১৫ আগস্ট রেডিও স্টেশনে কী হচ্ছিলো?
যখন মেজর রশিদ ও মেজর হাফিজ আমাকে রেডিও স্টেশনে যেতে অনুরোধ করছিলেন তখন আমি বললাম যে কোন সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমাকে অফিসে গিয়ে আমার অন্যান্য চীফদের সাথে আলোচনা করতে হবে। সম্ভবত তারা এই কথাটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলো। এবং তাই দ্রুত তারা আমাকে অন্যান্য চীফদের শরণাপন্ন করল। কথা বলার সময় তারা আমাকে বলল দ্রুত তারা ৪৬ ব্রিগেড এলাকায় এসে আমার সাথে দেখা করবে – এবং সেটা তারা দ্রুতই করেছিলো।
যখন আমি অন্যান্য চীফদের আসার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখন মনে মনে ভাবছিলাম কোন পথে একশন নেবো। ততোক্ষণে প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছেন। এই অবস্থা সামলাতে ঢাকায় আমার কাছে কোন ট্রুপ্স নেই। যদি কোনোভাবে ঢাকার বাইরে যেতে পারতাম, যেমন কাছাকাছি ধরলে কুমিল্লা, তাহলেও হয়ত কিছু ব্যবস্থা নিতে পারতাম। সেই সম্ভবনাও নেই যেহেতু মেজর ডালিম ও তার বাহিনী আমি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বা বাইরে যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই পেছনে পেছনে আসছে। এটা কারো কাছে অজানা নয় যে মেজর ডালিমও একজন বিদ্রোহী অফিসার। সামরিক অভ্যুত্থানে সরাসরি অংশ নেবার পাশাপাশি সে আমাকে টানা নজরে রাখছে এবং ৪৬ ব্রিগেড ও হেডকোয়ার্টার এলাকায় মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিদ্রোহী সেনারা ততোক্ষণে খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছে। সকাল থেকে জেনারেল জিয়া আমার প্রতি খুব সন্মান দেখাচ্ছে। এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ আমার থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখছে। সৃষ্টিকর্তাই জানেন তাদের মনে কী ছিলো। যেকোন কারণেই হোক, ব্রিগেডিয়ার খালেদ ছাড়া কাউকে আমার বিশ্বাস হচ্ছিলোনা। সেসময় আমার মনে হচ্ছিলো আমি একজন একা মানুষ। এক, যাই আসুক, টিকে থাকতে হবে অথবা ধ্বংস হয়ে যেতে হবে। যুদ্ধ করতে হবে যত কম সংখ্যক সৈন্য নিয়েই হোক না কেন। দুই, পরিস্থিতি যা আছে তা মেনে নিতে হবে। আমি এই দুইটি পথের কোন পথ বেছে নেব সেটা ভাবছিলাম। এবং সেগুলোর ভালো-মন্দ চিন্তা করছিলাম। প্রথম পথের ক্ষেত্রে, আমার যে সৈন্য দরকার ঢাকায় তা নেই। কারণ হচ্ছে বিদ্রোহীরা (আর্মার্ড ও আর্টিলারি) অসমর্থিত সৈন্যদের কৌশলে সাথে রেখেছে। ফলে তারা বিদ্রোহীদের প্রতি সহমর্মীতা দেখিয়েছে। ফলে তারা আর আমার জন্য নেই।
এই কাজের জন্য সবচেয়ে কাছের ক্যান্টনমেন্ট হচ্ছে কুমিল্লা। কিন্তু সেখানে পৌঁছান অতিদূর। যদি আমি কুমিল্লায় যেতে পারতাম তাহলে হয়ত একটা শো-ডাউন বা কাম-ব্যাক সম্ভব। এই শো-ডাউনটা অনেক ভয়ংকর হবে – যেহেতু আর্মি ফোর্স নিজেরাই নিজেদের বিদ্রোহীদের মুখোমুখি হবে। ফল হবে অপরিনাম রক্তপাত এবং এর ফলে পুরো দেশে গৃহযুদ্ধ লেগে যাবার মত অবস্থা তৈরি হবে। এই অবস্থায় এরকমও হতে পারে যে আর্মিতে প্রতিপক্ষ গ্রুপ রয়েছে। অবশ্যই আর্মিতে অসন্তোষ রয়েছে কিন্তু কে কার পক্ষ নেবে সেটা বলা মুশকিল। সেই প্রমাণ ৪৬ ব্রিগেড এলাকাতেই দেখতে পাচ্ছি।
