You dont have javascript enabled! Please enable it!

পিন্ডির ঘাতকেরা ব্যারাকে ফিরেছে

ইয়াহিয়া খান নতি স্বীকার করেছেন। তাঁর ঘাতকদল ব্যারাকে ফিরে গেছে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে আগামী ২৫শে মার্চ। বেতার ভাষণে বলেছেন ইয়াহিয়া খান। ভুট্টো-মুজিবর সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। বর্তমান অচল অবস্থার জন্য দায়ী ভুট্টো। তার ইঙ্গিতেই ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হতে দেননি। সর্বসম্মত সংবিধান রচনার আশা কম। তা সত্ত্বেও পাক-ডিকটেটর চাচ্ছেন সর্বসম্মত সংবিধান। নির্বাচন হয়ে গেছে প্রায় দু’মাস আগে। এর মধ্যে ভুট্টো-মুজিবর মতৈক্য হয়নি। আগামী দু সপ্তাহের মধ্যে তা হবার সম্ভাবনা নেই। ইয়াহিয়া খান যদি বলতেন, তিনি সংখ্যাধিক্যের রচিত সংবিধান মেনে নেবেন, তবে তাঁর ভাষণের মধ্যে নতুনত্ব থাকত! জনসাধারণ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারত। ইয়াহিয়া খান তার ধারে-কাছে যাননি। তিনি পুরানাে কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। তার মতলব সম্পর্কে সন্দেহ জাগা খুবই স্বাভাবিক। পূর্ব বাংলার পুলিশদল বিদ্রোহী। তাদের নিরস্ত্র করা হচ্ছে। জনগণ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অচল করে দিয়েছে। তারা রেল-লাইন তুলছে। ঢাকা শহর বিচ্ছিন্ন হতে চলছে। আরও সৈন্য না পাঠালে পূর্ব বাংলাকে আয়ত্তে রাখা যাবে না। পশ্চিম থেকে পূবে সৈন্য যেতে সময় লাগবে। জলপথে পাঞ্জাবী সৈন্যরা রওনা হয়েছে। বিমানে তারা পূর্ব বাংলায় পাড়ি জমাচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ সৈন্য সমাবেশের জন্য কটা দিন দরকার। ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের গােপন অভিসন্ধি তাই কিনা বলা মুস্কিল।
মুজিবর আগে যেখানে ছিলেন, এখনও সেখানেই আছেন। ছ’দফা দাবীতে তিনি অনড়। ওটা নড়চড় করার মত অবস্থা এখন তার নেই। মুজিবরের দাবী ভুট্টো মানবেন—এমন কথা তিনি এখন পর্যন্ত বলেননি। ইয়াহিয়া খান অজুহাত দেখাচ্ছেন—ভুট্টো-মুজিবর মতানৈক্যের জন্য তিনি ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রেখেছিলেন। ভুট্টো-মুজিবরের ব্যবধান আগের চেয়ে বেড়েছে। এ অবস্থায় ২৫শে মার্চ কি করে অধিবেশন বসবে? আর বসলেও যে সর্বসম্মত মত পাওয়া যাবে তারই বা গ্যারান্টি কোথায়? হয়ত জাতীয় পরিষদে চলবে সারাক্ষণ হট্টগােল। ভুট্টে নেবেন নৈরাজ্যের প্রধান ভূমিকা। তারপর ইয়াহিয়া খান নামবেন আসরে। ভেঙে দেবেন জাতীয় পরিষদ। দোষারােপ করবেন নেতাদের উপর। ভাল মানুষ সাজবেন নিজে। এসব সন্দেহের কারণ নিরসনের জন্যই প্রয়ােজন ছিল সংখ্যাধিক্যের মতামত গ্রহণের অকুণ্ঠ প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতি ছাড়া ইয়াহিয়া খানের ভাষণের গঠনমুখী মূল্য খুবই কম।
গত কদিন ধরে চলছে পূর্ব বাংলার অগ্নিপরীক্ষা। বাঙালী রক্তস্নান করে উঠেছে। শক্তিমান ডিকটেটরকে তারা টেনে মাটিতে নামিয়েছে। তিনি এখন রক্তপিছল পথে হাঁটছেন। আর মাঝে মাঝে থুবড়ী খেয়ে পড়ছেন। আয়ুব খানেরও ঘটেছিল এ-দশা। উত্তাল গণজাগরণের স্রোতে তিনি ভেসে গেছেন। ইয়াহিয়া খান হয়ত ভাবছেন, তিনি আয়ুবের চেয়ে ভাগ্যবান। আয়ুবের পিছনে ছিল না কেউ। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের পাশে আছে পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম অংশ। এই অংশের শক্তির প্রধান উৎস পাঞ্জাবী সৈন্যদল। সামরিক বাহিনীর সমর্থন যতদিন ছিল, ততদিন আয়ুবের তান্ডব বন্ধ হয়নি। গণতন্ত্রের পথে এক কদম এগােনাের সঙ্গে সঙ্গেই কায়েমী স্বার্থের জিম্মাদার পাঞ্জাবী চক্র তাঁকে পরিত্যাগ করেছিল। ফলে ছিটকে পড়লেন আয়ুব। আসরে এলেন ইয়াহিয়া খান। তিনি এখন সিন্ধি-পাঞ্জাবী চক্রের বন্দী। আপােষের হয়ত পূবের বাঙালীর দাবী মিটবে না। ওটা তাদের আদায় করতে হবে। মুজিবরের সামনে বিস্তৃত রণক্ষেত্র। একদিকে জাগ্রত বাঙালী এবং অপর দিকে পাঞ্জাবী বাহিনী। এক দলের নেতা তিনি নিজে। অপর দলের নেতা ইয়াহিয়া খান। শয়তানের ভূমিকায় ভুট্টো। রবিবার (৭ই মার্চ) গুরুত্বপূর্ণ ঘােষণা করবেন মুজিবর। শত শত শহীদের স্মৃতি-ভারাক্রান্ত তার মন। গতির এই আকস্মিক স্তব্ধতা হয়ত সাময়িক। মুজিবর তাকে কি ভাবে নেবেন, তা দেখার জন্য সারা দুনিয়া উৎসুক। সংগ্রামের প্রথম অধ্যায়ে বাঙালী জয়ী। কিন্তু চূড়ান্ত অধ্যায় বাকী। হয়ত দিতে হবে আরও রক্তমূল্য। ডিকটেটরদের পিপাসা সহজে মেটে না। ওরা শেষ পর্যন্ত ডােবে । তাদের ভরাডুবি সাধারণ জলে আসে না, আসে জনতার উঞ্চ শােণিতে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৭ মার্চ ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!