You dont have javascript enabled! Please enable it!

চতুর্থ অধ্যায়

দরখাস্তের রাজনীতিঃ চক্রান্ত

১। পাকিস্তান সেনা কাঠামাের আওতায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত জিয়াউর রহমান পাকিস্তানী ধ্যান-ধারণা ও আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। পাকিস্তানী রাজনীতির প্রাসাদ চক্রান্তে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা ১৯৫৮ সনের ৭ই অক্টোবর সামরিক আইন জারি করেন, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ ভেংগে দেন। রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত এবং ১৯৫৬ সনে রচিত শাসনতন্ত্রের মৃত্যু বলে ঘােষণা করেন। একই সাথে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মােহাম্মদ আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান ২৭শে অক্টোবর অস্ত্রের মুখে জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জার নিকট হতে পাকিস্তানের পেসিডেন্ট পদটি গ্রহণ করে একাধারে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, প্রধান সামরিক প্রশাসক এবং প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেন। বলাবাহুল্য জেনারেল আইয়ুবের এ ধরনের অগণতান্ত্রিক কর্মকান্ড পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রতিটি অফিসার ও সেনা সদস্যদ্বারা ব্যাপক ভাবে সমর্থিত হয়েছিল। ‘নিজের রাষ্ট্র দখলের’ আনন্দে পাকিস্তানী অফিসার ও সেনা সদস্যগণ প্রকাশ্যতঃ গর্ববােধে উল্লাসিত হয়ে উঠেছিলাে।জেনারেল আইয়ুবের এই ধারা ও পরবর্তী পদক্ষেপের মাধ্যমে এক দশকের বেশীকাল ধরে তিনি ক্ষমতা দখল করে রেখেছিলেন। 

২। জেনারেল আইয়ুবের এই পদক্ষেপগুলাে সামরিক বাহিনীর একজন অফিসার হিসেবে তদানীন্তন ক্যাপ্টেন জিয়ার মনে স্বাভাবিকভাবেই গভীর রেখাপাত করে থাকবে। জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসনের পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণের পর তার বিশেষভাবে প্রয়ােজন হয়ে পড়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা প্রবাহের নিখুঁত তথ্য প্রাপ্তির। জেনারেল আইয়ুবের একথাও অজানা ছিলনা যে তার কাঙ্খিত শাসন ক্ষমতার প্রতিবন্ধকতা আসবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে। সেজন্য পূর্ব পাকিস্তানে উপর তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা অত্যন্ত জরুরী ছিলাে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বেসরকারী প্রশাসনের উচ্চপদসমূহে যেমন পরিবর্তন সাধন করেন, তেমনি গােয়েন্দা সংস্থাগুলিতে বিশ্বস্ত লােক নিয়ােগের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বাঙালী সেনা অফিসারদের মধ্যে জিয়াউর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের গােয়েন্দাবাহিনীতে নিয়ােগ প্রাপ্ত হন। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিলগ্নে জিয়াউর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক গােয়েন্দা বিভাগে পাঠান যখন সামরিক শাসনের উচ্ছাস কেটে গেছে। মওলানা ভাসানী, আবুল মনসুর আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুল খালেক, হামিদুল হক চৌধুরী প্রমুখ কে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যাতে জেনারেল আইয়ুবকে ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ করতে না পারেন তার জন্য ‘পােরাে’ জারী করে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের যখন রাজনৈতিকভাবে ‘জবাই’ করার ব্যবস্থা জারী হয়েছে, যখন ছাত্র আন্দোলনে নতুন কৌশলে ও মাত্রায় ধূমায়িত হচ্ছে সেই মুহূর্ত পূর্ব পাকিস্তানের উপর দৃষ্টি রাখার জন্য জেনারেল আইয়ুবের প্রশাসনে বিশ্বস্ত লােক প্রয়ােজন ছিলাে। সেই প্রয়ােজনের তালিকায় জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন খাটি বিশ্বস্ত এবং অনুগত ব্যক্তিত্ব। জিয়াউর রহমান জেনারেল আইয়ুব খানের ‘নেক নজরে’ ছিলেন। এ কারণে আইয়ুব খান তাকে পূর্ব পাকিস্তান সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন।১  

৩। সামরিক শাসনের আওতায় গােয়েন্দাগিরি করতে এসে সেদিনের তরুণ সামরিক অফিসার হিসেবে জিয়াউর রহমান যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তা তাকে পরবর্তীকালে ক্ষমতা দখল ও সামরিক শাসন পরিচালনায় যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। সন্দেহ নেই। 

৪। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট। জেনারেল সফিউল্লাহকে হটিয়ে জিয়াউর রহমান প্রধান সেনাপতির পদ দখল করেন। ১৯৭৫ সনের ৩০শে আগষ্ট সামরিক ক্ষমতার বলে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়। 

৫। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার ৫০ দিন পর ৩রা অক্টোবর ‘৭৫ লায়লাতুল কদরের পরম পবিত্র রাতে স্বঘােষিত প্রেসিডেন্ট খুনী খন্দকার মােশতাক : আহমদ জাতির উদ্দেশ্যে রেডিও টেলিভিশনে ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণে ১৯৭৬ সনের ১৫ই আগস্ট থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা ও কাজকর্মের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ১৯৭৭ সনের ২৮শে ফেব্রুয়ারী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করার কথা ঘােষণা করে।২  

৬। ৩রা নভেম্বর খালেদ মােশাররফ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন।