এই অবস্থায় রক্তারক্তির পরিমাণ যতোই হোক না কেন বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনা যাবেনা। দ্বিতীয় পথের ক্ষেত্রে, আমি রক্তারক্তি এড়াতে পারি। সম্ভ্যাব্য গৃহযুদ্ধ এড়াতে পারি। এবং সর্বপরি আর্মিতে বিভক্তি ঠেকাতে পারি। দ্বিতীয় পথে সম্ভবত আমি আমার অথোরিটি পুনস্থাপন করতে পারবো এবং একটা চ্যানেল অব কমান্ড তৈরি করতে পারবো। একটা পজিশন হয়ে গেলে উশৃঙ্খলদের মাঝে শৃঙ্খলা অনেকটা ফিরিয়ে আনতে পারবো। যাই করিনা কেন যে উদ্দেশ্যে আমি যুদ্ধ করেছি সেটায় হেরে গেছি; প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছেন। যদি তিনি জীবিত থাকতেন তাহলে হয়ত ঝুঁকি নিলে বা যুদ্ধ করলে কিছু ফল হতে পারতো। যেহেতু তিনি বেঁচে নেই, এই মুহুর্তে বিদ্রোহী দমন করতে গিয়ে দেশকে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়ে ভালো কিছু হবেনা। এই বিষয়গুলো দ্বিতীয় পথ বেছে নিতে আমাকে অনেকটা প্রভাবিত করে।
যখন আমি মনে মনে এসব ভাবছিলাম ততোক্ষণে অন্যান্য চীফরা এসে পড়লেন। আমরা ৪৬ ব্রিগেড লোকেশনে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করলাম। এবং অল্প কিছুক্ষণ পরেই আমাদের রেডিও স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে পৌঁছানোর পর আমাদের যে রুমে নিয়ে যাওয়া হল সেখানে খন্দকার মোশতাক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। প্রথমবারের মত আমি সেখানে গিয়েছিলাম। রুমে প্রবেশ করতেই দেখলাম খন্দকার মোশতাক একটি সাদা ন্যাশনাল ড্রেস পরে আছে এবং একটি টেবিলের উপর রাখা একটি রেকর্ডারসহ মাইক্রোফোনের সামনে বসে আছে। তার বাম পাশে আছে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। সে পড়েছে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী এবং সে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখার সাথে সাথে খন্দকার মোশতাক বলল, “কনগ্রাচুলেশন শফিউল্লাহ, তোমার সৈন্যরা অভুতপূর্ব কাজ করেছে। এখন যাও বাকি কাজটা শেষ কর।” যখন আমি জিজ্ঞেস করলাম বাকি কাজটা কী, তখন সে জবাব দিলো, “তোমার ভালো জানার কথা।” আমি তখন তাকে বললাম, “তাহলে সেটা আমার উপর ছেড়ে দিন।” সেটা বলেই আমি রুম থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলাম।
যে মুহুর্তে আমি বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়িয়েছি, জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর খন্দকার মোশতাককে বলল আমাকে থামাতে – যাতে আমি রেডিও স্টেশন ছেড়ে চলে না যাই। বাইরে আমাদের পথ রুদ্ধ করে মেজর ডালিম ও তার ট্রুপ্স দাঁড়িয়ে ছিলো। তারা আমাদের থামাল। নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য রেডিও স্টেশনের একটি কক্ষে আমাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। রেডিও ও টেলিভিশনে সম্প্রচারের জন্য একটি ঘোষণার প্রয়োজন। আমরা যখন অপেক্ষা করছিলাম, জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর তখন তাড়াহুড়া করে একটা স্ক্রিপ্ট প্রস্তুত করল যাতে বর্তমান সরকারের প্রতি আমাদের আনুগত্য উল্লেখিত আছে। আমাদের সেটা পড়তে বলা হল এবং রেকর্ড করে পরবর্তীতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্প্রচার করা হল।
