জিয়ার রাজত্বে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
১. সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বলেছেন, তিনি আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার। প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার ক্ষেত্রে স্বাধীন বিচার বিভাগ অপরিহার্য। জিয়া বলে বেড়ান আওয়ামী লীগ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ন্যায় বিচার ও আইনের শাসনের পথ রুদ্ধ করেছিলাে।
২. ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচার। বিভাগের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা ছিলাে। বিচার বিভাগ সম্পর্কে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে উল্লেখ ছিলাে, “প্রেসিডেন্ট প্রধান বিচারপতিকে নিয়োেগ করবেন এবং প্রধান বিচারপতির সাথে আলােচনা করে অন্য বিচারকদের নিয়ােগ করবেন। ৫ম সংশােধনীতে এই অনুচ্ছেদটি ‘প্রেসিডেন্ট প্রধান বিচারপতি এবং অন্য বিচারপতিদের নিয়ােগ করবেন’-চতুর্থ সংশােধনীর কথাগুলােই রাখা হয়। তাহলে আওয়ামী লীগকে দোষারােপ করা হচ্ছে কেন? ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে উল্লেখ ছিলাে ‘বিচার বিভাগীয় কাজে। নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ। (বদলি, পদোন্নতি এবং ছুটি) এবং শৃঙ্খলাবিধান ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ারে . থাকবে। ৫ম সংশােধনীতে ‘বিচার বিভাগীয় কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিকে এবং বিচার। বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (বদলি, পদোন্নতি এবং ছুটি ইত্যাদি) এবং শৃঙ্খলাবিধান ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের এখতিয়ারে থাকবে।” পঞ্চম। সংশােধনীতে প্রেসিডেন্টের হাতেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়। তবে এর সাথে শেষে একটি লাইন যুক্ত করা হয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম কোর্টের সাথে। ‘আলােচনা করে বিচার কার্যে নিযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান করবেন।
৩. এছাড়া জরুরী আইন বলে আদালতের ক্ষমতা খর্ব করে, মার্শাল ল’ রেগুলেশন ৭/৭৭, মার্শাল ল’ রেগুলেশন ৩৪/৭৭ এইসব কালাকানুনের মাধ্যমে আদালতের এখতিযারকে হরণ করে এবং আদালত প্রদত্ত রায় নাকচ করে এবং পঞ্চম সংশােধনীর মাধ্যমে সমস্ত কালাকানুন বলবৎ রেখে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিংবা মৌলিক অধিকার অক্ষুন্ন রয়েছে এমনটি বলার কোনই অবকাশ নেই।
৪. বাংলাদেশের বিচার বিভাগ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবি বলেছেন, ন্যায় বিচারের স্বার্থে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে সরকারের প্রধানমন্ত্রী আর মন্ত্রীরা এতাে বলছেন যে, অন্য কারও পক্ষে নতুন করে বলার ভাষা খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখছি, দেখছি গােটা বিচার বিভাগটিই কার্যত সরকারের অনুগ্রহ আর সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে রয়েছে। যদিও সরকার অর্থশাসন বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগের সমষ্টি এবং সমন্বয়। অথচ কাজের বেলায় বিচার বিভাগের প্রতি দেখানাে হয় বিমাতাসুলভ মনােভাব। শুধু তাই নয়, সরকার এবং প্রশাসনে এমনও অনেকে আছেন যারা বিচার বিভাগ তথা কোট আদালতকে দেশ শাসনের পথে একটা বিরাট অন্তরায় হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত এবং তাদের ভাবটা এই যে, তারা নেহায়েতই ভালাে মানুষ বলেই এখনাে বিচার বিভাগের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন। এ জাতীয় মনােভাবকে লালন করা হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রদানের ক্ষেত্রে ফঁকি-ঝুঁকির আশ্রয় নেওয়া, কোর্ট আদালতের কায়িক অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তােলা খুবই স্বাভাবিক।”