এবং তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন করেন। খন্দকার মােশতাক সামরিক ফরমান বলে প্রেসিডেন্ট পদটি ছেড়ে  দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭৫ সনের ৬ই নভেম্বর প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হয়ে বিচারপতি সায়েম জাতির উদ্দেশে এক ভাষণ দেন। ভাষণে তিনিও জাতির সামনে দ্ব্যার্থহীনভাবে ঘোষণা করেন যে, ১৯৭৭ সনে পূর্বঘােষিত ফেব্রুয়ারী মাসেই জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এমনকি, সম্ভব হলে তার পূর্বেও নির্বাচন সম্পন্ন করার সংকল্প ব্যক্ত করেন। শুধু তাই নয়, ৭ই মার্চে সংঘটিত ঘটনাবলীর পরেও প্রেসিডেন্ট সায়েম পুনরায় জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা দৃঢ়তার সঙ্গেই ঘােষণা করেন। ১৯৭৫ সনের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত অপর এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট সায়েম জোর দিয়ে বলেন “বর্তমান সরকার অন্তবর্তীকালীন, অরাজনৈতিক এবং সম্পূর্ণ দল নিরপেক্ষ সরকার। সরকারের লক্ষ্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা”। 

৭. ১৯৭৬ সনের ২৮ শে জুলাই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক রাজনৈতিক দলবিধি জারী করেন। রাজনৈতিক দলবিধি জারী করার পূর্বেই ২৭শে জুলাই রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম ১৫ই আগস্টের মধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করার ঘােষণা দেন এবং পূর্ব ঘােষিত ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা পুনরায় জোর দিয়ে বলেন। একই সাথে রাষ্ট্রপতি বলেন, সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি সায়েম বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৩৮ জন নেতার ও উপ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়ার উপস্থিতিতে একথা বলেন।৩  

৮। সরকারী সংবাদ সংস্থা বাসস পরিবেশিত খবরে বলা হয়, উপস্থিত নেতৃবৃন্দ নির্বাচনের প্রস্তুতি, রাজনৈতিক তৎপরতা এবং নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পর্কে নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করেন, তা থেকে সর্বসম্মত কিছু মত বেরিয়ে এসেছে যা সুষ্ঠু রাজনৈতিক আবহাওয়া ও নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক হবে বলে মনে করা হয়। এই সভায় নির্বাচনের মাধ্যমে অতিসত্ত্বর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফিরিয়ে আনার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করা হয়। সরকারও নিজেদের নিরপেক্ষ ও অন্তবর্তীকালীন সরকার বলে যে ঘােষণা করেছে এবং সে ঘােষণার মর্যাদা রক্ষার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।৪  

৯। ২৮শে জুলাই সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে একটি ঘােষণা প্রচার করা হয় যে, রাজনৈতিক দল সমূহের গঠনতন্ত্র, তালিকা, ঘােষণা পত্র এবং কর্মসূচী সরকারের নিকট পেশ করার উদ্দেশ্যে আগামী ৩০শে জুলাই হতে ১লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলির কার্যক্রম ঘরােয়া রাজনৈতিক তৎপরাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এই সরকারী বিধি ১৯৭৬ এর চতুর্দশ অনুচ্ছেদের (১) উপ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ক্ষমতা বলে সরকার এই বিজ্ঞপ্তি জারী করেছেন।

১০. লক্ষ্য করা গেল, কড়া সামরিক শাসনের মধ্যে প্রেস সেন্সরশীপ আছে সত্বেও সরকারী প্রশ্রয়ে স্বাধীনতা বিরােধী গােষ্ঠী ঘরােয়া রাজনীতির নামে দেশের সংবিধানের মৌলনীতির বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। এমনকি, প্রেস কনফারেন্স ডেকে সংবিধানের মূলনীতির বিরুদ্ধে প্রদত্ত বক্তব্য অদৃশ্য রহস্যজনক কারণে কিছু কিছু সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া শুরু হয়েছে। কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের বক্তব্য ও লক্ষ্য সংবিধানে উল্লেখিত গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।৫  

১১. এক সময় ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শের ধারায় ছাত্রসংগঠন গড়ে তুলে দলীয় শক্তি বৃদ্ধির প্রাথমিক রিক্রুটমেন্ট হিসেবে ছাত্র সংগঠনকে বিবেচনা করা হতাে। ১৯৭৬ সালে সামরিক ফরমান বলে জিয়াউর রহমান ‘পলিটিক্যাল পার্টি রেগুলেশনস’ (পি পি আর) এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলােকে তাদের অংগ সংগঠনের নাম দলের সঙ্গে তালিকাভূক্ত করার নির্দেশ জারী করে। এর পূর্ব পর্যন্ত রাজনৈতিক দল সরাসরিভাবে অঙ্গ-সংগঠগুলােকে নিয়ন্ত্রণ করতাে না। জিয়ার আমলে পি,পি,আর-এর মাধ্যমে অঙ্গ-সংগঠনগুলােকে যুক্ত করার ফলে ছাত্র সংগঠনের সাংগঠনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব মূল দলের উপরে এস পরে। ছাত্রদের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে টেনে আনা হয় এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। 

১২. প্রথম থেকে লক্ষ্য করা গেছে যে, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি সায়েমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়া যেন সমান্তরালভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। অর্থ, তথ্য, শিক্ষা, বাণিজ্য এবং সামরিক শক্তির বদৌলতে জনগণ উপলদ্ধি করতে সক্ষম হলাে শাসনতান্ত্রিকভাবে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক প্রশাসক যতই ক্ষমতাবান ব্যক্তি হন না কেন, মূল শক্তি জিয়াউর রহমান ও তার সেনাবাহিনী। তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। বিচারপতি সায়েম তার হাতের পুতুল মাত্র। কর্ণেল তাহেরের ফাঁসির মাধ্যমে জিয়া তার ক্ষমতা জনগণের নিকট উলঙ্গভাবে প্রদর্শন করতে পেরেছে বিচারপতি সায়েম যথার্থ অর্থেই অন্তবর্তী কালীন সরকারের ভূমিকায় পার্লামেন্ট পদ্ধতির প্রতিশ্রুত নির্বাচন দেওয়ার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে কার্পণ্য করেননি। ১৯৭৫ সনের ২২শে নভেম্বর রাজনীতিক প্রক্রিয়া শুরু করার লক্ষে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী নিযুক্ত করেন যাতে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যােগাযোগ ও পরামর্শ করে নির্ধারিত সময়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে পারেন। 

