You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৬শে জানুয়ারী, শনিবার, ১৯৭৪, ১২ই মাঘ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন

জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ গত বৃহস্পতিবার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে মাস খানেক ধরে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে কার্য পরিচালনা করছিলেন। গত বৃহস্পতিবার তিনি দেশের নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায় বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী পদত্যাগ করার পর দেশের রাষ্ট্রপতি কে হবেন সে প্রশ্নে এতোদিন যে সব জল্পনা-কল্পনা চলছিলো তার অবসান ঘটলো। সাথে সাথে দেশের স্বাভাবিক প্রশাসনিক কাঠামোও একটি অনিশ্চয়তার হাত থেকে মুক্তি পেলো। দেশের মানুষও একটি চিন্তা থেকে রেহাই পেলেন।
জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ বাংলাদেশের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি এবং সেই ক্ষেত্রে তিনি জাতির জনকের উত্তরসুরীও বটেন। নিষ্ঠাবান কর্মী, নীরব চিন্তাবিদ এবং প্রগাঢ় চারিত্রিক বলিষ্ঠতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী জনাব মোহাম্মদ উল্লাহর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায় দেশের মানুষ অবশ্যই খুশী হয়েছেন। তাঁর পূর্বসুরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মূলতঃ বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হলেও যেহেতু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ছিলেন পাকিস্তানীদের জিন্দান খানায় বন্দী। সেজন্য তাঁর পক্ষে তখন প্রত্যক্ষভাবে এ পদের দায়িত্ব চালানো সম্ভব হয় নি। ফিরে আসার পর যেহেতু তিনি দেশে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সেহেতুই তাঁকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করতে হয়। তারপর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ ও প্রজ্ঞার আধার বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী। বাংলাদেশের জনগণ তথা এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিশ্বের জনমত সৃষ্টির জন্যে বিচারপতি জনাব চৌধুরী যেভাবে কাজ করেছিলেন, জাতি সেজন্য তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। দেশে ফিরে এসে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হবার পরও তিনি সেই একইভাবে দেশসেবা করে গেছেন। পরবর্তীকালে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে তথা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষে সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য এবং এদেশকে তার যোগ্য আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করার কাছে আত্মনিয়োগ করতেই তিনি রাষ্ট্রপতি পদের মায়া ত্যাগ করে বাংলাদেশের বিশেষ দূত হিসেবেই জেনেভা গেছেন। এত বড় ত্যাগ আজকের দিনে বিশ্ব ইতিহাসে বিরল।
জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ সেই বঙ্গবন্ধু ও বিচারপতি জনাব চৌধুরীর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। তিনি এমন এক সময় দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে নির্বাচিত হয়েছেন যখন সারাদেশ অস্ত্রহীন সমস্যার বেড়াজালে আবদ্ধ। যখন দেশের প্রশাসনিক কার্যক্ষেত্রে একটি জগাখিচুড়ী অবস্থা বিরাজিত, আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটছে, অভাব, অনাহার, দারিদ্র দেশকে গ্রাস করছে, শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য, জনস্বাস্থ্য বিপর্যস্ত, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিধ্বস্ত এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর কোনো ভিত্তিই এখনো প্রতিষ্ঠিত নয়, সেই সময়ে তিনি আমাদের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করছেন। আমরা জানি, রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর কর্মক্ষেত্রের পরিধি ব্যাপক হলেও প্রটোকলগত কারণে তা সীমিত এবং তাঁর পক্ষে তাবৎ সবকিছু সরাসরিভাবে সম্পাদনও সম্ভব নয়। তবুও তাঁর মতো সুবিবেচক ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিকের সময়োপযোগী বক্তব্য অবশ্যই সরকারী কর্মতৎপরতাকে সঠিক লক্ষ্যে এগিয়ে নেবে—সেই বিশ্বাস আমাদের আছে এবং সেটাই আজ জাতির কাম্য।