জিয়ার ভাওয়তাবাজি
৫. এডভােকেট সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বলেছেন, “প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পৃথকীকরণের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম এ দুটো মেট্রোপলিটন নগরীতে ম্যাজিট্রেসি গঠনের আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এ দু’টো নগরীতে কাজও শুরু করে দিয়েছে মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেসি। ম্যাজিস্ট্রেসি-সরকারের শাসন বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। আমরা বিভিন্ন জেলায়ও শাসন বিভাগ থেকে ম্যাজিস্ট্রেসিকে পৃথক করার চেস্টা করব।২) প্রেসিডেন্টের এ বক্তব্য সম্পর্কে একজন বিশিষ্ট আইনজীবী বলেন, ম্যাজিস্ট্রেসি সরকারের শাসন বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক বলে প্রেসিডেন্ট যে কথা বলেছেন, তা মােটেও ঠিক নয়। কারণ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসি সরাসরি সংস্থাপন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে। কাজেই প্রেসিডেন্টের বক্তব্য বিভ্রান্তিকর। শুধু এটুকুই নয়, প্রেসিডেন্টের পুরাে ভাষণে দেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উচ্চকিত সর্বসম্মত দাবি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং আইন পেশায় নিয়ােজিত ব্যক্তিদের সমস্যাবলীর ব্যাপারে ক্ষেপহীন মনােভাবই ব্যক্ত হয়েছে।
বিচার বিভাগের সংকট আরাে ঘনীভূত
৬. বাংলাদেশের বিচার বিভাগ আজ বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে প্রধান সমস্যাটি হচ্ছে সর্বোচ্চ আদালত থেকে শুরু করে নিম্ন আদালত পর্যন্ত বিচারকের অভাব। বলতে গেলে ৪৭ সালের পর বিচারকের সংখ্যা বাড়েনি বরং অনেক পদ খালি পড়ে আছে এখনাে। মুন্সেফদের যে বেতন দেয়া হয় তাতে নতুনরা মুন্সেফের চাকরির জন্য উৎসাহিত হচ্ছেন না। শুধু নিম্ন আদালত নয় সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরাও দারুণ আর্থিক সংকটে ভুগছেন। স্বাধীনতার আগে হাইকোর্টের বিচারপতিরা চার হাজার ও সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি পাঁচ হাজার টাকা বেতন পেতেন। এটা চলে এসেছে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই। পাকিস্তান আমলে সুপ্রীম কোর্টের বিচারকরা কেন্দ্রীয় সরকারের সেক্রেটারীর চেয়ে এক হাজার টাকা বেশি বেতন পেতেন। এখন পাচ্ছেন মাত্র একশ’ টাকা বেশী। সুপ্রীম কোর্টের বিচারকরা বর্তমান বেতন পান সর্বমােট ৩১০০ টাকা। কিন্তু এতাে অল্প টাকায় এই দুর্মূল্যের বাজারে চলা যে কতােটা কষ্টকর ব্যাপার সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়া বিচারকদের সরকারী গাড়ি ও বাসা পাওয়ার কথা। কিন্তু সুপ্রীম কোর্টের আপীল ডিভিশন ও হাইকোর্ট ডিভিশনের মােট ২৩ জন বিচারপতির মধ্যে ৫ জন এখনও সরকারী বাসা পাননি, গাড়ি পাননি ৭ জন। যাদের জন্য বাসা ও গাড়ির ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না তাদের দেয়া হয় মাত্র দুই হাজার টাকা। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বাড়ি না পাওয়ার সম্প্রতি বিচারপতি আবদুল মালেক ও বিচারপতি রফিকুর। রহমান পদত্যাগ করেছেন। বর্তমানে বারের কোনাে সুদক্ষ আইনজীবীকে সুপ্রীম। কোর্টের বিচারপতির পদ গ্রহণে আকৃষ্ট করা দুরূহ হয়ে উঠেছে।”
