You dont have javascript enabled! Please enable it! সঙ্গে সঙ্গে আমাকে শুইয়ে ফেলে লাঠি দিয়ে গরু পিটানো শুরু করে। - সংগ্রামের নোটবুক

 

আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়ী চলে যাই যশোর দখল হবার পর। টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড় কিছু না থাকায় ওখান থেকে ২৭শে এপ্রিল আমি শহরে আসি আমার বাসাতে কাপড় চোপড় নেবার জন্য।

 

২৮শে এপ্রিল খুব ভোরে থেকে আমাকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায়। লেঃ কঃ তোফায়েলের কাছে হাজির করে। জিজ্ঞাসাবাদ করে এক মেজর আমাকে যশোর সেনানিবাসে নিয়ে যায়। আমাকে এফ, আই, ইউ-র মেজর খোরশেদ ওমরের কাছে দেয়।

 

একজন সিপাইকে বানাতে বলে। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে শুইয়ে ফেলে লাঠি দিয়ে গরু পিটানো শুরু করে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরলে পা ধরে বারান্দায় টেনে এনে একজন সুবেদার কিল-চড়-ঘুষি যথেচ্ছা মারা শুরু করলো। আমি চিৎকার করতে থাকি। তারপর যেই আসুক না কেন লাথি কিল মারতে থাকে।

 

বিকালে আমাকে টানতে টানতে একটি ধরে রেখে আসলো। এরপর থেকে প্রত্যেহ সকাল বিকাল বের করতো এবং ভীষণভাবে মারতো। আমাকে জিজ্ঞাসা করতো এস,পি,ডি, কি করেছেন, তুমি কি করেছ? না বললেই মারতো। সমস্ত শরীর দিয়ে রক্ত না ঝরা পর্যন্ত, জ্ঞান হারা না হওয়া পর্যন্ত মারধর করতো।

 

আমি যেহেতু ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার, সেহেতু সব খবর জানি এই কথাই ধরে নিয়েছিল, তাই অত্যাচারের মাত্রা খুব বেশী ছিল। আমি পতাকা তুলে দিয়েছি সব খবর মুক্তিসেনাদের দিয়েছি ইত্যাদি। আমাকে ঐ ক্যাম্পে তিন মাস তিনদিন আটকে রাখে এবং প্রত্যেহ মারধর করতে থাকে।

 

আমাদের ছোট্ট একটি ধরে অফিসার, দারোগা, অধ্যাপক, মাষ্টার, পুলিশ, কৃষক, শ্রমিক সবাইকে একত্র রাখতো। সারাদিন কোন খাবার দিত না, সন্ধার আগে অল্প কিছু খাবার দিত। খুব ভোরে পায়খানা প্রস্রাব করাতে বসাতো, দেরী হলে মারধর করতো। সারাদিন রাতে একবার পায়খানা প্রস্রাব করাতো। সকালে আমাদের বের করিয়ে পায়খানা ধোয়াতো, ড্রেন পরিস্কার, জঙ্গল পরিস্কার মাল বওয়ানো অভুক্ত অবস্থায় করিয়ে নিতো। প্রস্রাব অনেকে ভিতরেই করে ফেলতো। মারের চোটে সারা শরীর ঘা হয়ে গিয়েছিল, মাছি বসে পুঁজ জমে সারা ঘরে একটি নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। মাঝে মাঝে এক লোক আসতো। আমরা ভালো করে বসতেও পারতাম না। সন্ধ্যার আগ দিয়ে সামান্য খাইয়ে ঘরে পুরে রাখতো। তিন মাস তিনদিন আমাকে গোছল করতে দেয়নি।

 

২রা মে ২৯ জনকে হাত, চোখ বেঁধে নিয়ে যায় সন্ধ্যাবেলা, বাকী থাকি আমি, একজন ড্রাইভার ও একজন সি, ও। পরে শুনলাম ওদের ট্রেন্স খুড়িয়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। ওর মধ্যে অধ্যাপকও ছিলেন।

 

তারপর থেকে প্রত্যহ রাত বারোটার পর ১০/১২ জন করে নিয়ে যেত আর ফিরতো না। প্রত্যেহ নতুন লোক এসে আবার ঘর ভরে যেতো।

 

জুলাই মাসের শেষের দিক হতে শুনলাম যাদেরকে গাড়ীতে করে নিয়ে যায় রাতে বহু দূরে নিয়ে গিয়ে বোয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করতো।

 

অপারেশন স্পটে যাদেরকে ধরে আনতো তাদেরকে হাত-পা পিটিয়ে ভেঙ্গে ফেলতো। তারপর শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে দিত এবং গুলি করে হত্যা করতো।

 

আগষ্ট মাসের ২/৩ তারিখে আমাদের ১০/১২ জনকে সেনানিবাসের মডেল প্রাইমারীর এক ধরে নিয়ে যায়। এখানে নিয়ে আসার পর শুনলাম এর আগে যাদেরকে হত্যা করেছে তাদের কোন তালিকা বা হিসাব নেই। অসংখ্য মানুষকে তারা হত্যা করেছে ঐ সময়। এপ্রিলে যাদেরকে ধরেছিল একমাত্র আমিই বেঁচে ছিলাম।

 

এখানে আসার পর খাওয়া দাওয়া একটু ভালো হলো। মারধর কম করতে থাকে।

 

আগষ্ট মাসের ১২/১৩ তারিখ ইনটারোগেশনের জন্য নিয়ে যেত এবং নানা কথা-যেমন বিহারী হত্যা করেছি, পাকসেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি, অস্ত্র যুগিয়েছি ইত্যাদির কথা লিখিয়ে আমাদের দিয়ে সই করিয়ে নেয়। চিৎ করে শুইয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলতো, একটু হেললে লাঠি দিয়ে পিটাতো। তিন দিন ঐ ভাবে অত্যাচার চালায় অমানুষিক।

 

সেপ্টেম্বরের শেষ অথবা অক্টোবর মাসের প্রথমে আমার বিরুদ্ধে সামরিক কেসের চার্জ নিয়ে একটি কপি দেয় এবং তার পরপরই জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়। ঢাকা থেকে আরও অতিরিক্ত কেস আমার বিরুদ্ধে আসে। আমার সাথে ডেপুটি ম্যাটিষ্ট্রেট সানাউল হক, ইন্সপেক্টর আক্তার চৌধুরী, নূর মোহাম্মদ, ডাঃ আনিসুজ্জামান এম, বি, বি, এস, আনিসুর রহমান ইত্যাদি লোকদের বিরুদ্ধে মামলা ওঠে।

 

অক্টোবর মাস থেকেই ম্যাজিষ্ট্রেট সানাউল হক সাহেবের কেস ওঠে। দুটো হিয়ারিং হবার পর কেস বন্ধ হয়ে যায়।

 

২৮ শে নভেম্বর চিঠি পেলাম আমি চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছি। মুক্তি পাই ২৮শে নভেম্বর।

 

আমি মুক্তি পেয়ে বাসাতে আসি। আমার দেশের বাড়ী সব পুড়িয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। আমার পরিবার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে বেরিয়েছে।

 

আমি শুনতাম দৈনিক বিভিন্ন স্থান থেকে মেয়েদের ধরে আনতো এবং সেনানিবাসের ২/৩টি স্থানে রেখে বিভিন্ন সময় ইচ্ছানুসারে তাদেরকে ভোগ করতো।

 

স্বাক্ষর/-

বদিউজ্জামান

হাজী মেহের আলী রোড

খুলনা

১৪/৭/৭৩