অবস্থা সুবিধের নয়

দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এ পর্যন্ত যে খবর পাওয়া গেছে, তাতে সরকার গৃহীত ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান একেবারেই হতাশাব্যঞ্জক। বলা যায়, সম্পূর্ণই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
অথচ, কতো সাধ করে ও ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সরকার এ পরিকল্পনাটি নিয়েছিলেন গত নভেম্বর মাসের পনেরো তারিখ থেকে। আশা ছিল, এর ফলে একদিকে যেমন প্রয়োজন মুহূর্তে দেশের ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে, অন্যদিকে তেমনি বেআইনী মওজুতদারী, কালোবাজারী বা সীমান্ত পাচারী বন্ধ করে খাদ্যদ্রব্যের নিত্যবর্ধমান অগ্নিমূল্য রোধ করে দেশের মানুষকেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ দেয়া সম্ভব হবে। মানুষও খুব খুশী হয়েছিল এবং প্রথম দিকে বেশ সাড়াও দিয়েছিল সরকারের এ প্রশংসনীয় উদ্যোগে। কিন্তু, এ উদ্যোগ ও উদ্যম বেশীদিন স্থায়ী হতে পারেনি। শেষের দিকে কিছুই থাকেনি বলা চলে।
প্রশ্ন করা যায়, এমন একটা জাতীয় প্রয়োজন মেটানোয় কেন সংশ্লিষ্ট সবার মনে উদ্যোগ ও উদ্যমের ক্ষেত্রে এ ভাটা এসে এমন প্রশংসনীয় পরিকল্পনাটি ভেস্তে গেল?
হ্যাঁ, গুনে দেখলে এ ভেস্তে যাবার পেছনে অনেক অনেক কারণ আছে। অনেক অশুভ অদৃশ্য হাতের প্রভাব ও কারসাজিও আছে। সামগ্রিকভাবে বিচার করলে এ ব্যর্থতার জন্য আমরা সবাই দায়ী। কম আর বেশী।
মূলে গলদ রেখে আজো পর্যন্ত কোনো সৎ পদক্ষেপ প্রকৃতভাবে বাস্তবায়িত হতে পারেনি। ভবিষ্যতেও হতে পারবে বলে ভরসা নেই। অথচ, গোড়ায় গলদ রেখেই আমরা অভিযানে নেমেছিলাম। তাই বেশী দূর আমরা এগুতে পারিনি।
ধান-চাল সংগ্রহের অভিযান অন্যান্য সমাজবিরোধী ব্যাধি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। অথচ, আমরা সে কথা সম্যক উপলব্ধি করতে পারিনি। তাই, চোরাচালানী, মুনাফাখোরী, মওজুতদারী, জোতদারী, সীমান্ত পাচারী ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকার কোনো কঠোর ও বাস্তব ব্যবস্থা নিয়ে অভিযানে নামিনি। সুতরাং অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই আমরা ব্যর্থ হয়েছি। ব্যর্থ হয়েছি সোনার বাংলা গঠনের শপথ নিয়ে দুঃখী মানুষের জঠর জ্বালা নিবারণ করে তার মুখে হাসি ফোটাতে। বিভিষণ আমাদের পদে পদে বাঁধা দিয়েছে।
আমরা বুঝতে পারিনি এ অভিযান ঠিক কতো ব্যাপক। তাই ভেবেছি প্রশাসনের পয়সা দিয়ে ভার দিলেই কৃষক সুড় সুড় করে তার ঘরের সমস্ত উদ্বৃত্ত ধান-চালই সরকারের হাতে তুলে দিয়ে যাবে। তাই কয়েকটি ক্রয় কেন্দ্র খুলেই আমরা ভেবেছি, আমাদের সব দায় পালন হয়ে গেছে।
কিন্তু আমরা বুঝিনি, এ আন্দোলন আরো ব্যাপক, আরো যত্নের দাবীদার। বুঝতে পারিনি এ একদিকে যেমন রাজনৈতিক আন্দোলন, অন্যদিকে তেমনি কৃষি আন্দোলনও বটে। আমরা শুধু আমাদের একটি ক্রয় আগ্রহই দেখিয়েছি, কিন্তু কৃষকের বিক্রয় আগ্রহ কেনার কোনোই বাস্তব ব্যবস্থা নেইনি। ফলে, আমাদের কেনার অভিযান ব্যর্থ হয়েছে।
কথা ছিল, এবার মোট উৎপাদনের প্রায় শতকরা ৫ ভাগ ধান-চাল সংগ্রহ করা হবে। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার ষোলোভাগের এক ভাগও সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। গত ১৫ই নভেম্বর থেকে ২৫শে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২৫,০০০ টন সংগ্রহ করা সম্ভব হয়, অথচ, লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার লাখ টন।
কারণ অনেক দেখানো হয়েছে। সময় মতো অনেক জায়গায় ক্রয় কাজ শুরু হয়নি, যেখানে শুরু হয়েছে সেখানে অর্থাভাবে কেনাকাটা বন্ধ, গুদামের অভাব, প্রশাসনের অসহযোগিতা, ফড়িয়া দালালের উৎপাত, ক্রয় পদ্ধতির ক্রুটি মওজুতদার, মুনাফাখোরদের দৌরাত্ম্য, ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীদের নির্বাচনী ব্যস্ততা, গণ কমিটি, কৃষক সমিতি বা খাদ্য কমিটির অনুপস্থিতি, কোথাও কোথাও সীমাবদ্ধ অংশ গ্রহণ, চোরাচালানীদের তৎপরতা, রাজনৈতিক ছত্রছায়ার দৌরাত্ম্য ইত্যাদি আরো অনেক কিছু।
এখনো যে সময় শেষ হয়ে গেছে এমন কথা আমরা বলবো না, তবে ত্বড়িৎ গতিতে কাজ চালালে হয়তো অবস্থার উন্নতি হতেও পারে।

