You dont have javascript enabled! Please enable it! 1978 | স্বাধীনতা বিরােধীদের সংখ্যাশক্তি যাচাই করতে জিয়ার কৌশল | সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে "চঁাদ তারা মার্কা পতাকা চাই” - মিছিল | ধর্মরাজনীতির দ্বার হল উন্মুক্ত - সংগ্রামের নোটবুক

স্বাধীনতা বিরােধীদের সংখ্যাশক্তি যাচাই করতে জিয়ার কৌশল
সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে “মার্কা পতাকা চাই” – মিছিল
ধর্মরাজনীতির দ্বার হল উন্মুক্ত – কেমন করে?
বঙ্গবন্ধু যাদের নগরিকত্ব বাতিল করেছিলেন জিয়া আইন সংশোধন করে তাদের নাগরিকত্ব দেন।

৮. স্বাধীনতা বিরােধী প্রতিক্রিয়াশীলদের সংখ্যাশক্তি যাচাই করার লক্ষ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমান তদানীন্তন এয়ার ভাইস মার্শাল এম, জি, তাওয়াবকে সক্রিয় করে তােলেন। এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াব স্বাধীনতা বিরােধী জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ এবং দক্ষিণপন্থী দল ও গ্রুপগুলােকে একত্রিত করে একটি শক্তি মহড়ার ব্যবস্থা করেন সিরাতুন্নবী দিবসকে সামনে রেখে। সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে সপ্তাহব্যাপী সিরাত মজলিশে এয়ার ভাইস মার্শালের বক্তৃতা দেবার সময় শ্লোগান ওঠে “তাওয়াব ভাই তাওয়াব ভাই, চঁাদ তারা মার্কা পতাকা চাই।” জামাত, মুসলিম লীগ ও দক্ষিণপন্থী দলগুলাে এই সিরাত মজলিশে তাদের শক্তি সংখ্যা প্রদর্শন করতে সমর্থ হয়।সমাজ বিপ্লবের ধারক বলে দাবীদার এবং ৭ই নভেম্বর ঢাকার সেনা ছাউনির বন্দীদশা হতে উদ্ধারকারী কর্ণেল (অবঃ) তাহের এবং জাসদ নেতৃবৃন্দকে ‘পাওয়ার কনটেষ্টে’-এ মাঠ থেকে বের করে দেবার এবং তাদের আচ্ছামত শাস্তি বিধানের নিমিত্তে জিয়া এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াবকে দিয়ে ডানদের দ্বারা ‘বামদের’ ঠেকানাের কৌশল গ্রহণ করেন। কর্ণেল তাহেরকে ফাসি ও জাসদ নেতৃবৃন্দকে কারান্তরালে পাঠানাের প্রেক্ষাপটে তিনি কিছুদিনের মধ্যে তাওয়াবকেও দেশ থেকে বের করে দেন স্বাধীনতা বিরােধীদের স্বীয় কবজায় আনার লক্ষ্যে।

৯. এতসব খেলায় ‘ধুরন্ধর’ রাজনীতিবীদগণের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, ক্ষমতার রশি আসলে প্রেসিডেন্ট সায়েমের হাতে নেই-ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে দাড়িয়ে আছেন জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং ক্ষমতার লাটাই তার হাতেই। সেজন্য সুবিধাবদী রাজনীতিবিদ যারা স্বাধীনতার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দালাল নামে আখ্যায়িত হয়ে কারাগারে ছিলেন এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিলেন, তারা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে বঙ্গভবনের দিকে আগ্রহ প্রত্যাহার করে সেনাছাউনির দিকে ছুটতে থাকেন। বঙ্গভবনে বসে বিচারপতি সায়েম যিনি যথার্থভাবেই মনে করেছিলেন সামনের শীতে (৭৭ সনে) দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন দিতে সক্ষম হবেন যেহেতু জাতির নিকট এ বিষয়ে তিনি ওয়াদাবদ্ধ; তিনি অচিরেই দেখতে পেলেন যে, “আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্যান্য রাজনীতিবিদগণ সেনাছাউনিতে দৌড়াচ্ছেন।” প্রধান সেনাপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান আসন্ন নির্বাচন বানচাল করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন একথা সম্ভবতঃ বিচারপতি সায়েম দৃষ্টিগ্রাহ্য হলেও তার কিছু করার ছিলাে না। তিনি ছিলেন কেবলমাত্র ঘটনার সাক্ষী, জ্যান্ত পুতুল মাত্র।

