১৫ আগস্ট সকালে ক্যান্টনমেন্টে কী হচ্ছিলো?
সকালে প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলার পরেই আমার একজন ব্যাটম্যান আমার কাছে একটা রেডিও নিয়ে আসলো এবং আমাকে ঘোষণা শুনতে বলল। মেজর শরিফুল হল ডালিমের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। যে বলল যে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে এবং নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। তার কথা হজম করতে করতে জেনারেল জিয়া এসে উপস্থিত হল। সময়টা সোয়া ৬ টা থেকে ৬ টা ২০ মিনিটের মধ্যে হবে। সে ইউনিফর্মে সুসজ্জিত, ক্লিন শেভ করা, তার অফিসিয়াল গাড়িতে এসে নামলো। জেনারেল জিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এসে পৌঁছালো। সেও নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি চেপে আসলো। সে তখনো পায়জামা পরা এবং শেভ করেনি। আমি জেনারেল জিয়া ও খালেদ মশাররফকে বললাম যে আমি কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে তিনটি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়ন নিয়ে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করতে বলেছিলাম। কিন্তু আমি কোন মুভমেন্ট দেখিনি বা তার কাছ থেকে কোন ফিডব্যাক পাইনি। আমি তার সাথে কোন যোগাযোগও করতে পারছিনা। আমি তার সাথে কোনোভাবেই সংযুক্ত হতে পারলাম না। অপারেটর আমাকে জানিয়েছিল যে তার টেলিফোন হাং-আপ করা। আমি জানিনা সে কী করছে বা কী তাকে মুভ করতে বাধা দিচ্ছে।
১৯৮৬ সালে একটি ইন্টারভিউতে কর্নেল শাফায়াৎ জামিল (প্রফেসর আবু সাইড লিখিত ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস বইয়ের ২৯৪-২৯৫ পাতা দেখুন) বলেন, ১৫ আগস্ট ‘৭৫ যখন তিনি জেনারেল জিয়ার বাসায় নির্দেশনা পাবার আশায় গেলেন, তিনি দেখলেন জিয়া শেভ করছেন। আমিও দেখলাম জিয়া আমার কাছে যখন এসেছে তখন সে ক্লিন শেভড ছিলো। একইদিন সকালে যখন আমি জেনারেল জিয়া ও ব্রিগেডিয়ার খালেদের সাথে কথা বলছিলাম এবং অভিযোগ করছিলাম যে কর্নেল শাফায়াৎ জামিল কী করছে – জিয়া তখন একেবারেই বলেনি যে শাফায়াৎ জামিল তার বাসায় গিয়েছিলো তার নির্দেশনা নেবার জন্য। এখানে হয় কর্নেল শাফায়াৎ জামিল পুরোটা সত্য বলেনি, অথবা জেনারেল জিয়া কিছু লুকোবার চেষ্টা করেছে। তার মাথায় অবশ্যই ভিন্ন কিছু ছিলো। যদি জেনারেল জিয়ার অন্য কোন ভূমিকা না থাকতো তাহলে সে কেন সেদিন আমার সাথে দেখা হবার আগে যে কর্নেল শাফায়াতের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়েছে সেটা বললনা? এটা খোঁজা এখন পাঠকের দায়িত্ব যে জিয়া সেদিন কী ভূমিকায় ছিল।
কর্নেল শাফায়েতকে অতি সত্বর সৈন্য পাঠিয়ে বিদ্রোহীদের দমন করার আদেশ দেবার পরেও আমি কোন কার্যক্রম দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি চিন্তায় পরে গেলাম। যেহেতু সময় গড়িয়ে যাচ্ছিলো তাই আমি অস্থির হয়ে গেলাম। বাসায় থাকার কারণে যেহেতু আমি কোন কোর্স অব একশন নিতে পারছিলাম না, আমি অফিসে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম যাতে আমি ট্রুপ্স মুভ করতে পারি। তাই আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে ইউনিফর্ম পরে ৪৬ ব্রিগেড এলাকায় আসতে বললাম যাতে কর্নেল শাফায়াৎ ও তার বাহিনীকে বিদ্রোহীদের দমনে পাঠাতে পারি। ব্রিগেডিয়ার খালেদকে পাঠিয়ে আমি ইউনিফর্ম পড়ার উদ্দেশ্যে ঘরে ঢুকলাম। আমি রেডি হতে হতে আমার ADC ক্যাপ্টেন হুমায়ূন কবির একটি গাড়িতে করে আমার বাসায় চলে আসলো।