৭. দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন সভা সমিতিতে প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রী ঘােষণা করলেই শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হয়ে যাবে না। এর জন্য প্রয়ােজন সব রকম ছল চাতুরি ত্যাগ করে সাংবিধানিক গ্যারান্টির ব্যবস্থা করা। একমাত্র সাংবিধানিক গ্যারন্টিই বিচার। বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারে। কাজেই ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগ সম্পর্কে যে মূল বিধানসমূহ সন্নিবেশিত ছিলাে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত ও কার্যকারী। করলেই বিচার বিভাগ শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে ব্যারিষ্টার ইশতিয়াক আরও বলেন, বিচার বিভাগের চাকরিতে বা বিচার বিভাগীয় কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব নিযুক্ত ম্যাজিষ্ট্রেটদের কেবল মাত্র কোর্টের সুপারিশ অনুসারেই নিয়ােগ করতে হবে এবং এটিকে সংবিধানের অবশ্য পালনীয় বিধানরূপে গণ্য করতে হবে। সুপ্রীম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে থাকবে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং বিচার বিভাগীয় কাজ সম্পদানে নিযুক্ত ম্যাজিষ্ট্রেটদের বদলি, পদোন্নতি ও শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব। স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং ভালাে আইন ছাড়া বিশ্বের কোনাে সরকারই তার জনগণের প্রতি ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি। বিচার বিভাগের প্রতি আমাদের জনগণের অবস্থা ও বিশ্বাস এখনও সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে বা লুপ্ত হয়ে যায়নি, কিন্তু ঔদাসীন্য, বীরাগ ও নৈরাশ্য ক্রমশই পরিব্যাপ্ত হচ্ছে। সক্রিয় কর্মপন্থা গ্রহণে ল’ রিফমর্স অডিনেন্স সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একটি কমিটির সুপারিশক্রমে আটাত্তর সালে আইন সংস্কার অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এই অধ্যাদেশ আইনজীবীদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে এবং আমরা সম্মিলিতভাবে এর প্রতিবাদ করেছি।
এই অধ্যাদেশে আইন সংস্কারের লক্ষ্য। নেই, যা আছে তা হলাে ফৌজদারী কার্যবিধির কতিপয় সংশােধনের চেষ্টা, দেওয়ানী কার্যবিধির আপীল ও সিভিল রিভিশনের ক্ষেত্রে দুই ধারা বিধির সংশােধন। এছাড়া আছে বিট্রেশন এ্যাক্টের ছােটখাট একটি সংশােধন এবং কোর্ট ফি এ্যাক্ট, স্মল কটেজ কোর্টস এ্যাক্টের মামুলি সংশােধন। এটাকে সংস্কার অধ্যাদেশ বলা হয় না, এটা সংশােধনী অধ্যাদেশ। যাহােক, নতুন জাতীয় সংসদকে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনাে আলােচনার সুযােগ দেয়া হয়নি। প্রস্তাবিত যে কোনাে সংস্কারমূলক আইন সম্পর্কে জনগণকে কোনাে আলােচনার সুযােগ না-দিলে এবং জনপ্রতিনিধিগণ জাতীয় সংসদে সেগুলাে যথাযথভাবে আলােচিত না হলে এই আইন সংস্কারের কোনাে পদক্ষেপই কার্যকারী কিংবা গ্রহণযােগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। আইন সংস্কার অধ্যাদেশের মাধ্যমে এক কলমের খােচায় একগাদা মামলা কমিটিয় কোর্ট থেকে সেশন কোর্টে স্থানান্তর করা হয়েছে। জেলা সেশন কোর্টগুলােতে এমনিতেই নিজেদের অনেক বিচারাধীন মামলা জমে আছে। তার ওপর কোটগুলাের সম্প্রসারণ ও লােকবল না বাড়িয়ে তাদের ওপর কোর্টস থেকে আরও বাড়তি মামলার বােঝা চাপানাে ক্ষতিকর। আমরা আশাকরি এই সমস্যাসমূহের ব্যাপকতা সম্পর্কে সম্যক বিবেচনা করা হবে। ক্রমাগত অবহেলার মধ্যে যে অন্তর্নিহিত বিপদ রয়েছে সে সম্পর্কে সঠিক ধারণার উন্মেষ ঘটবে। ম্যাজিষ্ট্রেটেদের ক্ষমতা বাড়ানাে হয়েছে, তাতে আপত্তির কিছু নেই। তবে যে পর্যন্ত ম্যাজিষ্ট্রেটরা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত না হবেন এবং বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে আলাদ না করা হবে- ততদিন পর্যন্ত ন্যায়বিচার নিশ্চত করা সম্ভব তাে নয়ই বরং সংকট আরও ঘনীভূত হবে। সামরিক আদালতের বিচার সম্পর্কে তিনি বলেন, সামরিক আদালতে বিচারের রায় আমি মানি না। এর বিরুদ্ধে অবিলম্বে উচ্চ আদালতে আপীলে সুযােগ দেয়ার জন্য আমি জোর দাবী জানাচ্ছি। এ ছাড়া মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীলের সুযােগ না দিয়ে কাউকে মৃত্যুদন্ড প্রদান মানবতা ও ন্যায় বিচারের পবিপন্থী।৩
