You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.08.15 | মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে কারা কেন কিভাবে এসেছিলো? - সংগ্রামের নোটবুক

মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে কারা কেন কিভাবে এসেছিলো?

বঙ্গভবনের হল রুমে খন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানের আগে ভারপ্রাপ্ত MS (P) লে কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) আমিন আহমেদ চৌধুরী আমাকে বললেন যে, জেনারেল ওসমানী আমার সাথে কথা বলতে চায়। আমি ফোন ধরার সাথে সাথে জেনারেল ওসমানী আমাকে অভিনন্দন জ্ঞ্যাপন করলেন। তিনি আমার কাজে সন্তুষ্টিজ্ঞ্যাপন করলেন এবং সাহস হারাতে নিষেধ করলেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারায় তিনি আমাকে প্রশংসা করলেন। আমি তার প্রশংসায় বিব্রতবোধ করলাম। কারণ সেই পরিস্থিতিতে আমি কারো প্রশংসা আশা করিনি, অন্ততপক্ষে জেনারেল ওসমানীর থেকে। যখন তিনি আমাকে এত প্রশংসা করছিলেন, আমি ভাবলাম তিনি হয়ত উপহাস করছেন। তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম, স্যার, আমি কি এই প্রশংসার যোগ্য?” তিনি বললেন, “ওল্ড বয়, তুমি কি জানোনা তুমি দেশকে কী ভয়ানক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছ।” আমি জেনারেল ওসমানীর রহস্যময় মন্তব্য বুঝতে পারলাম না, তবে আমি চুপ থাকলাম।

আমি এখনো পর্যন্ত জানিনা যে সেদিন জেনারেল ওসমানী কেন সমাদর করলেন অথবা তিনি অন্য কিছু বুঝিয়েছিলেন কিনা। আমি এও জানতাম যে, বঙ্গবন্ধুর সাথে তার অনেক বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও তাঁকে (বঙ্গবন্ধুকে) তিনি অনেক শ্রদ্ধা করতেন। তিনি বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু করেছেন কিনা বা কোন অসন্মান দেখিয়েছেন কিনা আমি নিশ্চিত নই। তার (ওসমানীর) এই প্রশংসা যে আসল নয় সেটি যদি আমি বলি, তাহলে হয়ত অন্যায় করা হবে।  তাই ভালোটা ধরে নিলে বলাই যায় যে তিনি যা বলেছেন সেটাই বুঝিয়েছেন। সেই খারাপ সময়ে একজন সিনিয়র হিসেবে জেনারেল ওসমানী কর্তৃক আমাকে আশ্বস্ত করাটা হয়ত আমাকে উৎসাহিত করেছে। সৈন্যদের মধ্যে রক্তারক্তি ঘটানোর মত সম্ভবনাগুলো প্রতিহত করতে পেরেছি বলে তিনি হয়ত আমাকে অভিনন্দিত করেছেন। পরিস্থিতি যে উচ্চতায় গিয়েছিলো তাতে গৃহযুদ্ধ বাধার সমূহ সম্ভবনা ছিলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পরেই এত দ্রুত (২৪ আগস্ট ‘৭৫) তিনি খন্দকার মোশতাকের ডিফেন্স এডভাইজার হিসেবে যোগ দেয়ায় আমি বিরক্ত হয়েছি। তিনি কেন এত দ্রুত খন্দকার মোশতাকের সাথে যোগ দিলেন? এখানে তাঁর বাধ্যবাধকতা কী ছিলো?

সুপ্রিম কোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবি মাহমুদ হোসেইন বঙ্গভবনে খন্দকার মোশতাককে শপথবাক্য পাঠ করান। সেসময় প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম দেশের বাইরে ছিলেন। খন্দকার মোশতাক যখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিচ্ছিলেন তখন তার প্রতিনিধি মেজর রশিদ, মেজর ডালিম, মেজর ফারুক, মেজর শাহরিয়ার এবং তাদের কোম্পানি বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের বিভিন্ন মন্ত্রীদের নিয়ে আসলো। বিকেলে কেবিনেটের শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল।

খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট হিসেবে অফিসে বসেই দুটো গুরুত্বপুর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রথম, প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি হিসেবে মাহবুবউল আলম চাষীকে নিয়োগ দিলেন। এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে, রেড ক্রসের (নতুন রেড ক্রিসেন্ট) চেয়ারম্যান জনাব গাজি গোলাম মোস্তফাকে বরখাস্ত করলেন। একই দিনে গাজি গোলাম মোস্তফার স্থলে জাস্টিস এবি সিদ্দিকিকে রেড ক্রসের চীফ হিসেবে নিয়োগ দিলেন। প্রথম দিনেই খন্দকার মোশতাক জনাব মাহবুব উল আলম চাষীকে প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেয়ায় এটা প্রমাণিত হল যে সেও (মাহবুব উল আলম চাষী) জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুরের মত বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত। জনাব মাহবুব উল আলম চাষী এর সাথে গভীরভাবে জড়িত। তবে তার (খন্দকার মোশতাকের) দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ গাজি গোলাম মোস্তফাকে রেড ক্রসের চেয়ারম্যানশিপ থেকে সরানোর সিদ্ধান্তটা সঠিক হয়েছে।