১০. বিচারপতি সায়েমের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে তাকে সামনে রেখেই জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সনের মে মাসে তুরস্কে অনুষ্ঠিত ৪২ জাতি ইসলামিক কনফারেন্সে যােগদান করেন। তুরস্কে গিয়ে তিনি রাজনীতি করার যে অাকাঙ্খা এবং ক্ষমতার শীর্ষস্থান দখল করার যে অদম্য অথচ সুপ্ত বাসনা দীর্ঘদিন লালন করে আসছিলেন তার বাস্তবায়নের পথ খুঁজে পান। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলাে তাকে বাংলাদেশকে “ইসলামীকরণের’ পরামর্শ দেন এবং এ ব্যাপারে যাবতীয় সাহায্য সহযােগিতা করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরােধী দলগুলাের সমর্থন তার পক্ষে আদায় করে দেবার বিষয়ে তাকে আশ্বস্ত করা হয়। ঐ একই সময়ে তিনি বালাদেশ মুসলিম লীগের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে পাকিস্তান গমন করেন, বাণিজ্যক চুক্তি করেন এবং এ বিষয়ে পাকিস্তান থেকে তাকে সমর্থন দানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এই লক্ষ্যে তিনি সামরিক ফরমান বলে দালাল আইন বাতিল করেন।

