You dont have javascript enabled! Please enable it!

তখন আমাকে প্রস্রাব খেতে দেওয়া হয়।

২৫ শে মার্চের পর দিনাজপুর যখন ইপিআর কর্তৃত্বে ছিল সে সময় আমি ইপিআর বাহিনীদের গাড়ি করে স্থান থেকে স্থানান্তরে নিয়ে যেতাম। আর এ অপরাধের জন্য আমাকে এপ্রিলের ৬ তারিখে পাক হানাদাররা দিনাজপুর শহর থেকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালি থানার পাশের জঙ্গলে নিয়ে যায়। উদ্দেশ্য, আমাকে সেখানে হত্যা করা হবে। আমাকে ঐ খানে নিয়ে গিয়েছিল কয়েকজন সামরিক লোকজন ও কতিপয় অবাঙ্গালী দালাল। সেখানে আমাকে জবাই করার জন্য ছোরা বের করে। ঠিক সে সময় শেষবারের মত পানি পান করার সুযোগ দেয়ার জন্য তাদের প্রতি অনুরোধ জানাই। অনুরোধে তাদের মধ্যের একজন দয়াপরবশ হয়ে আমাকে পানি পান করে আসার অনুমতি দেয়। থানার প্রাচীরের পাশের টিউবওয়েলে পানি পান করি এবং বাঁচার শেষ অবলম্বন হিসাবে তাদের বোঝার আগেই প্রাচীর টপকে অপর দিকে চলে যাই। সেখানেও খান সেনারা ছিল। তারা আমাকে পুনরায় গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে বেদমভাবে হুইপিং করা হয় এবং মুক্তিফৌজ কোথায়, ‘সুন্দরবন’ গাড়িটি কোথায়, কতজন বিহারীকে হত্যা করেছ ইত্যাদি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। কিছুক্ষণ হুইপিং সহ্য করার পর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফেরার পর ঐ দিন বিকালে আমাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। সে সময় কিছুসংখ্যক অবাঙ্গালী মেয়ে থানায় এসে জবানবন্দী দেয় যে আমি তার স্বামী, ভাই অথবা বাবাকে হত্যা করেছি। ফলে পুনরায় আমার উপর প্রহার শুরু হয়। কিছুক্ষণ পর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগে আমি পানি পান করতে চাই। তখন আমাকে প্রস্রাব খেতে দেওয়া হয়।

রাত বারটায় আমি জ্ঞান ফিরে পেলাম। অতঃপর আমাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওসির কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে জনৈক মেজরসহ, একজন ক্যাপ্টেন ও ডিএসপি ছিল। সেখানে আমার নামধাম ও আত্মীয়স্বজনের খবরাখবর আদায় করে নেওয়া হয়। সেখানে অবশ্য আরও ছয়জন আসামী ছিলেন। এরপর অফিসাররা নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কিছু বলবার পর উল্লিখিত ছ’জনকে পেছনে হাত ও চোখ বেঁধে জীপে উঠিয়ে নিরুদ্দেশের পথে নিয়ে যায়। এরপর আমাকে আবার বন্দীশালায় বন্দী করে রাখে। এ অবস্থায় আমাকে থানায় রেখে দুবেলা জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রহার করত। প্রথম সাত দিন আমাকে কিছুই খেতে দেয়নি। পানি চাইলে প্রস্রাব দিত। কয়েক দিন পর সামান্য পানি পান করতে দিত। তাও কর্তৃপক্ষের অগোচরে।

তেরদিন পর বেলা দশটায় জনৈক পাঞ্জাবী হাবিলদার এসে আমাকে দিনাজপুর কুঠিবাড়ী ক্যান্টনমেন্টে হাত পিছনে ও চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে যাবার পর আমার দু’পায়ে এবং দু’হাতে কড়া বেঁধে হাত পা ফাঁক করে টানা দেয়। টানা দেওয়া অবস্থায় সিনার উপর বুট দিয়ে পাড়া দেয় এবং কতজন লোককে মেরেছি ও গাড়ি কোথায় আছে তা জানতে চায়। দু’ঘন্টা এ অবস্থায় রেখে অত্যাচার করে। এর ফলে আমার নাকমুখ দিয়ে রক্ত উঠে; আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

ক্যান্টনমেন্টে নির্যাতন পর্ব শেষ হলে আমাকে পুনর্বার সন্ধ্যার দিকে থানায় পূর্বোক্ত পদ্ধতিতে পাঠায়। সারারাত বন্দী অবস্থায় রেখে পরদিন বেলা এগারোটার দিকে অন্য ছ’জনের সাথে আমাকে কোর্টে নিয়ে যায়। কোর্ট থেকে আমাকে জেলখানায় স্থানান্তরিত করা হয়।

