তাজউদ্দীন কি ভারতের দালাল? পাটের রাজনীতি
আর একটি কথা, তাজউদ্দীন ভারতঘেঁষা কিছু লােকের এমন একটি প্রচারণা ছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীন একজন মানুষ। যুদ্ধের পর প্রথম ছয় মাসে আমি দেখেছি মুক্তিযুদ্ধবিরােধী ভূমিকার কারণেই হয়ত তার মনােভাব আমেরিকাবিরােধী, কিন্তু তার পরেই তিনি সম্পূর্ণ প্রাগম্যাটিক। ভারতকে খাতির করব, রাশিয়াকে খাতির করব, আমেরিকানদেরকে খাতির করব না—এই মনােভাব তার কোন দিনই ছিল না। তাঁর মনােভাব ছিল, যুদ্ধের সময় কার সাহায্য নিয়েছি, কার সাহায্য পাইনি, বা এমন সাহায্য দেশের স্বার্থে সবাই নেয় তার মানে এই নয় যে সাহায্যের বদলে ওরা যা বলবে আমরা তাই করব, এটি হবে না। তাজউদ্দীন সাহেব সম্পর্কে এই ভারতঘেঁষা কথাটি যারা বলেছে তারা সম্পূর্ণ বাজে কথা বলেছে। তিনি কোন দিনই কারাে প্রতি নতজানু ছিলেন না। তার কোন রকম দুর্বলতা ছিল না। কোন দেশের প্রতি তার যা কিছু দুর্বলতা ছিল তা ছিল তাঁর নিজের দেশ বাংলাদেশের জন্য। তিনি ছিলেন প্রাে-বাংলাদেশ। আমি তার সাথে কাজ করতে গিয়ে এমন প্রমাণ পাইনি যে তিনি ভারতের সাথে খাতির করে সমঝােতা করেছেন। আমি প্রায় ৩ বছর তাঁর সাথে কাজ করেছি, আমার অভিজ্ঞতায় এটি নেই যে, ভারত আমার বন্ধু দেশ, কাজেই ছেড়ে দাও। অথবা ভারতের সাথে আলােচনার সময় শক্ত না থেকে নরম থাকতে হবে। এমন তিনি কখনােই করেননি বা বলেননি। তাজউদ্দীন সাহেবের মধ্যে কৃতজ্ঞতাবােধ ছিল। ভারত যুদ্ধের দিনে আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে, সাহায্য করেছে, সেই জন্য তিনি কৃতজ্ঞ। কিন্তু দেশের স্বার্থে পাট বিক্রি করতে হবে, ফার্টিলাইজার লাগবে এমন সব কথাবার্তার ক্ষেত্রে অনেক সময় আমরা ভারতীয়দের সাথে ঝগড়া পর্যন্ত করেছি। তাজউদ্দীন সাহেব কোন দিন নরম হতে বলেননি। আমরা একবার ভারতে গেলাম একটা ডেলিগেশান নিয়ে, আর এদিকে এনায়েতউল্লা খান হলিডেতে হেডলাইন দিয়ে লিখে ফেললেন, বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশন গেছে ভারতের আশীর্বাদ নিয়ে আসতে এবং প্ল্যান তৈরি করার আগে দিকনির্দেশনা নিতে। এই কথাগুলাে ছিল সম্পূর্ণ জঘন্য ও মিথ্যা অপপ্রচার। আমাদের মনােভাব ছিল, আমরা স্বাধীন দেশ, কথাবার্তা-আলােচনায় আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলব। আমাদের দেশের স্বার্থের বিষয়ে কোন খাতির নেই। যেমন পাট নিয়ে আলােচনার সময় আমরা সরাসরি ভারতকে বলেছি, তােমাদের পাট উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। তােমাদের খরচ বেশি, তােমরা উৎপাদন কেন করছ ? আমরা তােমাদের কাছে পাট বিক্রি করব। আমি রীতিমত ফাইট করেছি ওদের সাথে। আগে ভারত কিছু কিছু পাট উৎপাদন করত, বাকিটা নিত বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে। কিন্তু পাক-ভারত যুদ্ধের পর পাকিস্তান পরবর্তীতে ভারতে পাট বিক্রি বন্ধ করে দেবার ফলে ভারত বেশ জোরেসােরে পাট উৎপাদন শুরু করে। আমরা চেয়েছিলাম ওরা বাড়তি পাট উৎপাদনটা বন্ধ করে আবার আগের মত আমাদের কাছ থেকে পাট ক্রয় করুক। তাজউদ্দীন সাহেবের কথা ছিল, বিপদে সাহায্য করেছ ভাল কথা, আমরা বন্ধু থাকব, কিন্তু তাই বলে আমার দেশের স্বার্থের ক্ষতি হয় এমন কোন সুবিধা আমি তােমাকে দেব না।