ল-রিফর্মসে প্রশাসনের কালাে হাতের ছাপ
৮, বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে আলাদা করা হবে বলে প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী যতােই বক্তৃতা বিবৃতি দেন না কেন বাস্তবে তা সম্ভব নয়। কারণ আনুষ্টানিক বক্তৃতা কিংবা ফলাও করে প্রচার করলেই শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা হয় না, হতে পারে না। বর্তমান সরকার তথাকথিত ল’রিফর্মস অর্ডিনেন্স জগদল পাথরের মতাে চাপিয়ে দেয়। উক্ত অর্ডিনেন্সের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয়নি, বরঞ্চ দেশের বিচার বিভাগকে সার্বিকভাবে আইন সংস্কারের নামে নৈরাজ্যের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে। প্রশাসন যে-কোনাে ছুঁতােয় সর্বোচ্চ আদালতের এখতিয়ার সংকুচিত করতে সচেষ্ট এই ল’ রিফর্মস অর্ডিনেন্সে সেই প্রশাসনের কালাে হাতের ছাপ সুস্পষ্ট। এই অডিনেন্সে ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১৭৩ ধারা সংশােধন ক’রে ৩ (খ) উপধারা সংযােজন করে তদন্তকারী সংস্থার ক্ষমতাকে অসম্ভব বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এই সংযােজনের ফলে পুলিশ একবার চার্জশিট দেয়ার পরও বিচার চলাকালে ও ইচ্ছে করলে বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এক বা একাধিক চার্জশিট দাখিল করতে পারে। এর ফলে পুলিশ কর্তৃক নিরীহ ব্যক্তিদের হয়রানির আশংকা বেড়ে গেছে বহুগুণ। এই অর্ডিনেন্সের ফলে বিচারধীন মামলা রাতারাতি কমিটং কোর্টস থেকে জেলা সেশন আদালতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। ঢাকা জেলায় সেশন আদালতের আগে বিচারযােগ্য মােকদ্দমা ছিলাে মাত্র ৩৫০টি। ল’ রিফর্মস অর্ডিনেন্স দায়ের হওয়ার পর এখন সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯০০ এ, কিন্তু বিচারকের সংখ্যা বাড়েনি। ফলে বর্তমানে যে সংখ্যক বিচারক আছেন তারা যদি অন্য সব মােকদ্দমা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র সেশন মােকাদ্দমারই বিচারই করেন তা হলে দায়েরকৃত মামলাটি নিষ্পত্তি হতেও দশ বছর সময় লাগবে। এমনি অবস্থা সব আদালতেই।
গ্রাম আদালতঃ বিচারের নামে প্রহসন
৯. গ্রাম আদালত স্থাপন মানেই হলাে বিচারকে চরম অবিচারের দিকে ঠেলে দেয়া। আমাদের দেশের চেয়ারম্যানরা যেভাবে ভিলেজ পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়েন তাতে তাদের কাছে নিরপেক্ষ বিচার আশা করা যায় না। অথচ গ্রাম আদালতে বিচারের রায় সুপ্রীম দেওয়ানী আপীলে অথবা রিভিশনাল এখতিয়ারের বহির্ভূত করা হয়েছে। এতে বিচারের নামে প্রহসন হচ্ছে, হচ্ছে অবিচার।
বিচার বিভাগের প্রতি সরকারের উদাসীনতার কথা উল্লেখ একজন বিশিষ্ট আইনজীবী বলেন, জিয়া সরকার দেশের বিচার বিভাগের ব্যয় নির্বাহের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করেন, তা থেকেই বিচার বিভাগের প্রতি তাদের উদাসীনতা এবং বিরূপতা সুস্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। সরকার শুধুমাত্র কোর্ট ফি থেকেই আয় করে প্রায় পৌনে চার কোটি টাকা। কিন্তু সর্বোআদলতের বিচারকমন্ডলী থেকে শুরু করে সরকারের ল’ অফিসারদের বেতনাদিসহ সমগ বিচার বিভাগের বাজেট পৌনে চার কোটি টাকারও কম; অথচ পশু পালন ও পশু চিকিৎসা বাবদ সরকারী বাজেট . বরাদ্দ প্রায় পাঁচ কোটি টাকা।৪
বিশেষ ক্ষমতা আইন সম্পর্কেঃ জিয়া
