You dont have javascript enabled! Please enable it!

জিয়ার রাজত্বে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত চক্রান্ত

১. গণতান্ত্রিক দেশের অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। সংবাদপত্র জনগণের কণ্ঠস্বর। রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব যাদের হাতে তারাও-জনগণের মৌলিক অধিকার, নাগরিক অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলাের ভালাে ভালাে কথা বলে চলেছেন। দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু রয়েছে বলে সরকার বারবার মুখে দাবি করছেন, টিভি, রেডিও বিভিন্ন বক্তব্য বিবৃতিতেও ফলাও করে একথা প্রচার করছেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার উল্টোটাই দেখা যাচ্ছে। সরকার। ক্ৰমেক্রমে জনবিচ্ছিন্ন হচ্ছেন। জনগণের আশা-আকাঙ্খা পূরণে ব্যর্থ সরকার জনমত প্রকাশের পথ বন্ধ করছেন।

২. খাদ্য সংকট, চুরি, ডাকাতি খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি সামাজিক অপরাধ এবং দুষ্কর্মের অবাধ রাজত্ব দেশে কায়েম হয়েছে। এসব ব্যর্থতা, দুষ্কর্ম, অযােগ্যতা ফাস হওয়ার ভয়ে সরকার সংবাপত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছেন। জিয়ার সামরিক সরকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের তীব্রতাকে ভয় পান। তাই মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়িয়ে অগণতান্ত্রিক পথে নিউজপ্রিন্টের মূল্য বাড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের তীব্রতা দুর্বল করতে ছলে-বলে কৌশলে সংবাদপত্রের অস্তিত্বের ওপর ক্রমাগত আঘাত হানছে। সরকার সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ করছেন। সংবাদপত্রের কোনাে স্বাধীনতা নেই।

৩. নিউজপ্রিন্টকে সরকার রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। মাত্র। কয়েক মাসের ব্যবধানে এর মূল্য দু’-দু’বার বাড়িয়েছেন। শতকরা আশিভাগ বিজ্ঞাপনের ওপর রয়েছে সরকারী কর্তৃত্ব। বিজ্ঞাপন বন্টনের ক্ষেত্রেও জিয়া সরকারের পক্ষপাতমূলক নীতি অনুসৃত হচ্ছে। সংবাদপত্রের উৎপাদন ব্যয় অত্যধিক বেড়ে গেছে। স্বাধীন সংবাদপত্র যাতে এই সংকট সহসা কাটিয়ে উঠতে না পারে তার জন্যে সরকার বিজ্ঞাপনের বাজেট শতকরা আশিভাগ কমিয়ে দিয়েছে। সরকারের অনুসৃত এই নীতি স্বাধীন সংবাদপত্রের ওপর সরাসরি হুমকি বলে সংবাদপত্র পরিষদ, সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল বিবৃতি দিয়েছে। ইতিমধ্যে নিজউপ্রিন্টের মূল্য বৃদ্ধিতে সরকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ ‘৮০ সনের ২১শে অক্টোবর দেশব্যাপী কালাে দিবস পালনের যে কর্মসূচী ঘােষণা করেছে তার প্রতি দেশের রাজনৈতিক দল ও গণতন্ত্রমনা জনগণ সমর্থন জানিয়েছেন।

৪. প্রবীণ সাংবাদিক জনাব জহুর হােসেন চৌধুরীর মতে, “জাতীয় স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতার মতাে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কথাটারও কোনাে সরল অর্থ নেই। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে সাধারণত সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ চাপ বা প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা বােঝায়।” সাপ্তাহিক ‘রােববার প্রতিবেদকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জনাব জহুর হােসেন চৌধুরী বলেন, “বর্তমানে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনত্ব নেই। সংবাদপত্রগুলােকে সব সময়ই সরকারী, জকুটির দিকে লক্ষ্য রেখে মতামত প্রকাশ এবং সংবাদ ছাপতে হয়।”

