You dont have javascript enabled! Please enable it!

জিয়ার পথের কাঁটা

১। খুনী রশিদ-ফারুকের হস্তক্ষেপে জেনারেল সফিউল্লাহকে সরিয়ে সেনাপ্রধান পদে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এয়ার ভাইস মার্শাল এ,কে, খােন্দকারকে বিদায় দিয়ে ১৭ই অক্টোবর এয়ার ভাইস মার্শাল এম, জি, তােয়াবকে উক্ত পদে বসানাে হয়। ২৪ শে আগস্ট জেনারেল (অবঃ) এম,এ, জি, ওসমানীকে ‘ডিফেন্স এডভাইসার’ করা হলাে। ওসমানীর উপদেশ মতাে তিন বাহিনীর উপর, কর্তৃত্ব করার জন্য ডিফেন্স ষ্টাফ প্রধান পদ সৃষ্টি করে বিডিআর এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে নিয়ােগ করা হয়। কেননা, জেনারেল ওসমানী কোনদিনই জিয়াকে বিশ্বাস করেনি। সেনা প্রধান পদে তাকে বসানাে হলে তার মাথার উপরে ওসমানী ও খলিলুর রহমান এবং তার নিচেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফকে চীফ অফ জেনারেল স্টাফ করে রাখা হলাে। ২. ১৭ই আগস্ট রাতে আর্মি হেড কোয়ার্টারের একসভা জেনারেল কে,এম, সফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান, এয়ার ভাইস মার্শাল এ, কে, খােন্দকার, নৌবাহিনীর প্রধান এম,এইচ, খান, পুলিশের আই জি, পি এস ও ব্রিগেডিয়ার রউফ, খালেদ মােশাররফ, ডি এ এম, কর্ণেল মালেক, জি এ, ও ওয়ান লেঃ কঃ নূরুউদ্দিন আহমেদ ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় সিদ্ধান্ত হলাে, সামরিকবাহিনীর ‘চেন অফ কমান্ড’ ফিরিয়ে আনা হবে। অভ্যুত্থানকারীদের শাস্তি হওয়া দরকার। সভায় প্রতিজ্ঞা করা হলাে বিষয়টি গােপনীয় থাকবে।১ কিন্তু এই গােপনীয় সিদ্ধান্তটি জানাজানি হয়ে যায়।। ৩. জিয়াউর রহমানের নিস্পৃহ এই মনােভাব দেখে সেনাবাহিনীতে ‘চেইন অফ কমান্ড’ ঠিক করার জন্য খালেদ মােশাররফ শাফায়াত জামিল এক মত হলেন। জিয়াউর রহমান সার্বিক ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করছিলেন ভিন্নভাবে। তার সামনে বাধা ফারুক-রশীদ ছিলােনা। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীর প্রশিক্ষক থাকাকালে ঐ সময়ে ফারুক-রশিদ তার ছাত্র ছিলাে। পথের বাধা ছিলাে ওসমানী-খলিল, খালেদ, শাফায়াত গং। মেজরদের অপসারণ করলেই বা তাদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনলে অথবা চেইন অফ কমান্ড ঠিক হয়ে গেলে তার ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হচ্ছে না। সেজন্য জিয়া তার নিজস্ব পরিকল্পনায় কাজ করছিলেন গােপনে। জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধানের পদটি দখল করে এ অবস্থায় সুযােগের জন্য ওৎ পেতে থাকেন। ৪. কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের বসে ছিলেননা। যার যার ছক নিয়ে তারা কাজ করছিলেন।২ ভিন্ন ভিন্নভাবে। ৫. ২রা নভেম্বর ‘৭৫ গভীর রাত। ওসমানী, খলিল, এমনকি মােশতাক জিয়া ও খালেদের দ্বন্ধের কারণে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। রশিদের আপত্তি আগ্রাহ্য হলে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলাে জিয়া খালেদ দুজনকেই সরিয়ে দেয়া হবে। ২রা নভেম্বর রাত সাড়ে ১২টা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট এসে কমান্ড গ্রহণ করেন। রাত ১টায় ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি প্লাটুন ঝটিকার বেগে জিয়াকে গৃহবন্দী করে। তার টেলিফোনের তার ছিড়ে ফেলে। কিন্তু তাদের জানা ছিলনা টেলিফোনটি ছিল বেডরুমে। এটা তার এক্সটেনশন মাত্র। বঙ্গ ভবনে অভ্যুথানের খবর এসে পৌছে। রশিদ জিয়াকে ফোন করে। রশিদ তাকে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করে। রশিদ জেনারেল ওসমানীকে ফোন করে। ওসমানী জিয়াকে ফোন করেন। জিয়া ফোন ধরে জানালেন, সে বন্দী। সেনা অভ্যুথানের সংবাদ শুনেই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রিসালদার খুনী মােসলেম উদ্দিন কয়েকজন সৈন্যসহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাভ্যন্তরে ঢুকতে চাইলে ডি আই জি প্রিজন তাদের বাধা দেন। তখন কেন্দ্রীয় কারাগার হতে মােসলেহ উদ্দিন টেলিফোন করে রশিদকে। রশিদ ডি,আই, জি প্রিজনকে মােসলেউদ্দিনের কথা মত কাজ করতে বলেন। ডি আই, জি প্রিজনের অস্বীকৃতিতে মােসলেউদ্দিন ক্রোধে ফেটে পড়ে। ডি, আই, জি প্রিজন প্রেসিডেন্ট মােশতাকের সাথে কথা বললে মােশতাক মােসলেহ উদ্দিনের কথামত কাজ করতে নির্দেশ দেয়। মােসলেহউদ্দীন গং জেলের মধ্যে ঢুকে সবাইকে তাজউদ্দিনের সেলে নিয়ে এসে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম, মুনসুর আলী ও এ, এইচ এম, কামারুজ্জামানকে হত্যা করে। সম্প্রতি জাতির জনক বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বীকৃত খুনীদের অন্যতম কর্নেল (অবঃ) ফারুক বলেছে যে, ৩রা নভেম্বর জেল হত্যার জন্য খন্দকার মােশতাক আহমদ ও কর্ণেল (অবঃ) রশিদ দায়ী। খন্দকার মােশতাক প্রসঙ্গে কর্ণেল (অবঃ) ফারুক বলেছে যে, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একটা গন্ডগােল হচ্ছে। এ সময় সৈয়দ নজরুল ইসলাম বেঁচে থাকলে তার জন্য সমস্যা হবে। এ কারণেই মােশতাক জেল হত্যা ঘটিয়েছে। ৩