১৩। ২৫ ও ২৬ নভেম্বর ‘৭৫ এ উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট ও তার সহকারীর সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সংলাপ শুরু হয়। এর পাশাপাশি ২৪শে নভেম্বর রাত ১২টায় আকস্মিকভাবে মেজর জেনারেল জিয়া যে ভাষণ দেন তার সঙ্গে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কোন সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। যে সময় প্রয়ােজন রাজনৈতিক সমঝােতা ও ঐক্য – যা প্রেসিডেন্ট উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সে সময় জিয়াউর রহমান আইয়ুব খানের মত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও দলকে দোষারােপ করে চরম ভাষায় কথা বলেন। [পরিশিষ্ট-৩] 

১৪. ঘরােয়া রাজনীতির সুবাদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম পর্যালােচনা করলে স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল সরকারী নির্দেশের আওতায় একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অগ্রসর হচ্ছিল। রাজনৈতিক দলবিধি অনুযায়ী পুরাে আগস্ট মাস রাজনৈতিক তৎপরতা সীমিত থাকবে ঘরােয়া বৈঠকে। রাজপথে ময়দানে জনসভা, সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, দলের গঠনতন্ত্র, মেনিফেষ্টো দলিল দস্তাবেজ সহ দলগঠনের প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়েছে। সামরিক সরকার রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় যে সব দলের অনুমতি দেবেন তারা সেপ্টেম্বর হতে পুরােদস্তর রাজনৈতিক দল হিসেবে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পালন করতে এবং নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারবে। রাজনৈতিক দল বিধিতে বহু কড়াকড়ি শর্ত ছিল। বিদেশী অনুপ্রেরণায় বা অর্থে কেউ দল গঠন করতে পারবে না। দলের নেতা দেশের নিরাপত্তা বা জনশৃংখলার পক্ষে ক্ষতিকর কোন কাজ করতে পারবে না। দলের অর্থ তহবিল আয় ব্যয়ের উৎস প্রকাশ করতে হবে। কোন গােপন সংগঠন বা সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন বা রাখা যাবেনা। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করতে পারবে না। সরকারী অনুমতি পাওয়ার পর কোন দল এ-ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে বা বিধি লংঘন করলে সরকার সে দলকে নিষিদ্ধ করতে পারবে।(পরিশিষ্ট-৪) 

১৫. রাজনৈতিক দলবিধির শর্তাবলী কড়াকড়ি ছিলাে। ছিলাে অঘােষিত ধমক। যদিও বলা হয়েছিলাে সুষ্ঠু রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালু করার জন্যেই এই দলবিধি। রাজনৈতিক দল বিধিতে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞায় যে কথা বলা হয়েছিলাে তা ছিলাে অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট। সামরিকশাসন জারীর থাকার প্রেক্ষিতে কতিপয় ধারা স্থগিত থাকলেও দেশের সংবিধানের মৌলনীতি নিয়ে স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ নিয়ে তখন পর্যন্ত কোন বির্তক ছিলােনা। জাতীয়তা, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র সংবিধানের এই চার মৌলনীতি তখন পর্যন্ত সংবধানে সন্নিবেশিত ছিলাে। তখন পর্যন্ত সংবিধান হতে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারা বিলুপ্ত করা হয়নি। 

১৬. এমন অবস্থায় রাজনৈতিক দলবিধি জারীর মাধ্যমে সংবিধান বর্ণিত ৪ মূলনীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিমালার মধ্যেই দলগঠনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিলাে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় এই যে, রাজনৈতিক দল গঠনকে সামনে রেখে কোন নেতা নতুন দল বা পুরনাে দলের পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে দলের আদর্শ ও উদ্দেশ্য কর্মসূচীর আকারে এমন কিছু কিছু বক্তব্য বাজারে প্রচার করেছে যা দেশের সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী। সংবিধানের মূলনীতিগুলিতে স্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আশা আকাঙ্খার প্রতীকরূপে অলংঘনীয়তার দাবীদার। সংবিধান সংশােধনের ফলে সাবেক দলগুলির পুনরুজ্জীবন সম্ভব হলেও সংবিধানে বর্ণিত জাতীয় আদর্শ পরিপন্থী কোন দল গঠন করা যায়না। রাজনৈতিক দলগুলির লক্ষ্য ও ঘােষণাপত্র, কর্মসূচীকে রাজনৈতিক দলবিধির সাথে সাথে সংবিধানে উল্লেখিত গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক দল বিধিতে এ বিষয়ে স্পষ্ট কোন বিধান না থাকায় স্বাধীনতা বিরােধী জামাত মুসলিম লীগ নেজামে ইসলামী ইত্যাদি দলকে মাঠে নামানাের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যার ফলে এই সব স্বাধীনতা বিরােধী ব্যক্তিবর্গ প্রকাশ্যই যে ধরনের বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছে, তা সংবিধানের লংঘন। 

১৭. ১০ই আগষ্ট ‘৭৬ বিকেলে পাকিস্তানী দালাল ও স্বাধীনতার বিরােধী চক্রের অন্যতম হােতা শফিকুর রহমানের বাসায় সাবেক নেজামে ইসলামী, সাবেক জামাতে ইসলামী, সাবেক পিডিপি ও সাবেক খেলাফতে রব্বানী পার্টির এক যৌথ ঘরােয়া বৈঠকে পাকিস্তানী দালাল মওলানা সিদ্দিক আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ‘ইসলামী আদর্শের’ ভিত্তিতে দল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় স্বাধীনতা বিরােধী সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া ও জামাতের মওলানা আবদুর রহিমকে যুগ্ম আহবায়ক করে কমিটি গঠিত হয়। স্বাধীনতা বিরােধী শান্তি কমিটির নেতা সাদ আহমদকে আহবায়ক করে গঠনতন্ত্র ও মেনিফেস্টো কমিটি গঠন করা হয়। এর পাশাপশি আইয়ুব মােনায়েমের দালাল রসরাজ মন্ডলও তফশিলী জাতীয় ফেডারেশন পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এইভাবে রাজনৈতিক দলবিধি জরীর মাধ্যমে দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল গঠনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়া হলাে। 

