প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক শরনার্থি সমস্যার উপর গুরুত্ব আরোপ
দৈনিক স্টেটসম্যান, ১৭ মে ১৯৭১
প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, রোববার দমদম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত মতবিনিময় সভায় স্পষ্টভাবে বলেন যে, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার মত বহুল আলোচিত বিষয়টি এই মুহুর্তে কেন্দ্রীয় সরকার সবচেয়ে জরুরি বিষয় হিসাবে দেখছে না।
তিনি বলেন, প্রধান বিবেচনার ব্যাপার হল কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক উক্ত স্বীকৃতি বাংলাদেশের মানুষকে এই মুহূর্তে কোন সাহায্য করবে কিনা। “আমি মনে করি এটা তাদের কোন সাহায্য করবে না এবং ভুল সময়ে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত নয়, ” বলেন তিনি।
যখন একজন রিপোর্টার জিজ্ঞাসা করল আপনি কি অন্য কোন দেশের স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করছেন কিনা তক্ষণ তিনি দৃশ্যত বিরক্ত হয়ে পরলেন। তিনি বলেন, এ ধরনের প্রশ্ন আগে বেশ কয়েকবার করা হয়েছে। তিনি সব সময়ই বলেছেন যে ভারতের একটি স্বাধীন নীতি আছে এবং বিভিন্ন ইস্যুতে সে তার অবস্থান প্রণয়নে অন্যদের উপর নির্ভর করে না।
“আমরা স্বাধীন দেশ নিজেদের স্বাধীন নীতি দিয়ে চলি। খুব শক্তিশালী চোখ দিয়ে স্বাধীন সূর্যের নিচে নানা বিষয় নিয়েই আমরা বাস করি এবং অন্যরা কে কি বলল বা করল তার উপর আমরা নির্ভরশিল না। ”
দুই শরণার্থী শিবির এবং বনগাঁর একটি হাসপাতালে সফর করার পর একটি বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে বিমানবন্দরে পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের উপ-মুখ্যমন্ত্রী, জনাব অজয় মুখার্জির সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। শ্রীযুক্ত বিজয়গুপ্তের সিং নাহার, শ্রীযুক্ত সিদ্ধার্থ শংকর রায়, ইউনিয়ন শিক্ষা মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। বৈঠকটি আধা ঘন্টা স্থায়ী হয়।
মিসেস গান্ধী আসাম থেকে হলদিবাড়ি ভ্রমন করে সকালে দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছান ২টা ১৫ মিনিটে। তাঁর সাথে জনাব রায় ও মিস পদমজা নাইডু, যিনি বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির প্রধান – এরা উপস্থিত ছিলেন। দমদম থেকে প্রধানমন্ত্রী ও তার দল হেলিকপ্টারযোগে বনগাঁও যান। আরেকটি হেলিকপ্টার পশ্চিমবঙ্গ মন্ত্রীদের নিয়ে যায়। তারা একটু পরে সাড়ে পাঁচটায় দমদম আসেন।
প্রধানমন্ত্রী একটি নীল শাড়ি এবং একটি ফুলস্লিভ ব্লাউজ পড়া ছিলেন এবং তাকে ক্লান্ত লাগছিল। নতুন এয়ারপোর্ট এর লাউঞ্জে প্রথম তলায় এসে তিনি তার পরিচারকের কাছে নিচের তলায় দ্রুত একটি কনফারেন্স কল করেন – সাথে ছিলেন জনাব অজয় মুখোপাধ্যায় ও জনাব নাহার।
প্রেস সাংবাদিকদের দোতলায় লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। কিছু সময় পর, মিস পদমজা নাইডু কনফারেন্সে আসেন ও ত্রাণ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন।
জনাব অজয় মুখোপাধ্যায় ও জনাব নাহার এর সঙ্গে বৈঠক চলাকালে জনাব সিদ্ধার্থ রায় এর পশ্চিমবঙ্গ সংক্রান্ত বর্তমান সমস্যা ও আলোচনায় আসে। পরে যোগাযোগ করা হলে জনাব নাহার বলেন, কিছু গুরুতর সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিন্তু তিনি সেগুলো এখনই প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না।
বিশাল সমস্যা
শরণার্থী সমস্যা প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের বলেন: “এটি একটি বিশাল সমস্যা এবং এটা নিয়ে কঠিন মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের দ্রব্যমূল্য অপর্যাপ্ত এবং পরিস্থিতি মেটানোতেও ঘাটতি আছে; তবে সরকার ভালভাবে কাজ করছে। ”
তিনি বলেন যে সেখানে অনেকে আছেন যারা এখনো আশ্রয় পান নাই – যাদের ব্যাপারে তিনি সজাগ আছেন। তিনি বলেন জিনিসপত্র পৌঁছাতে একটু সময় লাগবে। যখন জিজ্ঞাসা করা হল কোনো সাহায্য বিদেশ থেকে আশা করছেন কিনা; তিনি জানান যে কেউ এটা আশা করতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই অন্যান্য দেশ থেকে আসেনি। তিনি আরো বলেন, তিনি মনে করছেন যে, বাইরে থেকে যদি সহায়তা আসে তবে, কি এসেছে ও কার কাছ থেকে এসছে সেটা ভারত জানাবে।
প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শরনার্থীদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছেড়ে যেতেই হবে, কিন্তু “কিভাবে শীঘ্রই সেটা সম্ভব হবে, আমি জানি না। ” তিনি মনে করেন যে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একটি অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে তাদের ফিরে যাওয়ার জন্য।
পাকিস্তান সরকার দাবি করে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন অবস্থা কেটে স্বাভাবিক হয়েছে – এই কথার উপর মন্তব্য করতে গিয়ে মিসেস গান্ধী বলেন, জনগণকে অন্য কোথাও সরিয়ে দিয়ে খুব সহজেই উদ্বিগ্ন অবস্থা স্বাভাবিক করা যেতে পারে তবে আমার মতে এটি কোন স্বাভাবিক পন্থা নয়।
কেন্দ্রীয় সরকার সীমান্ত এলাকা থেকে শরনার্থীদের হস্তান্তর করার জন্য প্রস্তাব বিবেচনা করছে। ত্রিপুরার মত ছোট্ট একটি রাজ্যে এই অবস্থা একটি বড় সমস্যার সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, দেশের অন্যান্য অংশে এদের আশ্রয় দেবার ব্যবস্থা বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে তিনি নিশ্চিত না সেটা সম্ভব হবে কিনা।
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সহায়তার জন্য অনেক রাজনৈতিক দলগুলোর যে প্রস্তাব সে ব্যাপারে মন্তব্য করতে বলা হলে, মিসেস গান্ধী বলেন, “এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া নেই”।
ঢাকা থেকে ভারতের কূটনীতিকদের ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে পরামর্শ চাইলে তিনি বলেন যে বিষয়টি একদম থমকে আছে; কারণ পাকিস্তান সরকার কোনো প্রস্তাব গ্রাহ্য করছেন না।
মিসেস গান্ধী বলেন সংবাদপত্রগুলোকে সংবাদ ও মতামত প্রকাশে খুব সতর্ক হতে হবে। এটা মনে রাখতে হবে যে শত্রুদের এজেন্টরা খুব সজাগ। খেয়াল রাখতে হবে শরনার্থী ইস্যুটি যেন একটি জাতীয় সমস্যা হিসাবে প্রকাশিত হয় – কোন সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে নয়।
তিনি বলেন, ভারত সীমান্ত বরাবর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ফায়ারিং করছে। এই ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। “সবসময় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব নাও হতে পারে’- প্রধানমন্ত্রী বলেন।
বনগাঁ
আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক বলেন – এর আগে আজ বিকেলে বনগাঁতে বাংলাদেশের শরণার্থীদের উদ্যেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি একটি দু:খের বিষয় যে পূর্ববঙ্গে স্বাধীনতাযুদ্ধকে এখন একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলে রং দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ধরনের প্রচেষ্টা শুধুমাত্র সে দেশের দুর্বলতার কারণ হবে।