কোলাবােরেটর্স আদেশ বাতিল
১১. জেনারেল জিয়ার অব্যাহত চাপে এবং জাতীয় ঐক্যের’ যুক্তিতে পরাস্ত প্রেসিডেন্ট
বিচারপতি জনাব সায়েম এক অর্ডিন্যান্স জারী করে ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ কোলাবােরেটর্স (বিশেষ ট্রাইবুন্যাল) আদেশটি (১৯৭২ সালের ৮ সম্বর প্রেসিডেন্ট আদেশ) বাতিল করে দেন। বাসস পরিবেশিত এক খবরে প্রকাশ, ১৯৭৫ সালের বাংলাদেশ কোলাবােরেটর্স। (বিশেষ ট্রাইবুন্যাল) (বাতিল) অর্ডিন্যান্স নামে অভিহিত এই অর্ডিন্যান্সেটিতে বলা হয়েছে যে, উক্ত আদেশটি বাতিল হওয়ায় কোন ট্রাইব্যুনাল, ম্যাজিষ্ট্রেট বা আদালত সমীপে এই আদেশ বাতিলের অব্যাবহিত পূর্বে মুলতবী থাকা সমস্ত বিচারকার্য বা অন্যান্য মামলা এবং উক্ত আদেশ বলে কোন পুলিশ অফিসার বা অপর কোন কর্তৃপক্ষ দ্বারা বা সমীপে পরিচালিত সমস্ত তদন্ত কার্য বা অন্যান্য মামলা বাতিল হয়ে যাবে এবং সেগুলি আর চালানাে হবে না। এতে উক্ত আদেশ বলে কোন ট্রাইব্যুনাল, ম্যাজিষ্ট্রেট কিংবা আদালত কর্তৃক প্রদত্ত কোন দণ্ড বা সাজার বিরুদ্ধে দায়েকৃত কোন আপীল ব্যাহত হবে না বলে। অর্ডিন্যান্সটিতে উল্লেখ করা হয়। অর্ডিন্যান্সটিতে আরও বলা হয় আদেশটি বাতিল হওয়ায় মুলতবী থাকা বিচার, তদন্ত ও অন্যান্য মামলা রদ হওয়া ছাড়া ১৮৯০ সালের সাধারণ উপধারা আইন “(১৮৯৭ সালের দশম আইন) এ ৬ নম্বর ধারার প্রয়ােগও ব্যাহত হবে না।”
১২. জিয়াউর রহমানের নিজস্ব পর্যালােচনায় এ বিষয়টিও বেরিয়ে এসেছিলাে যে, শুধুমাত্র জামাত-মুসলিম লীগের সমর্থন নিলে তার মুখে শুধু কলংক লেপনই হবে মুক্তিযােদ্ধার বাহিরাবরণ যা তিনি ধারণ করে আসল চেহারা আড়ল করে রেখেছেন তাও খসে পড়বে। এতে জনগণ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে দেখা দেবে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া। সেজন্য তার প্রয়ােজন ছিলাে চীনপন্থীদের সমর্থন আদায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চীনপন্থীরা ছিলাে কোণঠাসা, রাষ্ট্রক্ষমতা হতে বহু দূরে। অন্তর্কলহে ছিন্নভিন্ন চীনপন্থীদের সংগঠিত করার বয়স ও ক্ষমতা মাওলানা ভাসানীর ছিলাে না। চীনপন্থীদের এক বিরাট অংশ স্বাধীনতা বিরােধী ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলাে কেননা চীন বালাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি’ হিসেবে গণ্য করেছিলাে। স্বাধীনতার পর এদেশীয় চীন অনুসৃত রাজনীতিবিদদের অবস্থান সুখপ্রদ ছিলাে না, সাংগঠনিক বা রাজনীতি ক্ষেত্রে। জিয়াউর রহমান জামাত-মুসলিম লীগের সমর্থন আদর করার পর বিপ্লবী চীনা নেতাদের দিকে হাত বাড়ালেন। এই লক্ষ্যকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সনে জানুয়ারীতে চীন সফর করেন। এভাবে জিয়াউর রহমান উগ্র ডান এবং উগ্র বামদের এক মেরুতে দাঁড় করাতে ‘জাতীয় ঐক্যের’ শ্লোগান দিতে ভুল করেন নি। পরিস্থিতির উর্বর সময়ে ২১শে এপ্রিল ১৯৭৭ সনে সামরিক ফরমান বলে প্রেসিডেন্ট পদটি বিচারপতি সায়েমের নিকট হতে কেড়ে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি-যদিও ইতিপূর্বে ১৯৭৬ সনের ২৯শে নভেম্বর তিনি সামরিক প্রশাসকের পদটি দখল করতে ভুল করেন নি।

১৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ বিশেষ করে সৌদি আরব, তুরস্ক, জর্দান, সুদান, সংযুক্ত আমির আমিরাত দেশগুলাের পক্ষ হতে পূর্ণ সাহায্য ও সহযােগিতা প্রাপ্তির লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান সংবিধান হতে ধর্মনিরপেক্ষতার বিধানাবলী ১২ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে পাকিস্তানী ধারার শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে দাঁড় করালেন এবং একই সাথে ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করার অধিকার সম্বলিত ফরমান জারী করলেন এবং সংবিধানের ৩৮নং ধারার শর্তসমূহ বাতিল করলেন।