মােশতাক ও ৪ জাতীয় নেতাকে সরিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক শূণ্যতার মধ্যে নিজেকে একক ব্যক্তিত্বরূপে থেকে যেতে চাইলে জিয়াউর রহমান নিষ্ক্রিয় থেকে খালেদ মােশাররফকে এগিয়ে দিলেন। জিয়া জানতেন, খালেদ মােশতাককে রাখবেনা। মােশতাককে সরাতে পারলে ওসমানী খলিলের খবরদারী থাকবে না। সামরিক বাহিনীতে তখন তিনি হবেন সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী। জিয়ার এটা বঝতে অসুবিধা হয়নি যে, বিরাজমান পরিস্থিতিতে মােশতাক-রশিদ ফারুক প্রথম রাউন্ডে খেলছে, তারা যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার সফলতা অর্জন করে তখন সুযােগ বুঝে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর প্রধান পদটি দখল করে। খালেদ মােশাররফের অভ্যুথানের সময় জিয়াউর রহমান বন্দী হওয়ার পূর্বে প্রায় আধা ঘন্টা সময় পায়। জিয়া খালেদের অভ্যুত্থান ঠেকাতে চেষ্টা করেনি কিংবা রশিদের অনুরােধে তাদের পক্ষও নেয়নি। বরং খালেদ-জামিল বনাম রশিদ-ফারুকের সংঘাতে সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ফলে খালেদ তাকে প্রাণে মারেনি, বন্দী করেছে মাত্র। খালেদ মােশাররফ-এর ক্ষমতা দখলের পর জিয়ার পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসে। ৮. এ রকম একটা পরিস্থিতির মুখােমুখি হয়ে জিয়াউর রহমান তাৎক্ষণিকভাবে কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের-এর স্মরণাপন্ন হন। সি আই, এ ডকুমেন্টে পরিলক্ষিত হয় যে, জিয়া ও মেজর তাহের এর মধ্যে পূর্বে হতেই সুসম্পর্ক ছিল।৪  স্বাধীনতার পর কর্ণেল তাহের ও জিয়াউদ্দিন সেনাবাহিনী হতে পদত্যাগ করেন। জিয়াউদ্দিন সর্বহারা পার্টিতে যােগদান করে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নেয় । তাহের ও জিয়াউদ্দিনের চিন্তা ছিলাে অভিন্ন। জিয়াউর রহমান গােপনে সর্বহারা পার্টির নেতাদের প্রতি সমর্থন দেন এবং তাদের গ্রেফতারে নমনীয়তা প্রদর্শন করেন।৫  সেনাবাহিনী থাকাকালীন অবস্থায় তাহের ও জিয়াউদ্দিন জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে ব্যাপকভাবে কাজ করেন। তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ট। সৈনিকদের মধ্যে তাহেরের বৈপ্লবিক সংস্থার কার্যক্রম সম্পর্কেও জিয়ার অজানা ছিলােনা। ৯. সেজন্য বন্দী অবস্থায় কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরকেই জিয়াউর রহমানের মনে পড়েছে। কারণ তার প্রাণ বাঁচানাের জন্য কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের এবং জাসদ ব্যতীত অন্য কোন বিকল্প তখন তার হাতে ছিলনা।৬ তাহেরের জবানবন্দীতে একথা তাহেরও উল্লেখ করেছেন।৭ ১০. ৩রা নভেম্বর ‘৭৫ বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী রশিদ-ফারুক গং দেশ ত্যাগ করলে মােশতাক অসহায় হয়ে পড়ে। কোনক্রমেই মােশতাক প্রেসিডেন্ট হতে রাজি হলােনা। শাফায়াত জামিলের প্রস্তাবে প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েমকে প্রেসিডেন্ট বানানাে হয়।

