“ইয়ে মৌলভী সাব, আপ কাঁহা যাতে হে?”
বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে খান সেনারা চিরিরবন্দরে ক্যাম্প করে। সেখানে ক্যাম্প করার পর স্থানীয় গ্রামবাসীরা প্রাণের ভয়ে কতক ভারতে ও কতক গ্রাম থেকে গ্রামাঞ্চলে চলে যায়। এই সময়ে আমি স্ত্রী-পুত্রদের সঙ্গে নিয়ে দুই মাইল দূরে আমার শ্বশুরবাড়ি বালুপাড়ায় চলে যাই। আমি একদিন বালুপাড়া সন্নিকটে মরা নদীর ব্রিজের কাছে একদিকে চিরিরবন্দর হতে অপরদিকে পার্বতীপুর হতে এই দুই দিক হতে দুটি পাক সৈন্য বোঝাই গাড়ি এসে থামে। এখানে বলা প্রয়োজন যে, উক্ত ব্রীজটি এর পূর্বেই ইপিআর বাহিনী ভেঙ্গে দেয়। উক্ত বালুপাড়া গ্রামের ২০-২১ জন লোক ঐ গাড়ি দুটিতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট আছে ভেবে তাদের অভিনন্দন জানানোর জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু নিকটে যাবার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক হতে খান সেনারা তাদেরকে ঘিরে ফেলে। উক্ত ২০-২১ জনকে পরে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় হত্যা করে এবং লাশগুলি কাঁকড়া নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এই ঘটনার ৩-৪ দিন পরে বালুপাড়া গ্রামটি খান সেনারা তিন দিক হতে ঘিরে ফেলে। খান সেনাদের উপস্থিতি সম্পর্কে গ্রামবাসীরা পূর্বেই টের পেয়েছিল এবং তারা আগেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। ফলে খান সেনারা সেদিন গ্রাম থেকে কাউকে ধরতে পারে না। এদিকে গ্রামবাসীরা তাদের আর উক্ত গ্রামে থাকা উচিৎ নয় ভেবে অন্যত্র যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং খান সেনারা গ্রাম হতে চলে যাওয়ার পর গ্রামবাসীরা তাদের পোটলা-পুটলি আনার জন্য রাতের অন্ধকারে প্রবেশ করে। আমি উক্ত বালুপাড়া গ্রাম হতে আমার নানাশ্বশুরের বাড়ি দুর্গাপুর (২ মাইল) যাওয়ার জন্য তৈরি হয়। এবং শেষ রাতের দিকে রওয়ানা দেই। এদিকে খান সেনারা বালুপাড়া গ্রাম ও দুর্গাপুর গ্রামের মাঝখানে ঐ রাত্রের অন্ধকারে মিশন স্কুলে পজিশন নেয়। আমি ও আমার ভাই গরু বাছুর নিয়ে যখন মিশন স্কুলের নিকটে পৌঁছাই তখন হঠাৎ করে ১৮ জন খান সেনা ও ৪ জন অবাঙ্গালী রাজাকার আমাদের দুজনকে ঘিরে ফেলে এবং একজন আমাকে লক্ষ্য করে এক রাউণ্ড গুলি ছোড়ে। কিন্তু খোদা মেহেরবান, গুলি আমাদের দুজনের একজনকে ও না লেগে আমাদের সঙ্গে আনা একটি গরুর পায়ে বিদ্ধ হয়।
