You dont have javascript enabled! Please enable it!

লাহোর ওআইসি সম্মেলনে যোগদানে রাজি করানোর জন্য ওআইসি সেক্রেটারি জেনারেল আল তোহামি বাংলাদেশ সফর করেন। শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করে বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য কমানোর বিষয়ে আলোচনা করেন।

একাত্তরের ৯ জুন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। অদম্য সাহসী ১৭ তরুণ। সম্বল মাত্র ১২টি গ্রেনেড, ১৬০ রুপি (তখনকার পাকিস্তানি মুদ্রা) আর একটি করে বেয়নেট। ২১ বছর বয়সী হাবিবুল আলমের নেতৃত্বে এই দলটি জীবন-মৃত্যু তুচ্ছ করে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিশ্ববিবেক। শুধু দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সৈন্য ঘেরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সফল আক্রমণ চালিয়ে পৃথিবীকে জানিয়েছিলেন নিরস্ত্র বাঙালি হার মানতে জানে না। ওই দিন রচিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের নতুন একটি ইতিহাস- গেরিলা যুদ্ধ। দলনেতা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক স্মৃতিচারণে বলেন, সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।

এফডিসির ক্যামেরাম্যান বাদল ভাই গাড়ি চালাচ্ছেন। তার পাশের সিটে কামরুল হক স্বপন পিস্তল নিয়ে বসে আছেন। আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং আমি পেছনের সিটে বসা। আমাদের তিনজনের হাতে তিনটি করে গ্রেনেড। আমাদের গাড়ি রাষ্ট্রপতির বাসভবন (বর্তমানে সুগন্ধা) পার হয়ে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, জিয়া, মায়া এবং আমি তিনটি করে গ্রেনেড হাতে নিয়ে ৩-৪ ফুট দূরে দাঁড়ালাম। স্বপন তার শার্টের নিচে পিস্তল ধরে দাঁড়ালো। প্রথম গ্রেনেড ছুড়ল জিয়া। আমি এবং মায়া পরপর গ্রেনেড ছুড়লাম। এরপর একটার পর একটা গ্রেনেড ফাটিয়ে আমরা পালালাম।

অপারেশনের অন্যতম যোদ্ধা (বর্তমানে মন্ত্রী ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল ঢাকায় ত্রাস সৃষ্টি করা। আমাদের বলা হয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের আহ্বানে ঢাকায় আগত বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে উঠবেন। এর আশপাশে ৬ থেকে ৮ মাইলের মধ্যে অপারেশনটা চালাতে হবে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা যাতে বুঝতে পারেন যে, ঢাকা এখন আর পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে নেই এবং বাংলার প্রতিটি মানুষ পাকিস্তানিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।

সাহসী তরুণদের বাহিনীর নাম ‘ক্র্যাক প্লাটুন’। তারুণ্যের জোয়ার তোলা এই দলটি মুক্তিযুদ্ধে বিচ্ছুবাহিনী নামেও পরিচিত। ঢাকা শহরে অনেকগুলো সফল এবং বিধ্বংসী অভিযান চালায় এই দলটি। পরিচালিত অভিযানগুলোর মধ্যে অপারেশন ফার্মগেট একটি; যার সময়কাল মাত্র এক মিনিটের মত, তবে বিস্তৃতি ব্যাপক। ফার্মগেট অপারেশন সংঘটিত হয় ৭ আগস্ট। প্লাটুনের অন্যতম সদস্য সামাদের নিউ ইস্কাটনের বাসায় সবাই বসে সিদ্ধান্ত নেন ওই দিনই আক্রমণ চালাবেন তারা। অপারেশনের সময় নির্ধারিত হলো রাত ৮টা এবং এর জন্য সময় বরাদ্দ থাকবে ১ মিনিট। অস্ত্রসজ্জিত গেরিলা দলে ছিলেন ৭ তরুণ। জুয়েল, আলম, পুলু, স্বপন, সামাদ আর বদি। ঠিক করা হয় সামাদ গাড়ি চালাবেন। সবার হাতে থাকবে স্টেনগান, আলমের হাতে চায়নিজ এলএমজি। অতিরিক্ত অস্ত্রের মধ্যে সামাদের কাছে আছে রিভলবার, জুয়েল আর পুলুর কাছে আছে ফসফরাস গ্রেনেড আর গ্রেনেড-৩৬। এক মিনিটের মধ্যেই খান সেনা আর পাকি পেয়ারা রাজাকারদের দিগি¦দিক অন্ধকার করে দেয় চৌকস গেরিলা দলটি। মুহ‚র্তেই মরণের স্বাদ পায় পাঁচ মিলিটারি পুলিশ ও ছয় রাজাকার। সফল এই অপারেশনের নেতৃত্বে ছিলেন শহীদ বদিউজ্জামান।

এই ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে সারা ঢাকায়, আর নতুন উদ্যাম যোগ করে সারা দেশের মুক্তিকামী মানুষের মনে। আর ব্যাপক ভীতি সঞ্চার করে খান সেনা আর তাদের দোসর রাজাকারদের মধ্যে। এভাবেই অনেকগুলো সফল অপারেশন চালান এই ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা।