আর একটি ঘটনা, দেশ স্বাধীন হবার পর আমেরিকান কনসাল জেনারেল ঢাকায় রয়ে গেছেন, কিন্তু তার কূটনৈতিক স্টেটাস নেই—কারণ ওঁর দেশ তাে আমাদেরকে স্বীকার করে না। তাজউদ্দীন সাহবের জায়গায় অন্য কেউ হলে বলত, চলে যাও, তুমি এখানে কী করছ ? কিন্তু দেশের স্বার্থে তাজউদ্দীন সাহেব তাকে কিছু করলেন না, বরঞ্চ তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন। পরবর্তীতে তাকে সম্পূর্ণ কূটনৈতিক মর্যাদা দেয়া হয়। আমি এ কথাটি এজন্য বলছি, তখন তাে সাংঘাতিক আমেরিকাবিরােধী মনােভাব ছিল মানুষের। ‘৭২ সালে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট (দক্ষিণ এশিয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত) পিটার কারগিল ঢাকায় এলেন। তখনও বিশ্বব্যাংকের কোন প্রতিনিধি ঢাকায় ছিল। আমরা কারগিলকে বুঝালাম, বাংলাদেশের এই অবস্থায় তােমরা এমন একজন প্রতিনিধি দাও যিনি কোন বড় দেশের মানুষ হবেন না এবং যাকে নিরপেক্ষ ভাবা যাবে। নরওয়েজিয়ান ইয়ুস্ট ফালান্ড আমার দীর্ঘ দিনের বন্ধু ছিলেন, আমি তাঁর কথা বললাম। কারগিল বললেন, দেখি কী করা যায়। এরপর নরওয়েতে ফালান্ড-এর ইন্টারভিউ নেয়ার পর আমাদেরকে জানানাে হল ব্যাংক ফালান্ডকে তাদের প্রতিনিধি করতে রাজি আছে। আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে সমস্ত বিষয়গুলাে বললাম। ফালান্ড ঢাকায় এলেন। আমাদের সাথে বিশ্বব্যাংকের তিনিই ছিলেন যােগাযােগের মাধ্যম। তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে তাঁর অত্যন্ত চমৎকার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হি স্টার্টেড ফাইটিং ফর বাংলাদেশ রাদার দ্যান ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ইন্টারেস্ট। বাংলাদেশের জন্য তাঁর গভীর সহানুভূতি ছিল। তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে তাঁর এত ভাল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছিল যে বাংলাদেশ থেকে চলে যাবার পরও তিনি তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে দেখা করেছেন, যােগাযােগ রেখেছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেবের একটা ব্যাপার ছিল, তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মানুষকে হ্যান্ড করতে পারতেন। যেহেতু তিনি অসম্ভব রকমের বুদ্ধিমান, শিক্ষিত এবং যােগ্য মানুষ ছিলেন তাই তার জন্য খুব সহজ ছিল বিদেশীদের হ্যান্ড করা। তাঁর মত দক্ষ মানুষ বাংলাদেশে খুব কমই ছিল । বন্ধু হিসেবে তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন অত্যন্ত বিশ্বস্ত, অসম্ভব রকমের ভাল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সিম্পল এবং ভীষণ ভদ্র। নিজেকে জাহির করা, যে কোন ধরনের শাে অফ করা এসবের মধ্যে তিনি কখনােই ছিলেন না। অত্যন্ত ভাল একজন মানুষ ছিলেন তিনি।
– নুরুল ইসলাম
Reference: তাজউদ্দীন আহমদ – আলোকের অনন্তধারা