জেনারেল ওসমানীর সাথে টেলিফোন আলাপ সেরে যখন আমি হল রুমে গেলাম তখন দেখলাম সেখানে কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) এম এ মঞ্জুরও উপস্থিত। সেদিন তাকে বঙ্গভবনে দেখে আমি অবাক হলাম। সে দিল্লী মিশনে আমাদের মিলিটারি এডভাইজার ছিলো। সেদিন আমি তাকে ঢাকায় আশা করিনি। জিজ্ঞেস করায় সে জানালো সে কিছুক্ষণ আগে ঢাকা এসেছে। আমি যখন আরও জিজ্ঞেস করলাম যে কে তাকে আসতে বলেছে এবং কিভাবে এসেছে, তখন সে জবাব দিল সংবাদ শুনে যে সড়কপথে এসেছে। আমি জানিনা এত স্বল্প সময়ে দিল্লি থেকে ঢাকা পৌঁছানো কারো পক্ষে সম্ভব কিনা। কারণ ইতোমধ্যে ঢাকার অভ্যন্তরীণ সকল ট্র্যাফিকও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে কেন তাকে আসতে হল? যে কি জানতো ঢাকায় কী হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে? এত তাড়াতাড়ি সে কীভাবে আসলো?

কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) মঞ্জুরকে “অপারেশন সিলভার লাইনিং” চলাকালীন সময় যশোর গ্যারিসন থেকে বদলি করার প্রয়োজন হয়েছিলো। তাকে কিছুদিন নজরের বাইরে রাখার চেষ্টা করতে হয়েছিল। তাই তাকে নয়াদিল্লীর মিশনে মিলিটারি এডভাইজার হিসেবে পাঠানো হয়। কিন্তু সে এটাকে অপমান হিসেবে দেখে। এই পোস্টিং এর জন্য সে আমাকে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কখনোই ক্ষমা করেনি। তাই সেদিন বঙ্গভবনে কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) মঞ্জুরের উপস্থিতি কোন রুটিন বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে সে কি নিজ থেকেই সেখানে এসেছে? যদি তাই হয় তাহলে কেন? আর যদি তা না হয় তাহলে কে তাকে আসতে বলেছে?

কর্নেল মঞ্জুরের সাথে কথা শেষ করার পর মেজর ফারুক আমার কাছে আসলো এবং জানালো যে ভারতীয় সৈন্য সীমান্তে জড়ো হচ্ছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম এটা সে কিভাবে জানতে পেরেছে? সে বলল তার সংবাদসূত্র অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। এই অবস্থায় মেজর ফারুকের উদ্বেগের সাথে আমার জেনারেল জিয়ার মন্তব্যের কথা মনে পড়ল। সকালে জেনারেল জিয়া একই রকম উদ্বেগ জানিয়েছে। সকালে যখন আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে ৪৬ ব্রিগেড এরিয়ায় গিয়ে কর্নেল শাফায়াৎকে দেয়া আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলেছিলাম তখন কেন জেনারেল জিয়া ব্রিগেডিয়ার খালেদকে সেখানে পাঠাতে বাধা দিচ্ছিল? এমন তো নয় যে ব্রিগেডিয়ার খালেদ আমার নির্দেশনা বাস্তবায়নে অযোগ্য। তাহলে কেন সে (জেনারেল জিয়া) উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল? এই ঘটনায় কি তার (জেনারেল জিয়া) কোন হাত আছে? ঘটনার শুরু থেকেই কেন জেনারেল জিয়া ব্রিগেডিয়ার খালেদকে দিয়ে “Ops Order” প্রস্তুত করতে বলছে? এমন কি হতে পারে যে জেনারেল জিয়া চাচ্ছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদকে অফিসে ব্যস্ত রাখতে, যাতে করে সে (জিয়া) কী করে বেড়াচ্ছে সে ব্যাপারে কোন ক্লু ব্রিগেডিয়ার খালেদ না পায়?