১১. ১৯৭৫ সালের ৬ই নভেম্বর প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম দেশের ৫ম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। খালেদ মােশাররফ ইতিমধ্যেই নিজেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে সেনা প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৬ই নভেম্বর। বৃহস্পতিবার। নতুন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম রেডিও টেলিভিশনে ভাষণ দেন। জাতীয় সংসদ ভেংগে দেন। বললেন, তার সরকার নিরপেক্ষ, নির্দলীয় ও অন্তর্বর্তী কালীন সরকার। তিনি বলেন যে, শেখ মুজিবরের হত্যায় সেনাবাহিনী জড়িত ছিলােনা। তিনি বলেন, আইন শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করে নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তােলা হবে। এবং পূর্ব ঘােষিত ১৯৭৭ সনের ২৮শে ফেব্রুয়ারীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। ১২. ৩ থেকে ৬ই নভেম্বর ‘৭৫। তিন দিন। জিয়াউর রহমান ৪ তারিখে সেনাবাহিনী প্রধান হতে ইস্তাফা দান করেন এবং ইস্তেফা পত্রে উল্লেখ করেন যে, তিনি রাজনীতিতে নিজেকে জড়াতে চান না। সেজন্য তিনি সেনা প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করছেন।৮ পদত্যাগ পত্র দিয়ে তিনি খালেদ মােশাররফকে আশ্বস্ত করলেন। জিয়াউর রহমানের পদত্যাগ গৃহীত হলে খালেদ জিয়াউর রহমান অধ্যায় শেষ হয়েছে বলে ধরে নেন। খালেদ মােশাররফ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন। দেশের রেডিও টিভিতে কি ঘটছে তার খবর দেয়া হলাে না। জনমনে সন্দেহ দানা বাধতে থাকে। গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়, খালেদ ভারতের দালাল। ভারতের এজেন্ট হিসেবে খালেদ মােশাররফ ক্ষমতা দখল করছে। প্রমাণ হিসেবে পূর্ব ঘােষিত ৪ঠা নভেম্বর ‘মুজিব দিবস’ পালনে আওয়ামীলীগ, ন্যাপ, কম্যুনিস্ট পার্টি ছাত্র ও নেতৃবৃন্দের মিছিল কাজে লাগায়। সাম্প্রদায়িক শক্তি উঠে পড়ে লেগে যায়। বাংলাদেশে ছদ্মবেশে ভারতীয় সৈন্যও ঢুকে পড়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়।৯