বিকেলে মিসেস গান্ধী পেট্রাপোল ও ইটখোলাতে দুটি শরণার্থী ত্রাণকেন্দ্র পরিদর্শন করেন। তিনি বনগাঁর মহকুমা হাসপাতাল পরিদর্শন করেন এবং যারা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গুলিতে আহত হয়েছে তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
তিনি উদ্বাস্তুদের বলেন যে ‘পূর্ববঙ্গের মুক্তিযুদ্ধ সকল দমন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। মনে রাখবেন, আপনাদের যুদ্ধ আমাদের যুদ্ধ। ’’
অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় বাংলাদেশের জনগণ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। “আমরা জানি যে আমাদের সব সাহায্য সত্ত্বেও, আপনারা এখানে সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন কারণ আমরা ধনী দেশ না। ’’
মিসেস গান্ধী আশা করেন যে শরণার্থীদের দীর্ঘদিন ভুগতে হবে না এবং তারা খুব শীঘ্রই দেশে ফিরতে সক্ষম হবেন। তিনি বলেন, ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, পূর্ব বাংলার জনগণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য এবং যৌথভাবে মুক্তির জন্য যুদ্ধে লড়াই করবে।
পেট্রাপোল ক্যাম্পে যেখানে চার হাজারের অধিক শরণার্থী বসবাস করছে সেখানে মিসেস গান্ধী একটি ছোট মেয়েকে খাবার খেতে দিচ্ছিলেন। মেয়েটি বলে, সে তার অনেক আত্মীয় হারিয়েছে। ১০ বছর বয়সী একটি ছেলে তার কাঁধে তার ছোট বোনকে বহন করে নিয়ে আসার বর্ননা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তিনি একজন নারীর সাথেও কথা বলেন যার স্বামী পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছে।
ভরত সেবাশ্রম এর একজন মুখপাত্র বলেন পেট্রাপোল ক্যাম্পের জনসংখ্যার প্রায় ৪০% মুসলমান। আট বছরের নীচের ছেলেমেয়ের সংখ্যা ২২০০।
কলকাতা বিমান বন্দরে অবতরণের পর অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন এবং গণতান্ত্রিক যুব সংস্থার সমর্থকরা একটি বিক্ষোভের আয়োজন করে। বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে।
জনাব জে.সি. দে, ইন্ডিয়ান রেড ক্রস সোসাইটির পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী, এবং ইন্ডিয়ান রেড ক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান মিস পদমজা নাইডুকে পেট্রাপোল রাজ্য ইউনিটে তাদের কার্যকলাপ ব্যাখ্যা করে।
হলদিবাড়ি
হলদিবাড়িতে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক বলেন – ভারতীয় সীমানার মধ্যে পাকিস্তানের বারবার অনুপ্রবেশের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন সীমান্তের কাছে বসবাসকারী মানুষেরা “কিছু ঝুঁকির সম্মুখীন হবে”। তিনি বলেন, সীমান্তের নিকতবর্তী এলাকায় যারা শেখ মুজিবকে গত নির্বাচনে ভোট দিয়েছে তাদের ভারতে বহিষ্কার করে পূর্ববাংলার জনসংখ্যা হ্রাস করাই এর উদ্দ্যেশ্য।
এস ইউ সি এর স্থানীয় ইউনিট এবং ফরওয়ার্ড ব্লক ও আরও একটি প্রতিষ্ঠান মিসেস গান্ধীর কাছে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতির দাবিতে স্মারকলিপি পেশ করে।
এস ইউ সি সমর্থকরাও হেলিপ্যাডে এবং গণপূর্ত বিভাগের বাংলো যেখানে তিনি দলের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন তার সামনে বিক্ষোভ করে।
ইউ এন আই যোগ করে – মিসেস গান্ধী পশ্চিমবঙ্গের দুই মন্ত্রীকে নয়া দিল্লিতে ত্রাণ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেণ। তিনি রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, জনাব জয়নাল আবেদিন ও গণপূর্ত মন্ত্রী, জনাব সন্তোষ রায় কে ধন্যবাদ জানান। তারা বৃহস্পতিবার নয়া দিল্লির উদ্যেশ্যে রওনা হবেন বলে আশা করা যায়।