এটা করা হল নতুন সরকারের অবস্থান দৃঢ় করার জন্য। আনুগত্য প্রকাশের পেছনে যে বিষয়গুলো আমার মাথায় কাজ করেছে সে বিষয়ে উপরের পাতাগুলোয় আমি উল্লেখ করেছি। রেকর্ডিং এর পর খন্দকার মোশতাক জুম্মার নামাজের পর অনুষ্ঠিতব্য শপথ অনুষ্ঠানে আমাদের সকল চীফদের উপস্থিত থাকতে বললেন। এরপর যেহেতু সেখানে আমার আর প্রয়োজন নাই তাই আমি রেডিও স্টেশন থেকে আমার অফিসে ফিরে আসলাম। ফেরার পথে মেজর ডালিম ও তার ট্রুপ্স আমাকে আবারো ফলো করতে থাকলো।
অফিসে এসেই আমি দ্রুত কনফারেন্স রুমে আমার ব্রিফিং এর জন্য অফিসারদের একত্র করলাম। আমাকে দেখাতে হবে যে আমি এখনো কমান্ডে আছি। তাই আমার সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং এ আমি বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের অবহিত করলাম। আমি তাদের বললাম যে ঘটনা যা ঘটেছে তাতে ইতোমধ্যে অনেক দেরী হয়ে গেছে এবং বিদ্রোহী সেনারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করেছে। যখন আমি ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম তখনই আমি ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে সেনা পাঠিয়ে এই একশনকে প্রতিহত করতে আদেশ করেছিলাম। বিদ্রূপাত্মক হলেও সত্য যে কর্নেল শাফায়াৎ আমার অর্ডারের প্রেক্ষিতে কোন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখায়নি – কারণ হয়ত শুধু তার নিজেরই জানা। এটা সত্য যে ঘটনাটা প্রতিহত করতে যে সময়ের দরকার ছিলো সম্ভবত সে তা পায়নি। কিন্তু এটাও সত্য যে সে একাবারেই কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। প্রতিক্রিয়া দেখাক বা না দেখাক, আমি কী করে বলি যে সে যথেষ্ট সময় পায়নি? সত্যটা হচ্ছে, সে তার সৈন্যদের মুভ করতেই বলেনি। যদি সে তার সৈন্যদের মুভ করাতো তাহলে অন্তত বিদ্রোহী সেনাদের ক্যান্টনমেন্টে ঢোকা বা বের হওয়ায় বাধা দেয়া যেত।
যদি সে তার ট্রুপ্সকে ক্যান্টনমেন্টে কারো ঢোকা বা বের হওয়ায় বাধা দিতে আদেশ দিত, বিশেষ করে ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়নকে, যারা তখনো অসমর্থিত অবস্থানে ছিলো, তাহলে হয়ত ঘটনা অন্যরকম হত। মেজর ডালিম ও মেজর রশিদ এত সহজে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে বা বের হতে পারতোনা। ক্যান্টনমেন্টে তাদের বিনা বাঁধায় চলাচল দেখে সাধারণ সৈন্যরা ধারণা করেছে যা তারা যাই করছে সেটার অনুমোদন রয়েছে। অভ্যুত্থানের পেছনে যে আর্মি জড়িত সেই ধারণাটা বিশ্বাসযোগ্য হবার এটা অন্যতম কারণ। ফলে বিদ্রোহীরা ক্যান্টনমেন্টে অবাধে প্রবেশ করতে পেরেছে , এমনকি কোন বাঁধাবিঘ্ন ছাড়াই আমার অফিসে প্রবেশ করতে পেরেছে।