১৩. কর্ণেল (অবঃ) তাহের ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর এডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে কুমিল্লায় ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার নিয়ােগ প্রাপ্ত হন। কর্নেল তাহের ও কর্ণেল জিয়াউদ্দিন ব্রিটিশ আর্মি পদ্ধতির পরিবর্তে চাইনিজ স্টাইলে উৎপাদনমুখী পিপল আর্মি গঠনের ইচ্ছা বাস্তবায়িত না হওয়ায় তারা পদত্যাগ করে। বঙ্গবন্ধু তাহেরকে ড্রেজার অর্গনাইজেশন এর পরিচালক পদে নিয়ােগ করেন। বাংলাদেশের জন্য যা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে থেকেই কর্ণেল (অবঃ) তাহের গােপনে জাসদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যােগসূত্র রক্ষা করে আসছিলেন। গােপনে সেপাইদের নিয়ে সেল গঠন করেন এবং অফিসারদের বিরুদ্ধে তাদের লেলিয়ে দেন।

১৪। ৪ এবং ৫ নভেম্বর দু’দিন। বেঙ্গল ল্যান্সার আর সেকেন্ড ফিন্ড আর্টিলারীর সৈন্যরা দেখতে পেলাে যাদের নেতৃত্বে তারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে সেই সব নেতৃত্ব দেশছাড়া, ওসমানী ও মােশতাক ক্ষমতাচ্যুত। এবং জিয়া বন্দী। এসময় ১০ম ও ১৫ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ঢাকায় আনা হলাে। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যার নিয়ােজিত ট্যাংক ও আর্টিলারী বাহিনীর সৈন্যরা প্রেসিডেন্ট সায়েমের বক্তৃতায় বুঝতে পারল সেনাবাহিনী নয় একটি ‘ক্ষুদ্র গােষ্ঠী’ হিসেবে তাদের জঘণ্য কৃৎকর্মের শাস্তি আসন্ন। এই অবস্থায় মরিয়া হয়ে তারা জেনারেল জিয়াকে তাদের একমাত্র পরিত্রাণ কর্তা হিসেবে বেছে নিতে দ্বিধা করেনি। অন্যদিকে ডানপন্থী মুসলিমলীগ ও ‘বামপন্থী’ জাসদ ক্যান্টনমেন্ট সহ রাজধানীতে হাজার হাজার প্রচার পত্র বিলি করে। একজন বিশ্বাসঘাতক, ভারতের এজেন্ট এবং পরাজিত শক্তির প্রতিভূ খালেদ মােশাররফকে উৎখাতের জন্য জনগণ ও সেনাবাহিনীর প্রতি আহবান জানায়। সৈন্যদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের সিপাইদের জন্য ১২টি দাবী পেশ করে। এতে সাধারণ সিপাইগণের স্বার্থরক্ষার বিষয়গুলাে ছিলাে মুখ্য। (পরিশিষ্ট-২) ট্যাংক রেজিমেন্ট, আর্টিলারী বাহিনী এক যােগে অফিসারদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে। দলে দলে বিভক্ত হয়ে ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’ ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই সুবেদারের উপর অফিসার নাই” ইত্যাদি শ্লোগানে ক্যান্টনমেন্ট মুখরিত করে তােলে। অফিসারদের খুন করা হয়। দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারী ব্যারাকের কাছে অফিসার্স মেসে একজন তরুণ আর্মি অফিসারকে তারা হত্যা করতে এলে তারা পালিয়ে ধানক্ষেতে লুকিয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার ছােট ভাই সেকেন্ড লেফটেনেন্ট সৈয়দ ইস্কান্দার সাঈদ। ১০ ১৬। জিয়াউর রহমানের অনুরােধে এবং বিশেষ লক্ষ্যকে সামনে রেখে কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে সিপাহী বিপ্লবের নির্দেশ দেন। তার পূর্বে ৪ঠা নভেম্বর জিয়াউর রহমান আবারও তার জীবনকে বাঁচানাের জন্য কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরের নিকট আবেদন করেন। কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের মেসেঞ্জারকে একথা বলে পাঠান যে, শীঘ্রই তিনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন। জিয়া যেন সাহস সঞ্চয় করেন।এন সিও ও জেসিওদের সঙ্গে বৈঠক করে সেনাবাহিনীর সকল ইউনিটের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপনের পর কর্নেল (অবঃ) আবু তাহের ৬ই নভেম্বর শেষ প্রহরে বিভিন্ন সেনা প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রতিটি ইউনিটকে সতর্ক থেকে পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেন। ৭ই নভেম্বর রাত ১টার সময় সিপাহী বিদ্রোহ ঘটানাের নির্দেশ দেয়া হয়। এ লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়—

