাকরি থেকে যাদেরকে বাদ দেয়া হয়েছে তাদের প্রত্যেককে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ দিয়ে কেসগুলােকে আবার পর্যালােচনা করার ব্যবস্থা নেয়া হােক। একটা কমিটি গঠন করা হােক, সেখানে অভিযুক্ত সবাই তার কেস নিয়ে যাবে। সেই কমিটি যদি বলে, এরা পাকিস্তানিদের সহায়তাকারী অথবা প্রতি বছরের মত চাকরি জীবনের কৃতিত্বের ফলস্বরূপ তাঁরা খেতাব পেয়েছেন, তবে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। অর্থাৎ কেউ দোষী হলে শাস্তি পাবে। এরপর ড. কামাল হােসেনকে নিয়ে এক সদস্যের কমিটি হলে তার কাছে চাকরিচ্যুত সবাই তাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ খণ্ডনের সুযােগ পেলেন। এক এক করে সবার সাথে কথা বলে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেই রিপাের্ট ড. কামাল হােসেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে সবাই চাকরিতে পুনর্বহাল হয়েছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব কখনই অফিসারের পরিচয়ের দিকটি বড় করে দেখতেন না। যােগ্যতার বিষয়টিই ছিল তাঁর মূল বিবেচনা । যােগ্যতা আছে আসুন, নয়ত না। আবার যদি সত্যিই কেউ অন্যায় করে থাকে তবে তার আইন অনুযায়ী বিচার হবে। আমি বলতে চাইছি, উনি অত্যন্ত উদার দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। সেই সময় পাকিস্তানের সাথে সহায়তাকারী অনেকেই কারাগারে বন্দি ছিলেন। তখন আমাদের একটা অর্ডার ছিল, যারা কারাগারে আছেন তাদের অ্যাকাউন্টগুলাে আমরা ফ্রিজ করিনি, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বেশি তাঁরা ব্যাংক থেকে তুলতে পারবেন না। ডা. মালেকের ভাই আমার পূর্বপরিচিতছিল, আমার কাছে এসে বলল, ডা, মালেকের কেসটা তাে কোর্টে যাচ্ছে, সে কারণে বিশ হাজার টাকার দরকার। আমি সাথে সাথে তাকে একটা দরখাস্ত লিখতে বললাম এবং টাকা তুলবার অনুমতি দিয়ে দিলাম কাউকে কিছু না জিজ্ঞাসা করে। পরে সে দিনই বিকেলের দিকে বা পর দিন আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে বিষয়টি বললাম। তিনি শুনে বললেন, ‘ভাল করেছেন, দিয়ে দিয়েছেন, ঠিক আছে। যে বিষয়গুলাে স্বাভাবিক নিয়মে হয়ে যাবার কথা সেসব বিষয় নিয়ে আসলে তিনি মাথা ঘামাতেন না। আর তার মধ্যে এই জিনিস ছিল না যে অমুক আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা পাকিস্তানিদের সহায়তাকারী, তাই আমি তাকে নাজেহাল করব, অসুবিধা সৃষ্টি করব—এই ধরনের মনােবৃত্তি তার ছিল না। আর একটি ঘটনা, আখতারউদ্দিন নামে আমার এক সহপাঠী যিনি ডা. মালেকের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী ছিলেন, তিনিও তখন জেলে। একদিন তার স্ত্রী আমার বাসায় এসে কাঁদতে কাঁদতে জানাল, আখতারউদ্দিন খুবই অসুস্থ, তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, হাসপাতালে নিতে হবে। আমি সাথে সাথে স্বরাষ্ট্র সচিব এবং স্বাস্থ্য সচিবকে অফিশিয়ালি ঘটনাটি লিখে জরুরী ব্যবস্থা নিতে নােট পাঠালাম। এবং পরদিনই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে পরে বিষয়টি বলেছি। তিনি বলেছেন, “ঠিক আছে, এতে অসুবিধা কী, এগুলাে তাে মানবিক ব্যাপার। আসলে তাজউদ্দীন সাহেব অন্য কাউকে কষ্ট দেয়া বা অসুবিধা সৃষ্টি করার বিষয়গুলােকে কখনই উৎসাহ দিতেন না। তা ছাড়া আমি আমার কথা বলতে পারি, তাজউদ্দীন সাহেব তাঁর অফিসারদেরকে, বিশেষভাবে আমাকে, কাজ করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব চমৎকার বাংলা লিখতেন এবং তাঁর হাতের লেখা ছিল অত্যন্ত সুন্দর। এদিকে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সচিবালয়ের সমস্ত ফাইলপত্র বাংলায় লিখতে