১০, ১৯৭৫ সনের স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্ট বা বিশেষ ক্ষমতা আইন সম্পর্কে জিয়াউর রহমান সমগ্র দেশে এটাকে আওয়ামী-বাকশালীদের অপৰ্কীতি ও কালাকানুন বলে তীব্র ভাষায় আক্রমণ চালান। ‘৭৯ ক্ষমতা পাকাপােক্ত হওয়ার পরও ৭৪ সনের। সেই বিশেষ ক্ষমতা আইন জিয়াউর রহমান তার জীবদ্দশায় বাতিল করেন নি। নির্বিচারে ঢালাওভাবে তা প্রয়ােগ করে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করেন। জিয়া অত্যন্ত চাতুৰ্যপূর্ণভাবে এটাকে’, ‘৭৪ সনে প্রণীত কালাকানুন বলেছেন, অন্যদিকে একে বহাল রাখার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। তিনি বলেন “অনুকম্পার আবেদন সবসময় মানবিক কারণে সাধ্যমত বিবেচনা ও উপযুক্ত ক্ষেত্রে প্রাণদণ্ড লাঘব করা হয়। কিন্তু আমি যদি সত্যিই সামরিক আইনে সকল সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রর্দশন অথবা সুপ্রীমকোর্ট আপিল করার অধিকার দানের ব্যাপারে একমত হতে না পারি তাহলে আমাকে ক্ষমা করবেন। তিনি বলেন, “কোনাে বিশেষ আইনের অধিনে কোনাে বিশেষ আদালতের বিচারে দোষী সাব্যস্ত করা বা দণ্ডদানকে খারাপ বলা যায় না। অথবা নিয়মিত আপীল আদালতকে আমলে আনা হয়নি বলেই আপীলের বদলে কোনাে পর্যালােচনা অগ্রহণযােগ্য বলে গণ্য হওয়া উচিত নয়।” প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আরাে বলেন, “বিশেষ আইন ও বিশেষ আদালতের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট বলেন, দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এধরণের আইন ও আদালতের প্রয়ােজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ পরিস্থিতি মােকাবেলার জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে কৃত অপরাধের বিচার করতে বিশেষ আদালত প্রয়ােজন।” তিনি বলেন, “কোনাে আইন। কোনাে দেশের প্রয়ােজন উপযােগী হলে এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও সংহতি নিশ্চিত করতে পারলে এর একটা ‘অর্থ ও উদ্দেশ্য থাকে। আমরা সমাজকে অধঃপতিত হতে এবং দুষ্কৃতকারীদের অবাধ বিচরণ ও দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে দিতে পারি না।”৫
বিচার বিঘ্নিত হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে
১১. এডভােকেট সম্মেলনে ভাষণদানকালে প্রধান বিচারপতি জনাব কামালউদ্দিন
হােসেন বলেন, বিচার বিঘ্নিত হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।’ ল’ রিফর্মস অর্ডিনেন্স কার্যকর প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, এই অর্ডিনেন্স কার্যকর হওয়ার এবং ফৌজদারী কার্যবিধির অষ্টাদশ পরিচ্ছদ বাতিল হওয়ায় ব্রাজিষ্ট্রেট কোর্টের মােকাদ্দমাসমূহ সরাসরি সেশন জজের আদালতে স্থানান্তর হয়ে মামলার সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সৃষ্টি হয়েছে এক অচলাবস্থার। এসব মােকাদ্দমার নিষ্পত্তি হওয়া দূরে থাকুক, বিদ্যমান মামলাগুলাে নিষ্পত্তি হ’তে আরও তিন-চার গুণ বেশি সময়ের প্রয়ােজন। তিনি অবিলম্বে প্রত্যেক জেলা পর্যায়ে কমপক্ষে কয়েকজন অতিরিক্ত জেলা জজ এবং প্রত্যেক মহকুমা পর্যায়ে পরিমাণ সংখ্যক সাব জজ ও মুন্সেফ নিয়ােগের সুপারিশ করেন। বিচারপতি জনাব কামাল উদ্দিন হােসেন। বলেন, ‘সুপ্রীমকোর্টের বিচারকরাঅর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন। এ ছাড়া নিম্ন বিচার বিভাগের অফিসারগণ যেভাবে বেতন ও ভাতা পান তাও ন্যায়সংগতভাবে নির্ধারিত হয়নি।
সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবাবলি
১২. আইনজীবী সম্মেলনে শেষ দিনে (৩০শে মার্চ ১৯৮০) গৃহীত প্রস্তাবে চতুর্থ ও ৫ম। সংশােধনী, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন , গ্রাম ও পৌরশালিসী আদালতসংক্রান্ত অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করার জোর দাবি জানিয়েছে। বিচার বিভাগের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা দাবি করে সম্মেলন সুপ্রীম কোর্টের বিচারক নিয়ােগ ও অপসারণকে সংবিধানভুক্ত ও সংসদের এখতিয়ারাধীন করারও জোর দাবি জানায়। সম্মেলন বিচার বিভাগের সকল নিয়ােগ বদলী পদোন্নতি সুপ্রীম কোর্টের আওতায় ন্যস্ত, সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি সহ কোন বিচারককে রাষ্ট্রের অন্যবিধ কারণে দায়িত্বে নিয়ােগ না করার এবং দেশে সার্কিট কোর্ট ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য কোর্ট প্রশাসনিক বিভাগে উপযুক্ত স্থানে সুপ্রীমকোর্টর হাইকোর্ট ডিভিশনের ব্রাঞ্চ রেজিষ্ট্রী। স্থাপনেরও দাবি জানানাে হয়। সম্মেলনে গৃহীত অন্যান্য প্রস্তাবে সামরিক আইন ও অন্য আইনে দণ্ডিত সকল ব্যক্তিকে হাইকোর্ট ডিভিশনে আপীলের সুযােগদান, প্রধান বিচারপতির সুপারিশ।