৫. বিবিসি হতে বলা হয়েছে, “দৈনিক সংবাদপত্রের মধ্যে যে ক’টি বেসরকারী মালিকানায় পরিচালিত সেগুলাে সরকারের সমালােচনা করলেও সবসময়ই একটা আশঙ্কা রয়েছে যে, যে কোনাে সময় এ সমালােচনার জন্যে বিপদ আসতে পারে।

৬. তাছাড়া সবসময়ই সরকারের ভ্রুকুটির দিকে লক্ষ্য রেখেই মতামত প্রকাশ করতে হয়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অফিসাররা টেলিফোনে বিভিন্ন সংবাদপত্রে কোন খবর ছাপা যাবে আর কোন্ খবর ছাপা যাবে না সে সম্পর্কে পরিষ্কার নির্দেশ দেন। বর্তমানে শতকরা ৮০ ভাগ শিল্প বাণিজ্য সরকারী মালিকানায় থাকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার মারফতে সরকার যে কোনাে সংবাদপত্রের ওপরেই নিয়ন্ত্রণ চাপাবার চেষ্টা করতে পারেন এবং করছেনও।

৭. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা একটা ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা নিশ্চিত করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকারের অংশ বিশেষ। বিভিন্নভাবে সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার চাবি সরকারের হাতের মুঠোয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আসলে ব্যক্তি স্বাধীনতা বা বাক-স্বাধীনতার অংশবিশেষ। অপর কথায় জনগণের মঙ্গলামঙ্গল, কল্যাণের ব্যাপারে সরকারকে দায়িত্বশীল করার ক্ষেত্রে স্বাধীন সংবাদপত্র হলাে প্রতিবাদী কণ্ঠ। সরকারকে সঠিক পথে রাখার ব্যাপারেও স্বাধীন সংবাদপত্র বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার সমালােচনা সত্ন করতে পারে না। কারণ তারা যেভাবে হত্যা খুন করছে তা প্রকাশিত হলে জনতার রুদ্ররােষে সরকারের পতন হতাে। সেজন্য সংবাদপত্রকে নিয়ে সরকারের কত ভয়।

৮. দেশে এখনাে মার্শাল ‘ল ইমারজেন্সি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, মানুষের মৌলিক অধিকার জরুরী অবস্থার মধ্যে অক্ষুন্ন রয়েছে। কিন্তু আইনগত দিকে থেকে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইমারজেন্সি ও মৌলিক অধিকারের। সহ অবস্থান ব্যাপারটি পারস্পরিকভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ। ৫

৯. প্রেস এন্ড পাবলিকেসন্স অ্যাক্টের বাধন ছাড়াও স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্টেও সংবাদপত্রের ব্যাপারে বিশেষ নিষেধ রয়েছে। সংবাদপত্র প্রকাশ ব্যাপারে, সংবাদপত্রে নিউজ প্রিন্ট বন্টনের ব্যাপারে সরকারের পুরাে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। 19. বাংলাদেশের দু’টি মাত্র জাতীয় ইংরেজী দৈনিকের দু’টিই সরকারী মালিকানাধীন। || দেশে তৃতীয় কোনে ইংরেজী দৈনিক প্রকাশের ব্যাপারেও সরকার অনুমতি দেননি। মন বিভিন্নভাবে সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণের চাবি যেখানে সরকারের হাতে সেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকতে পারে না।

১০. যদিও বলা হচ্ছে সংবাদপত্রের সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু সংখ্যার পরিমাণ দেখেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পরিমাপ করা যায় না। ১১. সামরিক শাসনের বিধি-নিষেধ, জরুরী আইন বিশেষ ক্ষমতা আইন বহাল রেখে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা অর্থহীন। যদিও প্রেসিডেন্ট জিয়া সাংবাদিকদের মনজয় করার জন্য ১০ লক্ষ টাকা অনুদান ঘােষণা করেছেন।

সূত্র : জেনারেল জিয়ার  রাজত্ব  – অধ্যাপক আবু সাইদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!