যে মুহুর্তে আমি অফিসের উদ্দেশ্য বের হচ্ছিলাম সেই সময়ে আমার বাড়ির পেছনের দেয়াল টপকে আমার কাছে আসে ব্রিগেডিয়ার রউফ (তৎকালীন ডিজিএফআই)। সে লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরা। করিডোরে দাঁড়িয়ে স্বল্প সময় আমাদের কথা হল। আমি অফিসের উদ্দেশ্যে দ্রুত বের হচ্ছিলাম কারণ আমার তাড়া ছিলো। আমাদের স্বল্প সময়ের আলোচনায় ব্রিগেডিয়ার রউফ আমাকে সাজেশন দিলেন যেন আমি জেনারেল জিয়াকে আমার সাথে না রাখি। আমি জানিনা এর দ্বারা সে আসলে কী বোঝালো। সেও আর কিছু খুলে বলল না। জেনারেল জিয়া আমার ডেপুটি। কোন কারণ না জেনে কিভাবে আমি তাকে আমার কাছে ঘেঁষা বন্ধ করাই। ব্রিগেডিয়ার রউফ সম্ভবত এমন কিছু জানে যে সম্পর্কে আমি সজাগ নই। সে জেনারেল জিয়ার থেকে আমাকে আলাদা রাখতে চাচ্ছিল। জেনারেল জিয়া আমার লিভিং রুমে বসে আছে কারণ আমরা একসাথে অফিসে যাবো। তাই আমি ব্রিগেডিয়ার রউফকে বাসায় গিয়ে পোশাক চেঞ্জ করে দ্রুত অফিসে আসতে বললাম। ব্রিগেডিয়ার রউফ আমাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে আমার স্ত্রীর কাছে গেলেন এবং তাকে বোঝালেন যেন সে আমাকে অফিসে যেতে না দেয় এবং জেনারেল জিয়ার সাথে আমি না যাই। ব্রিগেডিয়ার রউফের মনে কী আছে আমি জানিনা। তবে সে সময় তার সাজেশনের প্রেক্ষিতে আমার কিছু করার ছিলো না। তাই আমি অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম এবং জেনারেল জিয়া আমার গাড়ির পেছনে আসতে লাগলো।
জেনারেল জিয়া আমার ডেপুটি। সেদিন সে আমার প্রতি একটু বিশেষ সৌজন্য দেখাচ্ছিল। সেদিন সকাল থেকে সে আমাকে খুব বেশী “স্যার” “স্যার” বলছিলো। ব্যক্তিগত আলোচনায় জেনারেল জিয়া আমার নাম ধরে ডাকে। এবং অফিসিয়াল ক্ষেত্রে স্যার বলে ডাকে। কিন্তু সেদিনের মত এত বেশী বেশী করে কোনোদিন বলেনি। যাই হোক, অফিসে পৌঁছেই আমি আমার ADC ক্যাপ্টেন হুমায়ূন কবিরকে বর্তমান পরিস্থিতি কী সেটা জেনে জানাতে বললাম। পাশাপাশি আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের থেকে ৪৬ ব্রিগেডে এখন কী হচ্ছে সেই বিষয়েও জানার অপেক্ষায় রইলাম। যেহেতু আমি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় কোন এক্টিভিটি বা সৈন্য সমাবেশ দেখতে পাচ্ছিলাম না আমার উদ্বেগ বেড়েই চলছিলো। ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিল আমাকে এড়িয়ে চলছিলো। এবং সেই তখন থেকে সে কী একশন নিয়েছে সেই ব্যাপারে এখনো কোন রিপোর্ট করেনি। এমনকি সে কি করছে সেটাও জানিনা।
