এক দুর্ধর্ষ খুনী ধর্ষক সম্পর্কে প্রতিবেদনে চাঁপাইনবাবগঞ্জে তােলপাড়
জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ এই মুহূর্তে চাপাইনবাবগঞ্জ শহর জুড়ে আলােচনা একটাই- জনকণ্ঠ বলেই এই রিপাের্ট ছাপতে পেরেছে। দৈনিক জনকণ্ঠে বুধবার “এক দুর্ধর্ষ খুনী ধর্ষক এখন সাবেক সাংসদ পরিচয়ে প্রতারণা করছে” শীর্ষক প্রতিবেদনটি শহরে ঝড় তুলেছে। সংবাদপত্রের হকার হতে শুরু করে দোকানপাট, অফিস-আদালত, সুধী মহল, চায়ের স্টলে প্রতারক হান্নানকে নিয়ে আলােচনা চলছে। তবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে হান্নান অপরিচিত। ত্রিশাের্ধ সকলের কাছে অতিঘৃণার পাত্র। ‘৭১-এ হান্নানের নৃশংসতা, বর্বরতা এবং ‘৭৫ পরবর্তী ঢাকায় অবস্থান গ্রহণের কারণে বর্তমান প্রজন্মের কাছে পাকি হানাদারবাহিনীর দোসর হান্নান অপরিচিত থাকলেও বুধবারের জনকণ্ঠ এই ঘাতককে পরিচিত করিয়েছে। তার অপকর্ম, হত্যা ও নৃশংসতা এবং স্বাধীনতাপরবর্তী প্রতারণা| জালিয়াতি হতে শুরু করে সকল দুষ্কর্মের কাহিনী জনকণ্ঠ পড়ে জানতে পেরে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে এই প্রজন্মের যুবকরা আরও উৎসাহিত হয়ে উঠেছে এই ধরনের কালাে অধ্যায় জানতে। পাশাপাশি যারা জানতেন না তাঁরাও জনকণ্ঠ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিদেশে অবস্থান করার কারণে এই ধরনের ঘাতকের অস্বাভাবিক অবিশ্বাস্য কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অনেকেই জ্ঞাত ছিলেন না। বিশেষ করে রাজাকার হান্নান ও তার পিতা পিস কমিটির সদস্য মাওলানা জিল্লার রহমানের ৯ মাস ধরে পাকি হানাদারদের শহর থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে মুক্তিযােদ্ধাসহ স্বাধীনতার পক্ষের মানুষকে হত্যা, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-হত্যার বিষয়গুলাে শহরের মানুষ এই ত্রিশ বছরেও জানতে পারেনি।
জনকণ্ঠের প্রতিবেদনে স্বাধীনতা যুদ্ধে হানাদারবাহিনীর দোসরদের বর্বরতার ইতিহাস তুলে ধরায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক উপজেলা ও ইসলাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন আহম্মদ অভিনন্দন জানিয়েছেন জনকণ্ঠকে। জেলা বারের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভােকেট এনামুল হক জানালেন, রাজাকার হান্নানের নানা ধরনের প্রতারণা-জালিয়াতির খবর জানলেও পরিপূর্ণতা লাভ করলাম জনকণ্ঠের রিপাের্ট পড়ে। তিনি জনকণ্ঠ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরােধ রেখেছেন রাজাকার হান্নানের চেয়েও আরও বড় বড় ঘাতক ও খুনীর অপকর্ম জনকণ্ঠে তুলে ধরার জন্য। অধিকাংশের মন্তব্য, নেতাদের হাত ধরে এরা পার পেয়েছে এবং এখনও তাদের ছত্রছায়ায় অবস্থান করছে। কোন কোন মুক্তিযােদ্ধা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, তারা আজ অবহেলার পাত্র, অভাব-অনটনের কারণে ছেলেমেয়েকে ভাল বিয়ে দিতে পারেননি। পড়াশােনা করাতে পারেননি। অথচ ঐসব রাজাকার স্বাধীনতার পক্ষের লােকজনদের ছত্রছায়ায় ব্যবসাবাণিজ্যের পার্টনার সেজে রাতারাতি মুক্তিযােদ্ধা সেজে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রীদের সাথে দহরম-মহরম রেখে সব ধরনের সুযােগ-সুবিধা ভােগ করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর একজন মুক্তিযােদ্ধা জনকণ্ঠের রিপাের্টে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে জানালেন, চাপাইনবাবগঞ্জ জেলা হচ্ছে রাজাকার-আলবদর পুনর্বাসিত জেলা। তাই এখানে সরাসরি কেউ পাকি হানাদার দোসরদের বিরুদ্ধে কথা বলেন না। ভয় করেন। আর এই কারণেই ত্রিশ বছরেও জেলা শহরে মুক্তিযােদ্ধা স্মৃতিসৌধ গড়ে ওঠেনি, এমনকি বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের শহীদ হবার স্থানটি সরকারী পর্যায়ে চিহ্নিত করা হয়নি। তার মাজারের ওপর একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়নি।
জনকণ্ঠের এই প্রতিবেদনে এখানকার মানুষের কাছে হঠাৎ করে ভিন্ন মাত্রা যােগ হয়েছে। মহাসাহসী পদক্ষেপ হিসাবে বর্ণনা করে অপর এক মুক্তিযােদ্ধা বললেন এবং অনুরােধ জানালেন সদর উপজেলা ছাড়াও শিবগঞ্জ, নাচোল ও গােমস্তাপুর উপজেলার খুনী-ঘাতক রাজাকারদের কাহিনী তুলে ধরার জন্য। এসব থানা হতেও রিপাের্টটির প্রশংসা করে সেই সব থানার একাধিক প্রতিবেদন তুলে ধরার জন্য টেলিফোনে অনুরােধ জানানাে হয়েছে। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা স্থানীয় কর্মচারীদের ডেকে জানবার-চিনবার চেষ্টা করছেন রাজাকার হান্নানকে। ত্রিশ বছর পর চাপাইনবাবগঞ্জের একজন রাজাকারের অপকর্ম, খুন, হত্যা, রাহাজানির খবর জনকণ্ঠে আসার পর এখানকার প্রতিক্রিয়াশীল সেই সময়ের ঘাতক ও তাদের দোসররা দারুণভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
জনকণ্ঠ ॥ ০১-০২-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন