বঙ্গবন্ধুকে সমাধিস্থ করার প্রশ্নে মোশতাকের জবাব কী?
দিনের প্রথম দিকে আমি খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সমাধিস্থ করার ব্যাপারে তার মত জানতে চেয়েছিলাম। তাকে জিজ্ঞেস করার কারণ ছিলো সমাধির স্থান জানার জন্য। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম বঙ্গবন্ধুর কবর কি নতুন পার্লামেন্ট বিল্ডিং এর প্রাঙ্গণে হবে নাকি পুরাতন হাই কোর্ট সংলগ্ন এলাকায় হবে (যেখানে জাতীয় চার নেতার সমাধি)। খন্দকার মোশতাককে যখন আমি এই প্রশ্ন করেছিলাম তখন এয়ার চীফ এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকারও ছিলো। আমাকে অবাক করে দিয়ে খন্দকার মোশতাক রেগে উঠল এবং বলল, “প্রতিদিন কত লোকই তো মরে, সেসবের দেখভাল কি আমি করব? তাকে ঢাকা বাদে সেখানে খুশি সেখানে কবর দাও।”
খন্দকার মোশতাকের এই মন্তব্যে আমি কী প্রতিক্রিয়া দেখাব বুঝতে পারছিলাম না। আমি একদম বধির হয়ে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু যে সে কোন ব্যক্তি নন যে তাঁকে যেকোন স্থানে কবর দেয়া হবে। এসবের বাইরেও তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট এবং রাষ্ট্রপ্রধান। রাষ্ট্রপ্রধানকে সমাধি দেবার সময় অনেক নিয়ম কানুন মানতে হয়। যেভাবেই তার মৃত্যু হোক না কেন সঠিক নিয়ম মেনেই আমাদের উচিৎ তাঁকে সমাধিস্থ করা এবং প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ পালন করা। প্রেসিডেন্টের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের অন্যতম হচ্ছে গান ক্যারিয়েজে করে তার কফিন বহন করে নিয়ে আসা এবং গার্ড অব অনার দেয়া, ইত্যাদি। খন্দকার মোশতাক এসব তাঁর (বঙ্গবন্ধু) জন্য করতে চাচ্ছিলনা। সে চাচ্ছিল যেন ঢাকা বাদে যে কোন জায়গায় কবর দেয়া হয়। খন্দকার মোশতাকের এই আচরণ দেখে আমি এয়ার চীফ এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকারের দিকে তাকালাম। সে সামান্য একটু হা সূচক মাথা নাড়ল – যার অর্থ আমাদের জিনিসটা দেখতে হবে। আজকের দিন পর্যন্ত আমি নিজেকে অভিশাপ দেই এটা ভেবে যে কেন আমি খন্দকার মোশতাকের কাছে সমাধিস্থ করার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম?
আমরা কী করতে পারতাম? খন্দকার মোশতাক চাচ্ছিলনা যে প্রেসিডেন্টকে ঢাকায় সমাধিস্থ করা হোক। আর আমরাও জাতির পিতাকে যেখানে খুশি সমাধিস্থ করতে পারিনা। তাই সিদ্ধান্ত হল বঙ্গবন্ধুকে টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর নিজ গ্রামে তাঁর পিতার কবরের পাশে সমাধিস্থ করা হবে। খন্দকার মোশতাক যে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার বাইরে কবর দিতে বলবে সেটা আমার ধারণারও বাইরে ছিলো। বঙ্গবন্ধুর সাথে তার (মোশতাকের) মতের অমিল থাকতেই পারে, কিন্তু তিনি (বঙ্গবন্ধু) মারা যাবার পরে লাশের সাথে নিশ্চই নয়। যদি এরকম সামান্যতম চিন্তাও আমার মাথায় আসতো আমি মোটেও তাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতাম না। সমস্যাটা তখনই হল যখন আমি খন্দকার মোশতাকের কাছে সমাধির ব্যাপারে সুনির্দিস্ট নির্দেশনা চাইলাম। কতোটা বিদ্বেষপূর্ণ মানুষ ছিলো সে!
দেশের জন্য বঙ্গবন্ধু তার সমস্ত কিছু বিলিয়ে দিয়েছেন। তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের চুড়া এই ঢাকায় হলেও আমরা এতোটাই অকৃতজ্ঞ যে তাঁকে রাজধানীতে শেষ বিশ্রামটুকু নিতে একটু জায়গা দিতে পারলাম না। খন্দকার মোশতাকের জন্য এটা করা গেলনা। খন্দকার মোশতাক কতোটা নির্দয় ও হৃদয়হীন ছিলো! রাজনীতি কতোটা আশ্চর্যের, কতোটা নিষ্ঠুর এবং কতোটা অমানবিক। বঙ্গবন্ধুর জন্য আমার খারাপ লাগে যে খন্দকার মোশতাকের মত কপটকে তিনি চিনতে পারেননি এবং তাকে (মোশতাক) তাঁর ঘনিস্ট বন্ধু মনে করতেন। কিছুক্ষণের ভেতর এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দকার একটি হেলিকপ্টার যোগাড় করলেন এবং আর্মি থেকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ একটি কন্টিনজেন্ট প্রস্তুত করে প্রেসিডেন্টের লাশের সাথে টুঙ্গিপাড়ায় কবর দিতে পাঠানো হল। সেখানে বঙ্গবন্ধুর পিতার কবরের পাশে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। আমাকে বলা হয়েছিলো যে কবর দেবার পূর্বে সব ধরণের ধর্মীয় আচার পালন করা হয়েছিলো। বাকিদের ব্যাপারে জেনেছি, তাদের সবাইকে বনানী গোরস্থানে কবর দেয়া হয়েছে।
প্রেসিডেন্টকে সমাহিত করার কথা আলোচনা করতে যেয়ে আমার বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুতফর রহমানের মৃত্যুর সময়কার কথা মনে পড়ছে। শেখ লুতফর রহমান বার্ধ্যক্যজনিত কারণে ১৬ মার্চ ‘৭৫ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন। প্রেসিডেন্টের সাথে তাঁর পিতার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিস্ট ছিলো। পিতার মৃত্যু তাঁর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিলো। তিনি অনেক মর্মাহত ছিলেন। পিতার শেষকৃত্য সম্পন্নের জন্য তিনি স্টিমারে গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। এসময় তাকে বিদায় দিতে পাগলা স্টিমার ঘাটে তাঁর কেবিনেটের সহকর্মীরা, গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ এবং আমরা তিন বাহিনীর প্রধানরা উপস্থিত ছিলাম। অত্যন্ত এই বিষণ্ণ এই মুহুর্তে সবাই চুপচাপ ছিলো। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে খন্দকার মোশতাকের আহাজারি ছিল সবচেয়ে জোরালো। তীব্র বেদনায় সে (মোশতাক) নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলোনা এবং এতো জোরে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলো যে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু, অর্থাৎ যার পিতা মারা গেছে, তিনিও বিব্রত বোধ করলেন। মনে হল তাঁর চেয়ে খন্দকার মোশতাক বেশী ভেঙ্গে পড়েছেন।
ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়া অনেক দূরের পথ। সেসময় টুঙ্গিপাড়ার সাথে সড়ক যোগাযোগ ছিলোনা বললেই চলে। একমাত্র নদীপথই ছিলো ভরসা। মার্চ মাসে নদী স্রোতস্বিনী হয়ে ওঠে। ফলে জলপথে টুঙ্গিপাড়া যাওয়াটা কিছুটা সহজ হয়। এই সময় বঙ্গবন্ধু স্টিমারে ঢাকায় থাকা তাঁর পুরো পরিবার এবং কিছু ঘনিস্ট বন্ধুদের নিয়ে রওনা করলেন। খন্দকার মোশতাক তাদের একজন যে সেদিন গিয়েছিলো।
টুঙ্গিপাড়া যশোর মিলিটারি গ্যারিসনের নিয়ন্ত্রণে। আমি যশোর গ্যারিসন কমান্ডার কর্নেল (পরবর্তীতে লে জেনারেল) মীর শওকত আলীকে জানালাম প্রেসিডেন্টের দলের সবাইকে যেন টুঙ্গিপাড়ায় পর্যাপ্ত সহায়তা দেয়া হয়। পরের দিন হেলিকপ্টারে আমরা তিন বাহিনীর লোকেরাও জানাজা আদায় করার জন্য টুঙ্গিপাড়া পৌছালাম। টুঙ্গিপাড়াতেও খন্দকার মোশতাকের আহাজারি ছিলো সবার চেয়ে বেশী। সেই খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে সন্মানজনকভাবে সমাহিত করতে চাচ্ছেনা। কত বড় ভণ্ড সে! এটা দেখে কষ্ট লাগলো যে এমন নীতিহীন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর ঘনিস্ট সহচর।
Translated by – সংগ্রামের নোটবুক
Reference: 15th August A National Tragedy Major Gen K M Safiullah BU PSC