বলেশ্বর নদীর জেটি ঘাটেই ৪/৫ হাজার লোককে পাক জল্লাদরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। পাক ক্যাপ্টেনের একমাত্র কথাই ছিল ‘জেটিমে ভেজ দেও।”
৪ঠা মে পিরোজপুর শহরে পাক বাহিনী প্রবেশ করে। পাক বাহিনী বরিশাল হুলার হাট হয়ে পিরোজপুর প্রবেশ করে। মিলিটারী তিন দিক থেকে পিরোজপুর পুরো শহর আক্রমণ করে।
৫ ই মে পাক বাহিনী আমার বাড়ী ধ্বংস করে। প্রথমে লুটতরাজ চালায়। তারপর অগ্নিসংযোগ বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। এই দিনই পাক বাহিনী পিরোজপুর সেকেন্ড অফিসার, এসডিপিও ট্রেজারী অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে।
পাক বাহিনী যখন ভান্ডারিয়া থানায় প্রবেশ করে তখন আমি আমার জীবনের নিরাপত্তার অভাব অনুভব করি। ভাণ্ডারিয়া আমার নিজ বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি বরগুনা(পটুয়াখালী) চলে যাই। এখানে আমি প্রায় দেড় মাস কাল অতিবাহিত করি। তারপর আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে চিঠি লিখি আমার অসুস্থতার খবর জানিয়ে। আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে চেয়ারম্যান সাহেব আমার কাছে চিঠি দেন এবং বলেন যে আমি ক্যাপ্টেন এজাজ সাহেবের সঙ্গে আপনার ব্যপারে আলাপ করেছি,কাজেই আপনি এখানে আসতে পারেন।
শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাহেবের চিঠি পাবার পর পিরোজপুর চলে আসি এবং চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে গোপন থাকতে বলে। তিনদিন পর চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে ডেকে পাঠান এবং ক্যাপ্টেন এজাজের কাছে নিয়ে যান। ক্যাপ্টেন এজাজ সাহেবের কাছে আমি এই সময় একটা দরখাস্ত দেই যে আমার ছেলে ” ক্যাপ্টেন জিয়া” আমার বাধ্য নয়, সে আমার অমতে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে।
আমি শহরে আসার ৭/৮ দিন পর জানলাম পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজের কাছে আমার নামে বলা হয়েছে যে, তার ছেলে প্রত্যেকদিন রাত্রিতে মুক্তিবাহিনী নিয়ে এসে তার সঙ্গে দেখা করে যায়। এরপর প্রায় ১০০ মিলিটারী নিয়ে আমার বাড়ি আক্রমণ করা হয়। আমার বাড়িতে এসে পাক বাহিনী আমার বুকের উপর, আমার স্ত্রীর বুকের উপর এবং আমার ছেলের বুকের উপর রাইফেল ধরে। এই সময় পাক বাহিনী আমাদের ঘেরাও করে যে তোমার ছেলে ক্যাপ্টেন জিয়া তোমার ঘরে আছে, তুমি তাকে বের করে দেও। আমি তার উত্তরে বলি যে আমার ছেলে বাড়ীতে নাই, তোমরা ইচ্ছা করলে আমার ঘর সার্চ করে দেখতে পারো। তখন আমার ঘর সার্চ করে তারা চলে যায়।
পাক বাহিনী সব সময়ই নারী ধর্ষণ করেছে। তারা রাজাকার দিয়ে গ্রাম থেকে সুন্দরী যুবতী মেয়েদেরকে ধরে আনতো। অনেক সময় তারা নিজেরাও কোন কোন বাড়ীর উপর চড়াও হতো এবং মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে যেত।
পাক বাহিনী বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, মুক্তিবাহিনী ও হিন্দু এদের খোঁজ বেশী করেছে এবং যাদের সন্দেহ হয়েছে তাদেরকেই মেরে ফেলেছে। এমন কোন রাত নাই যে পাক বাহিনী পিরোজপুর জেটি ঘাটে ৫০-১০০ জন লোককে হত্যা না করতো। শেষের দিকে নদীর ভিতর শুধু মৃত লাশ ভাসতে দেখা যেত। আমার মনে হয় একমাত্র বলেশ্বর নদীর জেটি ঘাটেই ৪/৫ হাজার লোককে পাক জল্লাদরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। পাক ক্যাপ্টেনের একমাত্র কথাই ছিল ‘জেটিমে ভেজ দেও।’
প্রথম অবস্থায় যে সব লোককে ধরেছে তাদেরকে জেটি ঘাটে গুলি করে হত্যা করেছে । কিন্তু শেষের দিকে তাদের বেয়োনেট দিয়ে জবাই করা হতো । যাকেই ধরা হতো তাকেই ভীষনভাবে প্রহার করতো ।
আমি নিজের চোখে ৩ জন লোককে জীপ গাড়ির পিছনে বেঁধে রাস্তায় টেনে মেরে ফেলতে দেখেছি । তাদের সেই করুণ চিৎকারের কথা আমার এখন পর্যন্ত কানে বাজে ।
শেষের দিকে নারী নির্যাতন ব্যাপকভাবে চলতে থাকে । শামসুদ্দীন তালুকদার নামে একজনকে দুই জন পাক বাহিনী দিয়ে তার দুই পা দুই দিকে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয় । এই সময় আবদুল গফুর মিয়া বিএ সাহেবকে সে নিজে তার মুখের মধ্যে স্প্রিট ঢেলে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করে ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রথম ৩ মাস আমার ছেলের কোনো খবর পাই না। ৩ মাস পর একজন আমার বাসার মধ্যে প্রবেশ করে এবং বলে যে আমাকে তারাতারি কোন জায়গায় লুকান , আমি ক্যাপ্টেন জিয়ার কাছ থেকে খবর নিয়ে এসেছি । সে আমাদের কাছে ক্যাপ্টেন জিয়ার খবর দেয় এবং বলে যে সে ভাল আছে আপনি কোন চিন্তা করবেন না । দেশ খুব তাড়াতাড়ি স্বাধীন হবে । এর পর থেকে প্রায়ই সেই ছেলেটি এসে ক্যাপ্টেন জিয়ার খবর আমাদের কাছে এসে দিয়ে যেত ।
পাক ক্যাপ্টেন এজাজ একদিন ঘোষনা করে দেয় যে , ক্যাপ্টেন জিয়া মঠবাড়িয়া যুদ্ধে মিলিটারীর হাতে এরেস্ট হয়েছে এবং তাকে বরিশাল পাঠানো হয়েছে ।এই খবর আবার দালাল দিয়ে আমার কাছে পৌছে দিত যেন আমি ভেঙ্গে পড়ি । অনেক সময় দালালরা আবার এসে বলতো যে আমার ক্যাপ্টেন জিয়ার মৃত লাশ বলেশ্বর নদীতে ভাসতে দেখেছি ।
স্বাক্ষর/-
আফতাব উদ্দিন আহাম্মদ
থানা-পিরোজপুর
জেলা- বরিশাল
১৯/৮/৭৩