দু’দিন পর জেল খানার ভিতরে ক্যাপ্টেন কয়েকজন অনুচরসহ যায়। সে সময় খাবার খেতে বসেছিলাম। না খেয়েই আমি এবং অপর একজন তার কাছে চলে যাই। সেখানে আবার একই কথাগুলি জিজ্ঞাসা করে। সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে আমাকে দু’ঘন্টা গাছে উল্টো দিকে করে লটকাবার নির্দেশ দেয়। নির্দেশ মোতাবেক আমাকে পা উপরে এবং মাথা নীচে করে লটকিয়ে দেওয়া হয়। ঐ অবস্থায় ওরা খুব পাশবিক উল্লাস করেছে, হাসাহাসি করেছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুতো দিয়ে মশকরা করেছে। দু’ঘন্টা পর অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে নামানো হয়।

পরদিন আবার জনৈক অফিসার এসে ডেকে চেম্বারে নিয়ে যায়। সেখানে এক বন্ধ ঘরে উলঙ্গ অবস্থায় পা ফাঁক করে দাঁড় করিয়ে রাখে এবং পুরুষাঙ্গে দুটো ইট বেঁধে দেয়। ঐ ইটের উপর আবার পানি ঢালা হয়েছিল। সামান্য নড়াচড়া করলে লাথি, ঘুষি ও বেত প্রহার করত। এই প্রক্রিয়ায় আমাকে দেড় থেকে দুই ঘন্টা রাখা হয়। একইভাবে আরও দু’জনকে এদিন শাস্তি দেয়।

এর দু’দিন পর রাত তিনটার সময় পাঁচজন সামরিক লোক এসে আমাকে সহ ২১ জনকে ডাকে। গেটে আসার পর সকলের হাত বাঁধা হয় এবং কালো কাপড় দিয়ে চোখ, কান কষে বাঁধা হয়। অতঃপর আমাদেরকে ট্রাকে করে কোথাও নিয়ে গিয়ে নামানো হয়। অবস্থাদৃষ্টে স্থানটিকে নরম মনে হয়েছে। দু’একটি ঘাস অথবা ছোট ঘাস জন্মেছিল। সেখানে নেয়ার পর এক একজনকে সারি থেকে খুলে নিয়ে যাতে থাকে। নিয়ে যাবার পর শুধু খাসি, গরু জবাই করলে যেমন শব্দ হয় তেমনি করুন ও হৃদয়বিদারী শব্দ শোনা যেত। তারপর হাত-পা আছড়ানোর মত শব্দ কিছুটা কানে ভেসে আসত। এমনি করে ১৯ জনকে সারি থেকে নিয়ে যাবার পর আমাকেসহ আর একজনকে জেলখানায় নিয়ে আসে। সেখানে চোখ ও হাত খুলে দেয় এবং সেখানেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেঃ দলে কে কে আছে তাদের নাম বল এবং ‘সুন্দরবন’ গাড়ি কোথায় আছে বল। সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে মাথার চুলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে প্রাচীরের সাথে আঘাত করতে থাকে এবং বুট দিয়ে ২/৩টি লাথি বুকে মারে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরলে আমি মুখে রক্ত দেখতে পাই। ডাক্তার এসে আমাকে ঔষধাদি খাওয়ানোর পর পুনরায় হাজত খানায় পুরে রাখে। আমার সাথে জনৈক মেকানিক সিরাজ মিয়াকে ধরে অনুরূপভাবে অত্যাচার করে। হাত-পায়ে পেরেক মেরে পাছার মাংস কেটে কুকুরকে দিয়েছে। সে অবশ্য এখনো জীবন্মৃত অবস্থায় বেঁচে আছে। জেলখানার ভিতর তিনজন যুবতী মেয়েকে দেখেছি। তাদের করুণ কান্না ও চিৎকার ধ্বনি শুনেছি।

এ অবস্থায় ৭ মাস ৩ দিন থাকার পর ১৬ই ডিসেম্বর ভোর পাঁচটায় মুক্তি বাহিনীর জোয়ানরা জেলখানার তালা ভেঙ্গে আমাকে সহ সকল বন্দীকে ছেড়ে দেয়। বর্তমানে পঙ্গু অবস্থায় আছি। আমি কোন রকম কাজ করতে পারি না।

স্বাক্ষর/-

রফিকুল ইসলাম

গ্রাম- সোনাপুকুর

থানা- পার্বতীপুর

জেলা- দিনাজপুর

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!