সকালে যখন আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে ৪৬ ব্রিগেডে যেতে বললাম জেনারেল জিয়া তাতে কিছুটা দ্বিমত প্রকাশ করল। এবং অনেকটা জোর করছিলো যেন আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে কোনোভাবেই ৪৬ ব্রিগেডে না পাঠাই। ব্রিগেডিয়ার খালেদ চলে যাবার পর, জেনারেল জিয়া এতোটাই মর্মাহত ভাব দেখাল যে অনেকটা বলেই ফেলল যে সে (খালেদ) সবকিছু নষ্ট করে ফেলবে। হয়ত জেনারেল জিয়ার নিজস্ব যুক্তি আছে যার জন্য সে মনে করে যে ব্রিগেডিয়ার খালেদকে সেখানে পাঠানো উচিৎ হবেনা। কিন্তু আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না এবং এই অস্থিরতা বেশিক্ষণ সহ্য করা কষ্টকর। তাই জেনারেল জিয়ার বাধা সত্ত্বেও আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদকে ৪৬ ব্রিগেড এরিয়ায় পাঠালাম। আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদকে এটাও বললাম যে আমার নির্দেশনা যেন বাস্তবায়িত হয়। এবং যত দ্রুত সম্ভব সে যেন আমাকে লেটেস্ট পরিস্থিতি জানায়।
অফিসে পৌঁছে আমি ঢাকার বাইরে ফর্মেশন কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ করি এবং যার সাথেই কথা হয়েছে তাকেই আমি ঢাকায় যা ঘটেছে সেটা জানাই। আমি তাদেরকে প্রস্তুত থাকতে বলি এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছ থেকে পরবর্তী নির্দেশনার জন্য তাদের অপেক্ষা করতে বলি। ঢাকায় কী ঘটেছে সে ব্যাপারে আমার খুব বেশী বলতে হয়নি। মনে হল তারা সবাই এব্যাপারে অবগত। সম্ভবত রেডিও মারফত তারা এসব জেনেছে। আমি প্রত্যেক কমান্ডারকে এটাও বললাম যে ঢাকায় যা ঘটেছে তা আমার সম্মতির বাইরে এবং আমার অজান্তে হয়েছে। এটা আমি বলছিলাম যাতে তাদের কোন রকম সন্দেহ না থাকে। আমি তাদেরকে আরও জানালাম যে আমি ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে এটা প্রতিরোধ করার জন্য ট্রুপ্স পাঠাতে বলেছি। যখন আমি Fmn কমান্ডারদের সাথে কথা বলছিলাম তখন জেনারেল জিয়া আমার সামনে বসা ছিলেন। তিনি তখন একদম চুপ করে ছিলেন। আমি যখন কমান্ডারদের সাথে কথা বলছিলাম সেই ফাঁকে জেনারেল জিয়া আমাকে বলল আমার উচিৎ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে কল ব্যাক করা। তার একটা অপারেশন অর্ডার তৈরি করা উচিৎ যাতে সৈন্যদের রেডি করে সীমান্তের কাছে পাঠানো যায় যেন তারা ভারত থেকে কোন আক্রমণ হলে তা প্রতিহত করা যায়।
যখন আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে ৪৬ ব্রিগেডে পাঠিয়ে অধীর আগ্রহে সেনামোতায়েন সম্পর্কে তথ্য পেতে অপেক্ষা করছিলাম তখন একটা ফোন এলো। ব্রিগেডিয়ার খালেদ ফোন করেছে। আমি জানতে চাইলাম তখন পর্যন্ত কর্নেল শাফায়াৎ কী ব্যবস্থা নিয়েছে। সে আমাকে জবাব না দিয়ে বলল ৪৬ ব্রিগেড এলাকায় আসতে। যখন আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম তখন সে বলল তারা তাকে (খালেদকে) ফোনে এব্যাপারে বলতে বাধা দিচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কারা তাকে (খালেদকে) বাধা দিচ্ছে। এবং কেন সে আমাকে ফোন করেছে। সে জবাব দিল তারা তাকে (খালেদকে) দিয়ে আমাকে ফোন করতে বলেছে শুধু আমাকে সেখানে যাবার জন্য। আমি জিজ্ঞেস করলাম তারা কারা? সে বলল এর বেশী তারা তাকে বলতে নিষেধ করছে। তখন আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদকে এক্ষুনি আমার অফিসে আসতে বললাম। কিভাবে আসবে তা জানিনা। তবে এসে আমাকে কি হচ্ছে জানাতে বললাম। এটা বলার পর আমি ফোনের রিসিভার ধরে রাখলাম। ব্রিগেডিয়ার খালেদ বললেন যে তারা তাকে স্বল্প সময়ের জন্য আমার অফিসে আসতে দেবে। আমি বুঝলাম না এর দ্বারা সে কী বোঝাতে চাইল, তবে আমি তাকে আসতে বললাম।