কর্তৃপক্ষের নেয়া একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ

বাংলাদেশের দুঃস্থ শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীদের কল্যাণের জন্য সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় একটি তহবিল গঠন করেছেন বলে সংবাদে প্রকাশ। এক সরকারী হ্যান্ডআউটে জানানো হয়েছে যে, দুঃস্থ শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীদের আর্থিক সাহায্য দান ও সাধারণ কল্যাণের দিকে নজর দেওয়াই এই তহবিলের উদ্দেশ্য। তহবিল সংগ্রহের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে পঁচিশের মার্চ থেকে তিন মাসের জন্যে ৬টি ভারতীয় ছবি প্রদর্শনী হবে। এই ছয়টি ছবির মধ্যে প্রখ্যাত পরিচালক সত্যজিত রায়ের ‘গোপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিটি ভারত সরকার বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছেন।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত এ ধরনের একটি উদ্যোগে আমরা আনন্দিত। দেশের দুঃস্থ শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর এ তহবিলের আবশ্যকতা নিঃসন্দেহে অপরিসীম। দেশের বহু শিল্পী তার দুঃস্থ জীবনে এসে তার গুণগ্রাহীদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে। এমন অনেক প্রখ্যাত শিল্পী রয়েছেন যাদের অসহায়ত্বের কালে কেউ খোঁজ খবর পর্যন্ত নেননি। সংস্কৃতিসেবীদের বেলায়ও এটা সত্য। যদি কর্তৃপক্ষের দিক থেকে বাস্তব সাহায্য ও সহযোগিতা মিলতো তাহলে এমন অনেক সাংস্কৃতিক সংস্থা ও সংস্কৃতিসেবী ছিলেন যারা জাতির সুনাম বৃদ্ধি করতে পারতেন। অতীতেও আমরা দেখেছি এবং বর্তমানেও আমরা তেমন কোনো সাহায্য ও সহযোগিতার উদাহরণ দেখিনি। অথচ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এদেশের শিল্পীরা ও সংস্কৃতিসেবীরা এতোদিন কোনো স্থায়ী বাস্তব সহৃদয়তা পায়নি। মাঝে মধ্যে বঙ্গবন্ধুর অপার মহানুভবতায় দুঃস্থ শিল্পীরা কিছু কিছু সাহায্য পেয়েছে। উল্লেখিত এ তহবিল গঠন করে সরকার একটি উল্লেখযোগ্য দূরদর্শিতার পরিচয় প্রদান করেছেন। গোটা বিশ্বই এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাবে। মহান বন্ধুরাষ্ট্র ভারত একটি মূল্যবান ছবি এই তহবিল গঠনের প্রাথমিক কাজে বন্ধুত্বের উপহার হিসেবে প্রদান করে আমাদেরকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন। সরকারের এই উদ্যোগ অবিলম্বে কার্যকরী হোক এটাই আমরা কামনা করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!