আওয়ামী লীগঃ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের আবর্তে 

১৮. জিয়াউর রহমান ও খুনী চক্রের নিকট স্বাধীনতার পক্ষের মূল দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ছিল ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার ক্ষেত্রে মূর্তিমান থ্রেট।  জিয়াউর রহমান  ও তার ‘অদৃশ্য চক্র’ আওয়ামী লীগকে ভেঙ্গে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে ফেলার পূর্বে ১৯৭৮ সনের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক ঐক্য জোট ভেংগে যায়। ১৯শে জুন বায়তুল মােকাররমে এক জনসভায় গজ দলের অন্তর্ভুক্ত ন্যাপ (মােজাফফর)-এর সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ বলেন, “দেশের গরীব মানুষ কেউ নৌকায় ভােট দেয়নি, তারা ভােট দিয়েছে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ১৯ দফা সমর্থন করে”। তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্ট তার এই কর্মসূচী বাস্তবায়নের উদ্যোগ করলে তিনি তার জীবনের বিনিময়েও সহযোগীতা করবেন।” ২১শে জুন পঙ্কজ ভট্টচার্য এবং মতিয়া চৌধুরী এক বিবৃতি দিয়ে বলেন, “ওই বক্তৃতা মােজাফফর আহমদের নিজস্ব, ন্যাপের নয়।”-এর পূর্বেই ন্যাপের ভাঙন শুরু হয়েছিল। সৈয়দ আলতাফ আর সুরঞ্জিত সেন সহ ৬ জনের প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়। ন্যাপ অনিবার্য ভাঙনের দিকে এগিয়ে যায়। শুরু হয় আওয়ামী লীগ নিয়ে চক্রান্ত। 

১৯. ‘৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়। জাতীয় দল-বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বাতিল ঘােষিত হয়। সামরিক শাসন জারী হয়। সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ। ১৯৭৬ সালের ২৮শে জুলাই সামরিক ফরমানের আওতায় সীমাবদ্ধভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার লক্ষে রাজনৈতিক দলগুলিকে রাজনৈতিক দল বিধির আওতায় অনুমতি দেবার কথা ঘােষণা করা হয়। রাজনৈতিক ‘দলবিধি’র আওতায় আওয়ামী লীগ অনুমােদন লাভ করে এবং সংগঠনকে ঘরােয়া পরিবেশের মধ্যেও গতিশীল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিতব্য পার্লামেন্ট নির্বাচন ১৯৭৬ সনের ২১ নভেম্বর অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করলে সামরিক শাসকগােষ্ঠী গণআন্দোলনের ভয়ে জনাব আবদুল মালেক উকিল, বেগম সাজেদা চৌধুরী, আবদুল মমিন তালুকদার, সালাহউদ্দিন ইউসুফসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ব্যাপকভাবে গ্রেফতার করে। কেননা আওয়ামী লীগ ছিলাে এমন একটি পার্টি, তৃর্ণমূল পর্যন্ত যার সংগঠন ছিল বিস্তৃত এবং যার ছিল লক্ষ লক্ষ ত্যাগী কর্মী। পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়ানাের শক্তি তখন পর্যন্ত কোনাে দলের ছিলাে না। উগ্রচীন, উগ্রডান, স্বাধীনতা বিরােধী দল ও চক্র আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার চাইতে নির্বাচন স্থগিতকে শ্রেয় মনে করে। এ পয়েন্টে জিয়াউর রহমান ও তাদের লক্ষ্য ছিল এক ও অভিন্ন। আওয়ামী লীগের অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করতে হবে। সেজন্য ষড়যন্ত্র শুরু হয়। 

২০। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে ঘাতক দল বসে ছিলােনা। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করার ব্লুপ্রিন্ট অনুসারে চার জাতীয় নেতা  সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ.এইচ, এম কামারুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে হত্যা করা হয়। 

 

২১. শুরু হয় অত্যাচার। নিপীড়ণ। নির্যাতন। গ্রাম বাংলার তৃর্ণমূল পর্যায় হতে শুরু করে সংগঠনের কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের নির্বিচারে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ৬২ হাজার নেতা-কর্মীকে ৭৫-৭৬ সনের মধ্যেই গ্রেফতার করা হয়। দৈহিক অত্যাচারে অনেককে হত্যা করা হয়। গুম করা হয় লাশ। জিয়াউর রহমানের নির্দেশিত লেলিয়ে দেয়া সাদা পােষাকধারী গােয়েন্দা বাহিনী অনেক নেতা-কর্মীকে এত নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে দৈহিক অত্যাচার চালায় যার ফলে অনেক নেতা-কর্মী পঙ্গু হয়ে পরেন। অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। হিটলারের গােপন বাহিনীর মতাে এদের অত্যাচারের পন্থাও ছিল ভিন্ন ও নিষ্ঠুরতায় পূর্ণ। সামরিক শাসনের নিগড়ে শৃঙ্খলিত বাংলাদেশ। মৌলিক অধিকার নেই। বিচার নেই। শাসনতন্ত্র স্থগিত। মুখ বন্ধ। টু শব্দটি করার উপায় নেই। সামরিক শাসকগােষ্ঠীর এই নির্মম নিষ্ঠুর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যাবে না। সামরিক ফরমানে ঘােষণা করা হয়েছে কথাবার্তা, আকার ইংগিত, চিহ্ন দ্বারা সামরিক শাসক গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে কিছু করলে বা বললে তার শাস্তি ৫ বছর কারাদন্ড হতে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত। জাতির জনক টুঙ্গিপাড়ার কবরে, সেখানে চব্বিশ ঘন্টা সশস্ত্র পাহারা। কেউ গেলে ধমকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। না মানলে গ্রেফতার করে। মােনাজাত করতে গিয়ে গ্রেফতার হন হাজী গােলাম মােরশেদ। বঙ্গবন্ধুর কবরে এই পাহারা ১৯৮০ সন পর্যন্ত বলবৎ ছিল।৯  ঢাকার ৩২নং বাড়ি ছিলাে তালাবদ্ধ। বাড়ির সামনে যেতে দেয়া হত না। বাড়ির সামনে দাঁড়ালে ধমক খেতে হতাে। কি নির্মম নিষ্ঠুর জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন! 