যখন খালেদ মোশাররফ ৪৬ ব্রিগেড থেকে ফিরে আসছিল তখন আমার এডিসি আসলো এবং জানালো প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। তখন পর্যন্ত আমার বিশ্বাস হয়নি যে বিদ্রোহীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারে। আমার এডিসি যে সংবাদ দিলো তা আমার জন্য প্রচণ্ড হতাশার। এটা খুব বেদনাদায়ক। এটা আমাকে ইমোশনাল করে ফেলল। বিষণ্ণ মুখে আমি চেয়ারে বসে থাকলাম। এমন সময় ব্রিগেডিয়ার খালেদ আসলো। তাকে খুব ক্লান্ত ও চিন্তিত মনে হল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ যখন আসলো জেনারেল জিয়া তখন আমার সামনেই বসা ছিলো। আমি খালেদ মোশাররফের কাছে জানতে চাইলাম কর্নেল শাফায়াৎ কি সৈন্য মুভ করেছিলো? সে বলল, “না স্যার।” সে বলল মনে হচ্ছে পুরো গ্যারিসন আপনার অর্ডারের বিরুদ্ধে (অর্থাৎ চীফের বিরুদ্ধে) বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। এই একশনের পেছনে কে আছে সে ব্যাপারে তার কোন ধারণা নেই। অথবা কে গুজব ছড়িয়েছে সে ব্যাপারেও ধারণা নেই। সে আরও বলল যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে পুরো আর্মি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। অবস্থা এমন যে এই অবস্থায় এটাকে ট্রুপ্স দিয়ে থামানো যাবেনা।
ব্রিগেডিয়ার খালেদ রিপোর্ট করার সময় জেনারেল জিয়া আমার অফিসে। ব্রিগেডিয়ার খালেদের কথা শেষ হবার আগেই জেনারেল জিয়া বলল GCS এর এখন কোথাও যাওয়া উচিৎ নয়। তার (GCS এর) উচিৎ এখনই বসে ভারতীয় আক্রমণ ঠেকানোর জন্য “Ops Order” তৈরি করা। ফর্মেশন কমান্ডারদের কাছে অর্ডার পাঠানো উচিৎ যাতে শর্ট নোটিশে সৈন্যরা মুভ করতে পারে। আমি একমত হলাম এবং বললাম যে এই সম্ভবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না। কিন্তু আমাদের এক্ষুনি কোন উপসংহারে যাওয়া উচিৎ নয়। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে আরও একটু দেখা দরকার। এরপর পদক্ষেপ নেয়া যাবে। ওইসময় খুবই গুরুতর পরিস্থিতি বিরাজমান ছিলো। আমাদের প্রথম কাজ হবে উশৃঙ্খল পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আনা এবং তারপর সিরিয়াস কিছুতে নিযুক্ত হওয়া। তবুও ব্রিগেডিয়ার খালেদকে আমি বললাম, বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি “Ops Order” রেডি করতে এবং এরজন্য আমার থেকে কিছু নির্দেশনা নিতে।
যখন আমরা এসব বিষয় ও ৪৬ ব্রিগেড নিয়ে কথা বলছিলাম তখন আমি আমার হেডকোয়ার্টারের বাইরে ট্যাংকের শব্দ ও ভারী যান চলার শব্দ পাচ্ছিলাম। অল্প সময়ের মধ্যে দুটো যান এসে আমার আর্মি হেডকোয়ার্টারের সামনে থামল। একটু পরেই আমার অফিস রুমের দরজা খুলে গেল। মেজর ডালিম সজোরে দরজা খুলল এবং কিছু সৈন্য নিয়ে আমার রুমে প্রবেশ করল। তারা সংখ্যায় ১৫ থেকে ১৮ জন। এবং তারা চিৎকার করছিল “চীফ কোথায়?” আমার রুমে ঢুকে সবাই আমার দিকে বন্দুক তাক করল। আমি এই ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে মেজর ডালিমের বন্দুকের নলের মুখে আমার তর্জনি লাগিয়ে (যেটা আমার দিকে তাক করা ছিলো) বললাম, “ডালিম এসব অস্ত্র দেখতে দেখতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। যদি তুমি এসব ব্যবহার করতে এখানে এসে থাকো তাহলে এক্ষুনি করতে পারো। আর যদি তুমি কিছু নিয়ে কথা বলতে এসে থাকো তাহলে তোমার ট্রুপ্স এবং অস্ত্র রুমের বাইরে পাঠাও এবং তারপর কথা বল।”