পূর্ব হতেই আর ও দুজন দাড়িওয়ালা মুরব্বী গোছের লোককে উক্ত স্কুলের সামনে বেঁধে রেখেছে। খান একজন আমাকে বলে যে, “ইয়ে মৌলভী সাব, আপ কাঁহা যাতে হে?” জবাবে আমি বলি যে আমি গরু বাছুর নিয়ে জমিনে কাজ করতে যাচ্ছি। খান সেনারা পুনরায় বলে যে, “তোম ইন্ডিয়ামে বাগ যাতে হে?” জবাবে বলি যে, না ভাই আমি ইন্ডিয়া যাচ্ছি না। আমি জমিনে কাজ করতে যাচ্ছি। খান সেনারা পুনরায় আমাকে প্রশ্ন করে যে, “ইয়ে মৌলভী সাব আপ সাচ্ছা বাত বলেগা তো আপকো হাম ছোড় দেগা, আপ বলিয়ে আওয়ামী লীগকা পার্টি কাঁহা, স্কুল কলেজ কাঁহা, ছাত্র কাঁহা, মালাউন কাঁহা।” উত্তরে আমি বলি যে, যারা আওয়ামী লীগ, ছাত্র এবং মালাউন সবাই ভারতে পালিয়ে গেছে। যারা এখানে আছে তারা সকলেই খাঁটি পাকিস্তানী। এই সময় খান সেনাদের সাথী অবাঙ্গালী রাজাকাররা আমাকে বাংলায় বলে যে, “আপনি ভয় পাবেন না। আমরা ভারতীয় সৈন্য। এখানে বিহারীরা আসবার চেষ্টা করছে। তাদের বাঁধা দেওয়ার জন্য আমরা এখানে পজিশন নিয়েছি।”
আমি সরলমনে এটা বিশ্বাস করি এবং বলি যে, “ভাই আমি থাকব না। আমাকে ভারত পাঠাবার ব্যবস্থা করেন।” উত্তরে রাজাকাররা আমাকে আশ্বাস দেয় এবং বলে যে আপনি কোন চিন্তা করবেন না, সে ব্যবস্থা আমরা করছি। ঠিক সেই মুহুর্তে আমি লক্ষ্য করি যে, পূর্বেই আনা সেই দুজন মুরব্বী লোককে খান সেনারা চতুর্দিক হতে ফুটবলের মত লাথি মারছে। এভাবে মারার পর লোক দুটিকে আমার কাছে নিয়ে আসে। এবং আমার কাছ থেকে গরু বাঁধার রশি নিয়ে উক্ত মুরব্বী দুজনকে মজবুত করে বাঁধে। অতঃপর আমাকেসহ ৪ জনকে কিছু দূরে ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন আর্মি লোকদের কাছে জানতে চান যে, ধৃত ব্যক্তিরা কারা। জবাবে তারা বাঙ্গালী জানতে পারলে উল্লিখিত দুই বৃদ্ধকে প্রহারের নির্দেশ দেয় এবং তাদের উপর হৃদয়হীন নির্যাতন চলতে থাকে। নির্যাতন চলা অবস্থায় উক্ত ক্যাপ্টেন তাদের জয় বাংলা বলার নির্দেশ দেয়। তারা তা না বলে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বললে তাদের উপর আরও প্রবলভাবে অত্যাচার করে। এই সময় আমাকে জয় বাংলা বলতে বলা হয়। আমি তা বলি, ক্যাপ্টেন আমাকে বলে, “ঠিক হায় মৌলভী সাব আপকো হাম ইন্ডিয়া ভি লিয়ে যায়গো।”
অতঃপর ৪ জনকেই পূর্ব দিকে নিয়ে যেতে শুরু করে। এবং একটি খালের কাছে গিয়ে থেমে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। এ সময় একটি বেয়নেট দিয়ে উক্ত বৃদ্ধদুটির শরীরের সমস্ত কাপড় কেটে উলঙ্গ করে। এবং তাদের তলপেটে থাপড়িয়ে বলে, “বাঙ্গালী আদমী খাড়া হায়, আওর ভুঢ়িনে তেল লাগাতা হায়।”
এরপর ঐ দুজনকে গুলি করে। একজন একটু মাথা আছড়াতে থাকলে তার মাথা লক্ষ্য করে আবার গুলি করে। ফলে তার মাথার মগজ ছিটকে চলে যায়। এ সময় দক্ষিণ দিক থেকে দুজন গাড়োয়ানকে গাড়িসহ ধরে আনে এবং আমার কাছ থেকে “মৌলভী সাব হামকো একটা রশি দিজিয়ে আপ” বলে রশি চেয়ে নেয় এবং তাদের হাত বাঁধে। অতঃপর তাদের একজনকে যে ৩০-৩৫ বছরের যুবক ছিলেন তাকে মারতে থাকে। মারের চোটে সে জ্ঞান হারাবার উপক্রম হলে তাকে জোর করে তুলে ধরে উলঙ্গ করে এবং তার গুহ্যদ্বারে নড়ি ঢুকিয়ে দেয়। এ পদ্ধতিতে কিছুক্ষণ অত্যাচার চালাবার পর তার হাত বেঁধে গাড়ির পিছনে বেঁধে দেয় এবং অপর ব্যক্তিকে জোরে গাড়ি হাঁকাবার নির্দেশ দেয়। এ সময় তারা আমাকে বলে, “ মৌলভী সাব আপ চালিয়ে ইন্ডিয়া।” রেল লাইনে সকলে আশা শুরু করে। রাস্তার মাঝ থেকে বেশ কয়েকটি খাসি ধরে গাড়িতে তুলে নেয়। মরা নদীর ভাঙ্গা ব্রীজের কাছে এসে জনৈক খান আমাকে তার কাছে ডেকে বসায় এবং জিজ্ঞাসা করে, “মৌলভী সাব, আপ সাচ সাচ বাতলাইয়ে আওয়ামী পার্টিকো লোক কাঁহা, স্কুল কো ছাত্র কাঁহা, মালাউন কাঁহা।” উত্তরে আমি জানাই যে “সব ইন্ডিয়ামে চল গিয়ে, কোই আদমী নেহি হ্যায়। জোভি হ্যায় ওভি পাকিস্তান কো নাগরিক হ্যায়।” এতে আমাকে মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করে। এ সময় আমাকে একটি সিগারেট খেতে দেয় এবং উক্ত প্রশ্ন গুলি আবার জিজ্ঞাসা করে।
অতঃপর ইন্ডিয়ায় পৌছে দেবার নাম করে আমাকে, সঙ্গীত ও গাড়ির দুজনকে এবং গাড়ির গরু দুটিসহ ক্যাম্পের দিকে আসতে থাকে। ক্যাম্পের নিকট ব্রীজের কাছে এসে হুইসেল দিলে ৫০-৬০ জন খান সেনা সেখানে যায়। তারপর সকলে স্টেশনে আসে। স্টেশনে পরিচিত জনৈক অবাঙ্গালীকে দেখে আমি খানদের কাছে সুপারিশের জন্য অনুরোধ করলে সে আমাকে আওয়ামী লীগের কর্মী বলে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং গুলি করে হত্যা করার জন্য খানদের অনুরোধ জানায়।
সেখান থেকে ধৃত সকলকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। গাড়োয়ান দুজনকে একটি আলাদা কুঠুরিতে বন্দী করে রাখে। এবং আমাদের ব্রীজে যে সিপাই জিজ্ঞাসা করেছিল তার ঘরে বসতে দেয়। এবং চা খেতে দেয়, সিগারেট খেতে দেয়।
কুঠুরিতে বন্দী দুজনকে পাশবিকভাবে মারা শুরু করে। উলঙ্গ অবস্থায় লাঠি, রড, রাইফেলের গাদা দিয়ে পর্যায়ক্রমে হাত বদল করে পিটাতে থাকে এবং পরিশেষে তাদেরকে ফুটবলের মত লাথি মারতে থাকে। বেলা ৪ টার দিকে লোক দুটিকে ছেড়ে দেয়।
অতঃপর আমাদের দুজনকে ওই ঘরে ঢুকায়। সেখানে একজন গুলিবিদ্ধ ভীষণভাবে আহত লোক হাত বাঁধা অবস্থায় ছিলেন। সন্ধ্যার সময় ঐ আহত লোককে ঘর থেকে বের করে পশ্চিম দিকে পুকুরের ধারে নিয়ে যায়। যাবার পথে তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে সারা পথ নিয়ে যায় এবং পুকুরের ধারে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। আমি এ দৃশ্য উক্ত ঘরের জানালা খুলে দেখেছি।
এশার নামাজের জন্য অজু করে আসছিলাম, তখন ক্যাম্প ইনচার্জ আমার পড়ার খবর শুনে কেরআত পাঠ শুনতে চায়। আমি তিন ঘন্টা ধরে মুখস্ত কোরআন পাঠ করে শুনিয়ে সন্তুষ্ট করি এবং পরদিন বিকাল চারটায় আমাকে মুক্তি দেয়।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আছির উদ্দিন মুন্সী
গ্রাম- চিরিরবন্দর মাজাপাড়া
থানা- চিরিরবন্দর,
জেলা- দিনাজপুর