২২. বিরাজমান এমনি ভয়াবহ অবস্থায় মুজিব অনুসারীদের বিভক্ত ও দুর্বল করার চক্রান্ত চলে। প্রাসাদ চক্রান্তের কুটিল খেলা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। 

১৯৭৬ সালের ২৮শে জুলাই। গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ রচনার কথা বলে সরকার সামরিক ঘােষণায় রাজনৈতিক দলবিধি জারী করলেন। বললেন, যারা বাংলাদেশে রাজনীতি করতে চায়, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়, দল গঠন করতে চায় তাদের রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় দল গঠনের অনুমতি চেয়ে দরখাস্ত জমা দিতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত। নিহত জেলখানায় চার জাতীয় নেতা। ১৯৭৫ সনের ২৫শে জানুয়ারী জাতীয় দল-বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠনের পর আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব আর ছিলাে না। আবদুস সামাদ আজাদ জিল্লুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমদ, আমির হােসেন আমুসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ কারাগারে। এই অবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিলাে পিপিআর-এর অধীনে আওয়ামী লীগ দল গঠন করবে কিনা? আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেদনাদায়ক ঘটনাবলীকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ গােপন বৈঠকে বসলেন। ১৯৭৩ সনে গঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির মধ্যে মাত্র ৮ জন বর্তমান। এমতাবস্থায় মহিউদ্দিন আহমদ, আসাদুজ্জামান খান, জহুরুল কাইয়ুম, আবদুল মান্নান, সালাউদ্দিন ইউসুফ, বেগম সাজেদা চৌধুরী, আবদুল মমিন তালুকদার, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, সােহরাব হােসনে, কামরুজ্জামান ফনীভূষণ মুজমদার, লুৎফর রহমান, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, সৈয়দ ফজলুল হক বিএসসি, মােঃ হানিফ, সিরাজুল ইসলাম, ফজলুল হক ভূঁইয়া প্রমুখ বৈঠকে উপস্থিত হলেন। সিদ্ধান্ত গৃহীত হলাে দল গঠন করা হবে। কেননা বঙ্গবন্ধুর বিশাল কর্মী বাহিনীকে সাংগঠনিক কাঠামােয় ধরে রাখতে হবে। 

২৩. ১৯৭৩ সনের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির গঠনতন্ত্রের ক্রম অনুসারে সিনিয়র সহ-সভাপতি জনাব মহিউদ্দিন আহমদ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং বেগম সাজেদা চৌধুরীর উপর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকার দায়িত্ব অর্পিত হলাে। বেগম সাজেদা চৌধুরী তখন হাসপাতালে অসুস্থ। তার মধ্যেও তাকে দায়িত্ব নিতে হল গঠনতন্ত্র মােতাবেক ও নেতৃবৃন্দের অনুরােধে। এবং সর্বোপরি দলের ধারাবাহিকতায় দল গঠনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে। 

 

২৪. কাজী জহিরুল কাইয়ুমের বাসায় প্রায় বৈঠক হতাে। আওয়ামী লীগ বৈঠকের জন্য জায়গা পাওয়াও ছিলাে দুষ্কর। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে না। জায়গা পাওয়া তাে দূরের কথা। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পেছনে ছায়ার মত গােয়েন্দা বাহিনীর লােক লেগে থাকতাে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির ২৬শে আগস্ট ৭৬ আনুষ্ঠানিক সভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারবর্গ ও চার নেতার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে সভার শুরু হয়। সভায় প্রথমেই সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীর প্রস্তাবে খন্দকার মােশতাক আহমদ, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন ও ওবায়দুর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। দলের একটি অংশ আইনগত প্রশ্ন তুলে বহিষ্কারাদেশ না দিয়ে প্রাথমিকভাবে ‘শােকজ’ করার দাবী জানান। কিন্তু তা নাকচ হয়ে যায়। 


২৫. পরবর্তী মিটিংগুলােয় ঠিক হয় পিপিআর-এর অধীনে দলের গঠনতন্ত্র ও ঘােষণাপত্র জমা দিয়ে দল গঠনের অনুমতি নিতে হবে। সিদ্ধান্ত হয় ৪ মূলনীতি অক্ষুন্ন থাকবে। মুখবন্ধে ‘বঙ্গবন্ধু’ কথাটি সন্নিবেশিত হবে।

২৬. ৯ই অক্টোবর ৭৬ সনে চার মূলনীতি বাঙালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র এই রাষ্ট্ৰীয় চার মূলনীতি যা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের দর্শন তার আলােকেই ঘােষণাপত্র এবং ঘােষণাপত্রের নিরিখে গঠন ঠিকঠাক করে জমা দেয়া হয়। ঘােষণা পত্রের মুখবন্ধে ‘বঙ্গবন্ধ’-এর নাম উল্লেখ করা হলাে। এরই মধ্যে সামরিক ফরমানে বলা হলাে কোন জীবিত বা মৃত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে দল গঠন করা যাবে না। (পরিশিষ্ট-৫)। 

২৭. কয়েক দিন পরেই আইন, বিচার ও সংসদ মন্ত্রণালয় হতে চিঠি এলাে “The very word ‘Banghbandhu’ should be omited.” ১৮ই অক্টোবর ৭৬ বেগম সাজেদা চৌধুরী এই পত্র হাতে পেলেন। আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এই ‘না-সূচক’ চিঠিতে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের দাখিলকৃত দলিলপত্রের বক্তব্য ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধির (১০)নং ধারার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। (পরিশিষ্ট-৪)। 