যখন মেজর ডালিম ও তার ট্রুপ্স আমার অফিস রুমে ঢুকে আমার দিকে তাদের বন্দুক তাক করে রেখেছিলো তখন আমার সামনে টেবিলের ওইপাশে জেনারেল জিয়া ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ আমার মুখোমুখি বসা ছিলো। কর্নেল (পরবর্তীতে লে জেনারেল) নাসিম এবং এম এস আমার বামে দাঁড়ানো ছিলো। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, যখন এত অফিসার আমার রুমে অবস্থান করছে তখন মেজর ডালিম ও তার দলের একমাত্র টার্গেট আমিই। সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় আমি বিচলিত হইনি। তার পরিবর্তে আমি মেজর ডালিমের প্রতি কঠোর ছিলাম।
যখন আমি মেজর ডালিমকে তার অস্ত্র ব্যবহারের আদেশ দিলাম সে তখন ধীরে ধীরে তার বন্দুক নামালো। এবং বলল, “প্রেসিডেন্ট রেডিও স্টেশনে আপনার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে।” আমি বললাম, “তুমি কার কথা বলছ? আমি জানি প্রেসিডেন্ট মারা গেছে।” সে তখন বলল, “স্যার, এতক্ষণে আপনার জানার কথা যে খন্দকার মোশতাক এখন প্রেসিডেন্ট।” আমি মেজর ডালিমকে বললাম, “খন্দকার মোশতাক তোমার প্রেসিডেন্ট হতে পারে। আমার নয়।” এর উত্তরে সে বলল, “স্যার, আমি আপনাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেতে এখানে এসেছি। কিন্তু আপনি আমাকে সেটা জোরপূর্বক করাতে বাধ্য করছেন, যার জন্য আমি আসিনি।” আমি তাকে বললাম, “তুমি তোমার যা খুশি করতে পারো। কিন্তু আমি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছিনা।” আমি আরও বললাম, আমি আমার ট্রুপ্সের কাছে যাবো এবং সিদ্ধান্ত নেব এরপর কী করা যায়।
মেজর ডালিম যখন আসলো বঙ্গবন্ধুর বেদনাদায়ক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমি খুবই মর্মাহত ছিলাম। রেডিওতে ঘোষণা শুনে এবং সে যেভাবে আমার অফিসে প্রবেশ করল এতে করে আমি আমার স্বাভাবিক মেজাজ হারালাম এবং তার সাথে চিৎকার করে তাকে তার অস্ত্র ব্যবহার করতে বললাম। এখন আমি বুঝি আমার চ্যালেঞ্জটা বোকার মত কাজ ছিলো। এই লোকগুলো যে কোন কিছু করবার জন্যই প্রস্তুত ছিলো। তারা বঙ্গবন্ধুকে মেরে আমার এখানে এসেছে। তারা যদি প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধুর মত মানুষকে হত্যা করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে সেখানে আমাকে মারতে তো তাদের কোন তাদের একটুও ভাবতে হবেনা।
পেছনে তাকালে বুঝতে পারি, কোন শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা থেকে মেজর ডালিম যে আমাকে মারেনি তা নয়। বরং তাদের নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে আমাকে জীবিত প্রয়োজন ছিলো। সেদিন সকালে তারা প্রচার করে যে, সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে আর্মি চীফের নির্দেশনায়। তাই তাদের স্বার্থেই আমাকে জীবিত প্রয়োজন। সৈন্যদের কাছে তাদের অবস্থান শক্ত করতে এটা দেখানো প্রয়োজন ছিলো যে তাদের সাথে আর্মি চীফও আছে। আমাকে যদি তারা মেরে ফেলত তাহলে উদ্ভূত পরিস্থিতি কি তারা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারতো? তাই উত্তেজিত বাকবিতণ্ডার পরেও আমাকে হত্যা না করবার এটাই সম্ভাব্য কারণ।