হবে। এর ফলে আমার খুব অসুবিধা হল। কারণ আমার বাংলা লেখা মােটেও ভাল না, আর সবচাইতে বড় সমস্যা ছিল, আমার চিন্তাটাকে সুস্পষ্ট এবং জোরালােভাবে বাংলায় লিখতে গেলে প্রয়ােজনীয় সঠিক শব্দের জন্য আমার অনেক সময় লেগে যেত। এ কারণে বিভিন্ন কেস ফাইলপত্র দ্রুত নিষ্পত্তির স্বার্থে আমি প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর কাছে আমার নােটগুলাে ইংরেজিতে লিখবার জন্য অনুমতি চেয়েছিলাম। এবং খুব দ্রুতই আমি এই অনুমতিও পেয়েছিলাম। তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আমি প্রায় দু’বছর কাজ করেছি। এই সময়টিতে আমি সব সময় ইংরেজিতে নােট লিখতাম, অর্থমন্ত্রী লিখতেন বাংলায়।তাজউদ্দীন সাহেব এক অর্থে শিল্পীও ছিলেন। তিনি গভীর উৎসাহের সাথে খেটে সেই সময়ে ছাপা হওয়া কাগজের মুদ্রার প্রতিটি ডিজাইনকে আরাে উন্নত করেছিলেন। বাংলাদেশের টাকার ৮’ প্রতীকটি তার নিজ হাতের কাজ।
অনেকেই বলে, তাজউদ্দীন সাহেব পশ্চিমা দেশগুলাের সাহায্য বা সহযােগিতা চাননি বা নেয়া পছন্দ করতেন না। এটা কিন্তু আমি শুনেছি। অথচ অর্থ সচিব হিসেবে আমি কিন্তু কোনদিনও তাঁর এই মনােভাবের কোন ইঙ্গিত পাইনি। তিনি খুব প্র্যাগম্যাটিক ছিলেন। আসল পরিস্থিতি সম্পর্কে ভীষণ সজাগ ছিলেন এবং সেইসাথে সুচিন্তিত বাস্তবসম্মত কর্মপদ্ধতিরও মানুষ ছিলেন। তিনি বুঝতেন পশ্চিমের সাহায্য ছাড়া আমাদের চলবে না, সাহায্য আমাদের নিতেই হবে। একটি বিষয়ে তিনি পাকিস্তান সরকারের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে আমার সুপারিশ নিয়েছিলেন। যেমন একটি ঘটনার কথা বলি : জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের প্রতিনিধি যিনি এখানে ছিলেন, উমব্রিখট তাঁর নাম। সুইস নাগরিক। তিনি রিলিফের তদারকি করতেন। তিনি একই সঙ্গে সম্ভবত সুইস কোম্পানি সিবা-গেইগীরও প্রতিনিধি ছিলেন। আমি অর্থ সচিব হিসেবে যােগ দেয়ার দিন সাতেক পর একদিন তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে ডাকলেন। গিয়ে দেখি দু’জন বিদেশী দ্রলােক বসা। তিনি তাঁদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এঁরা সিবা-গেইগী থেকে এসেছেন। সিবা-গেইগী আমাদেরকে কীটনাশক দিয়েছিল, অর্থাৎ সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানকে। পাকিস্তান সরকারের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে বিতরণের জন্য এখানে ওই কীটনাশক এসেছিল বাকিতে। এখন এঁরা এসেছেন বাংলাদেশ সরকারের কাছে, যাতে করে সরকার সেই কীটনাশকের টাকা শােধ দেয়ার দায়িত্ব নেয়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আমরা পাকিস্তান সরকারের দায়িত্ব নেব কি নেব না।’ আমি তখন বললাম, “দেখুন, এটা পলিসি ম্যাটার। তবে যদি কেউ সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে কোন কিছু দেয় সেটা পূর্ব পাকিস্তানের জন্যই ছিল। অর্থাৎ আমাদের জন্যই দেয়া হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে আমরা এই দায়িত্ব নিতে পারি।’ তিনি বিষয়টি মেনে নিলেন এবং বললেন, ‘আমরা পাকিস্তান সরকারের একমাত্র সেই সমস্ত দায়িত্বই নেব যা সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য আনা হয়েছিল বা ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঘটনা থেকেই বােঝা যায় তাজউদ্দীন সাহেব কতখানি প্র্যাগম্যাটিক ছিলেন। তিনি বলতে পারতেন, আমরা পাকিস্তানের দায়িত্ব নেব না। আমরা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ পেয়েছি, আমরা কেন পাকিস্তানের দায়িত্ব নেব!

(১০.২.১৯৯৯)
মতিউল ইসলাম : সরকারি কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অর্থ সচিব।