২৮. দলে সংকট সৃষ্টি হলাে। ইতমধ্যে প্রায় এক ডজন দল অনুমতি নিয়ে নিয়েছে। মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে দলের একাংশ বললেন, নামে কী আসে যায়। বঙ্গবন্ধু তাে আমাদের হৃদয়ে আছেন। মহিউদ্দিন-সাজেদা চৌধুরী গ্রুপ বললেনঃ বঙ্গবন্ধু ব্যতীত দলের অনুমতি নেয়ার প্রয়ােজন নেই। শুরু হলাে দ্বন্দ্ব। 

২৯. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষাবিদ আবুল ফজলকে জাতীয় অধ্যাপক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে শিক্ষা উপদেষ্টা হয়ে তিনি ক্ষমতায় বসেছেন। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীকে সচিবালয়ে ডেকে নিয়ে তিনি বললেনঃ বঙ্গবন্ধু, চার নীতি বাদ দিতে চাও না কেন? বাদ দিয়ে দলের অনুমতি নাও। সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরী স্পষ্টভাবে মুখের উপর বলে এলেন ঃ আমি বিশ্বাসঘাতক নই। আবুল ফজল বললেন ঃ ঐ জন্যই তাে জিয়া তােমাকে দেখতে পারে না। 

৩০।তারপরেও চাপ অব্যাহত থাকে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীকে বঙ্গভবনে ডেকে নিয়ে বললেনঃ তুমি আমার মেয়ের মত। আমি পরামর্শ দিচ্ছি। কেন মাত্র ৪টি অক্ষর ব-ঙ্গ-ব-ন্ধু নিয়ে জেদ ধরছে। নামটি বাদ দিয়ে অনুমতি নাও। সাজেদা চৌধুরী পার্টির পক্ষ হতে বললেনঃ ‘বঙ্গবন্ধু’ ঐ চারটি অক্ষরের মধ্যেই বাংলাদেশ নিহিত।১১  

৩১. মিজান চৌধুরীর বাসায় চক্রান্ত দানা বেঁধে উঠল। জোরেশােরে বলা হতে থাকলাে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি বাদ দিয়েই দলের অনুমতি নিতে হবে। মহিউদ্দিন আহমেদ ও সাজেদা চৌধুরী গ্রুপ বললেনঃ এটা হতে পারে না।

৩২। তখন মিটিং করার জায়গা ছিলােনা। ছিলােনা অফিস। খন্দকার হাবিবুর রহমান ৯১, নবাবপরের ৩ তলায় আওয়ামী লীগের অফিসের ব্যবস্থা করে দেন। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে ২৫শে অক্টোবর ৯১ নবাবপুরে পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসে প্রস্তুতি কমিটির সকল সদস্য, সাবেক আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, বা তাদের অবর্তমানে প্রতিনিধি (কেননা বহু জেলা নেতৃবৃন্দ কারাগারে ছিলেন) গণপরিষদ সদস্য, সাবেক সংসদ-সদস্যদের সমন্বয়ে বর্ধিত সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য অনুরােধ জানান। অন্যদিকে ২৭শে অক্টোবর মিজান চৌধুরী তার ৩২নং ধানমন্ডি রােডের ৬৬০ বি নম্বর বাসভবনে অনুরূপ সভা আহ্বান করেন। 

৩৩. এই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ২৫শে অক্টোবর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক জরুরী সভা ৯১ নবাবপুরে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জনাব মহিউদ্দিনের আহমদ-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সংগঠনের নীতি আদর্শ লক্ষ্য এবং বঙ্গবন্ধুর নাম সংযুক্তকরণের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এবং মুজিব সৈনিকদের চক্রান্ত রুখে দাঁড়ানাের আহ্বান জানান হয়। এই জরুরী সভার সিদ্ধান্ত মােতাবেক বেগম সাজেদা চৌধুরী একটি বিবৃতি প্রদান করেন— “গত ২৫ আগস্ট সাবেক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও কর্মীদের সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত হয় তার ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করার জন্য সাবেক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরীকে আহবায়ক করে একটি সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করে। কিছুদিন থেকে আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করে আসছি যে, এই প্রস্তুতি কমিটির দায়িত্বের পরিধির ব্যাপারে বেশ ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। বাস্তব অবস্থা হচ্ছে এই প্রস্তুতি কমিটির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। ইহা মূল কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির অধীনে একটি অস্থায়ী উপপরিষদ। কোন সাংগঠনিক সভা আহবান এবং তৎপরতা এই উপ-পরিষদের আওতায় বাইরে।”১৩ 

ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীর এই বিবৃতির পর অন্যান্য নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে বহু দেন দরবারের পর দু’টি সভাই বাতিল ঘােষিত হয়। ২৯শে অক্টোবর মিজানুর রহমান চৌধুরীর বাসভবনে এক বৈঠকে স্থির হয় যে, ৩১শে অক্টোবর সকাল ১০ ঘটিকায় মতিঝিলের হােটেল ইডেনে সাবেক আওয়ামী লীগের প্রাক্তন গণপরিষদ ও সংসদ সদস্য, সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হবে। কোন কারণে কর্মকর্তারা উপস্থিত হতে না পারলে সংগঠনের পরবর্তী কর্মকর্তারা যােগ দিতে পারবেন। মিজান চৌধুরীর বাসায় সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জনাব মহিউদ্দিন আহমদ-এর সভাপতিত্বে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।

ইতিমধ্যে পার্টির মধ্যে চক্রান্তের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মহিউদ্দিন আহমদ ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীকে আইন সংসদ বিষয়ক তদানীন্তন সচিব অবগত করান। তদানীন্তন আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ২৭শে অক্টোবর রাতের অন্ধকারে লুঙ্গি পরে তেজতুরী বাজারে এসে মহিউদ্দিন আহমদ ও বেগম সাজেদা চৌধুরীকে গােপনে সংবাদ দেন যে, মিজান চৌধুরী আওয়ামী লীগের দল গঠনে অনুমতি পাওয়ার জন্য গােপনে আর একটি দরখাস্ত জমা দিয়েছে। 