মেজর ডালিমের সাথে উত্তপ্ত কথাবার্তা বলতে বলতে আমি আমার আসন থেকে উঠে দাঁড়ালাম এবং মেজর ডালিমের সৈন্যদের প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পথ করে নিয়ে আমি ৪৬ ব্রিগেড এলাকার দিকে রওনা করতে অফিস থেকে বের হলাম। আমি অফিস থেকে বের হবার পর তারাও আমাকে ফলো করতে লাগলো। আমার অফিস ত্যাগ করার মুহুর্তে আমার অফিসের স্টাফদের সকলের চোখে জল দেখতে পেলাম। মেজর ডালিমের ব্যবহার এবং যেভাবে সে প্রবেশ করেছে সেটা দেখে আমার স্টাফরা মনে করেছে মেজর ডালিম আমাকে মেরে ফেলার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। তাই গাড়িতে ওঠার আগে আমি তাদেরকে স্বান্তনা দিলাম এবং ৪৬ ব্রিগেড এলাকায় রওনা দিলাম। মেজর ডালিম ও তার সৈন্যরা আমাকে ফলো করতে লাগলো। যে মুহুর্তে আমি ৪৬ ব্রিগেড এলাকায় প্রবেশ করলাম আমার মনে হল সেখানে কোন উৎসব হচ্ছে। যেন অনেক মহৎ কিছু হয়েছে। সৈন্যরা আমাকে দেখে আরও আনন্দিত হয়ে উঠলো এবং সেটা কিছুটা শোরগোল বা হৈচৈপূর্ণ। সেসব দৃশ্য দেখে তাদের সাথে কী করে কথা বলব সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সেখানে আমি আমার মুখই খুলতে পারলাম না। এই বিদ্রোহী ট্রুপ্সরা মেজর রশিদের।
ব্রিগেড এরিয়ায় একজন অফিসার পাহার দিয়ে আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে গেল। ভেবেছিলাম সেখানে কর্নেল শাফায়েতকে দেখতে পাবো। কিন্তু দেখতে পেলাম না। সেখানে বি এম মেজর হাফিজ ও মেজর রশিদের সাথে আমার দেখা হল। যখন মেজর হাফিজকে আমি তার কমান্ডারের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, সে কোন তথ্য দিতে পারলোনা। এসময় সবচেয়ে বেশী কথা বলছিল মেজর রশিদ। সকাল আমি কর্নেল শাফায়েতকে বলেছিলাম বিদ্রোহীদের দমন করতে। তা এখানে এসে যখন দেখলাম বেশিরভাগ কথা সেই (রশিদ) বলছে এবং তা মেজর রশিদের সামনেই (যে ৪৬ ব্রিগেডের বি এম) তখন ভাবতেই পারছিলাম না যে মেজর রশিদও এই উছৃংখল অভিযানের একজন চরিত্র। মেজর রশিদ যদি এই মঞ্চের নেতা হয় তাহলে মেজর হাফিজ কিভাবে একই সাথে থাকে? এরা তো একে অপরের মুখোমুখি অবস্থান নেবার কথা। এটা ভাবার কোন কারণ ছিলোনা যে মেজর রশিদ এখানে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াবে। ব্রিগেড এরিয়া থেকে মেজর রশিদ ও মেজর হাফিজ উভয়েই আমাকে অনুরোধ করল রেডিও স্টেশনে যাবার জন্য।
ব্রিগেড লোকেশনে আমার অবস্থানকালীন সময়ে আমি সৈন্যদের মেজাজ বোঝার চেষ্টা করছিলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম যে আমার কোন দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে কিনা। কীভাবে তাদেরকে অন্য মতের কথা বলব? আমি তাদেরকে বলতেই পারলাম না যে সেদিন যা ঘটেছে তাতে আমার কোন ভূমিকা নেই। পরিবেশটা এমন ছিলো যে আমি মুখই খুলতে পারলাম না। সেই অবস্থায় অন্য কোন পরিকল্পনায় যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। যেহেতু ঢাকা গ্যারিসনের সব ট্রুপ্স বিদ্রোহীদের পক্ষ নিয়েছে। অথবা ঘুরিয়ে বললে বলা যায় যে তারা সবাই বিদ্রোহী হয়ে গেছে।
Translated by – সংগ্রামের নোটবুক
Reference: 15th August A National Tragedy Major Gen K M Safiullah BU PSC