ভারতের আকাশ সীমা লঙ্ঘন
অস্বস্থিকর সংবাদ এসেছে। চুয়াডাঙ্গার উপর বােমা বর্ষণের সময় পাক-জঙ্গীবিমানগুলাে ভারতের আকাশ সীমা লঙ্ঘন করেছে। ওরা গেদে শহর এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলাের উপর দিয়ে উড়ে গেছে। বাঙলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে আকাশ থেকে বােমা বর্ষণের চেষ্টা করলে এধরনের অঘটন খুবই স্বাভাবিক। ইয়াহিয়া খানের গণহত্যার অভিযান যে কত বেপরােয়া এটা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। পাক-ধৃষ্টতার উপযুক্ত উত্তর ছিল জঙ্গীবিমানগুলােকে গুলি করে নামিয়ে ফেলা। আসামীরা যখন ফসকে গেছে তখন ইসলামাবাদের কাছে কড়া • প্রতিবাদ জানানাে ছাড়া উপায় নেই। ইয়াহিয়া খান হয়ত স্বীকার করবেন না তার অপরাধ। পাল্টা আঘাত পাওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক রীতিসম্মত ব্যবহার ইসলামাবাদের কোষ্ঠীতে লেখা নেই। ভারতীয় জনতা একেই উত্তেজিত। তার উপর পাক-জঙ্গী বিমানের ভারতের আকাশ সীমা লঙ্ঘনের সংবাদে তারা একেবারে ফেটে পড়বেন। চুয়াডাঙ্গায় যে ঘটনা ঘটে গেল তা কি পাক-পাইলটদের ইচ্ছাকৃত না অসাবধানতা— অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার। এমনও হতে পারে যে, ইয়াহিয়া খান শয়তানি জাল ফেলেছেন। বাঙলাদেশ থেকে পাততাড়ি গুটারার সম্ভাবনা এড়াবার জন্য বিচ্ছিন্ন সঘর্ষে তিনি সেন্টোর শরিকদের সাহায্যের বায়না। জোরদার করে তুলতে পারবেন। পাক-ধুরন্দরদের যে মতলবই থাক না কেন ভারতের আকাশসীমা অলঙ্ঘনীয়। সেখানে যে নাক গলাবে তার নাসিকাচ্ছেন রাষ্ট্রীয় কর্তব্য। ইরান এবং তুরস্কের পয়িতারার কথা বিবেচনা করার কোন দরকার নেই।
বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়ত দীর্ঘস্থায়ী হবে। বিভিন্ন শহরের ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ পাক-বাহিনীর সাহায্যে। পাক-বিমানগুলাে হামেশাই সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে আক্রমণ চালাবে। ভারতীয় এলাকায় মেশিনগানের গুলি এবং বােমা পড়াটাও অসম্ভব নয়। ফলে যুদ্ধটা ঘরের কাছে এসে পড়বে। বাঙালী মুক্তযােদ্ধাদের প্রতি রয়েছে ভারতীয়দের গভীর সহানুভূতি। স্বৈরাচারের সঙ্গে গণতন্ত্রী শক্তির লড়াইয়ে গণতন্ত্রের জয় ভারতের অকৃত্রিম আকাঙ্খ। সীমান্তের ওপারের জনতার সঙ্গে এপারের সাধারণ মানুয়ের রক্তের সম্পর্ক এবং সাংস্কৃতিক বন্ধন এ আকাঙ্খকে তীব্র করে তুলছে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধী অবস্থার বাস্তব মূল্যায়ন করেছেন। তিনে স্পষ্টই বলেছেন, বাঙলাদেশের গণহত্যায় ভারত নিশ্ৰুপ বসে থাকতে পারে না। যদি থাকে তবে তা হবে অন্যায় এবং ভারতের আদর্শ বিরােধী। নয়াদিল্লী অবশ্যই চুপ করে বসে নেই। সংসদ এবং শাসক কংগ্রেস নিয়েছেন সর্বসম্মত প্রস্তাব। তাতে ফুটে উঠেছে ইয়াহিয়ার প্রতি গােটা জাতির ধিক্কার, আর বাঙালীর ন্যায্য সংগ্রামের জয়লাভ সম্পর্কে সুনিশ্চিত আশা। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটিতে পদত্ত বক্তৃতায়ও প্রধানমন্ত্রী করেছেন পরিচিত মনােভাবের পুনরাবৃত্তি। পূবেব বাঙলীর সংগ্রামের চূড়ান্ত জয় কিভাবে ত্বরান্বিত করা যায় তাই হচ্ছে প্রধান সমস্যা। ঢাকা শহরে দেখা দিয়েছে মহামারী। সর্বত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে খাদ্যাভাব। আহত মুক্তিযােদ্ধা এবং সাধারণ মানুষ পাচ্ছেন না চিকিৎসার সুযােগ। ত্রাণ কমিটি গড়ে উঠেছে বলকাতায় এবং দিল্লীতে রেডক্রশের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেবে না পাক সমরনায়কেরা। সীমান্ত পথে ত্রাণ সম্ভার যথাস্থানে পৌছে দেবার ব্যবস্থা অবশ্যই হবে। ওটা মানবিক কর্তব্যের একটা দিক মাত্র। তাতে যুদ্ধের গতির মােড় ফিরবে না। মুক্তিযােদ্ধাদের দরকার আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং এগুলাের প্রয়ােগশিক্ষা। আলজেরিয়া লড়েছিল ফ্রন্সের বিরুদ্ধে। এটা সম্ভব হয়েছিল বৈদেশিক অস্ত্র সাহায্যের জন্য। জনগণের ছিল ইস্পাতের মনােবল এবং হাতে মিশর প্রভৃতি দেশের দেওয়া অস্ত্র। সাইপ্রাসে গ্রীক সিপ্রিয়টরা বৃটিশ সৈন্যদলের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সংগ্রামে দুনিয়াকে তাক লাগিয়েছিলেন। গ্রীস অস্ত্র সাহায্য না পেলে ওটা সম্ভব হত কিনা নিশ্চয় করে বলা মুস্কিল। অমিতশক্তিধর আমেরিকাকে নাজেহাল করে তুলেছেন ভিয়েতনামীরা। স্থানীয় জনতার সংগ্রামী ঐতিহ্য এবং চীন সােভিয়েটের অস্ত্র সাহায্যের জন্যই তা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু বাঙলাদেশের লড়াই তুলনাহীন। বাইরের কোন রাষ্ট্রের অস্ত্র সাহায্য সাহায্য ছাড়া প্রায় খালি হাতেই তারা লড়েছেন আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত এক সৈন্যদলের বিরুদ্ধে। তাড়াতাড়ি দখলদার বাহিনীকে নিচিহ্ন করতে হলে বৈদেশিক অস্ত্র সাহায্য অপরিহার্য। ভারতের কাছে বাঙালী মুক্তিযােদ্ধাদের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে অসঙ্গতির কিছু নেই। বিশ্ব জনমত সঙ্গে পেলে ভারতের সমস্যা হালকা হয়ে আসে। তার জন্যই চলছে কূটনৈতিক তৎপরতা। এই সঙ্গে জড়িত স্বাধীন বাঙলাদেশের সরকারের স্বীকৃতি দানের প্রশ্ন। এই স্বীকৃতির অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ। তাতে ক্ষতি নেই। গণতন্ত্রী এবং সগ্রামী জনতাকে ঘতকদলের মুখে ছেড়ে দিয়ে সামরিক স্বৈরাচারীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা অর্থহীন। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধী উদ্বেলিত ভাবতীয়দের অধীর না হবার জন্য অনুরােধ করেছেন এবং যথাসময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সরকারি চিন্তাধারা বিলম্বিত পদ্ধতিতে চলে। বাঙলাদেশে যা ঘটছে তাতে বিলম্বের অবকাশ খুবই কম। নয়াদিল্লী আগেভাগেই তৈরী থাকুক। সমর এলে যেন একমুহূর্ত দেরী না হয়। ইয়াহিয়ার গণহত্যা বন্ধের এবং গণতন্ত্রের জয়যাত্রার পথ নিষ্কন্টক করতে হলে প্রয়ােজন সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আশু প্রস্তুতি এবং তা রূপায়নের নিখুত পরিকল্পনা।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৬ এপ্রিল ১৯৭১