৩৪. জনাব মহিউদ্দিন আহমদ-বেগম সাজেদা চৌধুরী হতবাক হয়ে যান। চক্রান্ত কোন পর্যায়ে গেছে জানতে পেরে কৌশল গ্রহণ করেন এবং ২৯ তারিখে মিজান চৌধুরীর বাসায় গিয়ে মিটিং করেন এবং ৩১ তারিখে আহুত সম্মেলন সাফল্যমন্ডিত করার ক্ষেত্র প্রশস্ত করেন। মহিউদ্দিন-সাজেদা চৌধুরী গ্রুপের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলাে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে দলীয় নেতা-কর্মীরা সমস্ত চক্রান্ত ভেঙ্গে ফেলতে পারবে। 

৩৫. ৩১শে অক্টোবর ‘৭৬। ঐতিহাসিক হােটেল ইডেন। হােটেলের মালিক দারােগা চাচা। একটি পয়সা নেননি। সম্মেলনের জায়গা দিয়েছিলেন। প্যান্ডেল করতে হবে। টাকা নেই। হাজী চাঁদ মিয়া সাধারণ সম্পাদিকাকে বললেন, “আমি আছি, আপনে আগাই যান।”- সে সময় এই ‘ছােট কথাটুকুর কি যে মূল্য ছিল’ আজকের পরিবেশে তা উপলব্ধি করা যাবে না! 

প্যান্ডেল হল। মঞ্চ হল। মঞ্চে একটি শূন্য চেয়ার। যে চেয়ারে বঙ্গবন্ধু ৭৩ সনে বসেছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিরূপে হাজী চাঁদ মিয়া সে চেয়ারটি রেখেছিলেন সযত্নে। সেই চেয়ার। সেই চেয়ারের দু’পাশে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা। আর চেয়ারে স্থাপিত হলাে শিল্পী শাহাবুদ্দিনের আঁকা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিষন্ন অথচ দূত্যিময় এক ছবি। এসব দেখে মিজান গং বললেনঃ এখানে ছবি কেন? -আমাদের মারতে চাও নাকি।১৪ 

৩৬। সম্মেলন শুরু হলাে। রাস্তায় বিডিআর। পুলিশ। সাদা পােষাকে লােক এসে ইডেন হােটেলের মালিক চাচার নিকট জানতে চায়-হােটেল ভাড়া নেয়া হয়েছে কিনা। এসব আঁচ করতে পেরে দারােগা চাচা পূর্বেই সাদা কাগজে রেভিনিউ স্টাম্পের উপর সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীর স্বাক্ষর করে নিয়েছিলেন। সাধারণ সম্পাদিকার রিপাের্ট নিয়ে কথা উঠলাে। কথা হয়েছিলাে ঐ রিপাের্ট অধ্যাপক ইউসুফ আলী দেখে দেবেন। রাতে মহসীন আলীর স্ত্রী এলেন। বললেন, রিপাের্ট নিয়ে চলুন আমার বাড়িতে। অধ্যাপক ইউসুফ আলী ও অন্যান্যরা ওখানে আছেন। সাধারণ সম্পাদিকা বললেন ঃ চলুন ভারপ্রাপ্ত সভাপতির ওখানে। ওনারা গেলেন। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জনাব মহিউদ্দিন অসুস্থ ছিলেন। বললেন ঃ রিপাের্ট আমি দেখেছি। আর কাউকে দেখানাের প্রয়ােজন নেই। রিপাের্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকান্ডের নিন্দা ছিলাে।  

৩৭। ৩১শে অক্টোবর হােটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মহিউদ্দিন আহমদ। সভায় রাজনৈতিক দল বিধির শর্ত মােতাবেক দলের ঘােষণাপত্র সংশােধন করে পুনরায় তা দাখিল করার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সভায় শুরুতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারবর্গ ও চার নেতার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। জনাব মহিউদ্দিন আহমদ ভাষণ দেন। এরপর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরী গত ২৫শে আগস্ট অনুষ্ঠিত বর্ধিত সভা থেকে শুরু করে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ের বিভিন্ন কার্যকলাপ ঘটনাবলীর রিপাের্ট পেশ করেন। প্রায় ৮০% সংসদ সদস্য, জেলা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত হন। বাইরে হাজার হাজার কর্মীকে অধীর আগ্রহে সিদ্ধান্ত জানার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। সভায় মিজান চৌধুরী, জহিরুল কাইয়ুম, মােমিন তালুকদার, মালেক উকিল, মােল্লা জালাল, সালাউদ্দিন ইউসুফ প্রমুখ বক্তৃতা করেন। ১৬ 

৩৮. ২রা নভেম্বর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা এক বিবৃতিতে বললেন, ঘােষণাপত্রের প্রস্তাবনা থেকে শুধুমাত্র ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দ বাদ দিয়ে সংশােধিত আকারে পেশ করার যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা ঠিক নয়। সাজেদা চৌধুরী বলেন, ঘােষণাপত্রের পুরাে প্রস্তাবনাই বাদ দেয়া হয়েছে। কেননা বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে দলীয় অনুমতি নেয়া সম্ভব নয়, বিধায় আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ স্বরূপ মুখবন্ধ ‘ব্ল্যাংক’ রেখে ঘােষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র জমা দিয়েছে। 

৩৯. ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করার অনুমতি লাভ করে। ৯১ নবাবপুরে বঙ্গবন্ধুর ছবি উঠানাে হলাে। আওয়ামী লীগের সাইনবাের্ড টানানাে হলাে। জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলিত হয়। সমগ্র নবাবপুর রােড স্তব্ধ। শােকাহত। নেতারা গেলেন না। কর্মীরা এলেন। এলেন মােল্লা জালাল ও ফনী মজুমদার। সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ, মীরপুর বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিসৌধ এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়। ৯১ নবাবপুরে মিলাদের আয়ােজন করা হয়েছে। বিপুল সংখ্যক আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী এ সকল অনুষ্ঠানে যােগ দেয়। 