আমি অফিসারদের বললাম, আমি এই ঘটনা ঠেকাতে পারতাম না, আরও বেশী রক্তপাতের ফলে মূলত কোন ফল পাওয়া যেতনা। তাই আমাদের নিয়ন্ত্রণ হারানোর আগে এবং এতদিন আমরা যা সাজিয়েছি তা যাতে নষ্ট হয়ে না যায় সেজন্য এখন চ্যানেল অব কমান্ড পুনস্থাপন করতে হবে এবং আর্মিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। এই অবস্থা আর আমি চলতে দিতে পারিনা। আমাকে আমার কাজের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। আমার প্রধান লক্ষ্য ঐসব বিদ্রোহী সৈন্যদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের বিচার শুরু আগে তাদের ব্যারাকে ফেরত পাঠানো। আমার ধারণায় ভুল হতে পারে, তবে সেদিন অফিসারদের সাথে আলোচনায় আমার মনে হয়েছে কিছু কিছু অফিসার যা ঘটেছে সেটাকে অপছন্দ করেনা, শুধুমাত্র খুনের বিষয়টা ছাড়া। আমার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পর আমি খন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবার জন্য বঙ্গভবনের দিকে রওনা হলাম। মেজর ডালিম ও তার ট্রুপ্স বঙ্গভবন পর্যন্ত আমাকে ফলো করল।
সকাল থেকে বিদ্রোহী সেনারা নির্বিঘ্নে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ঘোরাফেরা করছিলো। কর্নেল শাফায়াৎ যদি আন্তরিক হতেন তাহলে এটা কি সম্ভব হত? আর্মিতে কি কোন দ্বিতীয় কমান্ড চলছে? যদি তাই হয় তবে কার কমান্ডে কর্নেল শাফায়াৎ চলছে? যদি সে আমার কমান্ডে চলত তাহলে অন্তত ক্যান্টনমেন্ট তার নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। সেদিন বিদ্রোহীদের থেকে ক্যান্টনমেন্ট রক্ষার কী করা হয়েছে? তার নিজের এবং আমার হেড কোয়ার্টার ছিলো সম্পূর্ন অরক্ষিত। এবং সহজেই বিদ্রোহীরা সব নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এমনকি তার বি এম মেজর হাফিজকে বিদ্রোহী অফিসার মেজর রশিদের সাথে একত্রে কাজ করতে দেখলাম। যদি আমার আদেশমত কর্নেল শাফায়াৎ সৈন্য মুভ করাতো তাহলে মেজর ডালিম ও মেজর রশিদ ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার সাহস পেতোনা। আমার অর্ডার পালন না করে সে নির্দেশনা নিতে ডেপুটি চীফ জেনারেল জিয়ার কাছে গিয়েছে। সে (জিয়া) তাকে শুধু বলেছে সতর্ক থাকতে। এটা শাফায়াতের নিজের দেয়া বক্তব্য। এই অর্ডারে কী বোঝায়? (জিয়া কর্তৃক ‘সতর্ক থাকতে বলার অর্ডার’)। এর মানে হচ্ছে প্রস্তুত থাকো এবং চুপচাপ থাকো, আর কিছু নয়। এভাবে শুধু সতর্ক থেকে বা নিষ্ক্রিয় থেকে সে কী ফল পেয়েছে? ক্যান্টনমেন্টকে অরক্ষিত পেয়ে বিদ্রোহী সেনারা শুধু ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশই করেনি, বরং তারা আমাকে জোর করে রেডিও স্টেশনে নিয়ে গেছে – তাও আবার কর্নেল শাফায়াতের ব্রিগেড এরিয়া থেকেই। যখন মেজর ডালিম আমাকে (চীফকে) ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে জোর করে রেডিও স্টেশনের দিকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন কর্নেল শাফায়াৎ জামিল তাদেরকে প্রতিরোধ করতে কোন রকম চেষ্টাই করেনি। এমতাবস্থায় কী করে আমি তাকে বিশ্বাস করি?
Translated by – সংগ্রামের নোটবুক
Reference: 15th August A National Tragedy Major Gen K M Safiullah BU PSC