১, খালেদ মােশাররফ চক্রকে উৎখাত, ২. বন্দী দশা থেকে জিয়াউর রহমানের মুক্তি, ৩. রেভুলেশনারী মিলিটারী কমান্ড কাউন্সিল গঠন, ৪. রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিপ্রদান, ৫. সকল হুলিয়া ও গ্রেফতারী পরােয়ানা প্রত্যাহার, ৬. বাকশাল ব্যতীত সকল দলকে নিয়ে অল পার্টি সরকার গঠন, ৭. বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২-দফা বাস্তবায়ন। 

১৭. সফল অভ্যুত্থানের এক পর্যায়ে জিয়াকে বন্দীদশা হতে মুক্ত করে সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারী হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসা হয়। রাত তিনটায় কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের তার ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গমন করেন। জিয়া নাইট ড্রেস পরেছিল আর পাশে বিগ্রেডিয়ার মীর শওকতসহ কিছু অফিসার ও সৈন্যরা ছিলাে। জিয়া কর্ণেল তাহেরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। তার ভাইয়ের সঙ্গেও কোলাকুলি করেন। এবং অশ্ৰুচোখে তার জীবন বাঁচানাের জন্য তাকে ধন্যবাদ জানান। এমনকি জিয়া এ পর্যন্ত বলেন যে, জাসদ এবং তাদের জন্য তিনি জীবন দিতে প্রস্তুত আছেন।১১ জিয়াউর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে কর্ণেল তাহের বাংলাদেশ বেতারে আসেন। জিয়া বেতার ভাষণে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘােষণা দেন। ঐ সময়ে ঠিক হয় জিয়া এবং তাহের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সিপাহী জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। ৮-৩০ মিনিটে খন্দকার মােশতাক রেডিওতে ভাষণ দিতে এলে তাহের তাকে বের করে দেন এই বলে যে চক্রান্তের রাজনীতির দিন শেষ হয়ে গেছে।” ১৮. কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের শহীদ মিনারে পূর্ব নির্ধারিত ভাষণ দেওয়ার জন্য জিয়াউর রহমানকে আনতে ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে দেখতে পেলেন পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। শহীদ মিনারে যাওয়ার জন্য বললে, জিয়াউর রহমান তাহেরকে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলেন যে, তিনি একজন সৈনিক, পাবলিক প্লেসে মিটিং করা তার ঠিক হবেনা। জিয়া সেভ করে ড্রেস পরেছেন, মনে হলাে বন্দীস্মৃতি ভুলে গেছেন। ১৯. বেলা ১১ ঘটিকায় সেনা সদরে মিটিং অনুষ্ঠিত হয় জেঃ ওসমানী, জিয়া, তােয়াব, এম,এইচ খান, খলিলুর রহমান, আবু তাহের এবং প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারী মাহবুব আলম চাষী উপস্থিত ছিলেন। বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট রাখার বিষয়টি পুনঃসিদ্ধান্ত হয়। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধীনে রাখার জন্য কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের প্রস্তাব করলে আলােচনার এক পর্যায়ে ব্রিগেডিয়ার খলিলুর রহমান ও ওসমানী বিরোধিতা করেন। এ পর্যায়ে সেনা, বিমান, নৌবাহিনী প্রধানদের উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে নিযুক্তির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় আরো স্থির হয় বাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দেয়া হবে। রাজনৈতিক কার্যক্রম চলতে দেয়া হবে এবং মােশতাক এবং সায়েমের প্রদত্ত নির্বাচনী তারিখের পূর্বেই সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। বিচারপতি সায়েম উপদেষ্টা পরিষদের সাহায্যে কেবলমাত্র অন্তবর্তীকালীন সরকার পরিচালনা করবেন। ১২ ৭ই নভেম্বর সন্ধ্যা ৭-৪৫ মিনিটে জিয়াউর রহমান বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার উত্থাপিত ১২- দফা দাবী স্বাক্ষর করেন।১৩ ২০. ৮ই নভেম্বর হতে ১১ই নভেম্বর পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনার কাজে জিয়াউর রহমান বারংবার কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরের সাহায্য গ্রহণ করেন। বিদ্রোহী সৈন্যরা অফিসারদের হত্যা শুরু করে এবং ৮ তারিখ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। ক্যাপ্টেন সিতারা, মেজর করিম, ক্যাপ্টেন আনােয়ার, লে মুস্তাফিজ, মেজর আজিম, মেজর মহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন খালেক ও লেঃ সিকান্দার উত্তেজিত সিপাইদের হাতে নিহত হন। সেনানিবাসগুলিতে ক্ষমতা সংহত করার পর পরই জিয়াউর রহমান ২৪ নভেম্বর কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরকে গ্রেফতার করে সরাসরি জেলে পাঠিয়ে দেয়। একই সঙ্গে রব, জলিল ও অন্যান্য জাসদ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। ২১. ১৯৭৪ সনের জুলাই মাস থেকে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে উস্কানী ও বিশৃংখলামূলক কর্মকান্ড পরিচালনা এবং ১৯৭৫ সনের ৭ই নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত সরকার উৎখাতের জন্য কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরকে অভিযুক্ত করা হয়। ১৪ উল্লেখ্য যে, ২১ শে জুন ৭৬ কর্ণেল (অবঃ) তাহের-এর বিচার শুরু হয়। ১৭ই জুলাই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ইউসুফ হায়দার তাহেরের ফাঁসির আদেশ দেন। ২২. প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম তাহেরের মূত্য দন্ডাদেশ রহিত করে ক্ষমা প্রদর্শন করেনি। তাহেরকে অভিযােগপত্র পূর্বে দেয়া হয়নি। তাকে আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করতে দেয়া হয়নি। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য সুযােগও দেয়া হয়নি। তাহের তার বিরুদ্ধে অভিযােগের সত্যতা সম্পর্কে জেনারেল ওসমানী মেঃ জেনারেল জিয়াউর রহমান, এম, জি, তোয়াব, এম, এইচ খানকে সাক্ষ্য হিসেবে ট্রাইব্যুনালে আনার দাবী জানান। তাও গৃহীত হয়নি। ১৫