১৪. ১৯৭৬ সনের ২৮ শে জুলাই রাজনৈতিক দল বিধি নিয়ন্ত্রণ (পি,পি,আর) জারী করেন। অনুমােদনপ্রাপ্ত ২২টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ধর্মীয় দলগুলাের ৬টিকে নিয়ে গঠিত আই ডি এল কে রাজনীতি করার অনুমতি দেন। বাংলাদেশে পুনরায় ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করার দরজা খুলে দেয়া হয়। অনুমতি প্রদান করলে এই দলগুলাে একযােগে ১৯৭৭ সনের ৩০শে মে অনুষ্ঠিত হাঁ না ভােটে জিয়াউর রহমানকে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ্য সমর্থন দান করেন। শুরু হয় জামাত-মুসলিম লীগ, ঘাতক দালালদের ব্যাপক পুনর্বাসন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে। শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকার অভিলাষে ক্ষমতার দাপটে সামরিক শাসনের আওতায় জনগণকে বুটের তলায় রেখে স্বাধীনতা বিরােধীদের ক্ষমতায় অংশীদারিত্বে আনার ক্ষেত্র ‘মুক্তিযােদ্ধা’ প্রস্তুতে জিয়াউর রহমান ইতিহাসে ‘ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখিত হবেন সন্দেহ নেই।

১৫. জিয়াউর রহমান মুক্তিযােদ্ধাদের পােশাকে মন্ত্রী সভায় স্বাধীনতা বিরােধীদের নেতৃস্থানীয় শাহ আজিজুর রহমান, মশিউর রহমান, মীর্জা গােলাম হাফিজ, শামসুল হুদা চৌধুরী, শফিউল আযম এবং আবদুল আলীমের মতাে ব্যক্তিবর্গকে নিতে সাহসী হয়েছিলেন। এমন কি স্বাধীনতার সরাসরি বিরােধকিারী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন।

১৬. বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক যে সমস্ত স্বাধীনতা বিরােধী নেতৃবৃন্দের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিলাে জিয়া স্বাধীনতা বিরােধী সেই সকল ব্যক্তিদের নাগরিত্ব ফিরিয়ে দেবার জন্য ১৯৭৮ সনের ১১ই ফেব্রুয়ারী নাগরিকত্ব আইনের সংশােধনী আনয়ন করেন। স্বাধীনতা বিরােধীদের রাজনৈতিকভাবে, সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হচ্ছিলেন। ১৯৭৮ সালের ১৮ই জানুয়ারী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এক প্রেসনােটের প্রেক্ষিতে অধ্যাপক গােলাম আজমও তার নাগরিকত্ব ফিরে পাবার আবেদন জানালে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা বিরােধী ঘৃণ্য কার্যক্রমে অধ্যাপক গােলাম আজমের স্থূপীকৃত ফাইলের হাত দিতে সাহসী হন নি। ১৯৭৮ সনে ১১ জুলাই অসুস্থ মাতাকে দেখার জন্য পাকিস্তানী নাগরিক হিসেবে পাকিস্তানের পাসপাের্টে তিন মাসের ভিসা নিয়ে গােলাম আজম বাংলাদেশে আসেন এবং বালাদেশে এখন পর্যন্ত অবস্থান করছেন।

১৭. এমনিভাবে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে স্বাধীনতা বিরােধীদের পুনর্বাসন করেন। স্বীয় ক্ষমতাকে স্থায়ী করার স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের দলিল শাসনতান্ত্রিক বিধানকে হেঁটে ফেলেন। জিয়াউর রহমানকে ‘এ কাজটি করতে হয়েছিলাে তার পাওয়ার বেজ’ ঠিক রাখার স্বার্থে। কেননা, সামরিক বাহিনীর প্রায় পুরােটাই ছিলাে পাকিস্তানী মানসিকতায় আচ্ছন্ন। চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্চপদে তাদের বসিয়ে জিয়াউর রহমান ভেবেছিলেন তার ক্ষমতা চিরস্থায়ী কাঠামােয় দাড়িয়ে গেছে। সেজন্য মুক্তিযােদ্ধার ‘মুখােশে’ জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের হৃৎপিন্ডে শাণিত ছুরি বসিয়ে দিতে এতটুকু কুণ্ঠিত হননি।

রেফারেন্স – জেনারেল জিয়ার রাজত্ব -অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

ভিডিও – ১৯৭৮ সালে চাইনিজ উপ-প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফর।

ভিডিও লিংক