মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অপকৌশল ও বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম
জাতীয় মুক্তি সম্রামের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ সামরিক অভিযান ও পরােক্ষ সাহায্য আজ আর গােপন নয়। বিশ্বে এমন কোন দেশ নেই যেখানে স্বাধীনতার সংগ্রামকে দমন করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সামরিক সাহায্য করছে না। এটাই হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের ধর্ম। বাঙলাদেশের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় নি।
এতদিন যাবৎ মার্কিন সরকার বাঙলাদেশে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কুন্তিরা বিসর্জন করে বাঙলাদেশের রাজনৈতিক মহলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির কৌশল গ্রহণ করেছিল। এখন তারা প্রতারকের মুখােশ ফেলে দিয়ে সরাসরি পাকিস্তানী জাহাজ বােঝাই করে অস্ত্র প্রেরণ করছে বাঙলাদেশের মুক্তি সগ্রামকে ধ্বংস করার জন্য। পেন্টাগণ থেকে স্বীকার করা হয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া অস্ত্র বােঝাই জাহাজ করাচী অভিমুখে রওনা হয়েছে। সারা বিশ্বের মানুষ যখন ইয়াহিয়া খানের জাতিহত্যার বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদে সােচার, যখন বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমেই ব্যাপক হয়ে উঠছে, তখনই মার্কিন সরকার তার ভেক পরিবর্তন করে পাকিস্তানকে সরাসরি সামরিক সাহায্য দানে অগ্রসর হয়েছে। তারা চায় পাক-ভারত উপমহাদেশে দ্বিতীয় ভিয়েতনাম সৃষ্টি করতে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে ধ্বংস করাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বায়ণনীতির অংশ। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের পেছনে যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দৃঢ় সমর্থন রয়েছে এবং মার্কিন সাহায্যপুষ্ট হয়েই যে বাঙলার মানুষের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার জাতিহত্যা অভিযান চলেছে তা আজ দিবালােকের মত পরিষ্কার। অতএব এই সত্যের সম্যক উপলব্ধি না হলে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে সর্বপ্রকার প্রত্যাশা পরিত্যাগ না করলে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের শক্তিসমূহ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। এটা যেমন সার্বজনীন সত্য, তেমনই বাঙলাদেশের পক্ষেও সত্য এবং বাস্তব। রক্তের বিনিময়ে বাঙলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে এ সত্য উপলব্ধির পরীক্ষা দিতে হচ্ছে।
বাঙলাদেশের আওয়ামী লীগ নেতাদের একাংশ পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ থেকে রাজনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন প্রত্যাশা করছেন বলেই এখনও বাঙলার জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে সংহতি বা ঐক্য সৃষ্টি হয়নি। বাঙলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারকে মার্কিনী সামরিক সাহায্যদান নিশ্চয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মােহমুক্ত করবে। বাঙলাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদেরই ভূত্য ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে সার্বিক জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন যে অপরিহার্য এই সত্যটিকে আর অস্বীকার করার উপায় নেই। দলমত নির্বিশেষে যারাই মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়ােগ করেছেন তাঁদের ঐক্যের মধ্যেই সগ্রামের দুর্বার শক্তি নিহিত রয়েছে। এটাই হল এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মুক্তি-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা। এই মূল্যবান অভিজ্ঞতা বাঙলাদেশের মুক্তি-সামীদের জন্য অমূল্য সম্পদ। আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত শত্রুর বিরুদ্ধে সার্বিক জাতীয় ঐক্য ব্যতীত অপর কোন পথ নেই। একমাত্র এই পথেই বাঙলার শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত এবং জাতীয় বুর্জোয়ারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। একমাত্র এই পথেই বাঙলাদেশের মানুষ ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে তুলতে পারে।
সার্বিক জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের যে সশস্ত্র গণ-বাহিনী সৃষ্টি হবে সেই বাহিনী সাধারণ মানুষের সাহায্যপুষ্ট হয়ে বাঙলার স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করবে, শত্রুকে নিধন করে মুক্ত অঞ্চল গঠনের মাধ্যমেই স্বাধীন বাঙলা প্রতিষ্ঠিত করবে। এই সার্বিক ঐক্যের পথ হল গণতন্ত্র বিকাশের ঐতিহাসিক পথ। এই ঐক্যের বিনাশ নেই, পরাজয় নেই। একমাত্র এই পথেই বাঙলাদেশের মুক্তি-সংগ্রাম জয়যুক্ত হতে পারে।
সূত্র: কালান্তর, ২৫.৬.১৯৭১