বিচারপতি থাকাকালীন সময়ে সায়েম পূর্ণচন্দ্র মন্ডলের ফাঁসির আদেশ ছুঁড়ে ফেলেছিলেন এই বলে যে, কোন বন্দীকেই আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রয়ােজনীয় সুযােগ না দিয়ে তাকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া যাবেনা। কিন্তু বিচারপতি সায়েম যখন প্রেসিডেন্ট হলেন তখন তার প্রদত্ত রায় উল্টে দিয়ে তাহেরকে ক্ষমা প্রদর্শনের সুযােগ দিতে ব্যর্থ হলেন। ১৬ কেননা, সামরিক শাসনে সায়েম নয়, জিয়াই ছিলেন মূল প্রশাসক। ২৩. উল্লেখ্য যে, কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরকে গ্রেফতারের কয়েকদিন পর তাকে রাজশাহী কারাগারে নেয়ে যাওয়া হয়। ২২ শে মে রাজশাহী হতে তাকে পুনরায় ঢাকা আনা হয়। ১৫ ই জুন ১৯৭৬ সনে বিচারের জন্য বিশেষ সামরিক আদালত গঠন করা হয়। পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক অফিসার কর্ণেল ইউসুফ হায়দার চেয়ারম্যান ও প্রসিকিউটর হিসেবে এটি এম, আফজাল দায়িত্ব পালন করেন। তাহেরের ফাসির পর বিচারপতি হিসেবে পুরস্কৃত হয়ে এ,টি,এম, আফজাল বলেছেন যে, আমি তাহেরের মৃত্যুদন্ডের খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছি। তিনি দাবী করেছেন, প্রসিকিউটার হিসেবে তিনি তাহেরের মৃত্যুদন্ড দাবী করেননি।১৭ প্রকৃত প্রস্তাবে ‘লিগ্যাসী অফ ব্লাড’ বইতে এন্থনী মাসকারানহেস যথার্থই বলেছেন, তাহেরের মৃত্যু একটি হুকুমের হত্যা। হুকুমদাতা মেজর জেনারেল জিয়া।১৮ ২৪. খালেদ মােশাররফকে দিয়ে রশীদ-ফারুককে হটিয়ে, মােশতাককে তাড়িয়ে, ওসমানী -খলিলকে সরিয়ে এবং খালেদকে হত্যা করে, সর্বোপরি কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরকে ফাসি দিয়ে জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতার সিঁড়িতে ওঠার কাটা দূর করেছেন নির্ভুল ব্লু-প্রিন্টে। এক্ষেত্রে তিনি অনন্য ও অসাধারণ।।

Reference: জেনারেল জিয়ার রাজত্ব – অধ্যাপক আবু সাঈদ

Reference list for this chapter

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!