ব্যতীত সুপ্রীম কোর্টের বিচারক নিয়ােগ না করার বিধান সংবিধানে সন্নিবিশিত করা, সংসদের তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের সমর্থনে গৃহীত প্রস্তাব ব্যতীত সুপ্রীম কোর্টের কোনাে বিচারক অপসারণ না করার প্রথা, নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে আদালতসমূহের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা খর্ব কিংবা সংকোচনের সকল কালাকানুন। বাতিল করার দাবি জানায়।
জিয়ার ভাষণে ক্ষোভ
১৩. সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্টের ভাষণের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, উক্ত ভাষণে দেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উচ্চকিত সর্বসম্মত দাবি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং আইন
পেশায় নিয়ােজিত ব্যক্তিদের সমস্যাবলির ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের ভ্রুক্ষেপহীন ১: মনােভাবই ব্যক্ত হয়েছে। দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি রােধ,দ্রব্যমূল্য হ্রাস, সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশা লাঘবে সম্মেলন সরকারের উদ্যোগ কামনা করে। সম্মেলন যে কোনাে আদালত বা ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে আপীলে সুযােগদান করা বাঞ্ছনীয় ব’লে মনে করে এবং হাইকোর্ট ডিভিশনের অনুমােদন ছাড়া এবং আপীলের সুযােগদানের আগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা উচিত নয় বলেও জোর অভিমত ব্যক্ত করে। প্রস্তাবে বলা হয়, সম্মেলন আইন সংস্কার অধ্যাদেশ পুরােপুরি বাতিল করার পক্ষপাতী নয়। তবে ন্যায়বিচার সহজতর করার স্বার্থে অর্ডিন্যান্সে ১৯৪৮-এর ফৌজদারী দণ্ডবিধি, ১৯০৮ সালের দেওয়ানী দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট কিছু সংশােধনী কামনা করে। এছাড়া সম্মেলনে গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ ও পৌরসালিসী অর্ডিনেন্স অবিলম্বে বাতিল করার জোর দাবি জানায়। বিচার বিলম্বের জন্য বিচারকের অভাবকে দাবি করে সম্মেলন উপযুক্ত চাকরির শর্তে আইনজীবীদের মধ্য থেকে বিচারক নিয়ােগের দাবি এবং বার কাউন্সিলের সদস্যদের নিয়ে বিচার বিভাগীয় কাউন্সিল গঠনের জন্য প্রধান বিচারপতিকে
ক্ষমতাদানের দাবি জানানাে হয়।
১৪. ১৯৭৯ সনের ৬ই এপ্রিল সামরিক শাসন প্রত্যাহার পর্যন্ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কেন, বলতে গেলে বিচার বিভাগের কোন ক্ষমতাই ছিলাে না। ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে সারাদেশে সামরিক শাসনজারী করা হয়। ২০শে আগস্ট ‘৭৫-এর এই
সামরিক ফরমানে ঘােষণা করা হয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীমকোর্ট হতে শুরু করে কোন কোর্টেই সামরিক শাসনের আওতায় জারীকৃত কোন কৃৎকর্ম, আদেশ, ঘােষণা, বিজ্ঞপ্তি বিধি-বিধান উপ-বিধি সহ অন্যান্য কিছু সম্পর্কে প্রশ্ন তােলা যাবে।৬ এই সামরিক ঘােষণা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে সামরিক আইন প্রত্যাহারের পূর্ব পর্যন্ত বলবৎ ছিলাে। সেক্ষেত্রে জিয়ার রাজত্বে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্ন আসে না, আসে না ন্যায় বিচার ও আইনে আশ্রয় লাভের প্রশ্ন।
সূত্র : জেনারেল জিয়ার রাজত্ব – অধ্যাপক আবু সাইদ