আমি যখন অন্যান্য কমান্ডারদের নির্দেশনা দিচ্ছিলাম তখন জেনারেল জিয়া আমার পাশে বসা ছিলো। সে অবশ্যই সেসময় ভাবছিলো যদি আমি এই গ্রুপটাকে বাইরের ফর্মেশন দিয়ে প্রতিহত করতে যাই, সেটা কিভাবে থামানো যায়। তাই তথাকথিত ভারতীয় সৈন্যদের বিষয়টা তার কল্পনাপ্রসূত এবং সেই অবস্থায় অনেকটা বিশ্বাসযোগ্যও বটে। তাই সে চেষ্টা করছিলো একটা গল্প ফাঁদতে যাতে করে আমার মনোযোগ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড থেকে অন্যদিকে অর্থাৎ ইন্ডিয়ান অফেন্সিভের দিকে ধাবিত হয়। তাই যখন আমি কনফারেন্সে উপস্থিত হলাম, তখন আমার চারপাশে এসব ষড়যন্ত্র চলছিলো।

যাই হোক, মেজর ফারুক যখন আমাকে ভারতীয় সৈন্যদের সীমান্তে জড়ো হওয়া নিয়ে বলছিলো, তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে সে আমার দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে চেষ্টা করছে। সকালে জেনারেল জিয়া একই রকম উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলো। তবুও মেজর ফারুক তার সোর্স এবং উদ্বেগ সম্পর্কে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। আমি তাকে বললাম খবরটা CGS কে দিতে যাতে সে “Ops Order” এর প্রস্তুতি নিতে পারে। এরপর আমি কনফারেন্সের জন্য প্রেসিডেন্ট অফিসে প্রবেশ করলাম। ঢুকেই দেখলাম খন্দকার মোশতাক আর কর্নেল মঞ্জুর গভীর শলাপরামর্শ করছে। আমার আর সন্দেহ রইল না যে কার সাথে কর্নেল মঞ্জুর যোগাযোগ রেখেছে। আমি তার চীফ ছিলাম। যদি তার কিছু বলার থাকে তাহলে সেটা সবার আগে আমাকে বলার কথা। তাছাড়া, খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট হয়েছেন কয়েক ঘণ্টা মাত্র। আগে থেকে কোন উদ্দেশ্য না থাকলে এত স্বপ সময়ে যোগাযোগ করবার কোন কারণই নেই।

খন্দকার মোশতাক ও কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) মঞ্জুরের গভীর আলোচনায় মগ্ন থাকতে দেখে আমার হঠাৎ পুরনো দিনের কিছু দৃশ্য মনে পরে গেল। কর্নেল মঞ্জুর আগে থেকে না জেনে থাকলে এত দ্রুত ঢাকা আসতে পারার কথা নয়। সকাল থেকে জেনারেল জিয়াও আমার সাথে একটু বেশী সৌজন্যতা দেখাচ্ছে। সকালে যখন আমি তাকে (জেনারেল জিয়া) ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে আমার বাসায় আসতে বলেছিলাম তখন দুজনেই ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে এসে পৌঁছেছিলো। জেনারেল জিয়া ইউনিফর্ম পরে এসেছিল, শেভ করা ছিলো এবং তার অফিসিয়াল গাড়িতে ড্রাইভার তাকে নিয়ে এসেছিলো। অন্যদিকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ এসেছিলো পায়জামা পরা অবস্থায়, শেভ করা ছিলো না এবং নিজেই নিজের গাড়ি চালিয়ে এসেছিলো। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, একই সময়ের মধ্যে জেনারেল জিয়া এসব সেরে আসতে পারলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ কেন পারল না? এত স্বল্প সময়ের মধ্যে সে (জিয়া) কিভাবে নিজের গাড়ি ডাকা, ওয়াস নেয়া, শেভ করা, এবং ইউনিফর্ম পরে আসলো যদি না আগে থেকেই সে প্রস্তুত থাকে ও তার জন্য গাড়ি ডেকে আনা থাকে? যদি তাই হয়, তাহলে এত সকালে সে কেন রেডি হচ্ছিলো? সে কি কারো কলের জন্য অপেক্ষা করছিলো? যদি তাই হয়, তবে কার ফোনের জন্য সে অপেক্ষা করছিলো?

বঙ্গবন্ধু আমাকে আদেশ করেছিলেন যশোর গ্যারিসন থেকে কর্নেল মঞ্জুরকে সরাতে। কর্নেল মঞ্জুর নিজেও এটা জানতেন। জেনারেল জিয়া আমাকে সরানোর জন্য এবং তাকে চীফ বানানোর জন্য বঙ্গবন্ধুকে জ্বালাতন করছিল। কিন্তু তার বদলে প্রেসিডেন্ট তাকে বলেছিল পদত্যাগ করতে। কাজেই জেনারেল জিয়া ও কর্নেল মঞ্জুরের বঙ্গবন্ধুর প্রতি কোন ভালোবাসা ছিলোনা। তাদের দুজনই ছিলো উচ্চাভিলাষী। তাই তাদের দুজনের লক্ষ্য একই ছিলো। এবং এর ফলেই তারা হাত মেলায়। তাদের কাছে প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু কোন উদ্বেগের বিষয় নয়। বস্তুত, তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) মৃত্যু তাদের পথের কাঁটা সরিয়ে দিয়েছে।

Translated by – সংগ্রামের নোটবুক
Reference: 15th August A National Tragedy Major Gen K M Safiullah BU PSC