৪০. ৪ ঠা নভেম্বর অনুমােদন লাভের পূর্বে মিজান চৌধুরী বললেন, যুবলীগ সংগঠনের দরকার নেই। দাখিলকৃত গঠণতন্ত্রে ছিল না। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদিকা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে নতুন করে লিখে দিয়ে এলেন “আওয়ামী লীগের একটি যুব সংগঠন থাকিবে তাহা আওয়ামী যুবলীগ নামে পরিচিত হইবে।” আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন জেলা শহরের ঘরােয়া পরিবেশে কর্মী সম্মেলনের কর্মসূচী দিলেন। ২১শে নভেম্বর প্রথম সভা হলাে ময়মনসিংহে। মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর ছবি টানানাে হলাে। কর্মীসভা জনসভায় পরিণত হলাে। ২৫শে নভেম্বর টাঙ্গাইলে কর্মীসভার পূর্বে মিছিল সহকারে কর্মীসভার স্থানে গেলেন-মালেক উকিল, আব্দুল মান্নান, সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরী, শামসুর রহমান খান শাহজাহান, ফারুক প্রমুখ। তারা বক্তৃতা করেন। ২১শে নভেম্বর তারিখে ১৯৭৭ সনে ফেব্রুয়ারীতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন বন্ধ করা হলাে। ২৯শে নভেম্বর সাধারণ সম্পাদিকাকে গ্রেফতার করা হলাে। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আত্মগােপন করলেন। মালেক উকিল গ্রেফতার হন। গ্রেফতার হন আবদুল মমিন তালুকদার, সালাহউদ্দিন ইউসুফ প্রমুখ। ষড়যন্ত্র শুরু হলাে। শুরু হলাে ব্যাপক ধরপাকড়। কেবল মিজানুর রহমান চৌধুরী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, মােল্লা জালাল এদের গ্রেফতার করা হলাে না। 

৪২। আওয়ামী লীগ বিভক্ত করার চক্রান্ত দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হলাে। মিজান চৌধুরী মােস্লা জালাল প্রমুখ বিভিন্ন জেলায় কর্মী সমাবেশে যেতে লাগলেন। কর্মীরা প্রশ্ন করতে লাগলাে অন্য নেতারা জেলে, আপনারা বাইরে কিভাবে? কর্মীদের প্রতিরােধের মুখে ষড়যন্ত্র বেশী দূর এগুতে পারেনি। জহুরুল কাইয়ুম, ময়েজ উদ্দিন, কামরুজ্জামান, লুৎফর রহমান, ফজলুল হক বিএসসি, ফজলুল করীম, মফিজুল ইসলাম খান কামাল প্রমুখ উদ্যোগ নিয়ে বেগম জোহরা তাজুদ্দিনকে পার্টির আহবায়ক করা হয়। চক্রান্ত করা হয় সেখানেও। ‘নেপথ্য নায়ক’ বলে পার্টি কর্মীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়। আহবায়ক কমিটি তারপরেও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে। ১৯৭৮ সনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বে এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। আবদুল মালেক উকিল সভাপতি ও আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর পরও চক্রান্ত চলতে থাকে। সে চক্রান্ত পরবর্তী অধ্যায়ে আলােচিত হয়েছে।

একটি নামে এত ভয় 

৪৩. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ইতিহাসের পাতা হতে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেবার চক্রান্ত, জারী হলাে সামরিক ফরমান। বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে রাজনৈতিক দলবিধি জারীর প্রাক্বালে বৈঠক করেন। বৈঠকে জিয়াউর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তিনি আওয়ামীলীগের নেতাদের সঙ্গে আলােচনা কালে বলেন, আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমি তাে আওয়ামীলীগেরই। আপনারা কাজ চালিয়ে যান। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হলাে এইযে, গঠনতন্ত্র ও মেনিফেস্টো জমা দেবার কিছুদিনের মধ্যে এক সামরিক ফরমান জারী করা হয়। সামরিক ফরমানে ঘােষণা দেওয়া হয় যে, “জীবিত বা মৃত কোন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে কোন পারসােনালিটি ‘কাল্ট’ প্রচার ও প্রকাশ করা যাবে না।” পিপিআর-এ প্রথমে এ শর্ত ছিলােনা। 

৪৫. বলাবাহুল্য আওয়ামীলীগের গঠনতন্ত্র ও দলিলাদিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম উল্লেখিত ছিলাে। জিয়ার সামরিক সরকার সামরিক ফরমান জারী করে নাম-এর উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে। এই মর্মে আওয়ামীলীগের দলিলাদি সরকারী তরফ হতে ফেরত পাঠানাে হয়। কার্যনির্বাহী কমিটিতে ‘বঙ্গবন্ধু’ নাম থাকা না থাকার উপর আলােচনা হয়। আলােচনায় গঠনতন্ত্রে ও ঘােষণাপত্রে নাম রাখা না রাখা নিয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। বিতর্কে যে সব নেতৃবৃন্দ ‘বঙ্গবন্ধু’র নাম রাখার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন তাদের কিছুদিনের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়। এ সম্পর্কে প্রামাণ্য দলিল বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর লিখিত একটি পুস্তক। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এ-চক্রান্ত সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায়।১৭ 

ক্ষমতায় টিকে থাকা ও ব্যক্তি উচ্চাভিলাস চরিতার্য করার নিমিত্তে জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সনের প্রথমার্ধেই ৬২,০০০ (বাষট্টি) হাজার রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের কারাগারে আটক রাখে, যার মধ্যে অধিকাংশই ছিলাে আওয়ামীলীগ যুবলীগ ছাত্রলীগ শ্রমিক লীগের নেতা ও কর্মীবৃন্দ।১৮ 

৪৬. জিয়াউর রহমান আওয়ামীলীগে যােগদানের এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের নিকট ইচ্ছা প্রকাশ করেন।১৯ যা ছিলাে সম্পূর্ণ প্রতারণাপূর্ণ এবং ক্ষমতা সংহত করার জন্য সময় ক্ষেপনের কৌশল।

Reference: জেনারেল জিয়ার রাজত্ব – অধ্যাপক আবু সাঈদ

Reference list:

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!