কেন এই ক্র্যাক প্লাটুন : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই দলটি গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম এবং এ টি এম হায়দার বীরউত্তম। এটি ২নং সেক্টরের অধীন একটি স্বতন্ত্র গেরিলা দল, যারা মূলত গণবাহিনীর অংশ বলে পরিচিত। এই বাহিনীর সদস্যরা ভারতের মেলাঘর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই প্রশিক্ষণে গ্রেনেড ছোড়া, আত্মগোপন করা প্রভৃতি শেখানো হয়।

খালেদ মোশাররফের নির্দেশেই দুঃসাহসী এই তরুণরা অত্যন্ত ঝুঁকির সঙ্গে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড হামলা করে বেশ কয়েকজনকে হত্যা করেন। সন্ধ্যায় বিবিসির খবর থেকে খালেদ মোশাররফ এই অপারেশনের কথা জানতে পেরে বলেন, ‘দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল।’ তিনিই প্রথম এই দলটিকে ক্র্যাক আখ্যা দেন; যা পরবর্তীতে ক্র্যাক প্লাটুন নামে পরিচিত হয়। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ‘হিট এন্ড রান’ পদ্ধতিতে অসংখ্য আক্রমণ পরিচালনা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক ত্রাসের সঞ্চার করেন।

ক্র্যাক প্লাটুনের গর্বিত সদস্যরা : এই গেরিলা দলটিতে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন- আবুল বারক আলভী, শহীদ আব্দুল হালিম চৌধুরী জুয়েল বীরবিক্রম, পপসম্রাট আযম খান, আমিনুল ইসলাম নসু, আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন বীরপ্রতীক, ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, কাজী কামালউদ্দিন বীরবিক্রম, কামরুল হক স্বপন বীরবিক্রম, গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক, চুন্নু, জহির উদ্দিন জালাল, জহিরুল ইসলাম, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, নীলু, পুলু, ফতেহ চৌধুরী, শহীদ বদিউজ্জামান, বদিউল আলম বদি বীরবিক্রম, মতিন ১, মতিন ২, শহীদ মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ, মাহবুব, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, মাযহার, রাইসুল ইসলাম আসাদ, লিনু বিল্লাহ, শহীদ শাফি ইমাম রুমী, শহীদুল্লাহ খান বাদল, শাহাদত চৌধুরী, সামাদ, হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক, হিউবার্ট রোজারিও এবং হ্যারিস প্রমুখ।

উল্লেখযোগ্য অপারেশন : পাঁচ-ছয় জনের এক একটি দল তৈরি করে এই গেরিলা দলটি অপারেশনে অংশ নিত। ঢাকা শহরে তারা মোট ৮২টি অপারেশন পরিচালনা করেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো- অপারেশন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, অপারেশন গ্যানিজ পেট্রল পাম্প, অপারেশন দাউদ পেট্রল পাম্প, অপারেশন এলিফ্যান্ট রোড পাওয়ার স্টেশন, অপারেশন যাত্রাবাড়ী পাওয়ার স্টেশন, অপারেশন আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন, অপারেশন সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন, অপারেশন উলন পাওয়ার স্টেশন, অপারেশন ফার্মগেট চেক পয়েন্ট, অপারেশন তোপখানা রোড ইউএস ইনফরমেশন সেন্টার, এটাক অন দ্য মুভ প্রভৃতি।

মৃত্যুঞ্জয়ী বীরেরা : কথাসাহিত্যিক হূমায়ুন আহমেদের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ ক্র্যাক প্লাটুনের অকুতোভয় বীর বদিউল আলমের ওপর ভিত্তি করেই নির্মিত। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা মেধাবী বদিকে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জালাল উদ্দিনের বাসা ধানমণ্ডি থেকে একাত্তরের ২৯ আগস্ট ধরে নিয়ে যায়। এরপরে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। দেশ স্বাধীন হলে শহীদ বদিউল আলমকে বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

 

একই দিনে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন রুমী, আজাদ, জুয়েল, সামাদ, মাসুদ সাদেকসহ ক্র্যাক প্লাটুনের অনেক গেরিলা। রুমীকে আনুমানিক রাত ১২টার দিকে তার বাসভবন থেকে বাবা শরীফ ইমাম, ছোট ভাই জামী, বন্ধু হাফিজ, চাচাতো ভাই মাসুমসহ ধরে নিয়ে যায়। অমানুষিক নির্যাতনের পর পরিবারের অন্য সদস্যদের দুদিন পর ছেড়ে দেয়া হলেও রুমী আর ফিরে আসেনি। ফিরে আসেননি আজাদ, জুয়েল, সামাদরাও। যারা নির্মমভাবে মৃত্যুর কাছে পরাজিত হলেও মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে আছেন বাংলার ইতিহাসে।

 

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!